বিপন্ন মুসলিম জনপদ, অভিবাসীদের লাশ ও পাশ্চাত্যের দায়

AbdulLatifMasumড. আবদুল লতিফ মাসুম: এ যেন অগ্নিকে আলো মনে করে পতঙ্গকুলের অভিসার যাত্রা। অভিবাসী উদ্বাস্তু আশ্রয় প্রার্থী অথবা ভাগ্যান্বেষী- যে নামেই ডাকা হোক, লাখো মানুষের অভিঘাত আজ ইউরোপের দ্বারপ্রান্তে। ইতালি, গ্রিস, বুলগেরিয়া, রোমানিয়া, হাঙ্গেরি, স্লোভাক বা অস্ট্রিয়ার বন্দরে বন্দরে বিধ্বস্ত জনপদ থেকে বিতাড়িত মানুষের ভিড়। ভূমধ্যসাগরের এপারে অথবা ওপারে অভিবাসী মানুষের লাশের মিছিল। লিবিয়া, তিউনিসিয়া, মাল্টা ও ক্রিটের তীরে তীরে ভাসছে মানুষের লাশ। ১ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত খবরে বলা হয়, লিবীয় উপকূলে প্রায় ৫০০ অভিবাসীবাহী দুটো নৌকা ডুবে ২০০ লোকের মৃত্যু হয়েছে। কয়েক সপ্তাহ ধরে বিচ্ছিন্নভাবে এ রকম অসংখ্য মৃত্যুর খবর জানিয়েছে বার্তা সংস্থাগুলো। সাগরে যেমন নিরাপদ নন অভিবাসীরা, তেমনি নিরাপদ নন সড়ক-জনপদে। ২৯ আগস্ট জানা যায়, অস্ট্রিয়ায় একটি পরিত্যক্ত ট্রাক থেকে পুলিশ ৭১টি লাশ উদ্ধার করেছে। ধারণা করা হচ্ছে, শ্বাসরুদ্ধ হয়ে তাদের মৃত্যু হয়েছে। ইতোমধ্যে তুরস্ক থেকে ছোট নৌকায় গ্রিসে যাওয়ার পথে ১২ জন অভিবাসনপ্রত্যাশী মারা গেছেন। লন্ডন-প্যারিস চ্যানেল টানেল পার হতে গিয়েও মৃতের ঘটনা ঘটেছে। গত সপ্তাহে অস্ট্রিয়ায় একটি গাড়ির ভেতর থেকে ২৪ জন আফগানকে উদ্ধার করা হয়। তারা শ্বাসর”দ্ধ হয়ে মুমূর্ষু অবস্থায় ছিল। দুঃসংবাদ আসছে পৃথিবীর এই প্রান্তে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া থেকে। ৩ সেপ্টেম্বর বার্তা সংস্থা জানায়, ১০০ জন প্রত্যাশিত অভিবাসী নিয়ে মালয়েশীয় উপকূলে একটি নৌকা ডুবে গেছে। ইউএনএইচসিআরের ভাষ্যে বলা হয়, এ বছর তিন লক্ষাধিক মানুষ সাগরপথে ইউরোপ পৌঁছেছে। এ ধরনের অভিযাত্রায় প্রাণ হারিয়েছে আরো আড়াই হাজার মানুষ। গত বছর ওই পথে ইউরোপে গিয়েছিল দুই লাখ ১৯ হাজার মানুষ। এদের বেশির ভাগই ধর্মে মুসলমান এবং জাতিতে আরব। এরা এসেছেন গৃহযুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়া, ইরাক ও আফগানিস্তান থেকে। এ ছাড়া আছে সঙ্ঘাত, সন্ত্রাস আক্রান্ত পাকিস্তান, মিসর, সুদান প্রভৃতি দেশের মানুষ। দেশ থেকে এসব মানুষ বিতাড়িত। তাদের আশ্রয় নেই, খাবার নেই, জীবনধারণের উপকরণ নেই। তাই সমৃদ্ধ ও নিরাপদ ইউরোপের দ্বারপ্রান্তে তাদের আহাজারি। ইউরোপীয় বাণিজ্যবাদ, সাম্রাজ্যবাদ ও উপনিবেশবাদের যাঁতাকলে নিষ্পেষিত হয়েছে যেসব জনপদ, আজ ইতিহাসের প্রান্তসীমায় সেসব মানুষ তাদের পুরনো প্রভুদের কাছে অবাঞ্ছিত।
