ঝুলন্ত পার্লামেন্ট অথবা মাইনরিটি সরকার

UK Electionদীর্ঘ বৈশ্বিক মন্দার কবলে গোটা ইউরোপের ভঙ্গুর অর্থনীতির তুলনামুলক চিত্রে ব্রিটেনকে দৃশ্যত তেজি মনে হয়। তবু ২০১০ সাল থেকে ক্যামেরন সরকার গ্রহণ করে চলেছে ব্যয় সঙ্কোচন নীতি। এমন এক হাঁসফাঁস অবস্থার মধ্যে আজ বৃহষ্পতিবার (৭মে) অনুষ্ঠান হতে যাচ্ছে সাধারণ নির্বাচন।
অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন- আর্ন্তজাতিক অর্থব্যবস্থায় মন্দার কবল থেকে বেড়িয়ে আসতে পারছে না ইউরোপ। দিন যত যাচ্ছে অর্থনীতিবিদ-রাজনীতিক সকলের উদ্বেগ বাড়ছে। কারণ বৈশ্বিক সঙ্কট কোন একক দেশ কীভাবে সমাধান করতে পারে তার সহজ উত্তর তাদের কাছে নেই।
এ অবস্থায় ব্রিটেনের আজকের নির্বাচন অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। এ নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে ক্ষমতা গঠনের পর নতুন সরকারকে অনেক কঠিন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে বলে তারা মনে করেন। এরমধ্যে অর্থনৈতিক মন্দা দূর করা, নতুন করে মন্দা সৃষ্টি হলে তা সামাল দেয়া, ব্রিটেনের অভিবাসন নীতি, সরকারি খাতে খরচ হ্রাসের পাশাপাশি ব্রিটেনের অখণ্ডতা রক্ষা, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ভুক্ত থাকা না থাকার চ্যালেঞ্জসহ অভ্যন্তরীণ নানা সমস্যার মধ্যে হাউজিং সঙ্কট,স্বাস্থখাতের উত্তরণ, সোস্যাল সিকিউরিটি সংকোচন নীতি, শিক্ষা খাতের সংস্কার, তরুণদের জন্য জব মার্কেট সৃষ্টি, জাতীয় নিরাপত্তা ইস্যু, বৈদেশিক উন্নয়নে অংশীদারিত্ব এবং আর্ন্তজাতিক জঙ্গিবাদ দমন অন্যতম।
এ প্রেক্ষাপটে যুক্তরাজ্যের চলমান আর্থিক সঙ্কটের জন্য দেশটির সাধারণ মানুষ লেবার পার্টিকে দায়ী করে থাকেন। অনেকেই মনে করেন- সৃষ্ট বৈশ্বিক মন্দার শুরুতে লেবার পার্টি ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় বিশেষ করে ২০০৮ সালের মন্দা এবং তা সামাল দিতে দলটি ব্যর্থ হয়। এতে ২০১০ সালের জাতীয় নির্বাচনে লেবার দলের ব্যাপক ভরাডুবি ঘটে।
অনেকেই মনে করেন লেবার দলের পরাজয়ের জন্য দায়ী লেবার পার্টি নেতা ও তৎকালিন প্রধানমন্ত্রী টনিব্লেয়ার। তাঁর উদ্যোগে যুক্তরাজ্য সরকার ইরাকের ওপর হামলা চালায়। ইরাকে হামলার পরিকল্পনা ভুল সিদ্ধান্ত বলে মনে করেন দেশটির উদারপন্থিরা।
সবমিলিয়ে মাশুল দিতে হয়েছে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ একজন অর্থনীতিবিদ লেবার দলের নেতা মি. গর্ডন ব্রাউনকে। তিনি ২০১০ সালের নির্বাচনে পরাজয়ের দায় স্বীকার করে দলের নেতৃত্ব থেকে সরে যান। নানা টানাপোড়েনের মাঝে অবশেষে লেবার পার্টির হাল ধরেন এডওয়ার্ড সামুয়েল মিলিব্যান্ড।
