স্বাগতম ১৪২৫ সন

shuvo-boishakhড. এম এ সবুর: স্বাগতম বাংলা নববর্ষ ১৪২৫ সন। নববর্ষ উদযাপন একটি ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতি। তবে কবে থেকে নববর্ষ বা বর্ষ গণনা শুরু হয়েছে তার সঠিক তথ্য পাওয়া যায়নি। মানব সভ্যতার প্রাথমিক পর্যায়ে মানুষ রাত দিন গণনা শুরু করেছিল সূর্য উদয়-অস্তের ভিত্তিতে। কিন্তু তারা মাস গণনা শুরু করেছিল চাঁদের ভিত্তিতে। অর্থাৎ মানুষ চাঁদের বৃদ্ধি-হ্রাস দেখে মাস গণনা করতো। তারা এক শুক্ল পক্ষ থেকে অন্য শুক্ল পক্ষ কিংবা এক কৃষ্ণপক্ষ থেকে অন্য কৃষ্ণপক্ষ পর্যন্ত সময়কে একমাস ধরে মাস গণনা করতো। এভাবে ১২ চান্দ্র মাসে এক বছর গণনা করা হতো। পরবর্তীতে সৌর বছর দিয়ে বর্ষ গণনা করা হয়। তাই বর্ষ গণনার ভিত্তি এক নয়। কেউ গণনা করে চন্দ্রের ভিত্তিতে কেউ আবার সূর্যের ভিত্তিতে। প্রত্যেক জাতি-দেশের বছর গণনা শুরু হয়েছে তাদের নিজস্ব সংস্কৃতিতে। আর বর্ষ গণনার ভিত্তি অনুযায়ী বিভিন্ন জাতি-রাষ্ট্র বিভিন্ন সময়ে নববর্ষ উদযাপন করে থাকে। যেমন ইরানের নববর্ষ ‘নওরোজ’ পালিত হয় বসন্তের পূর্ণিমায়। অন্যদিকে জুলিয়ান ক্যালেন্ডার অনুযায়ী ১লা জানুয়ারিতে Happy New Year উদযাপিত হয়। গ্রীস্মের শুরুতে অর্থাৎ ১লা বৈশাখে বাংলা নববর্ষ উদযাপন করা হয়। আর মুহররমের ১লা তারিখে হিজরি নববর্ষ পালিত হয়। সব জাতির বর্ষ গণনা যেমন এক নয় তেমনি সব জাতির নববর্ষের উৎসবও অভিন্ন নয়। প্রত্যেক জাতি তার নিজস্ব সংস্কৃতির ভিত্তিতে নববর্ষ উদযাপন করে থাকে। বাংলা নববর্ষ উৎসবও পালিত হওয়া উচিৎ বাঙালির নিজস্ব সংস্কৃতিতে। কৃষি নির্ভর বাঙালি জাতির নববর্ষ উদযাপন দরকার কৃষি সংস্কৃতির ভিত্তিতে।
নববর্ষ উদযাপনের ইতিহাস অনেক পুরনো। প্রায় ৫ হাজার বছর আগে পারস্যে ১১ দিন ব্যাপি নববর্ষ উৎসব ‘নওরোজ’ পালিত হতো। ব্যবিলনে নববর্ষ উৎসব উদযাপিত হতো প্রায় সাড়ে ৪ হাজার বছর আগেও। প্রায় একই সময়ে রোমনরা ব্যাবিলনীয়দের নিকট থেকে বসন্তকালের নববর্ষ উদযাপন শিখেছিল। যিশু খ্রিস্ট জন্মের অনেক আগ থেকেই ইহুদিরা নববর্ষ উৎসব ‘রাশ হুশনা’ পালন করতো। ইউরোপের বিভিন্ন দেশে গ্রেগ্রিয়ান ক্যালেন্ডার অনুযায়ী ১লা জানুয়ারি ঐধঢ়ঢ়ু ঘবি ণবধৎ পালিত হয়ে আসছে অনেক দিন থেকে। হিজরি নববর্ষ উৎসবের কোন আড়ম্ভরতা না থাকলেও আরবসহ গোটা মুসলিম বিশ্বেই এ দিবসটি পালিত হয়ে আসছে। অন্যদিকে বাংলা নববর্ষ ‘পয়লা বৈশাখ’ কয়েক শতক ধরে উদযাপিত হচ্ছে।
