হেফাজতে ইসলামের ১৩ দফা বাস্তবায়িত হলে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রে নারীদের অধিকার প্রতিষ্ঠা ও মর্যাদা সমুন্নত হবে

Hefazotহেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ চট্টগ্রাম মহানগরীর উদ্যোগে লালখান বাজার জামিয়াতুল উলূম প্রাঙ্গণে  অনুষ্ঠিত ৫ মে শাপলা চত্বরের শহীদানের জন্য বিশাল দোয়া ও ইফতার মাহফিলে প্রধান অতিথির ভাষণে সদ্য কারামুক্ত হেফাজতে ইসলামের মহাসচিব, দেশের প্রখ্যাত মুহাদ্দিস আল্লামা হাফেজ জুনাইদ বাবুনগরী বলেন, হেফাজত ইসলাম বাংলাদেশ ঘোষিত নবীপ্রেমিক জনতার প্রাণের দাবি ১৩ দফা বাস্তবায়িত হলে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রে নারীদের অধিকার প্রতিষ্ঠা ও মর্যাদা সমুন্নত হবে। ইসলাম মানুষের মর্যাদা ও অধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ও কালজয়ী জীবনাদর্শ। বিশেষত, যুগযুগ ধরে দুনিয়ার সর্বত্র নির্যাতিত, নিপীড়িত, অবহেলিত ও বঞ্চিত নারী সমাজের অধিকার প্রতিষ্ঠা ও তাদের মর্যাদা সমুন্নত করা বেলায় ইসলামের যে গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা রয়েছে তা ঐতিহাসিক সত্য। আমরা দ্ব্যর্থহীন ভাষায় আমাদের অবস্থান পুনর্ব্যক্ত করছি, হেফাজতে ইসলাম ঘরে-বাইরে, শিক্ষাঙ্গণে, কর্মক্ষেত্রে নারীর পূর্ণ নিরাপত্তা, তাদের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠা ও যথাযথ মর্যাদা সমুন্নত করার পক্ষে জোরালো ভূমিকা পালন করবে। এ ব্যাপারে কোনো বিভ্রান্তির অবকাশ নেই।
হেফাজত মহাসচিব বলেন, কিছু স্বার্থান্বেষী মিডিয়া ও ইসলামবিদ্বেষী গোষ্ঠী যারা হেফাজতে ইসলামকে নারীর প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড় করাতে নানামুখী অপপ্রচার চালাচ্ছেন তাদের প্রোপাগান্ডা সম্পর্কে নারী সমাজকে সতর্ক ও সচেতন থাকার আহ্বান জানাচ্ছি। আমরা পরিষ্কারভাবে বলতে চাই, নারীদের শিক্ষা অর্জনের জন্য রাষ্ট্রকে সর্বাঙ্গীন নিরাপদ ও অনুকুল পরিবেশ সৃষ্টি করে দিতে হবে। জীবন-জীবিকার তাগিদে পোশাক শিল্পসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে যেসব মেয়ে চাকরি করছেন কর্মস্থলের তাদের পূর্ণ নিরাপত্তা, ইজ্জত-সম্ভ্রম ও মর্যাদা সুনিশ্চিত করতে হবে। তাদের ন্যায্য মজুরি প্রদান এবং যথাসময়ে তা সসম্মানে পরিশোধের ক্ষেত্রে মালিকপক্ষসহ সংশ্লিষ্টদের যতœবান ও আন্তরিক হওয়া উচিত। বর্তমানে গার্মেন্ট শিল্প দেশের অর্থনীতি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। এই শিল্পকে আরও শক্তিশালী করে দেশের মানুষ স্বাবলম্বী হোক সেটা আমরা আন্তরিকভাবেই কামনা করি। ইসলামই পৃথিবীর একমাত্র ধর্ম যা শ্রমিকের ঘাম শুকানোর পূর্বে তাদের পারিশ্রমিক পরিশোধের জন্য মালিকপক্ষকে কড়া নির্দেশ দিয়েছে।