অবশ্য ২০১০ সালের নির্বাচনে কনজারভেটিভ দলের ইশতেহারে অর্থনৈতিক সংস্কার, মন্দা থেকে উত্তরণ, অভিবাসী নিয়ন্ত্রণসহ গুরুত্বপূর্ণ প্রতিশ্রুতি দেয়া হয় এবং দলের প্রধান হিসেবে নেতৃত্ব দেন ডেভিট ক্যামেরন। এ নির্বাচনে তাঁর দল মেজরিটি না পাওয়ায় লিবারেল ডেমোক্র্যাট দলের সঙ্গে কোয়ালিশন সরকার গঠন করেন মি. ক্যামেরন। ব্রিটেনের ২শ’ বছরের ইতিহাসে তিনি হন সবচেয়ে কম বয়সী প্রধানমন্ত্রী। তখন তাঁর বয়স ছিল ৪৩ বছর।
তিনি দেশ পরিচালনার ক্ষেত্রে ব্রিটেনের অর্থনৈতিক চাকা সচল করেছেন বলে সাফল্য হিসেবে দাবি করছেন। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন- এটা আপেক্ষিক। দৃশ্যত সচল দেখা গেলেও কতটা টেকসই তা এখনই বলা যাচ্ছে না।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন সত্তর দশকের পর থেকে ব্রিটেনে এতটা কঠিন পরিস্থিতিকে সামনে রেখে অন্যকোন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়নি।
এ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক মুশতাক এইচ খান বলেন, এরকম জটিল পরিস্থিতিকে সামনে রেখে নির্বাচনী ফলাফল কী হতে পারে তা অনুমান করা খুবই দূরুহ। কারণ কোন রাজনৈতিক দলের কথায় মানুষ আস্থা রাখতে পারছে না। কেউ স্পষ্ট করতে পারছে না কী করলে অর্থনৈতিক মন্দা থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভব? তারা উত্তরণের কথা বললেও সেটা কী পন্থায় হবে তা পরিষ্কার নয়। তারা এমন সব কথা বলছেন যা সামঞ্জস্যপূর্ণ নয় বলে তিনি উল্লেখ করেন।
তিনি বলেন, তবে ধ্রুব সত্য হচ্ছে- এ সমস্যার কোন সহজ সমাধান রাজনীতিক কিংবা অর্থনীতিবিদ কারো কাছেই নেই। বিষয়টি এমন নয় যে তাঁদের কাছে কোন সমাধান আছে কিন্তু তারা বলছেন না। তা নয়। মূলত তারা কেউ জানেন না। সমস্যাটি এতই জটিল যে এর কোন সহজ সমাধান নেই। আগামী দশকে ইউরোপের অবস্থা কি হবে সেখানে ব্রিটেনের ভূমিকা কি হবে, এদেশের অর্থনীতি কেমন হবে এবং আর্ন্তজাতিক অর্থনীতি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে এসব কিছুই অজ্ঞাত। এমতাবস্থায় সর্বত্র একটা অনিশ্চয়তা বিরাজ করছে। ফলে দোলাচলে সিদ্ধান্তহীনতার মাঝে সাধারণ ভোটারদের মতের প্রকাশ ঘটবে এই নির্বাচনে।
তিনি বলেন, আজকের বিশ্ববাজার অর্থনীতিতে সেকেন্ডের মধ্যে এক দেশ থেকে আরেক দেশে লক্ষ কোটি ডলার যাতায়াত করতে পারে। বিশ্ববাজার অর্থনীতিতে মার্কেটগুলো ওতপ্রোতভাবে জড়িত। আর্ন্তজাতিক পূঁজিবাজারে কোন একক দেশ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। একক মুদ্রা ব্যবস্থায় গিয়ে ইউরোপে যে আর্থিক সঙ্কট তৈরি হয়েছে তা দূরিকরণে একটা অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হয়েছে। এর পরোক্ষ প্রভাব ব্রিটেনেও পড়বে।