Syriaজাতিসঙ্ঘ উদ্বাস্তুসংক্রান্ত হাইকমিশনের (ইউএনএইচসিআর) ২০১৪ সালের বার্ষিক প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল ‘ওয়ার্ল্ড অ্যাট ওয়ার’ বা যুদ্ধে লিপ্ত পৃথিবী। স্নায়ুযুদ্ধের অবসানে মানুষ ভেবেছিল যুদ্ধ থেকে রেহাই পাবে পৃথিবী, কিন্তু তা হয়নি; বরং ৯/১১-এর পর নতুন অবয়বে যুদ্ধে বিধ্বস্ত হয়েছে প্রাচ্য। প্রকৃতপক্ষে বিধ্বস্ত হয়েছে মুসলিম জনপদ। পূর্ব গোলার্ধে এশিয়া, আফ্রিকা ও ইউরোপের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে মুসলিম জনপদ রয়েছে। আটলান্টিক মহাসাগরের মৌরিতানিয়া থেকে প্রশান্ত মহাসাগরের প্রান্তসীমায় ইন্দোনেশিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত ব্যাপক এই জনপদ। এক সময়ের সমৃদ্ধ, শক্তিমান এই জনপদ। এখন বহুলাংশে বিধ্বস্ত-বিপর্যস্ত, সহিংস-সন্ত্রস্ত ও বিপন্ন এই জনপদের কোটি কোটি মানুষ। ইউএনএইচসিআর তাদের রিপোর্টে পৃথিবীর ১৫টি সঙ্ঘাতময় এলাকা চিহ্নিত করেছে। এসব এলাকায় যুদ্ধ চলছে অথবা যুদ্ধাবস্থা বিরাজ করছে। এসব সঙ্ঘাতের কেন্দ্রভূমি হচ্ছে মধ্যপ্রাচ্য। এটিই হচ্ছে ইসলামের লালনভূমি এবং মুসলিম বিশ্বের হৃৎপিণ্ড। এই হৃৎপিণ্ডে অনবরত রক্তক্ষরণ করে চলেছে বিষফোড়া ইসরাইল। এক রকম চিরস্থায়ী যুদ্ধে লিপ্ত রয়েছে পাশের মুসলিম দেশগুলো। ফিলিস্তিনের গরিষ্ঠ জনগণ আজ উদ্বাস্তু। লঘিষ্ঠ অংশ ‘নিজ দেশে পরবাসী’। গৃহযুদ্ধ চলছে সিরিয়া, ইরাক ও ইয়েমেনে। ইউএনএইচসিআরের হিসাবে বর্তমান বিশ্বে বাস্তুচ্যুত মানুষের সংখ্যা পাঁচ কোটিরও বেশি। সবচেয়ে ক্ষতবিক্ষত সিরিয়া। এ দেশ থেকে প্রায় ৪০ লাখ মানুষ তুরস্কে ও ১১ লাখ লেবাননে আশ্রয় নিয়েছে। এশিয়ায় মধ্যাঞ্চলে এ রকম তিনটি দেশ হচ্ছে- আফগানিস্তান, কিরগিজস্তান ও পাকিস্তান। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অনেক দেশে সঙ্ঘাত চলছে। রিপোর্টে মিয়ানমার বা বার্মার উল্লেখ আছে। এখানে শান, কারান প্রভৃতি উপজাতির সাথে সঙ্ঘাত থাকলেও মূল নির্যাতিত অংশ হচ্ছে আরাকানের রোহিঙ্গা মুসলিমরা। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার আরেকটি সংক্ষুব্ধ জনপদ হচ্ছে- থাইল্যান্ডের পাত্তানি প্রদেশ এবং তদসংলগ্ন দক্ষিণাঞ্চল। আর ফিলিপাইনের মিন্দানাও অংশের মুর মুসলিমদের সঙ্ঘাত সংগ্রামের কথা আন্তর্জাতিক মহলে সুবিদিত। ভারতের কাশ্মিরি জনগণ সেই ১৯৪৮ সাল থেকে আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকারের জন্য লড়াই করে