মধ্যপ্রাচ্যের নববিন্যাস ও ইরান পরমাণু চুক্তি

Masumমাসুম খলিলী: ১৮ দিনের জটিল আলোচনা শেষে ১৪ জুলাই ভিয়েনায় পরমাণু ইস্যুতে চূড়ান্ত সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছে ৬ দেশ (যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, রাশিয়া, চীন ও জার্মানি), ইইউ ও ইরানের মধ্যে। ৬০ দিনের মধ্যে মার্কিন কংগ্রেস গ্রহণ বা প্রত্যাখ্যান করতে পারবে এ চুক্তি। কংগ্রেস প্রত্যাখ্যান করলে এর বিরুদ্ধে ভেটো দেবেন প্রেসিডেন্ট ওবামা। আর এই ভেটো অকার্যকর করতে হলে নিম্নকক্ষ প্রতিনিধিসভা ও উচ্চকক্ষ সিনেটে ন্যূনতম দুই-তৃতীয়াংশ ভোটে তা প্রত্যাখ্যান করতে হবে। তা না হলে চুক্তি প্রেসিডেন্টের ইচ্ছা অনুযায়ী কার্যকর হবে। বাকি দেশগুলোতেও তাদের নিয়ম অনুসারে অনুমোদন করতে হবে এ চুক্তি।
চুক্তি বিশ্লেষণে দেখা যায়, এই সমঝোতার পর পরমাণু স্থাপনা একেবারেই বন্ধ করতে হবে না ইরানকে। চুক্তির পর ১০ বছর আইএইএ’র তত্ত্বাবধানে ইরানের পরমাণু কার্যক্রম শান্তিপূর্ণভাবে চলবে। ১০ বছর পর পরমাণু অস্ত্র বানানোর মতো পর্যায়ে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণে যেতে পারবে ইরান। এই সমঝোতার বিনিময়ে ইরানের ওপর আরোপিত জাতিসক্সঘ, ইইউ, আমেরিকার অবরোধ প্রত্যাহার করা হবে। এই সমঝোতায় কয়েকটি পশ্চিমা দেশের দাবি সত্ত্বেও ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র সক্ষমতা আলোচনায় অন্তর্ভুক্ত হয়নি। ইরানের পরমাণুবিজ্ঞানীদের জিজ্ঞাসাবাদ করার যে ইস্যু উত্থাপিত হয়েছিল সেটিও গৃহীত হয়নি।
কেন আলোচনার এই উদ্যোগ?
অবরোধের মাধ্যমে ইরানকে অর্থনৈতিক ও সামরিক দিক থেকে পর্যুদস্ত করা যাবে বলে মনে করা হয়েছিল। কিন্তু এ সময়ে ইরান ট্যাংক, ড্রোন, ব্যালিস্টিক মিসাইল, সাবমেরিন, ডেস্ট্রয়ার, হেলিকপ্টার, জঙ্গিবিমান ও উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন অন্যান্য সমরাস্ত্র প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছে। অবরোধের অংশ হিসেবে ইরানের গ্যাসোলিন আমদানির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছিল। কিন্তু এরপর ইরান নিজেই গ্যাসোলিন উৎপাদন করে রফতানির ঘোষণা দেয়। তেল শিল্প উন্নয়নে নানা প্রযুক্তি আবিষ্কার করে সামনে অগ্রসর হয়। অর্থনৈতিক দুর্দশার কারণে ইরানিরা সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করবে বলে ধারণা করা হয়েছিল। কিন্তু ইরানের জনগণের মত প্রকাশের এক ধরনের ব্যবস্থা কার্যকর রয়েছে। দেশটিতে প্রেসিডেন্ট, সংসদ সদস্য ও সর্বস্তরের কর্মকর্তারা নির্বাচিত হওয়ার ব্যবস্থা চালু রয়েছে। এভাবে অবরোধের উদ্দেশ্য পুরোপুরি অর্জিত না হওয়ায় পাশ্চাত্যের পক্ষ থেকে ২০১২ সালে ইরানের সাথে যোগাযোগ স্থাপনের আগ্রহ দেখানো হয়। কিন্তু তখন রক্ষণশীল প্রেসিডেন্ট আহমাদিনেজাদ ক্ষমতায় থাকায় সে প্রচেষ্টা গতি পায়নি। পরে উদারপন্থী রাজনৈতিক নেতা আয়াতুল্লাহ হাসান রুহানি ক্ষমতায় আসার পর আলোচনার সুযোগ সৃষ্টি হয়।
