কওমি ডিগ্রিধারীদের দায়িত্ব ও ভবিষ্যত-চ্যালেঞ্জ: প্রকৃতি ও পরিধি

ড. মুহাম্মদ সাদিক হুসাইন: বহু জল্পনা-কল্পনার পর অবেশেষে ১৯ সেপ্টেম্বর ২০১৮ ‘কওমি সনদকে মাস্টার্স ডিগ্রি সমমানের বিল ২০১৮’ পাস হয়ে গেল সংসদের ২২ তম অধিবেশনে। এতে কওমি আলেমসমাজের দীর্ঘদিনের স্বপ্ন যেমন বাস্তবায়িত হলো, একইভাবে রাজনীতির মাঠে আওয়ামী লীগ যে পাকা খেলোয়াড় তাও আরেকবার প্রমাণিত হলো। কারণ স্বীকৃতির বিষয়টি বিগত চারদলীয় জোট সরকারের আমলে বারবার আলোচনায় এলেও নানা কারণে বিষয়টি তারা ঝুলিয়ে রাখে। অথচ এ জোট ছিল ডানপন্থী হিসেবে প্রসিদ্ধ এমন সব রাজনৈতিক দলের সমন্বয়ে গঠিত। এতে ইসলামের নামে রাজনীতিকারী দল ‘জামায়াতে ইসলাম’ ছিল। ছিল ‘ইসলামী ঐক্যজোট’।

স্বীকৃতি আদায়ের সংগ্রাম বিষয়ে অনেকে অনেক কথা বললেও এটা ঐতিহাসিক সত্য যে, খতীবে আযম মাওলানা ছিদ্দিক আহমদ (রহ.)-এর পূর্বে স্বীকৃতির প্রয়োজনীয়তা কেউ অনুভব করেননি। কেউ দাবী পর্যন্ত করেননি। খতিবে আযম (রহ.)ই পাকিস্তান আমলে শিক্ষা কমিশনের সাথে প্রদত্ত সাক্ষাতকারে স্বীকৃতি প্রসঙ্গ উত্থাপন করেন। পরবর্তীতে ইসলামী ছাত্রসমাজের আন্দোলনের ফলে কওমি নেতৃবৃন্দ এর প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। বিএনপির শাসনামলে শায়খুল হাদীস আল্লামা আজিজুল হক (রহ.) মুক্তাঙ্গনে অবস্থান ধর্মঘট করে জনমত তৈরী করেন। তবে এ দীর্ঘ আন্দোলন ও সংগ্রামের পূর্ণতা লাভ করেছে বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে। আর যে কোনো বিষয়ের পরিণামের কথাই মানুষের মনে থাকে বেশি। পরিণাম পর্যন্ত পৌঁছতে কতজনের কত রক্ত ও ঘাম ঝরেছে, সেটা সাধারণত মানুষ বেমালুম ভুলে যায়। স্মরণ রাখে স্রেফ শেষের কবিতা। ‘শেষ ভালো যার, সব ভালো তার’। এখানেই আওয়ামী লীগ তথা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কৃতিত্ব। ‘ঝোপ বুঝে কোপ মারা।’ যে যত কথাই বলুক। এটাই সত্য। যা আগামীতে ইতিহাস হয়ে থাকবে। ফলে অনেকের নিকট ইসলামের শত্রু হিসেবে খ্যাত আওয়ামী লীগ এখন ভিলেন থেকে সরাসরি হিরোতে পরিণত। ইসলামিক ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা, টঙ্গীতে বিশ্ব ইজতেমার জায়গা বরাদ্দ ইত্যাদির সঙ্গে যুক্ত হলো কওমি সনদের সরকারি স্বীকৃতি। এ যেন সরকারী দলের সফলতার রাজমুকুটে আরেকটি সোনালি পালক।

স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের ক্ষমতার মসনদে অনেক সরকার এসেছে আর গেছে। দীর্ঘ ৩৫ বছর আমাদের আকাবিরগণ কওমি স্বীকৃতির গুরুত্ব ও প্রয়োজনিয়তা বোঝানোর চেষ্টা করেছেন সরকার প্রধানদের। বারবার ব্যর্থ হয়েছেন। অবশেষে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিষয়ের গুরুত্ব অনুধাবন করেছেন। এ-জন্যে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বোধ ও বুদ্ধির প্রশংসা করতেই হয়।

