চরিত্র গঠনে নামাযের ভূমিকা

salahইঞ্জিনিয়ার ফিরোজ আহমাদ: মহান আল্লাহ্ তারালা তাঁর কালামে পাকে ঘোষণা করেন, ‘নিঃসন্দেহে নামায অশ্লীল ও খারাপ কাজ থেকে বিরত রাখে।” (আনকাবুত ৪৬) মূলত : জবাবদিহীতা ও খোদাভীতির বাস্তব অনুশিলন হল নামায। নামাযের স্বাভাবিক গুণ হল অশ্লীল ও অন্যায় কাজ দূর করা। নামাযী তার নামায দ্বারা চরিত্রের অন্যান্য গুণাবলী অর্জন করতে সক্ষম হয়। মানুষকে যাবতীয় অন্যায় ও দোষ ত্রুটি থেকে বিরত রাখার জন্য যতবাধাই সম্ভব তার মধ্যে নামাযই হতে পারে সর্বাপেক্ষা অধিক জোরদার ও কার্যকর বাধা। প্রতিদিন প্রত্যেক দুনিয়ায় স্বাধীন ও স্বেচ্ছাধিকারী নয়। একজন খোদা আছেন। নামাযী ভাবে যে, তার খোদা তিনি যিনি সব গোপন ও প্রকাশ্য জানেন। তিনি জানেন তার অন্তরের নিয়ত ও ইচ্ছা বাসনাও। একটি নির্দিষ্ট সময়ে অবশ্য তাকে মরতে হবে। জীবনের সব কাজের হিসাব অবশ্যই দিতে হবে। নামাযীরা যে অনুভূতি পায় তা হলো আল্লাহ্ থেকে লুকিয়ে গিয়ে কোন নিষিদ্ধ কাজ সে করতে পারে না।
প্রত্যেক ব্যক্তিকে প্রতি নামাযের সময় খোদাকে লুকিয়েও কোন নিষিদ্ধ কাজ না করার ট্রেনিং দেয়া হয়। নামাযের জন্য তৈরি হবার সময় থেকে নামায শেষ করা পর্যন্ত নামাযীকে ক্রমাগত এমন সব কাজ করতে হয় যা খোদার আইনমত করা হল কিনা সেও তার খোদা ছাড়া আর কেউ জানে না- জানতে পারে না। অজু নষ্ট হয়ে যাওয়া সত্ত্বেও যদি কেহ নামায পড়ে তা হলে ঐ ব্যক্তিও তার খোদা ছাড়া আর কেহই জানতে পারে না।  যদি কেহ নামাযের নিয়তই না করে আর বাহ্যত উঠা-বসা ও রুকু সিজদা করে, নামাযের নির্দিষ্ট সূরা ও দোয়া পড়ার পরিবর্তে যদি সে চুপ চাপ কবিতা আবৃত্তি করতে থাকে, তাহলে তার গোপন কারসাজির কথা তার ও তার খোদা ছাড়া আর কেই বা জানতে পারে।
এতো সব সুযোগ থাকা সত্ত্বেও যদি প্রকৃত নামাযী দেহও পোশাক পবিত্র করা থেকে শুরু করে নামাযের আরকান, সূরা ও দোয়া দরুদসহ খোদার বিধানের সমগ্ন শর্তানুরূপ প্রতিদিন পাঁচবার করে নামায যথারীতি আদায় করে, তবে তার অর্থ এই দাঁড়ায় যে, এই নামাযের সাহায্যে দৈনিক পাঁচবার করে তার মৃত দেহে নবজীবনের সঞ্চার করা হয়। তার মধ্যে দায়িত্ব চেতনা জাগিয়ে দেয়া হয়। তাবে দায়িত্ব সচেতন মানুষরূপে গড়ে তোলা হয়। সে যেন নিজেরই আবেগ উৎসাহে গোপনে ও প্রকাশ্যে খোদারই আইন পালন করে চলে। তার দ্বারা বাহিরে এই সব কাজ করাবার কোন শক্তি বর্তমান থাকুক আর নাই থাকুক। আর দুনিয়ার লোকেরা তার এই আমলের খবর রাখুক আর নাই রাখুক সে নিরবচ্ছিন্ন ভাবে এই কাজ করে যেতে থাকবে এমনভাবে ট্রেনিং দেয়া হয় নামাযের মাধ্যমে।
