কেমন করে কোহিনূর ভারত থেকে ব্রিটেন গেল

Kohinoorআখতার হামিদ খান: ভারতের বিধায়কগণ দল মত নির্বিশেষে সম্প্রতি ব্রিটেনের কাছে দাবি জানিয়েছেন। ঐতিহাসিক “কোহিনূর” হীরক খন্ডটি ভারতের কাছে ফেরৎ পাঠানোর জন্য। যেটি প্রায় গত দেড় শতাব্দী ধরে ব্রিটিশ রাজমুকুটে শোভা পেয়েছে। বড় আশ্চর্য ঘটনা হল বিশ্ব বিখ্যাত অথচ সর্বনাশা এই হীরকটি আবিষ্কৃত হওয়ার পর থেকে এর ইতিহাস কেবলই দখল আর জবর দখলের তথা হাত বদলের ইতিহাস। যে ইতিহাস কখনও নাটকীয়, কখনও হৃদয়বিদারক, কখনও রোমান্সকর আবার কখনও হাস্যকরও। কি সেই ইতিহাস তাই নিয়ে এই অনুসন্ধানী রচনা।
কোহিনূর শব্দটি ফার্সি। যার অর্থ হল “আলোর পর্বত।” এই  নামকরণ করেছিলেন পারস্যরাজ নাদির শাহ। অবশ্য সুচিন্তিতভাবে তিনি এই নামকরণ করেননি। ১৭৩৯ সালের ১ মে মুঘল সাম্রাজ্যের সম্রাট মুহম্মদ শাহ এর কাছ থেকে অধিকার করে হাতে নিয়েই চোখ ধাঁধানো হীরক খন্ডের উজ্জ্বলতা দেখে উল্লাসে চিৎকার করে বলে উঠেছিলেন “কোহিনূর”। তারপরই এই হীরক খন্ডটি এই নামেই বিশ্ব পরিচিতি পায়। এর পূর্বে এটি যুগ যুগ ধরে বাবরের হীরে নামেই পরিচিত ছিল। খুব সম্ভবত ভারতের গোলগোন্ডা অথবা কোলারের খনি থেকে এই হীরে আবিষ্কৃত হওয়ার অনেক পরে অর্থাৎ ১৫২৬ সালের পানি পরে ইব্রাহিম লোদির মৃত্যুর পর তার ধন-সম্পদের বহর থেকে মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা বাবরের হস্তগত হয়েছিল এই হীরাটি। এ সম্পর্কে বাবর তার আত্মজীবনীতে লিখেছেন “এটাই সম্ভবত সেই হীরে, যেটা আলাউদ্দিন খিলজী পেয়েছিলেন। এর ওজন হবে ৮ মিশকাল (প্রায় ১৮৮ ক্যারেট)। এটি দিয়ে সারা দুনিয়ার আড়াই দিনের খাবার সংগ্রহ করা যাবে। এটি এমনই মহামূল্য। আমি আগ্রা পৌঁছলে হুমায়ুন আমাকে এটি দেয়।”
তাহলে দেখা যাচ্ছে সম্রাট বাবরের সময় থেকে (মৃত্যুঃ ২৬ ডিসেম্বর ১৫৩০) মহম্মদ শাহের শেষ সময় ১৭৩৯ সাল অর্থাৎ শতাধিক বছর পর্যন্ত এটি ‘বাবরের হীরে” নামেই খ্যাত ছিল।
এই কোহিনূরে বহু হাত বদলের ইতিহাসে না গিয়ে এটি কি করে ব্রিটিশ রাজ্যের করায়ত্ত হল সেই ইতিহাসের বিবরণ দেয়া যাক। এখানে আরেকটি কথা বলা দরকার তা হল-ফার্সি শব্দ কোহিনূর মানে আলোর পর্বত কিন্তু বাস্তবতার নিরিখে কোহিনূরের আরেকটি অর্থ সৃষ্টি হয়েছিল। তা হোল কোহিনূর মানে দুর্ভাগ্য। দেখা গেছে, কোহিনূর ‘নীলা’ পাথরের বেলায় বলা হয় যে, নীলা সবার ভাগ্যে সহ্য হয় না। যাই হোক, নাদির শাহ ভারত থেকে কোহিনূরের সাথে আরও ধন-সম্পদ নিয়ে ফিরে যান পারস্যে। সেই সাথে ভারত থেকে দেহে ভরে নিয়ে যান শোথ রোগ। (শরীরে পানি নামার কারণে ফুলে যাওয়া)। ফিরে যাওয়ার ৪ বছরের মধ্যেই তিনি নিজ শিবিরেই এক আঁততায়ীর হাতে নির্মমভাবে নিহত হন।