আল্লামা জুনাইদ বাবুনগরী আরও বলেন, শিক্ষা-দীক্ষায় নারীরা এগিয়ে গেলে দেশ উন্নত হবে। ইসলাম নারীকে অধিকতর উৎসাহিত করেছে। নারীরা কুরআন-সুন্নাহর বিধান মেনে চলার জন্য এসব বিষয়ের জ্ঞানার্জন করার জরুরি। হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ নারী শিক্ষার বিপক্ষে কখনও কোনো কথা বলেনি, বরং শিক্ষাঙ্গণে মেয়েদের সামগ্রিক নিরাপত্তা, ইজ্জত-সম্ভ্রম যেভাবে প্রতিনিয়ত লঙ্ঘিত হচ্ছে তাতে উদ্বেগ জানিয়ে আসছে এবং এই অনাকাক্সিক্ষত অবস্থার প্রতিকার দাবি করেছে। আমরা কখনও নারী শিক্ষার বিরুদ্ধে নই।
সভাপতির ভাষণে হেফাজতে ইসলামের সিনিয়র  নায়েবে আমীর আল্লামা শাহ্ মুহিব্বুল্লাহ বাবুনগরী বলেন, হেফাজতে ইসলামের ১৩ দফা সম্পর্কে চিহ্নিত ইসলামবিরোধী গোষ্ঠীর অপপ্রচার ও মিথ্যাচার এখনো বন্ধ হয়নি। দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের ঈমান-আকীদা, তাহযীব-তামাদ্দুন ও আবহমানকালের লালিত সংস্কৃতি ধ্বংস করে বিজাতীয় অপসংস্কৃতির প্রসার ঘটানোর ভয়াবহ তৎপরতা চলছে। ইসলামবিদ্বেষীদের অর্থে পরিচালিত প্রিন্টেড ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া, সুশীল সমাজ ও চরিত্রহীন তথাকথিত সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব হেফাজতে ইসলামের ১৩ দফা নিয়ে দেশে-বিদেশে অপপ্রচার চালাচ্ছে। এই অপপ্রচারের জবাবে আমরা ১৩ দফার সুস্পষ্ট ও বিশদ ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ প্রকাশ করেছি। তের দফার প্রতি সবটাই, ইসলাম, মুসলমান, দেশ, দেশীয় সংস্কৃতি, নারী শিক্ষা ও নারী অধিকারের পক্ষে। আমাদের প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, মদিনা সনদ অনুযায়ী দেশ চলবে। আমরা সকলের উদ্দেশে বলি, ১৩ দফার মদিনা সনদের সাথে খুবই সামঞ্জস্যপূর্ণ। সর্বশ্রেণীর মানুষের কাছে তের দফা যথাযথভাবে উপস্থাপন করতে আমাদের আরো বেশি তৎপর হতে হবে।
হেফাজতে ইসলামের নায়েবে আমীর, আল্লামা সৈয়দ আবদুল মালেক হালিম বলেন, আল্লাহ, রাসূল ও ইসলাম অবমাননাকারী শাহবাগীরা রাস্তা অবরোধ করে, হাসপাতালে যাতায়াতে চরম বিঘœ ঘটিয়ে মাসের পর মাস রাজপথে অবস্থান করা সত্ত্বেও তাদের দুধ-কলা দিয়ে পোষা হলো কিন্তু আল্লাহ ও রাসূলের সম্মান রক্ষায় আন্দোলন ঈমানী আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী হেফাজতে ইসলামের লাখ লাখ কর্মী, আলিম-ওলামাকে এক রাত জিকির করার সুযোগ দেয়া হল না। তাদের ওপর লক্ষাধিক রাউন্ড গুলি চালিয়ে ইতিহাসের বর্বর গণহত্যা চালানো হল। জনগণ এই ধৃষ্টতা ও গণবিরোধী ভূমিকার সমুচিত জবাব দেবে। ইতোমধ্যে ইসলামবিরোধী নানা অপকর্মের পরিণতি বাস্তবায়ন হতে দেখে সরকার দিশেহারা হয়ে আল্লামা আহমদ শফীকে বিতর্কিত করার জন্য মিডিয়া ক্যু করেছে।