যাচ্ছে। আফ্রিকা, যাকে ইসলামি মহাদেশ বলা হয়, সেটি এখন সঙ্ঘাতপূর্ণ। এ রকম আটটি দেশ হচ্ছে লিবিয়া, দক্ষিণ সুদান, মালি, বুর”ন্ডি, নাইজেরিয়া, আইভরি কোস্ট, সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিক ও গণতান্ত্রিক কঙ্গো প্রজাতন্ত্র। এসব রাষ্ট্রের বেশির ভাগই মুসলিম জন-অধ্যুষিত। মুসলিম জনপদের রাষ্ট্র এবং সরকারবহির্ভূত একটি সংক্ষুব্ধ অংশ ইতোমধ্যে ‘নন স্ট্রেট অ্যাক্টর’ নামে অভিহিত হয়ে গোটা জনপদকে তছনছ করে চলেছে। যেমন- ইসলামি রাষ্ট্রের দাবি তুলে সিরিয়া ও ইরাকের বিরাট অংশ দখল করে মার্কিন যুদ্ধজোটের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত আইএস। তালেবানরা যুদ্ধ করছে আফগানিস্তানে। পাকিস্তানে সম্প্রসারিত হয়েছে ‘তাহারিক-ই-তালেবান পাকিস্তান’ টিটিপি। কাশ্মিরে যুদ্ধ করছে নানা নামের স্বাধীনতাকামী সংগঠন। সোমালিয়া তথা আরব সাগর উত্তাল করে তুলেছে ‘আল-শাহাব’। আফ্রিকায় নাইজেরিয়ার উত্তরাঞ্চলসহ পার্শ্ববর্তী ক্যামের”ন, শাদ, নাইজার প্রভৃতি রাষ্ট্রের মানুষের ঘুম হারাম করে তুলেছে ‘বোকো হারাম’। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আলকায়েদা প্রধান ওসামা বিন লাদেনকে হত্যা করার পর সংগঠনটি বিপর্যস্ত হলেও বিভিন্ন অঞ্চলে বিচ্ছিন্ন তৎপরতার সংবাদ পাওয়া যাচ্ছে।
মুসলিম বিশ্বের যে সার্বিক চিত্র আজ বিধ্বস্ত ও বিপর্যস্ত। বেশির ভাগ আরব রাষ্ট্র গৃহযুদ্ধে ক্ষতবিক্ষত। পাশের রাষ্ট্রগুলো সেই যুদ্ধবিগ্রহের আগুনে ঝলসিত। যেসব রাষ্ট্রে স্বাভাবিক শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় থাকার কথা, সেগুলোতে শাসক দল বা ব্যক্তির রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নে নাগরিক জীবন বিপন্ন। সুখের ‘আরব বসন্ত’ এখন দুঃখের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। চিরস্থায়ী শাসক দাবিদার মুয়াম্মার আল গাদ্দাফিকে তাড়াতে গিয়ে স্থায়ী দুর্ভোগের শিকার হয়েছে লিবীয় জনগণ। স্বৈরশাসক হোসনি মোবারকের পরিবর্তে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে নিপীড়ক সামরিক চক্র। সিরিয়ায় বংশানুক্রমিক শাসন ধারাকে বদলে দিতে গিয়ে আজ দেশটির অস্তিত্বই বিপন্ন। ইরাকে একজন লৌহশাসক সাদ্দাম হোসেনকে ক্ষমতাচ্যুত করেছে পশ্চিমা জোট। শান্তির পরিবর্তে এখন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে অশান্তি আর অরাজকতা। নেতৃত্বের দ্বন্দ্ব, গোষ্ঠী কোন্দল ও শিয়া-সুন্নি দাঙ্গায় বিধ্বস্ত এই প্রাচীন জনপদ। চিরস্বাধীন আফগানিস্তান