এই বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পরিবর্তনের পাশাপাশি বিশ্বজুড়ে অভিবাসন প্রবণতাও বাড়ছে। এর কাঠামোগত দিকেও পরিবর্তন এসেছে। বিশেষ করে ব্রিটেন ইউরোপিয় ইউনিয়নের অংশ। ফলে গোটা ইউরোপের বিশেষ করে পূর্ব ইউরোপের দরিদ্র দেশগুলোর অভিবাসীরা লন্ডনে ব্যপকভাবে আসার কারণে ব্রিটেনের ওপর চাপ বাড়ায় এটা একটা রাজনৈতিক ইস্যু সৃষ্টি হয়েছে। ফলে এই অভিবাসন নিয়ে ব্রিটেনে নতুন মেরুকরণে রাজনৈতিক হিসেব নিকেশও পাল্টে গেছে। জরিপে দেখা যাচ্ছে,  ইতোমধ্যেই লিবারেল ডেমোক্রাট দল তৃতীয় স্থান থেকে চতুর্থ স্থানে চলে আসছে। নতুন দল ইউকিপ আসন বেশি না পেলেও ভোটে তারা তৃতীয় স্থানে থাকবে এটা প্রায় নিশ্চিত। ফলে কনজারভেটিভ দল একক দল ক্ষমতায় আসা অনিশ্চিত।
প্রফেসর খান বলেন, সকল স্টাডিতে দেখা গেছে অর্থনৈতিক দিক থেকে অভিবাসীরা সবসময়েই অবদান রাখছে। এটা অর্থনীতির জন্য লাভজনক। কারণ অভিবাসীরা কাজ করে। তবে সামাজিক-সাংস্কৃতিকভাবে একটা সমস্যা। বিশেষ করে ব্রিটেনের মত ছোট একটি দেশে এতো মানুষের ধারণ ক্ষমতা সমস্যাই বটে। যদিও ব্রিটিশ অর্থনীতির জন্য কল্যাণকর। এটা যেমন পুরোপুরি গ্রহণ করা সম্ভব নয় তেমনি প্রত্যাখান করাও যাবে না। ফলে সমস্যা থেকেই যাচ্ছে।
অবশ্য কনজারভেটিভ পার্টি ইতোমধ্যে ঘোষণা দিয়েছে তারা ক্ষমতায় গেলে ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বের হয়ে আসবে। এই ব্যাপারটি ভীষণ অনিশ্চয়তা তৈরি করছে। কারণ কনজারভেটিভ দলের ঐতিহ্যগতভাবে সমর্থক বিজনেজ গ্রুপ এটাকে সমর্থন করে না। অতএব দলটির মূল সমর্থকরা একটা দোটানার মধ্যে রয়েছে। ব্যবসায়ী-ধনিক শ্রেণি মনে করেন ইইউ থেকে ব্রিটেনের বের হওয়া আত্মঘাতি হবে।
আবার দলটি বাজার অর্থনীতি বা পূজিঁবাদি অর্থনীতির কথা বললেও তা তাদের ইশতেহার স্ববিরোধী।
প্রফেসর খান বলেন, লেবার পার্টির মূল সমর্থক মূলত শ্রমিক-দরিদ্র শ্রেণির মানুষ। কিন্তু তারাও বলছে বাজেট ঘাটতি কমাতে হবে, বিশ্বায়নের সঙ্গে চলতে হবে, অভিবাসন বেশি কমাবে না। তাদের ইশতেহারও অর্ন্তদ্বন্দমূলক। তিনি আরো বলেন, কোন দলই সহজ ম্যাসেজ তাদের সমর্থক গ্রুপকে দিচ্ছে না।
এখানে নির্বাচনী প্যারাডক্স হচ্ছে- কনজারভেটিভ ঘোষিত ইশতেহারের ফলে তাদের মূল সমর্থকরা মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। কারণ ব্রিটেনের ধনিক শ্রেণি অভিবাসন বিরোধী নয়। আবার ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে তারা বের হতে নারাজ। কিন্তু কনজারভেটিভ দু‘টোই ঘোষণা দিয়েছে। অপরদিকে গরীব শ্রেণি অপেক্ষাকৃত বেশি অভিবাসনের বিরোধী। অপর দিকে লেবার পার্টিকে সরকার গঠন করতে হলে এসএনপি বা স্কটল্যান্ডের স্বাধীনতাকামী দলের সঙ্গে জোট করতে হবে। কিন্তু ব্রিটিশরা কোনক্রমেই চায়না স্কটল্যান্ড আলাদা হয়ে যাক। এক্ষেত্রেও রয়েছে জটিলতা।
অতএব আজকের ভোট শেষে কাল থেকে ব্রিটেন নতুন কোন জটিল পরিস্থির মুখোমুখি হতে পারে। তবে পর্যবেক্ষকরা বলছেন- ঝুলন্ত পার্লামেন্ট হওয়ার সম্ভাবনার পাশাপাশি মাইনরিটি সরকার গঠন করতে পারে লেবার বা কনজারভেটিভ। আবার কোন পর্যবেক্ষক বলছেন জটিলতা এমনও হতে পারে যে, এ বছরের শেষের দিকে আবার নির্বাচন হতে পারে।

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button