তারপরেও ঈদের আনন্দ আসুক সবার ঘরে ঘরে

Eidএমাজউদ্দীন আহমদ :
হিউম্যান রাইটস্ ফোরাম-বাংলাদেশ (এইচআরএফ) গত বছর ১৮ এপ্রিলে প্রকাশিত এক ঘোষণায় দেশে মানবাধিকার লঙ্ঘনের যে ভয়াবহ বিবরণ তুলে ধরেছে তা সত্যিই অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক। সংঘাতময় রাজনৈতিক সংস্কৃতির বিগত চার বছরে কোন পরিবর্তন তো হয়নি, বরং দেশে মানবাধিকার পরিস্থিতি আরো নাজুক, আরো করুণ এবং মর্মন্তুদ হয়ে উঠেছে। ১৯টি মানবাধিকার সংস্থার সংগঠন এইচআরএফের ১০ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল ২৯ এপ্রিলে সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় অনুষ্ঠেয় জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিলে প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করে। এইচআরএফের আহ্বায়ক সুলতানা কামাল, ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের ড. ইফতেখারুজ্জামান এবং আদিবাসী ফোরামের সঞ্জীব দ্রংসহ আরো কয়েকজন ২০০৯ থেকে ২০১২ সময়কালের মানবাধিকার পরিস্থিতি তুলে ধরেন। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই চার বছরে নাগরিকদের রাজনৈতিক অধিকার উপভোগের কোন সুযোগই রাখেনি সরকার। বিরোধী দলের সভা-সমাবেশে বাধা প্রদান, বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা, তাদের জেল-জুলুমের মাধ্যমে অমানবিক পীড়ন ছিল সরকারের প্রধান কাজ। এই সময়কালে ১৫৬ জন গুম হয়েছে। এরই মধ্যে মৃতদেহ মিলেছে ২৮ জনের। এই সময়ে ক্রসফায়ার নামে বিচার বহির্ভূত হত্যাকা-ের শিকার হয়েছেন ৪৬২ জন, যদিও সরকার বলেছে, বিচার বহির্ভূত হত্যাকা- দেশে হয়নি। হিউম্যান রাইটস্ ফোরামের আহ্বায়ক এবং আইন ও সালিস কেন্দ্রের (আসক) নির্বাহী পরিচালক সুলতানা কামাল ২০০৯ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১২ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দেশে বিচার বহির্ভূত হত্যাকা-ে এবং গুম, খুন ও অপহরণের ঘটনাবলী বিশ্ববাসীর নিকট সরকার গোপন করেছে বলে অভিযোগ করে তিনি বলেন, জাতিসংঘের জন্যে তৈরি করা প্রতিবেদনে বাংলাদেশ সরকার এসব বিচার বহির্ভূত হত্যাকা-ের কথা অস্বীকার করেছে।
১৯দলীয় জোট নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া মাত্র এক মাসে সংঘটিত (২৬ ডিসেম্বর থেকে ২৭ জানুয়ারি) মানবাধিকার লঙ্ঘনের করুণ চিত্র তুলে ধরে ২০১৪ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি বলেন, ‘এক মাসে সারা দেশে ৩০২ জন রাজনৈতিক নেতাকর্মীকে খুন ও গুম করা হয়েছে।’ এদের মধ্যে ২৪২ জনকে হত্যা এবং ৬০ জনকে গুম করে দেশে এক ত্রাসের রাজত্ব (জবরমহ ড়ভ ঞবৎৎড়ৎ) সৃষ্টি করা হয়েছে। দেশে অবাধে যে হত্যাকা- চলছে তিনি জাতিসংঘসহ সকল আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন এবং এর বিরুদ্ধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের আহ্বান জানিয়েছেন। কেন তিনি আন্তর্জাতিক পদক্ষেপ চান তার ব্যাখ্যা দিয়ে বেগম খালেদা জিয়া বলেন : ‘গণতন্ত্রহীন বাংলাদেশে আইনের শাসন এবং ন্যায় বিচারের অনুপস্থিতিতে অবাধ রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস যেভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে তার ফলে শান্তিকামী মানুষের দেশ বাংলাদেশে মানবিক বিপর্যয় যেমন তরান্বিত হচ্ছে, তেমনি গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ ও রাজনৈতিকভাবে বিরোধী দলসমূহের নির্মম দলনে দেশে সঙ্গে সঙ্গে চরমপন্থী ও জঙ্গিবাদী শক্তির উত্থানের পথও প্রশস্ত করা হচ্ছে। দেশের প্রতিবাদী তারুণ্য ও অবদমিত শক্তিকে ঠেলে দেয়া হচ্ছে উগ্রবাদী পথে।
এদিকে গত ১৮ ডিসেম্বর বাংলাদেশের মানুষকে বাঁচাতে অবিলম্বে জাতিসংঘকে তৎপর হতে জাতিসংঘের মহাসচিব বান কী মুনের নিকট খোলাচিঠি লিখেছেন হংকং থেকে এশিয়ান হিউম্যান রাইটস্ কমিশনের নির্বাহী পরিচালক বিয়ো ফ্রান্সিস। তিনি জাতিসংঘের মহাসচিবকে বলেন, বাংলাদেশে বিপজ্জনক বাস্তবতার প্রতি আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের প্রেক্ষাপটে রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলো প্রতিদিনই ক্ষমতাসীন দলের সদস্যদের দেখিয়ে দেয়া রাজনৈতিক বিরোধীদের বিচার বহির্ভূতভাবে হত্যা করেছে। র‌্যাব, বিজিবির সমন্বয়ে গঠিত যৌথবাহিনী বিভিন্ন জেলায় বিরোধী রাজনৈতিক দলের প্রতি সহানুভূতি সম্পন্ন লোকজনকে গ্রেফতার করছে। তাদের বাড়িঘরে আগুন লাগাচ্ছে। ব্যবসা-প্রতিষ্ঠান পুড়িয়ে দিচ্ছে। চিঠিতে বলা হয়, পাশবিক শক্তি প্রয়োগসহ সকল পন্থায় রাজনৈতিক বিরোধীদের দমন করাই দেশটিতে ক্ষমতাসীনদের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার। ফলে বিরোধীরাও সহিংস প্রতিরোধ গ্রহণে প্ররোচিত হচ্ছে। ফলে ঢাকা ও দেশজুড়ে রক্তাক্ত ঘটনা ঘটছে প্রতিদিন। ২৫ নভেম্বর নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর থেকে ১০৫ জন নিহত হয়েছেন। সবচেয়ে ঘৃণ্য ব্যাপার হলো ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক জোট ১৫ ডিসেম্বর থেকে তাদের ক্যাডারদের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোকে ‘সহায়তা করার’ নির্দেশ দেয়। এশিয়ান হিউম্যান রাইটস্ কমিশন উদ্বিগ্ন এই জন্য যে, এই সহায়তার অর্থ হলো ক্ষমতাসীন জোটের সহযোগী দুর্বৃত্তরা রাষ্ট্রের সংস্থাগুলোর সাথে যোগ দিয়ে ইচ্ছেমত খুন, নির্যাতন ও ধর্ষণ চালিয়ে সমাজে সৃষ্টি করেছে নারকীয় এক অবস্থা। কমিশন মনে করে যে,  জাতিসংঘ মহাসচিবের অফিস এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় নজিরবিহীন উদ্যোগ গ্রহণ না করলে বাংলাদেশে ভয়াবহ মাত্রায় সহিংসতা ও নৃশংসতা সংঘটিত হবে। হুমকি ও ভয়ভীতি প্রদর্শনের কারণে দেশটির মিডিয়া নীরব হয়ে পড়েছে। সরকারের সমালোচনাকারী সুশীল সমাজের সদস্য ও মানবাধিকার কর্মীরাও গ্রেফতার হচ্ছে। বাংলাদেশের বিচারিক প্রতিষ্ঠানগুলো কার্যত সরকারের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।