কথিত আছে, বিগত চারদলীয় জোট সরকারের আমলে কওমি সনদের স্বীকৃতির বিষয়টি সবচে বেশি বাধাগ্রস্ত হয়েছে জামায়াতে ইসলামীর কতিপয় নেতার কারণে। আলিয়া-ধারার এসব নেতা ও বুদ্ধিজীবি কখনোই চান নি, কওমি মাদরাসার সনদ সরকারি স্বীকৃতি লাভ করুক। কারণ তারা বিলক্ষণ জানেন, যোগ্যতা, আমল ও মেধার দিক দিয়ে কওমি ছাত্ররা আলিয়া ছাত্রদের চেয়ে অনেক এগিয়ে।

সংসদে বিলটি পাসের সঙ্গে সঙ্গে কওমি ডিগ্রিধারীদের দায়িত্ব অনেক গুণ বেড়ে গেল। সরকারপ্রধানের ভাষ্য মতো কওমি মাদরাসার সনদধারীগণ এখন সমাজের মূলধারায় অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেছেন। ইতঃপূর্বে গুমনাম, অখ্যাত ও বিচ্ছিন্নভাবে জীবনযাপন করার সুযোগ থাকলেও এখন সে-সুযোগ নেই। এখন প্রতিযোগিতা হবে মাঠে, যোগ্যতা নিয়ে কথা উঠবে। বিশেষ করে আলিয়া-ধারার মাদরাসা-ছাত্রদের উপস্থিতির দরুন প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে চরমে। এটা একধরনের চ্যালেঞ্জ। কওমি মাদরাসা-ছাত্রদেরকে এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে সফলতার সঙ্গে।

স্মর্তব্য, বিলে দাওরায়ে হাদিসের (তাকমিল) সনদকে মাস্টার্স ডিগ্রির (ইসলামিক স্টাডিজ ও আরবি) সমমান করার জন্য ‘আল হাইআতুল উলয়া লিল-জামি’আতিল কাওমিয়া বাংলাদেশ’ নামে দেশে বিদ্যমান ৬টি কওমি মাদরাসার বোর্ডের ওপর একটি সুপিরিয়র বোর্ড গঠনের বিধান রাখা হয়েছে। ৬টি কওমি মাদরাসার বোর্ডের সভাপতি ও মহাসচিবসহ সরকার মনোনীত সদস্যরা এই বোর্ডের সদস্য হবেন। বোর্ডের অধীনে কওমি মাদরাসাগুলোর তাকমিলের বোর্ডকে সিলেবাস প্রণয়ন, পরীক্ষা গ্রহণ ও মূল্যায়নের ক্ষমতা দেওয়া হয়। বিলের উদ্দেশ্য ও কারণ সম্বলিত বিবৃতিতে বলা হয়েছে, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনার আলোকে কওমি মাদরাসার দাওরায়ে হাদিসের (তাকমিল) সনদকে মাস্টার্স ডিগ্রির (ইসলামিক স্টাডিজ ও আরবি) সমমান আইন ২০১৮ বিল আকারে সংসদে উপস্থাপন করা হলো। এর আগে ১৩ আগস্ট নীতিগত অনুমোদন দেয় মন্ত্রিসভা।

২০১৭ সালের ১১ এপ্রিল রাতে গণভবনে কওমি মাদরাসার আলেম-ওলামাদের সঙ্গে এক বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কওমি মাদরাসার দাওরায়ে হাদিসের সনদকে মাস্টার্সের সমমানের স্বীকৃতির ঘোষণা দেন। কওমি মাদরাসার স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য বজায় রেখে ও দারুল উলুম দেওবন্দের মূলনীতিগুলোকে ভিত্তি ধরে কওমি মাদরাসার দাওরায়ে হাদিসের সনদকে মাস্টার্সের (ইসলামিক স্টাডিজ ও আরবি) সমমান প্রদান করে ওই বছরের ১৩ এপ্রিল শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগ থেকে এ বিষয়ে আদেশ জারি করা হয়। আদেশে বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশ (বেফাক)-এর সভাপতি ও হেফাজতে ইসলামের আমীর আল্লামা আহমদ শফী (দা. বা.)-কে প্রধান করে একটি কমিটিও গঠন করার কথা জানানো হয়।

