প্যারিসে উদযাপিত প্রথম ঈদুল ফিতর

Paris eidমাহমুদ শাহ কোরেশী :
ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ উচ্চতর শিক্ষা লাভের উদ্দেশ্যে প্যারিসে গিয়েছিলেন ২৫ সেপ্টেম্বর, ১৯২৬ সালে। একই লক্ষ্যে আমি ১৯৪৯ সালের অক্টোবারের শেষ সপ্তাহে গিয়ে হাজির হলাম শিল্প-সাহিত্যের সেই বিখ্যাত তীর্থকেন্দ্রে। আরও ক’দিন পর সেখানে গিয়েছিলেন অর্থনীতিবিদ মুজাফফর আহমদ। অবশ্য তিনি একটি শিক্ষাবর্ষ পার করিয়ে মার্কিন মুলুকে পাড়ি দিলেন। তবে তার সঙ্গে যথার্থভাবে মুলাকাত হলো পবিত্র ঈদের দিনে।
তার আগে প্রথমদিন থেকে আমার অবস্থান সম্পর্কে কিছু বলি। প্যারিসের পথে যাত্রা শুরুর পূর্বে ঢাকায় আমার সাক্ষাৎ হয়েছিলো সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের আবাসিক বন্ধু রুহুল আমিন মজুমদারের সঙ্গে। প্যারিসে যাচ্ছি শুনে তিনি তার কাজিন নুর মোহাম্মদ শেখের ঠিকানা দিলেন। এদিকে পৌঁছে আমি কিছু বিপদে পড়লাম। শহীদুল্লাহ যে বাড়িতে থাকতেন তারই কাছে আমার জন্য নির্দিষ্ট করা হয়েছে ছ’তলার একটি ক্ষুদ্র কক্ষ। দেখেই পছন্দ হলো না। তার ওপর বাইরে বেড়িয়ে একটু একটু বৃষ্টিতে হঠাৎ পা পিছলে পড়ে যাচ্ছিলাম একটা দেয়াল ধরে দাঁড়াতে গিয়ে চশমাটা ভেঙে গেল। যা হোক, পরে একটু বিশ্রাম করে নিচে রিসেপশনে গিয়ে নুর মোহাম্মদ শেখকে ফোন করলাম। তিনি খুব দরাজ গলায় আমাকে আমন্ত্রণ জানালেন। সঙ্গে সঙ্গে ডাল-ভাত খাবার দাওয়াত। পৃথিবীতে তখন এর চাইতে মূল্যবান কিছু যেন ছিল না। চারপাশে সব অপরিচিত পরিবেশ। দোকান-পাট, লোকজন! শেখ বললেন, আপনার বাড়ির কাছেই মেট্রো স্টেশন। মাটির নিচে মেট্রোতে চড়ে চলে আসুন। আমি বললাম, ওটা হবে না। আমি একটা ট্যাক্সি নিয়েই আসবো। আপনি আমাকে পরে বুঝিয়ে দেবেন মেট্রোতে কীভাবে চড়তে হয়, কোথা থেকে কোথায় যেতে হয়- কেমনভাবে ইত্যাদি বৃত্তান্ত।
শেখের হোটেলে গিয়ে খুব ভালো লাগল। অনেক পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। অনেক নতুন। লিফট রয়েছে, মাসখানেকের মধ্যে একটা চমৎকার সুুইটখালি হলে মুজাফফর আহমদ ও আমি কাঁচ-পর্দার পার্টিশন ঘেরা দুটি অংশে থাকার ব্যবস্থা করলাম। আমাদের জন্য কিচেনেট ও টয়লেট রয়েছে আলাদা। নেহাত ভাগ্য বলে সে সময়ে আমরা এমন থাকার জায়গা পেয়েছিলাম।
অন্যদিকে শেখের ব্যবস্থাপনায় প্রথম রাত্রের খাবার পরে ইফতার এবং ঈদ ও অন্যান্য উপলক্ষে অনেক ভূরিভোজের ব্যবস্থা হয়েছিল। এতদিন পরও তা ভোলা যায়নি।
ঈদের সকালে নুর মোহাম্মদ শেখের নেতৃত্বে আমরা প্যারিসের গ্র্যান্ড মসজিদে গেলাম। ফ্লারোস হোটেল থেকে সুদর্শন মুজাফফর সাহেব সাদা পা’জামা ও কালো শেরওয়ানী পরে এলেন। চারদিকে তাকে ঘুরে ফিরে দেখছে লোকজন। চমৎকার দেখাচ্ছিল তাকে। নুর মোহাম্মদ শেখের পাঞ্জাবীর ওপর কোট-মাফলার আর আমি দেশ থেকে নেওয়া সাদা শার্কস্কিনের ঢিলেঢালা স্যুটে ওভারকোট-মাফলার জড়িয়ে চললাম।