কিন্তু আল্লাহ ইসলামবিদ্বেষীদের ষড়যন্ত্র নস্যাত করে দিয়েছেন। একটি জাল ভিডিও প্রচার করে জনমনে ব্যাপক বিভ্রান্তি ছড়ানোর কৌশল বুমেরাং হয়েছে। হেফাজতে ইসলামের ইসলামের জনপ্রিয়তা মোটেও কমেনি বরং আরও বেড়েছে। আগামী ঈদুল আযহার পর সারা দেশে তের দফা দাবিতে সর্বস্তরের নবীপ্রেমিক জনতা ব্যাপক আন্দোলনে শরীক হবে ইনশাআল্লাহ। এই ঈমানী জাগরণ কেউ ঠেকাতে পারবে না।
হেফাজতে ইসলামের অন্যতম নায়েবে আমীর, বিশিষ্ট আলিমেদীন মুফতি ইজহারুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, দেশে সূদ, ঘুষ, দুর্নীতি, গুম, হত্যা ও নৈরাজ্য মহামারীর আকার ধারণ করেছে। সরকার লম্বা লম্বা কথা বললেও দেশের এসব সমস্যা সমাধানে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে। মানবতা ও মানবাধিকার খোদ সরকারের হাতেই পর্যুদস্ত হচ্ছে। ভিন্নমত  দলনের উদ্দেশ্যে ভিন্নমতাবলম্বী গণমাধ্যমগুলোর গলা টিপে ধরা হয়েছে। শাপলা চত্বরের গণহত্যার সরাসরি সম্প্রচারের কারণে সম্পূর্ণ বেআইনীভাবে দিগন্ত টিভি ও ইসলামিক টিভি বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। সত্য প্রকাশ ও ইসলামের পক্ষে সাহসী ভূমিকা পালনের কারণে জনপ্রিয় পত্রিকা দৈনিক আমার দেশ বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। দেশ ও ইসলামের পক্ষে আপোষহীন অবস্থান গ্রহণের দায়ে সময়ের নির্ভিক সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে কারাগারে নিক্ষেপ ও নানা রকম নির্যাতন করা হচ্ছে। আমরা সরকারকে অনুরোধ করছি, পাপের বোঝা আর ভারি না করে সুপথে ফিরে আসুন; নইলে ভয়াবহ পরিণতি অপেক্ষা করছে। পাঁচ সিটি নির্বাচনের এর কিছু আভাস পেয়েছেন।
দোয়া ও ইফতার মাহফিলে বিশেষ অতিথির বক্তব্যে জামিয়া দারুল মা’আরিফ আল ইসলামিয়ার প্রিন্সিপাল আল্লামা সুলতান যওক নদভী বলেন, নারীবাদী নারীর বন্ধু সেজে তাদের সর্বনাশ ঘটাচ্ছেন। আজ নারীদের দিয়ে পর্ণোগ্রাফী বানানোর মতো জঘন্য ও কুরুচিপূর্ণ অপকর্ম সংঘটিত হচ্ছে। ফ্যাশন শো’র নামে স্বল্পবসনা তরুণীদের দেহপ্রদর্শনীর মাধ্যমে নারী জাতির সম্মান ধূলোয় মিশিয়ে দেয়া হচ্ছে। নারী অধিকারের অসার বুলি আওড়িয়ে নারীকে পণ্যে পরিণত করেছে। প্রতিটি পণ্যের বিজ্ঞাপনে নারীর অশালীন ও অযৌক্তিক প্রদর্শনীর মাধ্যমে তারা নারীর সম্মান নয় পুরো মায়ের জাতির চরম অবমাননা করে চলেছেন। নানার রকম মুখরোচক স্লোগান দিয়ে নারীকে রাস্তায় নামিয়েছে, আজ শিক্ষাঙ্গণে পরিমল ধরের মতো ঘৃণ্য লোকদের হাতে ছাত্রীরা