গত বছরের ১৩ এপ্রিলের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপন তুলে ধরে মন্ত্রিপরিষদ সচিব শফিউল আলম বলেন, ‘কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গকে নিয়ে একটি কমিটি করা হয়। তারা কওমি মাদরাসা শিক্ষায় বোর্ডের মত কাজ করবে। সেটাকে অনেকটা এখানে নিয়ে আসা হয়েছে। এটি ১০টি ধারার একটি আইন।’ খসড়া আইনে বিভিন্ন বিষয়ে সংজ্ঞা দেয়া আছে জানিয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, ‘কওমির সংজ্ঞায় বলা হয়েছে- আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাত ও দারুল উলুম দেওবন্দের আদর্শ মূলনীতি ও মতপথের অনুসরণে মুসলিম জনসাধারণের আর্থিক সহায়তায় ওলামায়ে কেরামের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত ও পরিচালিত ইলমে ওহীর শিক্ষা কেন্দ্র।’

এখানে অনেকগুলো ঐতিহাসিক বিষয় সরকার ও জনসমক্ষে চলে এসেছে। ফলে মতভেদকারীদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা হবে মাঠে-ময়দানে। কখনো সরাসরি, কখনো বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে। যেমন-

১. বাংলাদেশে মাজারপন্থী-সুন্নি-বেদাতিরা এতোদিন নিজেদেরকে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাত দাবি করলেও প্রকৃত আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাত যে দেওবন্দিরা তা পরোক্ষভাবে স্বীকার করে নেয়া হয়েছে সরকারিভাবে। ফলে ইতিমধ্যেই তাদের গাত্রদাহ শুরু হয়ে গেছে। স্বীকৃতি ঠেকাতে ইতোপূর্বে বেশ কয়েকবার মানববন্ধনসহ বিভিন্ন আন্দোলনও করেছে তারা রাজপথে। কর্মক্ষেত্রে তারা নবাগত এসব সমমনা ডিগ্রিধারীদের সহজে মেনে নেবে বলে মনে হয় না।

২. স্বাধীনতার পর থেকে সরকারি মদদ ও পৃষ্ঠপোষকতা সবচে বেশি উপভোগ করেছে একশ্রেণীর আমলহীন ধর্মীয় লেবাসধারী লোক। আমলদার কওমিপন্থীরা সবসময় উপেক্ষিতই ছিল। মাজারপন্থী, কথিত সুন্নী ও শিয়া মতবাদ; এমনকি কাদিয়ানি মতবাদকে পৃষ্ঠপোষকতা করেন এমন লোকও সরকারের উচ্চপর্যায়ে আছেন বলে জনশ্রুতি রয়েছে। এ বিলের মাধ্যমে দেওবন্দের আদর্শ, উসূলে হাশতগানা তথা দেওবন্দের মূলনীতির কথা এখন সুপরিচিত ও স্বীকৃত সরকারি পর্যায়ে। অথচ আদর্শগতভাবে উপর্যুক্ত মতবাদসমূহের সঙ্গে কওমি আলেমসমাজের দ্বন্ধ চিরন্তন। এ দ্বন্ধ এখন আরো প্রকট হবে। বুদ্ধিবৃত্তিক লড়াই হবে। এ লড়াইয়ের জন্য কওমি ডিগ্রিধারীদের প্রস্তুত থাকতে হবে।

