মুদ্রা পাচারের কারণে গোটা কানাডায়ই বেড়েছে আবাসন ব্যয় ও মূল্যস্ফীতি

আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের আড়ালে অর্থ পাচার হচ্ছে কানাডায়

কানাডা থেকে শস্য আমদানি এক বছরের ব্যবধানে বেড়েছে প্রায় ১৫০ শতাংশ

কানাডা থেকে শস্য আমদানিতে বিলিয়ন ডলারের ক্লাবে যোগ দিয়েছে বাংলাদেশ। সম্প্রতি এধরণের একটি রিপোর্ট গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। স্ট্যাটিস্টিকস কানাডার তথ্যমতে, প্রতি বছর দেশটি থেকে শতকোটি ডলার মূল্যমানের খাদ্যশস্য আমদানি করে থাকে মোট তিনটি দেশ—চীন, জাপান ও যুক্তরাষ্ট্র। ১০৮ কোটি ডলার মূল্যের শস্য আমদানির মাধ্যমে এ তিন দেশের কাতারে উঠে এসেছে বাংলাদেশ। পরিসংখ্যান বলছে, ২০১৮ সালেও বাংলাদেশ কানাডা থেকে শস্য আমদানি করেছিল ৪৩ কোটি ৮০ লাখ ডলারের। সে হিসাবে এক বছরের ব্যবধানে দেশটি থেকে বাংলাদেশের শস্য আমদানি বেড়েছে প্রায় ১৪৬ দশমিক ৫৭ শতাংশ।

তবে এর পরও কিছু প্রশ্নের অবকাশ থেকে যাচ্ছে বলে মনে করছেন অনেকে। তাদের মতে, এক বছরের ব্যবধানে পণ্যগুলোর আমদানি যেভাবে বেড়েছে, বাংলাদেশের পণ্যবাজারে কানাডীয় পণ্যের অংশীদারিত্ব সেভাবে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়েনি। বেড়ে সাত গুণ, তিন গুণ বা দ্বিগুণ পরের কথা, এমনকি দেড় গুণ বা সোয়া এক গুণও হয়নি। সুতরাং, এখানে নিশ্চিতভাবেই অন্য কোনো কিছু প্রভাবক হিসেবে কাজ করেছে।

আমদানি পরিমাণের এ উল্লম্ফন সত্ত্বেও ব্যবসায়ীরা বলছেন, শস্যের বাজারে এখনো একাধিপত্য গড়ে নিতে পারেনি কানাডা। দেশে ভোগ্যপণ্যের সবচেয়ে বড় পাইকারি বাজার খাতুনগঞ্জের মেসার্স হক ট্রেডার্সের স্বত্বাধিকারী আজিজুল হক জানালেন, বাজারে কানাডার গম, তেলবীজ ও ডালশস্যের পর্যাপ্ত সরবরাহ রয়েছে। এ সরবরাহ দিন দিন বাড়ছে। তবে বাজারে প্রচলিত গম সবচেয়ে বেশি আসে রাশিয়া থেকে। ডালশস্য সবচেয়ে বেশি আসে অস্ট্রেলিয়া থেকে। এসব পণ্য সরবরাহে কোনো দেশের একাধিপত্য নেই।

কানাডা থেকে শস্য আমদানিতে এত বড় উল্লম্ফনের আগে ২০১৮ সালেই বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের (বিআইবিএম) এক গবেষণায় বলা হয়েছিল, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের আড়ালে প্রচুর অর্থ দেশের বাইরে পাচার হচ্ছে। আমদানীকৃত অর্থের পণ্যের বিবরণ পরিবর্তন বা মিথ্যা ঘোষণায় শুল্কায়ন, এলসিতে কারসাজিসহ নানা কায়দায় এসব অর্থ পাচার হচ্ছে।

বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) তথ্যও বলছে, বাংলাদেশ থেকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যেসব অর্থ পাচার করা হচ্ছে, তার ৮০ শতাংশই হচ্ছে আমদানি-রফতানি বাণিজ্যের মাধ্যমে। শুধু বিআইবিএম বা বিএফআইইউ নয়, বিদেশী বিভিন্ন সংস্থার প্রতিবেদনেও একই কথা উঠে এসেছে। গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটির গত বছরের এক প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ট্রেড মিসইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে যেসব দেশ থেকে সবচেয়ে বেশি অর্থ পাচার হয়, সেসব দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৮তম।