নাদির শাহ ১৭৩৪ সালে আফগানিস্তানের কান্দাহার অধিকার করে নেয়ার পর সেখানকার সেনাদলের তাঁর এক দেহরক্ষী সৈনিক আহমদ খান আবদালি ক্রমান্বয়ে সেখানে প্রভাবশালী হয়ে উঠেছিলেন। নাদির শাহের আফগান পত্নীর কাছ থেকে নাদিরের মৃত্যু সংবাদ শুনে আবদালি ছুটে যান পারস্যে এবং মৃত রাজার আঙ্গুল থেকে রাজকীয় সিলমোহর ও সেই মহামূল্যবান কোহিনূর নিয়ে রওয়ানা দেন কান্দাহার। ফিরে গিয়েই রাজা হয়ে দূরর-ই-দূরবার (যুগের মুক্তা) নাম দিয়ে দুরবারি বংশ স্থাপন করেন। যিনি ৮ বার ভারত আক্রমণ করেছিলেন। এই পরাক্রমশালী যোদ্ধাও একদিন ২৩ অক্টোবর ১৭৭২ কর্কট রোগে প্রাণ ত্যাগ করেন। মৃত্যুর আগে দুররানি চার ছেলের মাঝে ছেলে তাইমুরকে উত্তরাধিকার নির্বাচন করেন। তার মৃত্যু হয় ১৭৯৩ সালের ২০ মে। এরপর তাইমুরের ছেলেদের মধ্যে হাত বদল হতে হতে এক সময় যায় সুজা নিমর্জার কাছে। তারিখটা ছিল ১৮১৩ সালের ১ জুন। সেদিন লাহোরের মহারাজ পাঞ্জাব কেশরী রনজিৎ সিং সেই কোহিনূরটি সুজা মির্জার কাছ থেকে কৌশলে আর জোর খাটিয়ে নিলেন দখল করে।
এক চোখ অন্ধ, বসন্তমুখো, ছোটখাটো চেহারার এই অসীম মনোবল আর শক্তিশালী শিখ সন্তান রনজিৎ ছিলেন বেজায় রত্ন প্রিয় মানুষ। তার বাবা শরীর ঢাকা থাকত নানা হীরে-জহরত দিয়ে। তিনি  কোহিনূর অধিকারের পর একটি ব্রেসলেটে বসিয়ে সেটি পরতে লাগলেন। ক’দিন পরে তার মনে হল এটি কারো নজরে পড়ছে না। ফলে তা ব্রেসলেট থেকে খুলে পাগড়িতে বসিয়ে পড়তে থাকেন।
একদিকে লাহোরের মহারাজ অন্যদিকে কোহিনূরের মালিক এই দুই অহংকার নিয়ে বেশ সুখেই দিন চলছিল তার। এরই মধ্যে ১৮৩৫ সালের ১৭ আগস্ট হঠাৎই তিনি অসুস্থ হয়ে পড়লেন। এর ফলে তার মুখের একটা অংশ অসাড় হয়ে যায়। ১৮৩৭ এবং ১৮৩৮ পরপর দু’বার বড় ধরনের দু’টি স্ট্রোক হয়ে যায় পাঞ্জাব কেশরীর। অবশেষে ২৭ জুন, ১৮৩৯ সালে তার মহাপ্রয়াণ ঘটে। মৃত্যুর কয়েক ঘণ্টা আগে তার কোহিনূর নিয়ে কম দুশ্চিন্তা ছিল না। জীবন যায় যায় অবস্থায় তিনি নির্দেশ দিলেন জগন্নাথ মন্দিরে জগন্নাথ দেবের ললাটে হীরেটি বসিয়ে দেয়ার জন্য। তারপর অনেক মণিমুক্তা, হীরা দান করে দেন ব্রাহ্মণদের মাঝে।
এ সময় রনজিৎ সিংহের তোশাখানার ভারপ্রাপ্ত আধিকারিক মিশ্র বেলিরাম রাজার সিদ্ধান্তে সায় না দিয়ে জানালেন জগন্নাথ দেব নয় কেবল রাজাই হবেন এই কোহিনূরের গর্বিত অধিকারী। ফলে শুরু হয়ে গেল জল্পনা-কল্পনা আর তোড়জোর কে হবেন সিংহাসনের উত্তরাধিকারী। সে সময় নানাপথে চেষ্টা করতে লাগলেন প্রধানমন্ত্রী ধিয়ান সিং তার ছেলে হীরা সিংকে সিংহাসনে বসাবার জন্য। কিন্তু তার কোন চেষ্টাই সফল হল না। যে কারণে প্রতিহিংসা