মধ্যপ্রাচ্যের তেল-গ্যাসে লোলুপ দৃষ্টি রাশিয়ার

Oil১৯৯০ সালের ২ আগস্ট ইরাকি সৈন্যরা কুয়েতে হামলা চালায়। কুয়েতে ইরাকি আগ্রাসনের প্রধান কারণ ছিল অর্থনৈতিক। ইরানের সাথে দীর্ঘ ৮ বছরের যুদ্ধের পর ইরাক তার বিপুল পরিমাণ ঋণ শোধ করতে পারছিল না। দুই দেশের যৌথ মালিকানায় পরিচালিত তেল ক্ষেত্র থেকে অতিরিক্ত তেল উৎপাদনের মাধ্যমে তেলের মূল্য কমিয়ে ফেলার জন্য সাদ্দাম হোসেন কুয়েতকে দায়ী করেন। কুয়েত-ইরাক যুদ্ধের ঋণ পরিশোধ করতে অস্বীকৃতি জানানোর পর সাদ্দাম হোসেন তার দেশের সীমানা মুছে দিয়ে কুয়েতকে ইরাকের ১৯তম প্রদেশ ঘোষণা করেন। ইরাকের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে জাতিসঙ্ঘ নিরাপত্তা পরিষদের অর্থনৈতিক অবরোধে বেশ কয়েকটি প্রস্তাব গ্রহণের পর একটি আন্তর্জাতিক কোয়ালিশন গঠিত হয় এবং ওই অঞ্চলে হাজার হাজার সৈন্য প্রেরণ করা হয়। ১৯৯১ সালে ইরাকি সৈন্যরা ৬০০টিরও বেশি কুয়েতি তেলকূপে একের পর এক অগ্নিসংযোগ করে। ওটা ছিল সাদ্দাম হোসেনের সর্বশেষ দুঃসাহসী তৎপরতা। তিনি বলেছিলেন, ‘আমি ওটা দখল করতে না পারলে কেউ তা পারবে না।’
এখনকার মতোই জ্বালানি সব সময় মধ্যপ্রাচ্যে একটি বড় ধরনের ভূমিকা পালন করেছে। সিরিয়ায় আইসিসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে বলে দাবি করে ক্রেমলিন সিরিয়ায় বিমান হামলা শুরু করে। অনেকে প্রশ্ন করছে মধ্যপ্রাচ্যে রাশিয়ার চূড়ান্ত লক্ষ্য কী? এখন পর্যন্ত রাশিয়ার সত্যিকার উদ্দেশ্য বা সিরীয় সংঘাতের জ্বালানি সংক্রান্ত পটভূমি কি তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েই গেছে। রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে এই পর্যন্ত রাশিয়া বিভিন্ন পর্যায়ে সিরীয় সেনাবাহিনীর কাছে অস্ত্র পাঠিয়ে অথবা ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য করতে জাতিসঙ্ঘ যে সব খসড়া প্রস্তাব গ্রহণ করেছে তাতে ভেটো প্রয়োগ করে আসাদ সরকারকে টিকিয়ে রাখতে কার্যকর উদ্যোগ নিয়েছে। দুই দেশের মধ্যে ৪০ বছরেরও বেশি সময় ধরে সম্পর্কের বন্ধন অটুট রয়েছে এবং রাশিয়া হচ্ছে সিরিয়ার বৃহত্তম অস্ত্র সরবরাহকারী দেশ। সিরিয়ার উপকূলীয় শহর তারতুসে রাশিয়ার একটি নৌ ঘাঁটিও রয়েছে।
সিরিয়ায় রাশিয়ার চূড়ান্ত লক্ষ্য: বৃহত্তম তরল প্রাকৃতিক গ্যাস রফতানিকারক (এলএলজি) কাতার ২০০৯ সালে তাদের প্রাকৃতিক গ্যাস ইউরোপে পাঠানোর জন্য আসাদের কাছে একটি ট্রান্সসিরিয়াল পাইপলাইন স্থাপনের প্রস্তাব দেয়। কিন্তু আসাদ তার দীর্ঘ দিনের মিত্র রাশিয়ার স্বার্থ রক্ষার জন্য এই প্রস্তাব মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানান। রাশিয়া হচ্ছে