দীর্ঘ ১৮ মাস আলোচনার পর শেষ পর্যন্ত আন্তর্জাতিক পক্ষগুলোর সাথে সমঝোতা প্রতিষ্ঠিত হয়। ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ খামেনির অনুমোদনক্রমেই পারমাণবিক আলোচনা পরিণতি পেয়েছে। তিনি পারমাণবিক সমঝোতাকে সমর্থন দিলেও রক্ষণশীলদের এ ব্যাপারে বিরোধিতাকেও আমলে রেখেছেন। তিনি বলেছেন, ‘চুক্তি সম্পন্ন হওয়ার অর্থ এই নয় যে, এই অহঙ্কারী ঔদ্ধত্য শক্তির সাথে আমাদের লড়াই-সংগ্রাম সব এখানেই শেষ হয়ে যাবে। বরং তাদের আধুনিক গোয়েন্দাগিরি ও এ অঞ্চলে তাদের বিভক্তিমূলক কৌশলের বিরুদ্ধে লড়াই চলবে। ’
সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতার এই বক্তব্যে আমেরিকান পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি বেশ বিরক্তি প্রকাশ করেছেন। তবে এর মাধ্যমে ইরান পাশ্চাত্যের সাথে সমঝোতায় পৌঁছলেও তার ভারসাম্যমূলক পররাষ্ট্রনীতি থেকে যে দেশটি সরে আসবে না, তার লক্ষণ স্পষ্ট।
৬ বিশ্বশক্তির সাথে ইরানের পরমাণু চুক্তির বিরাট প্রভাব পড়তে পারে অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতিতে। ইরানের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক শক্তি প্রধানত দু’টি ধারায় বিভক্ত। একটি ধারা ‘কট্টরপন্থী’ হিসেবে পরিচিত। যারা পাশ্চাত্যের সাথে সমঝোতার ওপর কমই আস্থা স্থাপন করেন এবং ইসলামের অনুশাসনগুলো কঠোরভাবে প্রতিপালনের পক্ষে। পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে আমেরিকানবিরোধী যে বিশ্ব বলয় রয়েছে, তার সাথে কৌশলগত সম্পর্ক রক্ষা করে ইরানকে একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে এগিয়ে নিতে চান তারা। প্রেসিডেন্ট আহমাদিনেজাদ ছিলেন এই ধারার নেতা।
অন্য দিকে, উদারপন্থী ধারার নেতারা ইরানের রাজনৈতিক ব্যবস্থা ও পররাষ্ট্র সম্পর্কে সংস্কার আনার পক্ষপাতী। তারা মনে করেন, পাশ্চাত্য থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া ইরানের অগ্রগতির জন্য ইতিবাচক নয়। ইরান বিপ্লবের শুরুতে আমেরিকান পণবন্দি সঙ্কট, ফেদাইনে খালকের আত্মঘাতী তৎপরতার সময় উদারপন্থী ধারার লোকেরা ছিলেন কোণঠাসা। এ কারণে বনি সদর, সাদেক কুতুবজাদেহ, মেহেদি বাজারগানের মতো নেতারা দেশটির নীতিনির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা অব্যাহত রাখতে পারেননি। পরে ইরানের বিপ্লবে গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা পালনকারীদের মধ্যে প্রেসিডেন্ট হাশেমি রাফসানজানি ও প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ খাতামির মতো ব্যক্তিরা উদারপন্থী ধারাকে এগিয়ে নেন। প্রেসিডেন্ট আহমাদিনেজাদের দ্বিতীয় দফা নির্বাচনের সময় কট্টরপন্থীদের সাথে উদারপন্থী ধারার সক্সঘাত স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এ সময় উদারপন্থী প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হোসেন মুসাভি কোণঠাসা হয়ে পড়লেও বিগত নির্বাচনে হাসান রুহানি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর উদারপন্থী ধারা ইরানি রাজনীতিতে আবার শক্তিমান হয়ে ওঠে।