পরায়ণ হয়ে প্রধানমন্ত্রী বিয়ান সিং মিশ্র বেলিরামকে কারাগারে পুরলেন। তাতেও হল না। অবশেষে হীরা সিং হত্যা করলেন মিশ্র বেলিরামকে। ১৮৪৩ সালে রনজিৎ সিং’র মাত্র ৫ বছরের শিশু পুত্র দলিপ সিংকে সিংহাসনে বসানো হল। ততদিনে ভারতে ব্রিটিশ বেনিয়াদের বাণিজ্যের অজুহাতে দুরভিসন্ধি শুরু হয়ে গেছে। একদিন শিশু রাজা দলিপের রাজত্বেই শুরু  হয়ে যায় ইঙ্গ-শিখ যুদ্ধ। পরিণামে উন্নত সমরাস্ত্রের অধিকারী ইংরেজরা ১৮৪৬ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি বিজয় ঘোষণা করল।
এরপর ব্রিটিশ সরকার দলিপের মা মহারাণী জিন্দর কাউরকে অছিপদ থেকে সরিয়ে নিয়ে এক নতুন অছি পরিষদ গঠন করে রাজ্য শাসনের ব্যবস্থা করে। এভাবেই চলে কয়েক বছর। চলার পর ১৮৪৯ সালে দলিপকে অপসারণ করে ব্রিটিশরাই পাঞ্জাব অধিকার করে নেয়। দলিপকে বন্দি অবস্থায় ফতেগড়ে জন লগিনের হেফাজতে স্থানান্তরিত করা হয়।
এখানে শিশু বয়সে ইংরেজদের সাথে মেলামেশার কারণেই খুব সম্ভবত ১৮৫৩ সালে দলিপ খ্রিস্ট ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে ধর্মান্তরিত হয়ে পড়েন। পরের বছর দলিপকে সরকারিভাবে ইংল্যান্ডে পাঠিয়ে দেয়া হয়। সেখানে বসেই তিনি হৃত রাজ্য পুনরুদ্ধারের একটা চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। যাই হোক, ১০ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৬ সালে ইঙ্গ-শিখ যুদ্ধে ইংরেজরা জয়ী হবার পর মার্চেই একটা চুক্তিনামা করা হয়েছিল। তার এক নম্বরে ছিল, দলিপ নিজেই লাহোরের সিংহাসন থেকে তার সমস্ত অধিকার এবং পাঞ্জাবের সার্বভৌমত্ব সবকিছু ছেড়ে দেবেন। দ্বিতীয় নম্বরে ছিল, দলিপের যাবতীয় স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি ব্রিটিশ সরকার বাজেয়াপ্ত করবে।
এই চুক্তির দ্বিতীয় নম্বরে যা লেখা ছিল তাতে আর কোন কিছুর প্রয়োজন পড়ে না। তারপরেও চুক্তির তৃতীয় নম্বরে বলা হয়- লাহোরের মহারাজ্য কোহিনূর হীরেটি ইংল্যান্ডের মহারাণী ভিক্টোরিয়ার কাছে অর্পণ করবেন। এই কাজটির সঙ্গে সরাসরি যুক্ত ছিলেন গভর্নর জেনারেল ডালহৌসী। এর মধ্যে ১৮৪৯ সালের এপ্রিল এক চিঠিতে মহারাণীকে জানিয়েছেন যে, উদ্ধারকৃত কোহিনূরটি তার কাছে পাঠানো হচ্ছে। আলোচনান্তে ঠিক হল, নদীপথেই কোহিনূর পাঠানো হবে। তবে খুব গোপনে। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী “এইচ এম এস মোদিয়া” নামে একটি যুদ্ধ জাহাজে করে ১৮৫০ সালের ৬ এপ্রিল ভারতের বোম্বাই বন্দর ত্যাগ করল কোহিনূর। এই জাহাজটি চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্বে ছিলেন কমান্ডার লকইয়ার। তিনিও জানতেন না এই জাহাজে সওয়ার হয়েছে কোহিনূর। দীর্ঘপথ চলতে চলতে অবশেষে ১৮৫০ সালের ২৯ জুন পোর্টসমাউথ বন্দরের এক নির্জন মাল জেটিতে নোঙর ফেলে মোদিয়া।