পয়লা বৈশাখ বাংলা নববর্ষ। বাংলাদেশে উৎসবমুখর পরিবেশে বাংলা নববর্ষ উদযাপন করা হয়। শিশু-যুবা-বৃদ্ধসহ সব বয়সের এবং সব শ্রেণীর মানুষ এ দিনটি উদযাপন করে মহাধুমধামে। দিনটি উৎসবমুখর পরিবেশে উদযাপনের জন্য সরকারি বেসরকারি সামাজিক সাংস্কৃতিক ও বিভিন্ন সংস্থা বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করে। নববর্ষ উদযাপনের সুবিধার্থে দিনটি সরকারি ছুটি। বাংলা নববর্ষ উদযাপন বাঙালি সমাজ ও সংস্কৃতির একটি অন্যতম প্রধান উপাদান। বাংলা নববর্ষকে কেন্দ্র করে গ্রামে গঞ্জে বৈশাখী মেলা বসে। কৃষিজ পণ্য, কুঠির শিল্প দ্রব্য, মৃৎ ও হস্ত শিল্প দ্রব্য প্রয়োজনীয় ও অপ্রয়োজনীয় আসবাব পত্র, খেলনা ইত্যাদি ক্রয়-বিক্রয়ের ধুম পড়ে যায় মেলায়। আগের দিনে মেলায় প্রদর্শনী হতো ষাঁেড়র লড়াই, মোরগের লড়াই, লাঠিখেলা, বলী খেলা ইত্যাদি বিনোদন অনুষ্ঠান। তখন মেলা ছিল বাঙালির প্রাণের উৎস। মেলা উপলক্ষে আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে বেড়ানো ও আপ্যায়নের ব্যবস্থা হতো। আর বিবাহিতা মেয়েরা নাইওর যেত বাপের বাড়িতে। আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা সবাই বৈশাখী মেলায় আনন্দে মাতোয়ারা হয়ে উঠতো। এমনিভাবে বাংলা নববর্ষ উদযাপনে বাংলার গ্রামে গ্রামে আনন্দের ধুম বয়ে যেতো। বৈশাখী মেলায় আগের দিনে লাঙ্গল, জোয়াল, মইসহ বিভিন্ন কৃষি সরঞ্জামাদি, গৃহস্থালির প্রয়োজনীয় মাটির হাড়ি-পাতিলসহ বিভিন্ন আসবাবপত্র, শিশুদের খেলাধুলার জন্য ঘুড়ি, মাটির তৈরী হাতি-ঘোড়া ইত্যাদি বেচা-কেনা হতো। মেয়েদের হাতের চুড়ি, কানের দুল, গলার হার ইত্যাদি দ্রব্যও বেচা-কেনা হতো বৈশাখী মেলায়। এছাড়া জুড়ি-বুন্দি, জিলাপি, রসগোল্লা ইত্যাদি মুখরোচক খাবারের সমারোহতো ছিলই।
বাংলা সনের ইতিহাস খুব দীর্ঘ নয়। তাই বাংলা নববর্ষ উৎসবের সংস্কৃতিও খুব পুরনো নয়। বাংলা সাহিত্যের প্রাচীন যুগে তো নয়ই এমনকি মধ্যযুগেও (১২০৩-১৭৫৭ খ্রি.) বাংলা নববর্ষভিত্তিক কোন সাহিত্য নাই। আধুনিক যুগের প্রথম শতকের (১৮০১-১৯৪৭ খি.) সাহিত্যেও বাংলা নববর্ষভিত্তিক কোন রচনা পাওয়া যায় না। বিশ শতকের প্রথমার্ধেও নববর্ষ বাংলা সাহিত্যে তেমন কোন প্রভাব বিস্তার করতে পারে নাই। তাই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা-গানে ‘বৈশাখ’ ‘পূণ্যাহ’ বিষয় থাকলেও বাংলা ‘বর্ষবরণ’ বা নববর্ষ উৎসবের বিষয় নাই। একইভাবে কাজী নজরুল ইসলামের সাহিত্যে পারস্যের ‘নওরোজ’ অনুষ্ঠানের উল্লেখ থাকলেও বাংলা নববর্ষ বা ‘বর্ষবরণ’ উদযাপনের বিষয় নাই। অর্র্থাৎ গত শতাব্দীর প্রথমার্ধে সাহিত্যে বাংলা ‘নববর্ষ  উৎসব’ প্রভাব বিস্তার করতে পারে নাই। অবশ্য তখন যে নববর্ষ বা বর্ষবরণ ছিল না বিষয়টি তেমন না। তবে তৎকালে বর্ষবরণ বা নববর্ষ উদযাপন ছিল অনাড়ম্ভরপূর্ণ ও জৌলুসহীন। ঘরোয়া পরিবেশে পরিবার-পরিজন ও আত্মীয়-স্বজনের