এই প্রসঙ্গে ব্রিটিশ ফরেন অ্যান্ড কমনওয়েলথ অফিসের সিনিয়র মিনিস্টার সাঈদা ওয়ারসি বলেছেন, নির্বাচনকে সামনে রেখে কম-বেশি সহিংসতা বাংলাদেশে আগেও হয়েছে, কিন্তু এবারের মতো ভয়াবহ সহিংসতা আর কখনো দেখিনি।
এ ভয়াবহ পরিস্থিতিতে মানুষের জীবনে অনিশ্চয়তা এবং সমাজব্যাপী সহিংসতার মধ্যেও ঈদ এসেছে প্রাকৃতিক নিয়মে। বাংলাদেশে এবারের ঈদ এসেছে অনেকটা মেঘে ঢাকা চাঁদের আলোর মতো। শওয়ালের চাঁদ উঠেছে বটে, কিন্তু কুণ্ঠায় আচ্ছন্ন যেন। অনিশ্চয়তার অবগুণ্ঠনে ঢাকা। উদার আকাশে ভীরু চাঁদের কম্পমান আলোর মতো। সত্যি বটে, ঈদ হলো আবালবৃদ্ধবনিতার অনুষ্ঠান। ধনী-দরিদ্র সবার জন্য আনন্দঘন দিনটি। পল্লী ও শহরাঞ্চলের সবাই এই অনুষ্ঠানে উদ্বেল হয়ে ওঠেন। উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠেন শিক্ষিত ও নিরক্ষরদের সবাই। সবাই এই দিনে প্রিয়জনদের সান্নিধ্য পেতে চান। দু’দ- কাটাতে চান আপনজনদের সাথে। সন্তানরা দূর থেকে ছুটে যেতে চায় মা-বাবার নিকট। স্বামী ছুটে যায় প্রিয়তমা স্ত্রীর নিকট। বাবা হাজারো প্রতিবন্ধকতা জয় করে ছুটে চলেন সন্তানদের কাছাকাছি। সবাই ভাগাভাগি করে নিতে চান ঈদের আনন্দকে। ঈদের জামাতে ছোট-বড় একসাথে কৃতজ্ঞতা জানাই সৃষ্টিকর্তার নিকট। বাবা ছোট ছেলেটির হাত ধরে নিয়ে যান ঈদের জামাতে। নামাজ শেষ হলে সবাই কোলাকুলি করে আপন করে নিতে চায় সবাইকে। মুরুব্বিদের সালাম জানিয়ে দোয়া কামনা করে। সুখ-দুঃখের আলাপচারিতায় সবাই দু’দ- সব জ্বালা ভুলে গিয়ে অনুভব করেন বেহেশতি সুখ। সমগ্র সমাজব্যাপী ঈদের আনন্দ ছড়িয়ে পড়ে ¯েœহ-প্রেম-প্রীতির অঝোর ধারায়। প্লাবিত করে সমাজজীবনের চারদিক।
শুধু কী তাই! ঈদের দিনে সবাই প্রিয়জনদের হাতে কিছু না কিছু তুলে দিয়ে তৃপ্ত হতে চায়। মা-বাবার জন্যে নতুন কাপড়, ছেলে-মেয়ের জন্যে জামা-কাপড়, আত্মীয়-পরিজনদের হাতে কিছু উপহার সামগ্রী তুলে দেয়া রেওয়াজ বটে। ভালো খাবার তৈরি  তো আছেই। সবাই এদিন সবার সাথে খাবার-দাবার ভাগ করে খেতে চায়, আপন-পর ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে। শত্রুও এদিন মিত্র হয়ে ওঠে। সবাই ছোটে অন্যের খোঁজখবর করতে। দরিদ্র ভিখারিও ঈদের দিন ফেৎরা লাভ করে তাদের ভাঙা কুড়েঘরকে আনন্দমুখর করতে চায়।
কিন্তু ঐ যে বলেছি, এবারের চাঁদ যেন ¤্রয়িমান। চাঁদের আলোর নেই প্রত্যাশিত ঔজ্জ্বল্য। ঈদের জামাতে যাবার সময়ও এক ধরনের অনিশ্চয়তা। দ্বিধা সবার মনকে দ্বিধাগ্রস্ত করে। তারপরও আমাদের ঐকান্তিক কামনা- সবার ঘরে আসুক ঈদের আনন্দ। সবার মুখে হাসি ফুটুক, অন্তত এই দিন। সব জ্বালা-যন্ত্রণা ভুলে, সব ব্যথা-বেদনা ভুলে সবাই সবার সঙ্গে বুক মিলাক। স্বজন-প্রিয়জনের কলকাকলিতে ভরে উঠুক সবার ঘর-সংসার। ঈদের আনন্দে বিভোর হোক এদেশের  সবাই। সবার ঘরে ঈদ আসুক। আসুক বিন¤্র পদভারে, অনাবিল খুশির ডালা সাজিয়ে।

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button