বাকিংহাম প্যালেসে একটা সভা বসেছে। তারিখটা ছিল ৩ জুলাই, ১৮৫০। মোদিয়া থেকে লোহার সিন্দুকটি নিয়ে প্রাসাদে পৌঁছুলেন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির চেয়ারম্যান স্যার আর্চিবল্ড গ্যালওয়ে। সঙ্গে আছেন ভাইস চেয়ারম্যান। সভায় সংক্ষিপ্ত একটা ভাষণ দিয়ে আর্চিবল্ড মহারাণী ভিক্টোরিয়ার হাতে তুলে দিলেন ভারতের জগৎ বিখ্যাত “কোহিনূর”।
অবশ্য রাণীর কাছেও কোহিনূর স্বস্তিতে থাকতে পারল না। ১৯ এপ্রিল, ১৮৫১ রাণীর জহুরী সেবাস্টিয়ান গ্যারার্ড ওজন করে দেখলেন ১৮৬ ক্যারেট। হায় সর্বনাশ। এটি কি করে হল! দুশ্চিন্তায় কি কোহিনূর ২ ক্যারেট শুকিয়ে গেল! এরপর কোহিনূরের আরও সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য স্লিম করার চিন্তা করা হল। রাণীর যা কথা তাই কাজ। শেষ পর্যন্ত কোহিনূরকে স্লিম তথা মেদহীন করতে কেটেকুটে একাকার করে ফেলা হল। হীরে কাটার অনেক পদ্ধতির মধ্যে অন্যতম দু’টি পদ্ধতি আছে। একটি “রোজকাট” অন্যটি “ব্রিলিন্ট কাট”। কোহিনূরকে রোজকাট করায় এর ওজন হল ১০৮.৯৩ ক্যারেট। শুধু তাই নয়, ভুল কাটের কারণে এর ঔজ্জ্বল্যও কমে গেল। যদিও আলোক বিজ্ঞানী স্যার ডেভিড ব্রিউ ইস্টার একটা অনুবীক্ষণ যন্ত্রের নীচে রেখে অনেক পরীক্ষা-নিরিক্ষা করে বলেছিলেন এর জ্যোতি আরও ছড়াবে যদি এটি কাটা যায়। অন্য বিশেষজ্ঞরাও ঠিক একই মত প্রকাশ করেছিলেন। আমস্টারডার্মের ডাচ মেসার্স কোস্টার কোম্পানির দু’টি বিখ্যাত হীরে খোদাই বিশেষজ্ঞ ভুর স্যাঙ্গার ও ফেডডার লন্ডনে আসেন। তারা দু’জন ২৫ নং হে মার্কেটে রাণীর রাজ জহুরী গ্যারার্ডের কারখানায় ৩৮ দিন ধরে কাটাকুটির কাজ সারলেন। এতে ব্যয় হল ৫ হাজার পাউন্ড।
এরপর ১৮৬১ সালে লন্ডন ক্রিস্টাল প্যালেসে “দ্য গ্রেট এক্সিবিশন” নামে একটি প্রদর্শনী হল। প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ কোহিনূর দৃশ্য উপভোগ করলেন। প্রদর্শনীর পরে রাণী ভিক্টোরিয়া দু’হাজার ছোট ছোট হীরের মাঝখানে কোহিনূরে বসিয়ে একটি টায়রা তৈরি করালেন। যেটা তিনি জীবদ্দশায় অহংকার ভরে পরতেন। এরপর রাজা পঞ্চম জর্জের যখন অভিষেক হল তখন রাণী মেরি এই কোহিনূরের মুকুট পরলেন। ১৯৩৭ সালে রাণী এলিজাবেথের বিয়ে হওয়ার পর থেকে তিনি তার মুকুট ব্যবহার করতেন।
বর্তমানে কোহিনূর আর কারও মুকুটে শোভাবর্ধন করে না। টাওয়ার অব লন্ডন এর জুয়েল হাউজে এটি প্রদর্শনীর জন্য নিশ্চিদ্র নিরাপত্তার মধ্যে রাখা হয়েছে।

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button