কাকতালীয়ভাবে দেশের অর্থ পাচারকারীদের লুট করা টাকারও অন্যতম প্রিয় গন্তব্য কানাডা। মাত্র দেড় লাখ কানাডীয় ডলার বা ১ কোটি ১০ লাখ টাকা জমা দিলেই কানাডার নাগরিকত্ব পাওয়া যায়। এছাড়া মুদ্রা পাচার প্রতিরোধে দেশটির আইনকানুনও খুব একটা কঠোর নয়। এ সুযোগে দেশ থেকে অর্থ লুট করেও কানাডায় পাড়ি দিচ্ছেন ঋণখেলাপি ও দুর্নীতিবাজদের অনেকেই।

কানাডায় ভাগ্যান্বেষণে যাওয়া প্রবাসীরা জানিয়েছেন, বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচার করে দেশটিতে বিলাসবহুল জীবনযাপন করছেন অর্থ পাচারকারী ও ঋণখেলাপিরা। টরন্টোর অভিজাত এলাকাগুলোয় দেখা মেলে এদের অনেকেরই। সেখানে তারা নগদ টাকায় মিলিয়ন ডলারের বাড়ি কিনে শুরু করছেন ব্যবসা। এমনকি চেষ্টা করছেন কমিউনিটির মধ্যেও প্রভাব বিস্তারের।

মাত্র দেড় লাখ কানাডীয় ডলার বা ১ কোটি ১০ লাখ টাকা জমা দিলেই কানাডার নাগরিকত্ব পাওয়া যায়। এছাড়া মুদ্রা পাচার প্রতিরোধে দেশটির আইনকানুনও খুব একটা কঠোর নয়। এ সুযোগে দেশ থেকে অর্থ লুট করেও কানাডায় পাড়ি দিচ্ছেন ঋণখেলাপি ও দুর্নীতিবাজদের অনেকেই।

এসব মুদ্রা পাচারকারীদের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন কানাডায় পরিশ্রম দিয়ে ভাগ্য জয় করতে যাওয়া প্রবাসীরা। স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় ব্যাঘাত ঘটছে সেখানকার প্রবাসী-স্থানীয় সবারই। গত বছরের মাঝামাঝি প্রকাশিত দেশটির ব্রিটিশ কলম্বিয়া প্রাদেশিক সরকারের এক তদন্ত প্রতিবেদনের সূত্র ধরে কানাডার গণমাধ্যমগুলো জানাচ্ছে, ২০১৮ সালে শুধু আবাসন খাত দিয়েই প্রদেশটির অর্থনীতিতে পাচারকৃত অর্থ যোগ হয়েছে প্রায় ৫০০ কোটি ডলার। ব্রিটিশ কলম্বিয়ার পাশাপাশি অন্টারিও, অ্যালবার্টা ও প্রেইরিও এখন মুদ্রা পাচার নিয়ে অনেকটা একই ধরনের সংকটের মুখোমুখি হচ্ছে। অন্টারিওর ক্যাসিনোগুলোয় ২০১৮ সালে সন্দেহজনক লেনদেন বেড়েছে প্রায় ৫০ শতাংশ। মুদ্রা পাচারের কারণে গোটা কানাডায়ই বেড়েছে আবাসন ব্যয় ও মূল্যস্ফীতিও।

বর্তমানে এসব লুটেরার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছেন সেখানকার স্থানীয় বাংলাদেশী কমিউনিটির সদস্যরা। লুটেরা পাচারকারীদের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ ও প্রতিবাদ সভার আয়োজন করছেন তারা। পাশাপাশি সেখানকার সরকারের ফিন্যান্সিয়াল মনিটর এজেন্সিগুলোতেও অভিযোগ তোলার কথা ভাবা হচ্ছে। এমনকি চিহ্নিত লুটেরা-পাচারকারীদের আয়োজিত কোনো অনুষ্ঠানে অংশ না নেয়া বা সেখানে চাঁদা না দিতে স্থানীয় কাউন্সিলর, প্রাদেশিক ও ফেডারেল এমপিদের কাছেও দাবি তোলার কথা ভাবছেন প্রবাসীরা। অনেকেই দুর্নীতিবাজদের সামাজিকভাবে বয়কটের কথাও বলছেন।

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button