৩. কথিত আছে, বিগত চারদলীয় জোট সরকারের আমলে কওমি সনদের স্বীকৃতির বিষয়টি সবচে বেশি বাধাগ্রস্ত হয়েছে জামায়াতে ইসলামীর কতিপয় নেতার কারণে। আলিয়া-ধারার এসব নেতা ও বুদ্ধিজীবি কখনোই চান নি, কওমি মাদরাসার সনদ সরকারি স্বীকৃতি লাভ করুক। কারণ তারা বিলক্ষণ জানেন, যোগ্যতা, আমল ও মেধার দিক দিয়ে কওমি ছাত্ররা আলিয়া ছাত্রদের চেয়ে অনেক এগিয়ে। সুতরাং যোগ্যতার সঙ্গে সঙ্গে এদের যদি সরকারি স্বীকৃতিও থাকে কর্মযুদ্ধে কওমিদের সামনে তারা কখনোই টিকবে না। অতীতে এর অনেক নজির রয়েছে। অর্থাৎ কওমি ছাত্রদের মধ্যে, বিশেষ করে পটিয়া, হাটহাজারি, দারুল মা‘আরিফ ইত্যাদি মাদরাসা থেকে প্রতিষ্ঠানের অগোচরে যারা অতীতে বিচ্ছিন্নভাবে নিজের উদ্যোগে সরকারি মাদরাসার দাখিল, আলিম, ফাযিল ও কামিল স্তরের পরীক্ষায় অংশ নিয়েছে তাদের অধিকাংশই সম্মিলিত মেধা-তালিকায় সরকারি মাদরাসার নিয়মিত ছাত্রদের চেয়ে বেশি ভালো করেছে। বিগত কয়েকবছর ধরে চট্টগ্রাম ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালস্থ আরবি ও ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ থেকে যারা প্রধানমন্ত্রীর স্বর্ণপদক অর্জন করেছেন, তাদের অধিকাংশই কওমি ব্যাকগ্রাউন্ডের ছাত্র। বেশ কয়েকজন ছিল চট্টগ্রামস্থ জামেয়া দারুল মা‘আরিফের ছাত্র। ফলশ্রুতিতে পূর্ব থেকেই প্রতিষ্ঠিত আলিয়া-ধারার সনদধারীদের সঙ্গে কওমি সনদধারীদের অঘোষিত একটি স্নায়ুযুদ্ধ চলতেই থাকবে। অতীতের ন্যায় যোগ্যতা দিয়ে কওমি ছাত্রদের এ যুদ্ধে নিজের জয় ও সম্মান বজায় রাখতে হবে।

কওমি সনদের বিল সংসদে পাস হয়েছে ঠিক। তবে কিছু বিষয় এখনো মনে হয় অমিমাংসিতই রয়ে গেছে। যা পুরোপুরি নিষ্পত্তি হতে হয়ত আরও সময় লাগবে। কারণ কওমি মাদরাসার দাওরায়ে হাদিস সনদকে মাস্টার্স ডিগ্রি সমমান দেয়ার বিষয়টি আগেই হয়ে আসছে জানিয়ে মন্ত্রী পরিষদ সচিব বলেন, ‘এখন সেটাকে আইনের কাঠামোতে নিয়ে আসা হয়েছে। এখানে একটা বোর্ডের বিষয় রয়েছে। এটার নাম হচ্ছে, আল-হাইয়্যাতুল উলিয়ালিল জামিয়াতুল কাওমিয়া বাংলাদেশ।’

তিনি বলেন, ‘এখন ছয়টি কওমি মাদরাসা শিক্ষাবোর্ড আছে ওনাদের নিজস্ব ব্যবস্থাপনায়। একেক এলাকায় একেকটি। বেফাকুল মাদারিসিলি আরাবিয়া বাংলাদেশ, বেফাকুল মাদারিসিলি কওমিয়া গওহরডাঙ্গা বাংলাদেশ, আঞ্জুমানে ইত্তেহাদুল মাদারিসি বাংলাদেশ, আজাদ দীনি এদারায়ে তা’লীম বাংলাদেশ, তানজিমুল মাদারিস দীনিয়া বাংলাদেশ ও জাতীয় দীনি মাদরাসা শিক্ষা বোর্ড বাংলাদেশ। বাংলাদেশে যত কওমি মাদরাসা আছে, সেগুলোকে এই ছয়টি বোর্ড নিয়ন্ত্রণ করে। এই ছয়টি বোর্ড নিয়ে আল হাইয়্যাতুল উলিয়া লিল জামিয়াতুল কাওমিয়া বাংলাদেশ গঠন করা হবে। এটাই হবে কওমি মাদরাসা শিক্ষা বোর্ড। এর কার্যালয় হবে ঢাকায়।’