ইউরোপের বৃহত্তম প্রাকৃতিক গ্যাস সরবরাহকারী দেশ। ইউরোপ যখন থেকে রাশিয়ার গ্যাস সরবরাহের ওপর নির্ভরশীল তখন থেকে এ পর্যন্ত রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিন তার মেজাজ গরম হলেই ক্ষেপে গিয়ে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করে দেয়ার হুমকি দেন। সিরিয়ার মধ্য দিয়ে গ্যাস পাইপলাইনের মাধ্যমে গ্যাস রফতানিও ইউরোপের জন্য একটি আকর্ষণীয় প্রস্তাব। আসাদ এই প্রস্তাবে অস্বীকৃতি জানান, তবে তিনি উপলব্ধি করেন যে, এটা একটা বড় চুক্তি এবং এর মাধ্যমে অন্য সুযোগ সুবিধার পথ খুলে যেতে পারে। তিনি ইরানের সাথে অপর একটি ট্রান্সসিরিয়ান পাইপলাইন পরিকল্পনা নিয়ে কথা বলেন। এই পাইপলাইন দিয়ে ইরানি ও ইরাকি গ্যাস সিরিয়ার মধ্য দিয়ে ইউরোপে সরবরাহ করা যাবে। বিশ্বের বৃহত্তম শিয়া অধ্যুষিত দেশ ইরান। সাদ্দামের পতনের পর শিয়া প্রভাবিত ইরাক সরকার এবং আলাভি প্রভাবিত সিরিয়া সরকার ইরান-ইরাক-সিরিয়া পাইপলাইনের ব্যাপারে দ্রুত কাজ শুরু করে। জ্বালানি স্থানান্তরের জন্য একটি শিয়া লাইন নির্মাণের পরিকল্পনা করা হয়। এভাবে প্রথম গোষ্ঠীগত সংঘাতের বীজ বপন করা হয়।
রাশিয়া ওই প্রকল্পটি অনুমোদন করেছে। তবে কাতারের গ্যাস আমদানির চেয়ে ইরানের গ্যাস আমদানির ওপর তাদের অধিকতর নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। ইতোমধ্যে ইরানের সাথে রাশিয়ার দীর্ঘকালীন জ্বালানি চুক্তি কার্যকর রয়েছে। তারতাস ঘাঁটি পুতিনকে পাইপলাইন প্রশ্নে কৌশলগতভাবে নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে সুবিধা এনে দেবে। গ্যাসপ্রম ওই পাইপলাইন নির্মাণ ও তার ব্যবস্থাপনাগত দায়িত্ব পালনে সম্মত হয়েছে। গ্যাস তরলীকরণের জন্য এবং এলএনজি জাহাজে করে ইউরোপে প্রেরণের জন্য সিরিয়ায় একটি প্ল্যান্ট নির্মাণ করা হবে। অধিকন্তু সিরিয়া ও রাশিয়া ভূমধ্যসাগীয় অঞ্চলে সিরিয়ার অফসোর প্রাকৃতিক গ্যাসফিল্ড উদ্ভাবন ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে সম্মত হয়েছে। এতে গ্যাস অথবা তেল পাওয়া গেলে রাশিয়ার রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত প্রতিষ্ঠানটির গ্যাসের উপর ২৫ বছরের নিয়ন্ত্রণজনিত স্বার্থ থাকবে। অপর দিকে গ্যাজপ্রম ইসরাইলের সাথে একটি অফসোর এলএনজি ফ্যাসিলিটিতে অর্থায়ন করতে সম্মত হয়েছে। ভূমধ্যসাগরীয় সমুদ্রে ইসরাইলি গ্যাস আবিষ্কার ও অনুসন্ধান এবং সেগুলো এলএনজি শিপের মাধ্যমে ইউরোপে পাঠানোর পরিকল্পনা করা হয়েছে। রাশিয়ার জ্বালানি জায়ান্ট ইতোমধ্যে একই এলাকায় সাইপ্রাসের গ্যাস বিতরণের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিয়েছে। একই লক্ষ্য নিয়ে তারা এই কাজ করছে। ফলে রাশিয়ার জন্য ইরানি পাইপলাইন গুরুত্বপূর্ণ অগ্রাধিকার। এ কারণে গত অক্টোবরে যখন রুশ বাহিনী সিরিয়ায় প্রবেশ করে তখন রাশিয়া কেবল আসাদ সরকারকে সমর্থন করেই ক্ষান্ত হয়নি বরং তাদের প্রধান লক্ষ্যের প্রতিও সমর্থন দিয়েছে।