এখন চিরস্থায়ী যুদ্ধবিগ্রহের দেশ। পাকিস্তানে চলছে জনগণ এবং কায়েমি স্বার্থবাদের দ্বন্দ্ব। ক্ষতবিক্ষত হচ্ছে মানুষ। কাশ্মিরে প্রতিদিন অধিকৃত বাহিনীর গুলিতে প্রাণ হারাচ্ছে মানুষ। মিয়ানমারে রোহিঙ্গা মুসলমানদের নাগরিক অধিকার অস্বীকার করছে সরকার। হত্যা, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট করে স্বনাগরিকদের বিতাড়ন করছে রাষ্ট্র। পাত্তানি ও মিন্দানাওতে চলছে উৎখাত ও উৎপীড়ন।
পৃথিবীব্যাপী অভিবাসনপ্রত্যাশী, আশ্রয় প্রার্থী জনসংখ্যার ৯০ ভাগ মুসলমান। এরা এসেছে যুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়া, ইরাক, আফগানিস্তান বা পাকিস্তান থেকে। আর দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় উদ্বাস্তুদের বেশির ভাগই আরাকানি মুসলমান। বাংলাদেশ থেকে যারা ভাগ্যান্বেষণে সাগর পাড়ি দিচ্ছে, তারা উদ্বাস্তু নয়। এরা রাষ্ট্রের প্রতিহিংসার শিকার অথবা প্রতারক মানবপাচারকারী বা আদম বেপারিদের নিকৃষ্ট ব্যবসায়ের শিকার। বিশ্বব্যাপী বিশেষত মুসলিম জনপদ থেকে পৃথিবীর চার দিকে এসব মানুষের ছড়িয়ে পড়ার কারণ কী? প্রাথমিক বর্ণনায় গৃহযুদ্ধ, সহিংসতা, অত্যাচার, অনাচার ও উন্নত জীবনের আকাক্সক্ষা এদের দেশ ত্যাগের আপাতকারণ। কিন্তু আমরা যদি গভীর পর্যবেক্ষণ দিয়ে ঘটনাবলির ইতিহাস-ভূগোল অনুসন্ধান করি, তাহলে দেখব পাশ্চাত্য সাম্রাজ্যবাদই এই দুরবস্থা সৃষ্টির মূল নিয়ামক।
ক. ১৯১৯ সালের ভার্সাই চুক্তির মধ্যেই দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের কারণ নিহিত। হিটলার ও মুসোলিনির উত্থান ওই কারণেই ত্বরান্বিত হয়েছে। অনুরূপ প্রথম মহাযুদ্ধের পর পাশ্চাত্য সাম্্রাজ্যবাদ কর্তৃক সমৃদ্ধ শক্তিধর, মুসলিম বিশ্বের ওপর সার্বিক কর্তৃত্বশীল, একক নেতৃত্বের অধিকারী তুর্কি সালতানাতের পতনের ফলেই আজ মুসলিম বিশ্ব শতধাবিভক্ত হয়েছে এবং বিধ্বস্ত জনপদে পরিণত হয়েছে। একক কর্তৃত্বের অভাবে মুসলিম জনগোষ্ঠীর শান্তি-শৃঙ্খলা ও একতা আজ সুুদূরপরাহত। ঐক্যের প্রতীক হিসেবে যে খেলাফত কার্যকর ছিল, তার অনুপস্থিতিতে সেই আবেগকে ব্যবহার করে তথাকথিত ইসলামি রাষ্ট্র ফায়দা নিতে চাচ্ছে।
খ. মরক্কো থেকে পারস্য উপসাগর তথা মধ্য এশিয়াব্যাপী যে বিশাল সাম্্রাজ্য তুর্কি সালতানাতের অধীনে এককভাবে শাসিত হচ্ছিল, তা টুকরো টুকরো করে ভাগবাটোয়ারা করে নেয় ব্রিটিশ, ফরাসি ও রুশ সাম্রাজ্যবাদ। তুর্কি সালতানাতের ইউরোপীয় অংশ বেশির ভাগই দখল করে নেয় তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন। মধ্যপ্রাচ্য ভাগ করে নেয় ব্রিটেন ও ফ্রান্স। তারা স্থানীয়ভাবে রাজা-বাদশা, আমির-ওমরাহদের মাঝে এসব অঞ্চল নামকাওয়াস্তে বিলিয়ে দেয়। কায়েম করে স্থানীয় ব্যক্তিগত, গোষ্ঠীগত ও আঞ্চলিক শত্রুতা। তারা কতগুলো কৃত্রিম রাষ্ট্র সৃষ্টি করে তারা ধর্ম ও জাতিগত বিদ্বেষ লালন করে।
গ. এই উপমহাদেশের মতো ‘ভাগ করো এবং শাসন করো’ নীতি মধ্যপ্রাচ্যেও তারা অনুসরণ করেছে। ক্রুসেড খ্যাত সালাউদ্দিন আইয়ুবি র:-এর উত্তরাধিকারী কুর্দি জনগোষ্ঠীকে চার ভাগে বিভক্ত করেছে। আজ তারা তুরস্ক, ইরাক, সিরিয়া ও ইরানের মধ্যে স্থায়ী গৃহযুদ্ধের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ঘ. সব সাম্রাজ্যবাদী শক্তি একত্র হয়ে সবচেয়ে বড় যে সর্বনাশটি করেছে, তা হচ্ছে ইহুদি রাষ্ট্র ইসরাইলের সৃষ্টি। পৃথিবীতে বিশেষত পশ্চিম গোলার্ধে শূন্য জনবসতি অঞ্চল থাকা সত্ত্বেও এবং কোনো কোনো গোষ্ঠী কর্তৃক মালাগাছি দ্বীপ বা উগান্ডার মতো অঞ্চলে ইহুদি রাষ্ট্রের পত্তনের প্রস্তাব উপেক্ষিত হয়। ১৯৪৮ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, সোভিয়েত ইউনিয়ন, ব্রিটেন ও ফ্রান্স পারস্পরিক যোগসাজশে আরবদের ফিলিস্তিন থেকে ক্রমেই বিতাড়ন করে কৃত্রিম ইহুদি রাষ্ট্র সৃষ্টি করেছে। এখন যখন গোটা ফিলিস্তিনি জনগণ উদ্বাস্তু হয়েছে এবং ইউরোপের দ্বারপ্রান্তে হাজির হয়েছে তখন তাদের কি কোনো দায় নেই?
ঙ. যারা গণতন্ত্রের নামে কার্যত লিবিয়ার তেলসম্পদ দখল করেছে এবং এর স্থিতিশীল নেতা গাদ্দাফিকে হত্যা করে দেশটিতে গৃহযুদ্ধ সৃষ্টি করেছে, তাদের দেশ থেকে যখন উদ্বাস্তু ইতালি অথবা গ্রিসের বন্দরে ভিড় করছে, তখন যারা ওই উদ্বাস্তু সৃষ্টির জন্য দায়ী তারা কি কোনো দায়িত্ব পালন করবে না?
চ. ইরাকে স্বৈরাচার উৎখাতের নামে কার্যত পাশ্চাত্যের শিখণ্ডী সরকার কায়েম হয়েছে। শিয়া-সুন্নি বিরোধের নামে দেশটি খণ্ড-বিখণ্ড হয়েছে। সেখানে যতটা না শিয়া-সুন্নিধর্মীয় বিরোধ, তার চেয়ে পাশ্চাত্যের উদ্দেশ্যমূলক বিরোধ-তৎপরতাই দায়ী।
ছ. ইয়েমেন থেকে যদি কোনো উদ্বাস্তু গৃহযুদ্ধের কারণে ইউরোপে আশ্রয় প্রার্থী হয় তাহলে তার ইন্ধনদাতা পাশ্চাত্য শক্তি কোনো দায় অনুভব করবে না কেন?
জ. পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের কিছু লোক হাঙ্গেরি বা অস্ট্রীয় সীমান্তে আশ্রয়ের জন্য উপস্থিত হয়েছে। যারা আফগানিস্তানকে বোমা মেরে তামা বানিয়েছে এবং এর জনসংখ্যার ২০ ভাগকে উদ্বাস্তুতে পরিণত করেছে, চলমান উদ্বাস্তু অভিবাসনের দায় কিভাবে তারা এড়াতে পারে?
