মন্দা মোকাবেলায় ব্যাংক অব ইংল্যান্ডের সব অস্ত্র ফুরিয়ে যায়নি

সুদহার হ্রাসের সুযোগ কমে আসায় চলমান মন্দা মোকাবেলায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর নিরস্ত্র হয়ে পড়ার ধারণাটিকে নাকচ করে দিয়েছেন ব্যাংক অব ইংল্যান্ডের (বিওই) গভর্নর অ্যান্ড্রু বেইলি। আর্থিক মন্দা মোকাবেলায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভাণ্ডার থেকে এখনো সব অস্ত্র ফুরিয়ে যায়নি বলে মনে করছেন তিনি। এর সপক্ষে যুক্তি দিতে গিয়ে তিনি বলেছেন, মার্চে ব্যাংক অব ইংল্যান্ডের ২০ হাজার কোটি পাউন্ডের বন্ড ক্রয়ের পদক্ষেপটি এরই মধ্যে বৃহৎ পরিসরে ও দ্রুতগতিতে কোয়ান্টিটেটিভ ইজিং (মন্দা মোকাবেলায় বাজারে অর্থের সরবরাহ বৃদ্ধি) কার্যক্রম বাস্তবায়নের উপযোগিতাকে সামনে তুলে ধরেছে।

ভার্চুয়াল জ্যাকসন হোল সেন্ট্রাল ব্যাংকিং কনফারেন্সে সম্প্রতি এ বক্তব্য রাখেন অ্যান্ড্রু বেইলি। তিনি বলেন, আমরা কোনোভাবেই পুরোপুরি নিরস্ত্র হয়ে পড়িনি। সত্যি কথা বলতে আজকের এ পর্যায়ে এসে দেখা যাচ্ছে, করোনা-পূর্ববর্তী সময়ে আমাদের হাতে যেসব পদক্ষেপ নেয়ার সুযোগ ছিল, সেগুলো ব্যবহারের বিষয়ে আমরা অতিসতর্ক অবস্থান নিয়েছি। কিন্তু এসব পদক্ষেপের মধ্যে সঠিকটি বেছে নেয়ার গুরুত্ব এখন আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি। অতীতে ব্যাংক খাতের সংকট ও ব্রেক্সিট গণভোট পরবর্তী সংকটসহ বিভিন্ন সময়ে বিওই বন্ড ক্রয়ের যে পদক্ষেপ নিয়েছিল, মার্চের পদক্ষেপটি বাস্তবায়ন করা হয়েছে তার চেয়েও অনেক বেশি আগ্রাসীভাবে এবং তুলনামূলক বৃহৎ পরিসরে ও দ্রুতগতিতে। এ পদক্ষেপ প্রমাণ করেছে, যে সময় বাজার পুরোপুরি ধসে পড়ে এবং আর্থিক সংকট গোটা অর্থনীতিতে বড় মাপের ক্ষতের কারণ হয়ে ওঠার আশঙ্কা তৈরি করে, তেমন মুহূর্তে কোয়ান্টিটেটিভ ইজিংয়ের মতো পদক্ষেপই সবচেয়ে ভালো কাজ করে।
এখন পর্যন্ত অর্থনীতিতে কভিড-১৯-এর প্রভাব মোকাবেলায় সবচেয়ে সাহসী ও আগ্রাসী পদক্ষেপ নিয়েছে যুক্তরাজ্য। এক্ষেত্রে দেশটির অর্থমন্ত্রী ঋষি সুনাককে যেমন কৃতিত্ব দিতে হয়, তেমনি স্বীকার করে নিতে হবে বিওই গভর্নর অ্যান্ড্রু জনসন বেইলির অবদানও। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী এ কেন্দ্রীয় ব্যাংকার এমন এক সময় ব্রিটিশ অর্থ ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমের ভার হাতে তুলে নেন যখন করোনা সংকটের কারণে বিশ্ব অর্থনীতিতে শোনা যাচ্ছে ভয়াবহ মন্দার পদধ্বনি। চলতি বছরের ১৬ মার্চ এ পদে অভিষিক্ত হন তিনি।
শুরু থেকেই সংকট মোকাবেলায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ব্যালান্সশিট সম্প্রসারণ ও কোয়ান্টিটেটিভ ইজিং কার্যক্রমের ওপর জোর দিয়ে এসেছেন অ্যান্ড্রু বেইলি। অর্থাৎ অর্থনীতিতে মুদ্রা সরবরাহ বাড়ানোর মাধ্যমে জনগণকে দৈনন্দিন জীবনযাপন চালিয়ে যেতে সহায়তা করার পাশাপাশি সম্পদ বৃদ্ধির মাধ্যমে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে আরো শক্তিশালী অবস্থানে নিয়ে যাওয়ার ওপরও জোর দিয়েছেন তিনি। ভার্চুয়াল জ্যাকসন হোল সেন্ট্রাল ব্যাংকিং কনফারেন্সে দেয়া বক্তব্যেও এর প্রতিফলন দেখিয়েছেন তিনি।