হাইয়্যাতুল উলিয়ালিল জামিয়াতুল কাওমিয়া বাংলাদেশ-এর কমিটিতে ৯ ধরনের ব্যক্তি থাকবেন জানিয়ে শফিউল আলম বলেন, ‘বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশ-এর চেয়ারম্যান হবেন কমিটির সভাপতি। কো-চেয়ারম্যান হবেন বেফাকুল মাদারিসির সিনিয়র সহ-সভাপতি। বেফাকের আরও ৫ জন সদস্য পদাধিকার বলে বেফাকের মহাসচিব বা বোর্ড নির্ধারণ করে দেবে।’ এছাড়া কমিটিতে অপরাপর পাঁচটি বোর্ডের দুইজন করে সদস্য থাকবে। চেয়ারম্যান ইচ্ছা করলে কমিটিতে যে কোন সদস্য অন্তর্ভুক্ত করতে পারবেন। তবে সেই সংখ্যা ১৫ জনের বেশি হবে না বলেও জানান মন্ত্রিপরিষদ সচিব। এ প্রসঙ্গে কিছু বিষয় এখনো অস্পষ্ট রয়ে গেছে বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন। ওসব বিষয়ে খোদ মন্ত্রী পরিষদ সচিব পরিস্কারভাবে কিছু বলেন নি। যেমন-

কমিটিতে সরকারের কোন প্রতিনিধি নেই-এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে সচিব বলেন, ‘এটা আসলে কমিটি যেটা ছিল সেটাকে বোর্ড আকারে নিয়ে আসা হয়েছে। ছয়টি বোর্ডকে একীভূত করে বোর্ড করা হয়েছে।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাফিলিয়েশন ছাড়া মাস্টার্স ডিগ্রি কীভাবে দেয়া হবে- এমন প্রশ্নের জবাবে শফিউল আলম বলেন, ‘এটা একটি ব্যতিক্রমী বিষয়। এটা হল মূলত কওমি মাদরাসায় পড়ালেখা করা প্রায় ১৫ লাখ শিক্ষার্থীকে মূল ধারায় নিয়ে আসা। সরকারের এই কাঠামোতে নিয়ে আসার বিষয়টি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। এরা কিন্তু সবাই সরকারের আওতার বাইরে।’
ইসলামিক আরবি বিশ্ববিদ্যালয় আছে। সনদ দেয়ার দায়িত্ব তাদের দেয়া যেত এ বিষয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, ‘আইনে এ বিষয়ে কিছু বলা নেই, ভবিষ্যতে হয়তো বিবেচনায় আসতে পারে।’
মাস্টার্সের আগের ডিগ্রিগুলোর স্বীকৃতি না দিয়ে সর্বোচ্চ ডিগ্রিকে কেন স্বীকৃতি দেয়া হল জানতে চাইলে মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, ‘এটা গভর্নমেন্টের পলিসি, আইনের বাইরে আমাদের ব্যাখ্যা দেয়ার সুযোগ নেই। ওখানে দাওরায়ে হাদিসটাকে চূড়ান্ত শিক্ষা সমাপনী হিসেবে গণ্য করা হয়।’

এখানেই আওয়ামী লীগ তথা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কৃতিত্ব। ‘ঝোপ বুঝে কোপ মারা।’ যে যত কথাই বলুক। এটাই সত্য। যা আগামীতে ইতিহাস হয়ে থাকবে। ফলে অনেকের নিকট ইসলামের শত্রু হিসেবে খ্যাত আওয়ামী লীগ এখন ভিলেন থেকে সরাসরি হিরোতে পরিণত। ইসলামিক ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা, টঙ্গীতে বিশ্ব ইজতেমার জায়গা বরাদ্দ ইত্যাদির সঙ্গে যুক্ত হলো কওমি সনদের সরকারি স্বীকৃতি। এ যেন সরকারী দলের সফলতার রাজমুকুটে আরেকটি সোনালি পালক।

ইংরেজিভাষায় একটি কথা আছে, Everything has merit and demerit অর্থাৎ প্রত্যেক বস্তুরই ভালো-মন্দ দিক রয়েছে। একটি ছুরি দিয়ে কুরবানির পশু যবেহ করে যেমন পুণ্য অর্জন করা যায়। আবার একই ছুরি দিয়ে মানুষখুনের ন্যায় মারাত্মক অপরাধও করা যায়। কওমি সনদকে কেন্দ্র করে যদি বোর্ড সংশ্লিষ্ট আলেম-কর্মকর্তার মধ্যে দ্বন্দ্ব ও কাদা ছোড়াছুড়ি হয়, ঘুষ-দুর্নীতি চলে, প্রচলিত আলিয়া-ধারার ছাত্রদের ন্যায় নকলের প্রবণতা দেখা দেয়, সাজেশন্স ও কোচিং বাণিজ্য শুরু হয়ে যায়, মাদরাসায় মাদরাসায় গ্রুপিং হয়, দলাদলি হয় … সর্বোপরি পবিত্র কুরআন-হাদিসের প্রতি আমলের যে কওমি ঐতিহ্য রয়েছে তা যদি বিনষ্ট হয়.. তা হলে এ স্বীকৃতি তাদের জন্য কাল হয়ে দাঁড়াবে।