মসজিদের সুদৃশ্য গেইট ও অভ্যন্তরে গোলাপ বাগান দেখে মনটা ভরে উঠল- ভারি সুন্দর! এবং সম্পূর্ণ ভিন্ন তরিকার। আসলে ক্লাসিক আরবী স্থাপত্য এবং সাজ-সজ্জায় রুচিবোধের অনন্য দৃষ্টান্ত। এবং এটা হচ্ছে মূলত মাগরেবি তথা পশ্চিমা-আরব সংস্কৃতির নিদর্শন। মরক্কো, তিউনিসিয়া ও আলজেরিয়া, ভুটানও এই সংস্কৃতি অংশীদার। প্রথম মহাযুদ্ধের পর বিংশ শতাব্দীর তৃতীয় দশকে নির্মিত হয় এই অনন্য ইমরাত। আদ্যোপান্ত সুন্দর কার্পেটে মোড়া, আতরের খোশবুতে মৌ মৌ করা মসজিদ অভ্যন্তরে এক অনবদ্য পরিবেশ পেলাম। তবে নামাজে দাঁড়িয়ে দেখলাম বহু ধরনের অঙ্গভঙ্গি। নামাজিরা অনেক জাতির- সাদা ফরাসি কিংবা ইয়োরোপীয়, হলুদ, বাদামী, কমলা কিংবা আবলুশ কালো রঙের বিভিন্ন আরব, আফ্রিকান, এশীয়, উপমহাদেশীয়, দূর প্রাচ্যের তথা মিয়ানমার, মালয় কিংবা ইন্দোনেশীয় মুসলিম উম্মাহর বংশধররা। বিশাল আয়তনের মসজিদে হয়তোবা হাজারখানেক মুসল্লি দাঁড়িয়ে। বেশ কিছু শিশু ও নারী, হিজাব পরিহিতা মহিলা বাইরে বাগানের আঙ্গিনায় উপবিষ্ট বা দাঁড়িয়ে ছিলেন বলে মনে পড়ে। ইমামের খোতবা পাঠ ও মুনাজাতের পর যথারীতি আলিঙ্গন চললো সীমিত আকারে। ‘আসসালাম’ ধ্বনিই বেশি শোনা যায়। ইমাম সাহেবের সঙ্গে পরিচিত হবার একটা সুযোগ গ্রহণ করে কিছু শুকনো ফল, খোরমা, পেশতা-বাদাম গ্রহণ করে আমরা বিদায় নিলাম। আমাদের গন্তব্য তখন দূতাবাসে হিসাব বিভাগের প্রধান কর্মকর্তা আবুল খায়ের সাহেবের বাসা। তিনি এবং তার স্ত্রী শামসুন্নেসা ছিলেন অসামান্য মেহমানদার। কিছুদিনের মধ্যে সৈয়দ আলী আহসান করাচী থেকে প্যারিসে এলে তাকে তারা আপ্যায়িত করেন। মুজাফফর সাহেব ছিলেন। ওদিকে মিসেস খায়ের ছিলেন তার পূর্ব পরিচিতা। এক সময়ে এই বিদগ্ধ মহিলা ঢাকা রেডিওতে কর্মকর্তা ছিলেন।
যাহোক, প্যারিসে সেই প্রথম ঈদুল ফিতরের দিনে আমরা পরম আত্মীয়ের মতো খায়ের দম্পতির এপার্টমেন্টে গৃহীত হলাম এবং খুশি মতো পোলাও-কোর্মা, সেমাই-জর্দা ও মিষ্টি খেয়ে পরিতৃপ্ত হয়েছিলাম। উপরন্তু টেপরেকর্ডারে পরিচিত চমৎকার কিছু বাংলা গানও শুনলাম। অনেকক্ষণ গল্পগুজবে কাটিয়ে আমরা কাছেই শঁজেলিজে সড়কে চলে গেলাম। শঁজেলিজে এক বর্ণনাতীত সুন্দর ও সুপ্রশস্থ রাজপথ। এ রাস্তা দিয়ে হাঁটা তথা প্যারিস পর্যটকদের অবশ্য করণীয় কাজ। রাস্তার দুপাশে সোনালি পত্রপুষ্প শোভিত বৃক্ষরাজি, কোথাও ছোট পার্কের অপূর্ব শোভা। প্রথমবার না হলেও সেদিন অপরাহ্নে ঈদ মুবারকের কল্যাণে তিন প্রবাসী যুবকের মন প্রশান্তিতে ভরে উঠছিল। তাতে কোনো সন্দেহ ছিল না।
সন্ধ্যা নামার আগেই নুর মোহাম্মদ শেখের হোটেলে ফিরলাম। শেখ ব্যস্ত হয়ে পড়লেন রান্নাবান্না নিয়ে। মুজাফফর ও আমি তাকে সাহায্য করতে লেগে লাগলাম। আমার বিশেষজ্ঞতা সালাদ বানানোতেই সীমাবদ্ধ। রাত্রে শেখের কিছু ভারতীয় বন্ধুও নিমন্ত্রিত ছিল। যথাসময়ে তারা কিছু কেক-মিষ্টি নিয়ে এসে হাজির। খাবার পরে কিছু গানও শোনা হলো। এভাবে দেশের বাইরে গিয়ে অল্প দিনের মধ্যেই আমরা এক অনন্য আনন্দের অভিজ্ঞতা লাভ করলাম। আমার কাছে এখন তা জীবন্ত ইতিহাস। অল্পদিন হলো স্বনামধন্য অর্থনীতিবিদ মুজাফফর আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন চিরদিনের জন্য। রসায়নে ডক্টর নুর মোহাম্মদ শেখও জীবিত আছেন বলে মনে হয় না। তিনি ছিলেন সিএসআইআর-এর নিবিষ্টচিত্ত গবেষক। তিনি বেঁচে থাকুন আর ইন্তেকাল করুন, তার প্রতি আমার ছিল এবং এখনো রয়েছে সুগভীর প্রীতি ও শ্রদ্ধা। আমার কাছে তিনি এক অবিস্মরণীয় বন্ধুপ্রতীম ব্যক্তিত্ব।
লেখক : গবেষক, সাবেক উপ-পরিচালক বাংলা একাডেমি।

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button