এই হিসেবে বিচার করলে স্বীকার না করে উপায় নেই যে, নামায তার ব্যক্তিকে অশ্লীল ও অন্যায় কাজ হতে কেবল বিরতই রাখে না, মানুষকে যাবতীয় অন্যায় ও কুকাজ থেকে বিরত রাখবার মত নামায অপেক্ষা প্রশিক্ষণ পন্থা আর কিছুই হতে পারে না। কিন্তু তবুও প্রশ্ন থেকে যায় যে নামায রীতিমত পড়লেও কার্যত মানুষ অন্যায় ও পাপ কাজ থেকে বিরত থাকে কি? এ সম্পর্কে বক্তব্য এই যে, ইহা সম্পূর্ণরূপে ব্যক্তির ইচ্ছার উপর নির্ভর করে। সে যদি ইচ্ছা করে, তাহলে এই নামায থেকে এই রূপ প্রশিক্ষণ ও সংশোধন অবশ্যই লাভ করতে পারে। সে যদি জাগ্রত মনে ও সচেতন উদ্যমে এই ফায়দা লাভ করতে চায় তবে নামাযের সংশোধনী প্রভাবের প্রতিক্রিয়ায় তার চরিত্রে ও স্বভাবে অবশ্যই দেখা দেবে। অন্যথায় যে লোক কোন সংশোধনী প্রচেষ্টার প্রভাব স্বীকার করতে চেষ্টিত হয় না কিংবা জেনে, বুঝে তার প্রভাবকে প্রত্যাখান করতেই সচেষ্ট হয়, তার উপর কোন সংশোধনী প্রচেষ্টাই কার্যকর হতে পারে না। তার একটি দৃষ্টান্ত দেয়া যেতে পারে। খাদ্যের অনিবার্য প্রতিক্রিয়া হল দেহিক সুস্থতা ও শারীরিক ক্রমবৃদ্ধি। কিন্তু তা লাভ করা যায় তখন যদি খাদ্যকে দেহের অংশ হবার সুযোগ দেয়া হয়। কিন্তু যদি কেউ খাদ্য গ্রহণের পর পরই বমি করে ফেলে দেয়, তবে এইরূপ খাদ্য গ্রহণের কোনই ফল হতে পারে না। এইরূপ কোন ব্যক্তিকে দৃষ্টান্ত স্বরূপ পেশ করে যেমন বলা যায় না যে, খাদ্য স্বাস্থ্য রক্ষার অনুকুল নহে, তেমনি নামাযীর চরিত্রহীন তাকে দেখে বলা যায় না যে নামায মানুষকে খারাপ কাজ থেকে বিরত রাখে না। এই রূপ নামাযী সম্পর্কে বরং বলতে হয় যে, সে আসলে নামাযই পড়েনি। যেমন খাদ্য গ্রহণের পরযে লোক উহা বমি করে ফেলে দেয়, তার সম্পর্কে বলতে হয় যে, সে খাদ্যই গ্রহণ করেনি।
ঠিক এ কথাই নবী করিম (সা:) কতিপয় হাদীসে কয়েকজন প্রধান সাহাবী ও তাবেয়ীন হতে বর্ণিত হয়েছে। হযরত ইমরান ইবনে হুসাইন (রা.) বর্ণনা করেছেন। নবী করীম (সা.) বলেছেন, যে লোককে তার নামায খারাপ ও নির্লজ্জ কাজ কর্ম থেকে বিরত রাখতে পারলো না, তার নামায নামাযই নহে। (আবি হাতেম)