অ্যান্ড্রু বেইলি বলেন, গত এক দশকে অধিকাংশ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উদ্বৃত্তপত্রের (ব্যালান্সশিট) আকার স্থিতিশীল হারে বেড়েছে। বিষয়টি আর্থিক নীতি এবং অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার লক্ষ্য অর্জনের ক্ষেত্রে একধরনের সহায়ক ভূমিকা পালন করছে। এর আগে বৈশ্বিক আর্থিক সংকটের কালে দেখা গিয়েছিল, সে সময় ব্যাংকগুলোর হাতে উচ্চমানসম্পন্ন লিকুইডিটি অ্যাসেট ছিল অনেক কম, যার কারণ ছিল আর্থিক নিয়ন্ত্রণমূলক কার্যক্রমে বিচক্ষণতার অভাব। ওই সময়ের পর থেকেই নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম ও ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবর্তন এসেছে। ফলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোয় উচ্চমানসম্পন্ন লিকুইডিটি অ্যাসেটের বড় একটি অংশ হিসেবে উল্লেখযোগ্য মাত্রায় রিজার্ভ বাড়ানোর চাহিদাও তৈরি হয়েছে। বিশেষ করে বৃহৎ অর্থনীতির দেশগুলোর ব্যাংক ব্যবস্থায় এ সময়ে রিজার্ভের মাত্রা বৃদ্ধির প্রয়োজনীয়তা ক্রমেই বেড়েছে। তবে এ মাত্রা কতটা বেশি হবে সে হিসাব খুব একটা সরলও নয়। প্রকৃতপক্ষে তা নির্ভর করে সময়ের সঙ্গে পরিবর্তনশীল অনেক প্রভাবকের ওপর। গত এক দশকে আর্থিক নীতিতেও বড় ধরনের পরিবর্তন এসেছে। এ সময়ে সরকারি ঋণসহ বিভিন্ন সম্পদ ক্রয়ের মাধ্যমে আর্থিক প্রণোদনার মাধ্যম হিসেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ব্যালান্সশিটকে ব্যবহারের প্রবণতাও বেড়েছে। এসব কারণেই সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর ব্যালান্সশিটের আয়তনও বেড়েছে।
তিনি আরো বলেন, সংকট-পরবর্তী সময়ে আর্থিক নীতি বাস্তবায়নের পাশাপাশি বড় মাত্রায় কোয়ান্টিটেটিভ ইজিংয়েরও প্রয়োগ দেখা যায়। এক দশক আগেও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ব্যালান্সশিটের আকার বাড়ানোর আর্থিক নীতিগত দিকটিকে বিবেচনা করা হতো স্বল্পমেয়াদি হিসেবে। অন্যদিকে আর্থিক স্থিতিশীলতার নীতিগত দিকটি ছিল স্থায়ী। কিন্তু ইকুইলিব্রিয়াম সুদহার (যে সুদহারে বাজারে অর্থের চাহিদা ও সরবরাহ সমান হয়) কমে যাওয়ার পেছনের কাঠামোগত প্রভাবকগুলো বিবেচনায় বলা যায়, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ব্যালান্সশিট সম্প্রসারণের আর্থিক নীতিগত উপযোগিতা অতীতে যতটা ধারণা করা হতো তার চেয়েও অনেক বেশি দীর্ঘমেয়াদি।
দায়িত্ব গ্রহণের পর শুরু থেকেই কোয়ান্টিটেটিভ ইজিংয়ের মাধ্যমে সংকট মোকাবেলার ক্ষেত্রে যথেষ্ট দৃঢ়তা ও আত্মবিশ্বাস দেখিয়ে এসেছেন অ্যান্ড্রু বেইলি। তার মতে, কোয়ান্টিটেটিভ ইজিং কার্যক্রমের দ্রুত সম্প্রসারণ ও আগ্রাসী বাস্তবায়ন শুধু আর্থিক বাজারকে শান্ত করেনি, বরং একই সঙ্গে তা সংকোচনশীল বৈশ্বিক অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটের মধ্যেও মূল্যস্ফীতির স্বাভাবিক ধারাটিকে বজায় রাখতে সহায়ক ভূমিকা রেখেছে।
ভার্চুয়াল জ্যাকসন হোল সেন্ট্রাল ব্যাংকিং কনফারেন্সের বক্তব্যেও নিজের এ অবস্থানের পুনরাবৃত্তি করেছেন তিনি। বক্তব্যে অ্যান্ড্রু বেইলি বলেন, কভিড-১৯ সংকট কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোকে আর্থিক মন্দা-পরবর্তী পৃথিবীতে প্রথম বড় পরীক্ষার সামনে ঠেলে দিয়েছে। অভূতপূর্ব ধাক্কা সামলানোর তাগিদে উপযুক্ত আর্থিক নীতি গ্রহণের প্রয়োজনীয়তাও দেখা দিয়েছে। অনেক কেন্দ্রীয় ব্যাংকের জন্যই এখন পর্যন্ত এক্ষেত্রে প্রধান অস্ত্র হলো আগ্রাসী মাত্রা ও গতিতে সম্পদ ক্রয়ের মাধ্যমে কোয়ান্টিটেটিভ ইজিংয়ের ব্যাপ্তি বাড়ানো। এর ফলে কোয়ান্টিটেটিভ ইজিং কীভাবে কাজ করে এবং অর্থনীতি ও আর্থিক ব্যবস্থার পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে এর কার্যকারিতা কতদূর, সে বিষয়ে একধরনের প্রশ্ন উত্থাপনের অবকাশ তৈরি হয়। তবে চলমান কভিড-১৯ সংকটে কোয়ান্টেটিভ ইজিং যথেষ্টই কার্যকর প্রমাণিত হয়েছে। আদতে এর প্রভাব নিরূপণ করা অনেক কঠিন, কারণ এটি প্রয়োগ না করা হলে কী হতো, সেটা আমাদের পক্ষে বলা মুশকিল। কিন্তু পরিষ্কারভাবেই বাজারের মারাত্মক আর্থিক চাপ সামষ্টিক অর্থনীতিতে সংক্রমিত হওয়ার বিপজ্জনক ঝুঁকিটিকে ঠেকিয়ে দিয়েছে কোয়ান্টিটেটিভ ইজিং। এর মাধ্যমে আর্থিক সংকোচনের ঝুঁকি এড়ানোর পাশাপাশি সুদহার নীতির কার্যকারিতা বাড়ানোও সম্ভব হয়েছে।
বর্তমান করোনা পরিস্থিতিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ব্যালান্সশিট সম্প্রসারণের আর্থিক নীতিগত প্রভাব ও আর্থিক স্থিতিশীলতার প্রভাবকগুলোর মধ্যকার সম্পর্ক আরো গভীর হয়ে দেখা দিয়েছে মন্তব্য করে এ সময় তিনি আরো বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর সামনে এখন বর্তমান সংকটের প্রাথমিক ধাক্কাটি সামলানোর পাশাপাশি মাত্রা ও গতির দিক থেকে অভূতপূর্ব এক অর্থনৈতিক ধস মোকাবেলার উপযোগী আর্থিক নীতিমালা গ্রহণের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে। কিন্তু আর্থিক স্থিতিশীলতার দিক থেকে জরুরি পদক্ষেপ বাস্তবায়নের বর্তমান প্রেক্ষাপটটি অতীতের তুলনায় ভিন্ন। বর্তমান সংকটের উত্পত্তি ব্যাংক ব্যবস্থার মধ্যে নয়, বরং ব্যাংকবহির্ভূত খাতের তহবিল, ব্যবসায়ী ও করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে।
তিনি বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো রেপো কার্যক্রমের মাধ্যমে ব্যাংকে তারল্য সরবরাহ বাড়াতে প্রথাগত পদ্ধতিগুলো ব্যবহার করছে। পরিস্থিতির ভারসাম্য আনার ক্ষেত্রে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। কিন্তু ব্যাংকবহির্ভূত খাতে দ্রুত তারল্য সরবরাহের জন্য এসব পদ্ধতি পর্যাপ্ত নয়। এজন্য বড় আকারে ও আগ্রাসীভাবে সম্পদ ক্রয়ের কার্যক্রমও হাতে নিতে হয়েছে।
বিওই বলছে, আগে যতটা আশঙ্কা করা হয়েছিল, করোনা পরিস্থিতির কারণে যুক্তরাজ্যের অর্থনীতি ততটা ক্ষতিগ্রস্ত না হওয়ার সম্ভাবনাই এখন বেশি। যদিও এখান থেকে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারে কিছুটা সময় লেগে যেতে পারে। তবে ব্রিটিশ অর্থনীতি যে এখন একটু একটু করে পুনরুদ্ধারের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, সে বিষয়ে বেশ প্রত্যয়ী অবস্থান নিয়েছে অ্যান্ড্রু বেইলির অধীন বিওই।
ব্রিটিশ সরকারের ফারলাফ স্কিম-সংক্রান্ত সর্বশেষ ঘোষণায় সমর্থন দানের মাধ্যমেও এ অবস্থান পুনর্ব্যক্ত করেছে বিওই। স্কিমটির আওতায় ৯০ লাখেরও বেশি ব্রিটিশ শ্রমিকের মজুরি পরিশোধ করার মাধ্যমে তাদের কর্মসংস্থান টিকিয়ে রেখেছিল ব্রিটিশ সরকার। অক্টোবরে এ স্কিমটির বাস্তবায়নে ইতি টানার সিদ্ধান্ত নিয়েছে যুক্তরাজ্য। এতে সমর্থন জানিয়ে বিওই গভর্নর বলেছেন, যেহেতু ব্রিটিশ অর্থনীতি এখন পুনরুদ্ধারের দিকে এগোচ্ছে, সেহেতু অধিকাংশ কর্মীই এখন কাজে ফিরে যেতে পারবেন। তবে এজন্য শ্রমিকদের অনুৎপাদনশীল কাজ থেকে উৎপাদনশীল খাতে সরিয়ে নেয়ার দিকে নীতিনির্ধারকদের মনোযোগী হতে হবে বলে মন্তব্য করেছেন তিনি।

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button