আর যদি মনে করা হয়, কওমি মাদ্রসার ঐতিহ্য, স্বকীয়তা, স্বীয় বৈশিষ্ট্য… সবকিছু আগের মতোই থাকবে। সনদের এ স্বীকৃতি কেবলমাত্র কওমি আলেমসমাজের খেদমতের পরিধিটা বাড়িয়ে দিয়েছে। কওমি ছাত্রদের সামনে উচ্চশিক্ষার দুয়ার খুলে দিয়েছে। কর্মক্ষেত্রে নিজের যোগ্যতা প্রমাণের সুযোগ সৃষ্টি করেছে। সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষের সঙ্গে আরও বেশি মেশার, আরও বেশি কাজ করার মাধ্যমে দাওয়াতের পথ সুগম হয়েছে। সর্বোপরি সনদের স্বীকৃতি না থাকার কারণে এতদিন যে-সব লোক ও প্রতিষ্ঠানে ইসলামের শ্বাশত পয়গাম ও শিক্ষা পৌঁছানোর সুযোগ হয়নি; স্বীকৃতির কল্যাণে এখন সেখানেও তাদের পৌঁছানো সম্ভব হবে। তা হলে কওমি সনদের এ সরকারি স্বীকৃতি কওমিয়ানদের জন্য সোনায় সোহাগা। যোগ্যতা ও আমল তো আগ থেকেই ছিল; অভাব বা অন্তরায় ছিল কেবল সনদ ও ডিগ্রির। এখন সেই অভাব ও অন্তরায় দূরিভূত হওয়ায় কাজ করতে আরও বেশি সুবিধা হলো তাদের।

পরিশেষে বলতে পারি, বাংলাদেশ একটি স্বাধীন গণতান্ত্রিক দেশ। এখানে নির্বাচন হবে। রাষ্ট্র পরিচালনায় এক সরকার যাবে, আরেক সরকার আসবে। সরকার পরিবর্তনের সাথে সাথে সরকারের অনেক পলিসিও পরিবর্তন হয় অনেক সময়। সেহেতু আগামীতে দেশের রাজনীতিতে হয়ত অনেক পরিবর্তন আসবে। ক্ষমতারও পালাবদল হবে। সরকারের আমলাতন্ত্রে রদবদল হবে। তখন এ স্বীকৃতি নিয়ে অনেকে অনেক ধরনের রাজনীতিও করতে চাইবেন। এক সরকারের অর্জন অন্য সরকার কর্তৃক নষ্ট করার নজিরও আমাদের দেশে রয়েছে। অতএব, আমরা কি তখন সময়ের গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে দিবো, নাকি নিজ আদর্শ ও স্বকীয় মর্যাদায় অটল থাকবো, তা এখনই সিদ্ধান্ত নিতে রাখতে হবে কওমি মাদরাসার মুরুব্বি ও দায়িত্বশীলদের। যে যাই করুক, আমরা যদি আমাদের আমল, স্বীয় ঐতিহ্য, স্বকীয় বৈশিষ্ট্য, ইখলাস, জনসেবা তথা খেদমতে খালক, দাওয়াত ও তাবলিগ, নিখাদ দেশপ্রেম.. সর্বোপরি কাজের মাধ্যমে আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার মানসিকতা বজায় রাখতে পারি, তা হলে সময়ের সকল চ্যালেঞ্জ আমরা মোকাবিলা করতে সক্ষম হবো। ইনশা আল্লাহ। জনৈক উর্দু কবি চমৎকার বলেছেন,

ان کا جو کام ہے وہ اہل سیاست جانے
ہمارے پیغام محبت جہاں تک پہوچے

(ওন কা যূ কাম ওয়হ আহলে সিয়াসত জানে,
হামারে পয়গামে মুহব্বত যাহাঁ তক পৌঁছে।)

অর্থাৎ ‘ওরা ওদের রাজনীতি করুক। তাতে আমাদের কী আসে যায়!
আমরা আমাদের পয়গামে মহব্বত পৌঁছাতে থাকব, যতটুকু যায়।

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button