মধ্যেই নতুন বছরের প্রথম দিনে ভালো খাবার আয়োজন-আপ্যায়ন এবং নতুন পোষাক পড়ার বর্ষবরণ বা নববর্ষ উদযাপন সীমাবদ্ধ ছিল। বর্তমানের মতো এতো জমকালো অনুষ্ঠান তৎকালে ছিল না। মিষ্টন্ন বা মিঠা জাতীয় দ্রব্য দিয়ে ‘মিঠামুখ’ করানো এবং অপেক্ষাকৃত ভালো খাবারের আয়োজন করা হতো ‘বর্ষবরণ’ বা নববর্ষ দিনে। তৎকালীন বাঙালি সমাজে প্রচলিত ধারনা ছিল বছরের শুরুর দিনে ‘মিঠামুখ’ করলে সারা বছর মুখ মিঠা থাকবে এবং এদিন ভালো খাবার খেলে সারা বছর অনুরূপভাবে ভালো খাবার খাওয়া যাবে। কুসংস্কার হলেও বাঙালিরা এ বিশ্বাসের ভিত্তিতে ‘নববর্ষ’ দিনে অপেক্ষাকৃত ভালো খাবারের আয়োজন ও ভালো পোশাক পরিধান করতো। কালের পরিক্রমায় বছরের প্রথম দিনে ভালো খাবারের আয়োজন-আপ্যায়ন, নতুন পোশাক পড়া, হিন্দুদের পুজা-অর্চনা, মুসলমানদের মিলাদ-মাহফিল-দোয়া অনুষ্ঠান ইত্যাদির মাধ্যমে বাংলা নববর্ষ ‘বর্ষবরণ’ উদযাপনের উৎপত্তি ঘটে।
বাংলা নববর্ষের মূলে কৃষক ও কৃষি। মুঘল শাসনামলে হিজরি সনের ভিত্তিতে এ দেশে বছর গণনা হতো। হিজরি বছর সৌর বছর থেকে ১১ দিন ছোট হওয়ায় এ দেশের ঋতু পরিবর্তনের সাথে হিজরি বছরের মিল হয় না। এতে কৃষকদের ফসলি সন গণনায় সমস্যা হয়। অধিকন্তু কৃষকের কাছ থেকে জমিদারের খাজনা আদায়েও সমস্যা দেখা দেয়। এজন্য কৃষক ও জমিদারের সমস্যা দূর করতে মূলত বাংলা সনের প্রর্বতন করা হয়। তাই দেখা যায় বাংলা নববর্ষ সব বাঙালির হলেও উৎসবের আমেজটা কৃষকের একটু বেশি।
বাংলা নববর্ষের সূচনা মুসলমানদের হাতে। মুসলিম ঐতিহ্যের হিজরি সনকে ভিত্তি করেই বাংলা সনের উৎপত্তি হয়েছে। মুঘল সম্রাট আকবর বাংলার কৃষকদের সুুুবিধার্থে হিজরি সনকে ভিত্তি ধরে বাংলা সনের প্রর্বতন করেন। বাংলা নববর্ষের যাত্রা খুব বেশি দিন আগের নয়। চলতি নববর্ষে বাংলা সন ১৪২৫ তম বছরে পদার্পন করলেও মূলত এর যাত্রা শুরু হয়েছে মাত্র ৪৬২ বছর আগে মুঘল শাসনামলে। উল্লেখ্য, হিজরি সন গণনা করা হয় মহানবী হযরত মুহম্মদ সা: এর মক্কা থেকে মদিনা হিজরতের ঘটনাকে কেন্দ্র করে। হযরত ওমর রা: রাসূল সা: এর হিজরতকে স্মরণীয় রাখতে হিজরতের বছরকে ভিত্তি বছর ধরে হিজরি সনের প্রবর্তন করেন। আর মুঘল সম্রাট আকবর তার সিংহাসন আরোহনের বছরকে স্মরণীয় করতে সভাজ্যোতিষী আমীর ফতেউল্লাহ সিরাজীর (দৈবে দশরত্ন) পরামর্শে হিজরি ৯৬৩ সনকে বাংলা ৯৬৩ সন ধরে বাংলা সন গণনার নির্দেশ দেন।
প্রকৃতপক্ষে বাংলা নববর্ষ উৎসবের মূলে আছে মুসলিম ঐতিহ্য। উৎপত্তিগত দিক দিয়ে বাংলা সনের সাথে যেমন মুসলিম ঐতিহ্য জড়িত তেমনি নববর্ষ উৎসবের সাথেও পারসিয়ান মুসলিম সংস্কৃতি জড়িত।

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button