তুরস্ক প্রসঙ্গে: তেল ও গ্যাস মওজুদের দিক দিয়ে তুরস্কের অবস্থান বেশ দুর্বল। কিন্তু ভূকৌশলগত অবস্থানের কারণে দেশটি মধ্যপ্রাচ্য এবং ইউরোপের মাঝামাঝি জ্বালানির কেন্দ্রস্থলে পরিণত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। মধ্য এশিয়া এবং মধ্যপ্রাচ্য থেকে তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাস তুরস্কের মধ্য দিয়ে ইউরোপে বহন করে নিয়ে যাওয়ার জন্য বেশ ক’টি ট্রান্স তুরস্ক পাইপলাইন প্রকল্প কিছু সময়ের জন্য আলোচনার টেবিলে এসেছিল। কিন্তু এর অর্থ হচ্ছে তেল এবং প্রাকৃতিক গ্যাসের দাম কমে যাবে এবং এর প্রেক্ষিতে রাশিয়ার জন্য ইউরোপীয় মার্কেটের চাহিদা কমে যাবে। উল্লেখ্য, তেল ও গ্যাস ছাড়া অন্য সব প্রয়োজনীয় পণ্য রাশিয়া ইউরোপ থেকে আমদানি করে থাকে। পুতিন তেল ও গ্যাস মার্কেটে রাশিয়ার প্রভাব হারাতে চান না। এ ছাড়াও তিনি ইরান, ইরাক, সিরিয়া ও ভূমধ্যসাগরীয় ঘানা থেকে তেল ও গ্যাস আহরণের প্রত্যাশা করেন। কিন্তু এক্ষেত্রে তুরস্ক রাশিয়ার জন্য একটি সমস্যা। নাবুকো পাইপলাইন প্রকল্প ক্রেমলিনের জন্য মাথা ব্যথা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই ট্রান্স আনাতোলিয়ান গ্যাস পাইপলাইন (টিএএনএপি) এবং ট্রান্স আড্রিয়াটিক পাইপ লাইনকে (টিএপি) রাশিয়া পথের কাঁটা মনে করছে। কাতারের ট্রান্সসিরিয়া পাইপলাইন গৃহীত হলে সেটাও ক্রেমলিনের বড় ধরনের একটি সমস্যা হয়ে দাঁড়াবে।
আর ইরান-ইরাক-সিরিয়া পাইপ লাইন চালু হলে তুরস্ককে এড়িয়ে যাওয়া যাবে। এ ছাড়াও রাশিয়া সমর্থিত ইস্ট-মেড (ইসরাইল-সাইপ্রাস-গ্রিস) পাইপলাইনও তুরস্ককে এড়িয়ে যাবে। তুরস্ক ও রাশিয়া প্রস্তাবিত তুর্কি স্ট্রিম পাইপলাইন নিয়ে আলোচনা শুরু করেছিল। এই পাইপলাইনটি বাতিলকৃত রুশ-দক্ষিণ স্ট্রিম প্রকল্পের স্থলে ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে প্রতিষ্ঠা করা হবে বলে মনে করা হয়েছিল। কিন্তু গত মাসে এ সংক্রান্ত আলোচনা স্থগিত হয়ে যায়। জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা টার্কিশ স্ট্রিম প্রকল্পটিকে একটি সম্ভাবনাময় প্রকল্প হিসেবে বিবেচনা করছেন না। তাদের মতে এটা উভয় দেশের কেবল একটি রাজনৈতিক তৎপরতা। ইউক্রেনে রাশিয়ায় হস্তক্ষেপের পর ইউরোপীয় অবরোধে পুতিন কোণঠাসা হয়ে পড়েন। অপর দিকে পশ্চিমা মিত্র দেশগুলোর নীরবতায় তুরস্ক হতাশ হয়েছে। অথচ পশ্চিমা দেশগুলো সিরিয়া সঙ্কটের সমাধান চায় বলে প্রচার করা হলেও এ ক্ষেত্রে তাদের কোনো বলিষ্ঠ ও সিদ্ধান্তকারী ভূমিকা পরিলক্ষিত হচ্ছে না।