ধর্ষিতা হচ্ছে। এতে ছদ্মবেশী নারীবাদীদের মাঝে কোনো আন্দোলন বা তৎপরতা দৃষ্টিগোচর হয় না। তারা বস্তুত নারীবাদী নয়; ইসলামের শত্র“দের নিয়োজিত বেতনভোগী এজেন্ট। আমরা তাদের হুশিয়ার করছি, এদেশ সংখ্যাগরিষ্ঠ ধর্মপ্রাণ মানুষের দেশ, অলি-আউলিয়ার পূণ্যভূমি, এদেশে আমরা যুগযুগ ধরে সকল ধর্মের মানুষ মিলেমিশে দৃষ্টান্তবিরল সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির সঙ্গে বসবাস করে আসছি, যারাই সমাজে ধর্ম অবমাননার মাধ্যমে বিশৃঙ্খলা ও নৈরাজ্য সৃষ্টির পাঁয়তারা চালাবে তাওহীদি তাদের বিরুদ্ধে সম্মিলিত প্রতিরোধ গড়ে তুলবে।
আল-জামিয়া আল-ইসলামিয়া পটিয়ার শায়খুল হাদিস, বিশিষ্ট ইসলামি আইনবিদ আল্লামা মুফতি আহমদুল্লাহ বলেন,  দেশের গরীব মানুষ দিন দিন গরীব হচ্ছে, হাতেগোণা কিছু মানুষের হাতে দেশের সম্পদ পুঞ্জিভূত হয়ে আছে। দারিদ্র্য বিমোচনের ব্যবসা নিয়ে বিদেশি এনজিওগুলো সারা বাংলাদেশ চষে বেড়ালেও প্রকৃতপক্ষে দারিদ্র্য বিমোচন হচ্ছে না। দারিদ্র্য বিমোচনের সঠিক ও একমাত্র বাস্তবসম্মত পন্থা হলো যাকাত ভিত্তিক অর্থব্যবস্থা। দেশে যাকাত ভিত্তিক অর্থব্যবস্থা চালু করা হলে দ্রুত সময়ের মধ্যে দেশ দারিদ্র্যের অভিশাপ থেকে মুক্ত হবেÑ এ বিষয়ে আমরা গোটা দুনিয়াকে চ্যালেঞ্জ করছি। সুতরাং অভাব ও দারিদ্র মুক্ত বাংলাদেশ গড়ার জন্য যাকাত ভিত্তিক অর্থব্যবস্থা রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে বাস্তবায়ন করার দাবি জানাচ্ছি।
দোয়া ও ইফতার মাহফিলে অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য রাখেন, কুষ্টিয়া ইউনিভার্সিটির সাবেক ভাইস-চ্যান্সেলর প্রফেসর মাওলানা ড. এনামুল হক, হেফাজতে ইসলামের মহানগর সহসভাপতি, বায়তুশ শরফ আদর্শ কামিল মাদরাসার অধ্যক্ষ সৈয়দ আবু নোমান, মাওলানা আজিজুল হক ইসলামাবাদী, আবদুর রহমান চৌধুরী, মাওলানা জিয়াউল হোসাইন, মাওলানা জায়নুল আবেদীন, মাওলানা মনসুরুল হক জিহাদী, মাওলানা ইলিয়াস উসমানী, হাকিম এম. এ. তাহের আরবি, মুফতি হারুন ইজহার, মাওলানা হাবিবুল্লাহ আজাদীবাজার, ঢাকা মহনগর যুগ্ম সম্পাদক মাওলানা সাখাওয়াত হোসাইন, মাওলানা আহমদ আলী কাসেমী, মাওলানা মীর মুহাম্মদ ইদরিস, মাওলানা নাছির উদ্দিন মুনির। উপস্থিত ছিলেন বিএনপি নেতা, আবু সুফিয়ান, এডভোকেট আবদুস সাত্তার, হুম্মাম কাদের চৌধুরী, ইসলামী আন্দোলন চট্টগ্রাম মহানগর সভাপতিÑ আলহাজ্ব জান্নাতুল ইসলাম, কমিশনার মাহফুজুর রহমান, মাওলানা জালালুদ্দিন, বিজেপি নেতা নূর মুহাম্মদ খান, মাওলানা মুফতি হাসান মুরাদাবাদী, মাওলানা এনামুল হক, মাওলানা সোহাইল প্রমুখ।

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button