হযরত ইবনে আব্বাস (রা:) নবী করীম (সা:) এর এই কথাটি বর্ণনা করেছেন: যার নামায তাকে নির্লজ্জ ও খারাপ কাজ কর্ম থেকে বিরত রাখতে পারল না, তাকে নামায আল্লাহ থেকে দূরে নিয়ে গেল। (ইবনে জবীর, বায়হাকী)
হাসান বছরী (রা:) ও এ কথাই করীম (সা:) এর থেকে প্রচার করেছেন। (ইবনে জরীর বায়হাকী)
ইবনে মাসউদ (রা:) থেকে নবী করীম (সা:) এর এই বাণী বর্ণিত হয়েছে: যে লোক নামাযের আনুগত্য করল না তার নামায কোন নামাযই হল না, নামাযের আনুগ্য এই যে, উহা নামাযীকে নির্লজ্জ ও পাপ কাজ থেকে বিরত রাখবে। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ, আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস, হাসান বছরী, কাতাদাহ ও আ’সাশ প্রমুখ ছাহাবী ও তাবেয়ীন থেকে এরূপ বহু কথাই উদ্বৃত্ত হয়েছে।
ইমাম জাফর ছাদেক বলেছেন: “যে ব্যক্তি জানতে চায় যে তার নামায কবুল হয়েছে কি হয়নি, তার লক্ষ্য করা উচিত যে, তার নামায তাকে নির্লজ্জ ও পাপ কাজ কর্ম থেকে কত দূর বিরত রাখতে পেরেছে। নামাজ ফিরিয়ে রাখে বলে যদি সে কাজ করা তেকে ফিরে গিয়ে তাকে তবে তার নামায কবুল হয়েছে বুঝতে হবে। (রুহুল সায়ানী)
নামায হল শ্রেষ্ঠ যিকির। সব যিকিরের সেরা যিকির হল এই নামায। নামাযের প্রভাবে শুধু নেতিবাচকই নহে, উহা পাপ কাজ থেকে নামাযীকে বিরত রেখেই ক্ষান্ত হয়নি। উহা থেকেও বড় কাজ করে নামায। তা হলো, উহা নেক কাজে লোকদের উদ্বৃদ্ধ করে। কল্যাণময় কাজে উহা মানুষকে অগ্রসর হয়ে যাবার জন্যও প্রস্তুত করে। দ্বিতীয় আল্লাহর স্মরণ মূলতই বহু বড় কাজ। নামায হল সব আমলের সার ও সেরা। নামায হল সব কিছুর মূল। নামায থেকে উত্তম কাজ মানুষের জন্য আর নেই। নামাযীদের একটি বড় ও পুরস্কার হল- আল্লাহ্ বলেন “তোমরা আমাকে স্মরণ কর, আমি তোমাদের স্মরণ করব (বাকারা ৯৫) বান্দাহ যখন নামাযে আল্লাহকে স্মরণ করে, তখন আল্লাহ ও অবশ্যই তাকে স্মরণ করে।
তাহলে বান্দাহকে আল্লাহ্ স্মরণ করা, বান্দার আল্রাহকে স্মরণ করার চেয়ে অনেক উত্তম ঘটনা। নামাযীরা এভাবেই সেরা ভাগ্যবান। এই ভাগ্যবান বান্দাগণ বড়ই গৌরবান্বিত। নামাযী এই সান মর্যদাই তাকে সর্বোত্তম চরিত্রের গুণে গুণান্বিত করে। সমাজের সেরা এই নামাযীরাই পাপীতাপী, অপরাধীদের বিচার ফয়সালা করে। নামাযীরা ঐ সব অপরাধের সাথে জড়িত নয় যে সব অপরাধ আর জন সাধারণ মানুষ করে থাকে। তাই সুন্দর মুখী সমূদূশালী সমাজ ও দেশ গড়তে নামাযীর বিকল্প নেই।

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button