ঝ. ১৯৪৭ সালের স্বাধীনতা আইনানুযায়ী কাশ্মিরের পাকিস্তানে যোগ দেয়ার প্রক্রিয়া শুর” হয়। ভারতের গভর্নর জেনারেল লর্ড মাউন্ট ব্যাটেন কলে-কৌশলে কাশ্মিরকে ভারতের অন্তর্ভুক্ত করান। ১৯৪৮ সালে জাতিসঙ্ঘ নিরাপত্তা পরিষদে গৃহীত প্রস্তাব অনুযায়ী সেখানে গণভোট অনুষ্ঠানের কথা। দীর্ঘ ৬৭ বছরেও সেখানে গণভোট প্রস্তাব কার্যকর হয়নি। অথচ একই ভাবে খ্রিষ্টান অধ্যুষিত পূর্ব তিমুর ও দক্ষিণ সুদানে গণভোট অনুষ্ঠানের প্রস্তাব কার্যকর হয়েছে। কার্যত দু’টি স্বাধীন দেশের উদ্ভাব হয়েছে। কাশ্মিরে গণভোট না হওয়ার কারণ হিসেবে যদি কেউ এ কথা বলে যে এর মুসলিম সংখ্যাধিক্য দায়ী তাহলে সেটি কি খুব অন্যায় হবে?
ঞ. মিয়ানমার রাষ্ট্রের আরাকান কখনোই বৃহত্তর বার্মার অংশ ছিল না। ধর্ম-বর্ণ-গোত্র ও জীবনাচার- কোনো দিক দিয়েই তারা বার্মার গরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর অংশ নয়। ব্রিটিশ শাসনের পূর্বক্ষণে আরাকানে বার্মিজ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৪৮ সালে ব্রিটেন যখন বার্মার স্বাধীনতা মেনে নেয়, তখন আরাকানের জনগণ স্বাধীন সার্বভৌম আরাকানের দাবি করে। তাদের যৌক্তিক দাবির প্রতি ভ্রুক্ষেপ না করে শুধু সদাচরণের ভরসায় আরাকান বার্মার অন্তর্ভুক্ত হয়। কী ধরনের সদাচরণ মিয়ানমার সরকার করছে তার প্রমাণ থাইল্যান্ডের গণকবর, সাগরে সাগরে অনাহারে ভাসমান মৃত্যু এবং স্ব-জাতি বাংলাদেশে অভিবাসনের প্রত্যাখ্যান! এই যে মৃত্যু এবং অধীনতর শৃঙ্খল-এ জন্য কি ব্রিটিশ সরকার এতটুকু দায় বহন করবে না?
মুসলিম অভিবাসী বিক্ষুব্ধ ইউরোপ : ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত (ইউ) স্লোভিনিয়া যুদ্ধপীড়িত দেশ সিরিয়ার মুসলিম উদ্বাস্তুদের আশ্রয় দিতে অস্বীকার করছে। স্লোভিনিয়া সরকার মুসলিম ধর্মাবলম্বীদের বাদ দিয়ে সিরিয়া থেকে আসা ২০০ খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বীকে নিতে চাইছে। বিশ্লেষকেরা বলছেন, শুধু স্লোভিনিয়া নয় প্রচ্ছন্ন ভাবে প্রায় সব ইউরোপীয় দেশ একই মনোভাব পোষণ করে। এসব দেশে উদ্বাস্তুদের বির”দ্ধে বিভিন্ন শহর ও জনপদে বিক্ষোভ প্রদর্শন করা হয়েছে। এমনকি উদ্বাস্তু শিবিরে হামলার ঘটনা ঘটেছে। হাঙ্গেরি বলকান অঞ্চলের উদ্বাস্তুদের ঠেকাতে ৪ মিটার উঁচু বেড়া নির্মাণ করেছে। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ক্যামের”ন অভিবাসনপ্রত্যাশীদের প্রতি নেতিবাচক মন্তব্য করেছেন। ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী ফিলিফ হ্যামন্ড বলেছেন, ‘এরা ইউরোপের উন্নত জীবনযাত্রার মানকে নষ্ট করতে চায়’। ব্রিটেন ও ফ্রান্সের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীদ্বয় অভিবাসী আগমন প্রতিরোধে বিভিন্ন ব্যবস্থা নিয়েছেন। তারা বলেন ‘আমাদের রাস্তাগুলো স্বর্ণ দিয়ে বাধানো নয়’। ব্রিটেন অভিবাসী ঠেকাতে নতুন আইন করছে। সরকার বলছে, ‘যুক্তরাজ্য যে অবৈধ অভিবাসীদের জন্য কোনো উদার গন্তব্য স্থল নয় নতুন আইনটি সে বার্তাই দিতে সক্ষম হবে’। অন্যান্য ইউরোপীয় দেশ অভিবাসী আগমন ঠেকাতে ট্রেন বন্ধ করে দিচ্ছে এবং শক্তি প্রয়োগ করছে। এদের কেউ কেউ ঔপনিবেশিক ইতিহাস ভুলে অভিবাসীদের প্রতি তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যকর মন্তব্য ছুড়ে দিচ্ছেন।
ইউরোপ অভিমুখী অভিবাসী স্রোত রীতিমতো মানবিক বিপর্যয় সৃষ্টি করেছে।
এই অভিযাত্রা ঠেকাতে প্রথমত, বিশ্বসম্প্রদায়ের সমন্বিত পদক্ষেপ প্রয়োজন। দ্বিতীয়ত, অভিবাসনের মূল কারণ দূরীকরণে শক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ আবশ্যক। সিরীয় গৃহযুদ্ধের অবসান হলে কেউ উদ্বাস্তু হবে না। তৃতীয়ত, প্রকৃতই যারা জীবনের নিরাপত্তার জন্য মারাত্মক ঝুঁকি নিয়ে দেশান্তরি হচ্ছে তাদের প্রতি মানবিক ও আইনানুগ আচরণ নিশ্চিত করা। চতুর্থত, যারা রাজনৈতিক নিপীড়নে দেশ ত্যাগ করছেন, সেই নির্দিষ্ট সরকারকে মানবিক আচরণ করতে বাধ্য করা। পঞ্চমত, যেসব ভাগ্যান্বেষী দারিদ্র্য, বেকারত্ব, দুর্যোগ, দুর্ভোগ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য বিদেশগামী হচ্ছে, তাদের জীবনমান উন্নয়নের জন্য দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করা। ষষ্ঠত, গোটা বিশ্বব্যাপী মধ্যসাগর ও বঙ্গোপসাগরে যে মানবপাচারকারী দুষ্টচক্রের সন্ধান পাওয়া গেছে, তাদের নির্মূলে পাশের দেশগুলোকে আইনানুগভাবে ক্ষমতায়ন করা। ‘আতঙ্কিত ও হতবিহ্বল’ জাতিসঙ্ঘ মহাসচিব ইউরোপে আশ্রয়প্রার্থীদের মৃত্যু প্রতিরোধে আরো বেশি তৎপরতার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি অভিবাসীদের জন্য নিরাপদ ও বৈধ পথ বাড়াতে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর প্রতি আহ্বান জানান। বিস্ময়ের ব্যাপার, গোটা বিষয়টিতে যখন মুসলিম ও ইসলামি সহযোগিতা সংস্থাভুক্ত (ওআইসি) দেশগুলো সংশ্লিষ্ট, তখন তাদের প্রতিনিধিত্বশীল এ সংগঠনের কোনো প্রতিক্রিয়া বা কার্যব্যবস্থা অনুপস্থিত। একসময়ের গৌরবময় ঐতিহ্য ও সমৃদ্ধ রাষ্ট্রব্যবস্থার অধিকারী মুসলিম জনগোষ্ঠী আজ ইউরোপের দ্বারে দ্বারে আশ্রয়ের আশায় আহাজারি করছে, সেসব বেদনাময় দৃশ্য মোটেই সম্মানজনক নয়। এর অবসানে গোটা মানবজাতি তথা মুসলিম বিশ্ব তাদের দায় ও দায়িত্ব অনুভব করবে- এটাই প্রত্যাশিত।
লেখক : প্রফেসর, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button