তেলের মূল্য হ্রাস: রাশিয়ার একটি বিমান তুরস্কের আকাশসীমা লঙ্ঘন করার পর তুরস্ক বিমানটিকে গুলি করে ভূপাতিত করার পরিপ্রেক্ষিতে সিরিয়ায় রাশিয়ায় চূড়ান্ত লক্ষ্য এবং তুরস্কের বিরুদ্ধে রাশিয়ায় ভারসাম্যহীন প্রতিক্রিয়ার বিষয়টি ব্যাখ্যা করা যেতে পারে। রাশিয়ার ক্রোধ দ্রুত শেষ হয়ে যাবে বলে মনে হয় না। ক্রেমলিনের আগ্রাসী তৎপরতা দেখে প্রশ্ন সৃষ্টি হচ্ছে তারা কি দ্রুত কোনো কিছু ঘটাতে চায়?
রাশিয়া এখন অর্থনৈতিক মন্দায় আছে। দেশটির একক বৃহত্তম রফতানি আয়ের উৎস হচ্ছে তেল। তেলের মূল্য ২০১৪ সালের জুনে ব্যারেল প্রতি ১১৫ ডলার থেকে হ্রাস পেয়ে ২০১৫ সালের নভেম্বরে মাত্র ৪৫ ডলারে দাঁড়িয়েছে। গত সাত বছরের মধ্যে অপরিশোধিত তেলের দাম সর্বনিম্ন পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছা সত্ত্বেও ওপেক সামষ্টিকভাবে তেল উৎপাদন বৃদ্ধির ব্যাপারে সম্প্রতি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করায় রাশিয়া ও ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর মধ্যে অর্ন্তভুক্ত। রাশিয়া মূল্য বৃদ্ধির জন্য তার তেলের উৎপাদন হ্রাস করতে আগ্রহী নয়। এতে রাশিয়া প্রায় ২ শত কোটি ডলার রাজস্ব হারিয়েছে। তেলের দামের নিম্নগতি অব্যাহত থাকলে রাশিয়া সম্ভবত আরো ক্ষতিগ্রস্ত হবে। রুশ সরকারের জনমত জরিপ অনুযায়ী পুতিনের জনপ্রিয়তা এখনো সর্বোচ্চ পর্যায়ে থাকলেও এটা চিন্তা করা যায় যে, রাশিয়ার জনগণ পুতিনের নেতৃত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুলবে। আর্থিক দৈন্যের কারণে ক্রেমলিন তার চলমান সামরিক ব্যয় বহন করতে পারবে না। তুরস্কের সাথে উত্তেজনার পরিপ্রেক্ষিতে পুতিন তেলের দাম বাড়বে বলে আশা করেছিলেন। কিন্তু যে অঞ্চলটি এমনিতেই বিক্ষুব্ধ ছিল সেটাকে তিনি আরো অস্থিতিশীল করে তুললেন। অপর দিকে তুরস্ক পরিস্থিতি শান্ত করার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। যাই হোক না কেন, মধ্যপ্রাচ্যের অতীত অভিজ্ঞতাকে অবহেলা করা যাবে না। আমরা আশা করব পুতিন সাদ্দামের মতো বলবেন না : ‘আমি না পারলে কেউ পারবে না।’
মূল: মার্ভে সেবনিম, অনুবাদ: মুহাম্মদ খায়রুল বাশার, লেখক অনলাইন জার্নালিজমের ম্যানেজিং এডিটর, তুরস্কের একজন ভাষ্যকার ও কলামিস্ট। তিনি তুরস্কের রাজনীতি ও কূটনীতি আরব-ইসরাইল সম্পর্ক এবং মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতি নিয়ে লেখালেখি করেন।

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button