আহমাদিনেজাদ ক্ষমতায় আসার পর পারমাণবিক ও ক্ষেপণাস্ত্র গবেষণায় একের পর এক সাফল্যের ঘোষণা দেয়ার ফলে অর্থনৈতিক অবরোধকে আরো জোরদার করা হয়। নিষেধাজ্ঞার মুখে ইরানকে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের জন্য চীন, রাশিয়া, ভারত ও ক্যারিবিয়ান দেশগুলোর সাথে বিনিময় ব্যবস্থা ও দ্বিপক্ষীয় মুদ্রা ব্যবহার পদ্ধতি অনুসরণ করতে হয়। ইরান তেল-গ্যাস বিক্রি করতে বাধ্য হয় বাজারদরের চেয়ে কম মূল্যে। এর প্রভাব ইরানি জাতীয় অর্থনীতিতে যেমন পড়ে, তেমনিভাবে ইরানিদের দৈনন্দিন জীবনকেও অনেকটাই দুর্বিষহ করে তোলে। আমদানিনির্ভর পণ্যসামগ্রীর দাম হয়ে পড়ে আকাশচুম্বী। মূল্যস্ফীতি মাত্রা ছাড়ানোভাবে বাড়তে থাকে।
এ ধরনের পরিস্থিতিতে বিগত নির্বাচনে সংস্কারপন্থী আয়াতুল্লাহ হাসান রুহানি বিপুল ভোটে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হবার পর খাতামির সূচিত, পাশ্চাত্যের সাথে সংলাপ প্রক্রিয়া নতুন জীবন লাভ করে। এদিকে, পাশ্চাত্য সাদ্দাম হোসেনের নেতৃত্বাধীন ইরাকের ওপর সর্বাত্মক অবরোধ আরোপ করে যেভাবে দেশটিকে অর্থনৈতিক ও প্রতিরক্ষা খাতে পর্যুদস্ত করতে সক্ষম হয়েছিল, সেভাবে ইরানের বিরুদ্ধে অবরোধ কার্যকর করতে পারেনি। অর্থনৈতিকভাবে কিছুটা প্রতিক‚লতা দেখা দিলেও বিকল্প ব্যবস্থা ও বলয় সৃষ্টি করে ইরান তার আন্তর্জাতিক বাণিজ্য চালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে অবরোধ ইরানের সামনে সৃষ্টি করে নতুন সম্ভাবনা। অবরোধের মধ্যেও ইরানের প্রতিরক্ষা সামর্থ্য এমন পর্যায়ে উন্নীত হয় যে, দেশটি ইরাক, সিরিয়া, লেবানন ও ইয়েমেনে প্রক্সিযুদ্ধ চালিয়ে নিজের সামর্থ্যরে প্রমাণ রাখতে সক্ষম হয়।
এ অবস্থায় পাশ্চাত্য ইরানকে নিয়ে কৌশলের পরিবর্তন করে। নাইন-ইলেভেনের পর আফগানিস্তানে তালেবান ও আলকায়েদাবিরোধী অভিযানে ইরানের সর্বাত্মক সহায়তা লাভ এবং সাদ্দামকে ক্ষমতাচ্যুতির অভিযানে সহযোগিতা ইরান-আমেরিকার মধ্যে একটি অভিন্ন স্বার্থ সমঝোতার বন্ধন তৈরি হয়। মধ্যপ্রাচ্যের মানচিত্র বিন্যাসের পরিকল্পনা বাস্তবায়নে শিয়াপ্রধান মুসলিম শক্তি ইরানকে কৌশলগত মিত্র হিসেবে পাওয়ার সম্ভাবনা যুক্তরাষ্ট্রের সামনে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। ইরানের উদারপন্থী নেতৃত্বও মনে করে, কট্টরপন্থীরা দেশটিকে যেভাবে অর্থনৈতিক দুর্দশার দিকে ঠেলে দিয়েছে, তাতে পারমাণবিক আলোচনার পথ ধরে অবরোধ তুলে নেয়া গেলে ইরানি অর্থনীতিতে বিপ্লবের সৃষ্টি হবে। এতে ইরানি জনগণের মধ্যে যে সমৃদ্ধি আসবে, তাতে উদারপন্থী রাজনীতির ভিত্তি স্থায়িত্ব পাবে।
পাশ্চাত্য নেতারা আহমাদিনেজাদের দ্বিতীয় দফা নির্বাচনের সময় ‘আরব বসন্ত’ অনুকরণে হোসেন মুসাভির সূচিত আন্দোলনে সর্বাত্মক সমর্থন জানিয়ে সুবিধা করতে পারেননি। তারা উপলব্ধি করেন, ইরানের ইসলামি বিপ্লবের শক্তি এতটাই সুগভীর যে, আরব জাগরণ মার্কা কোনো কিছু দিয়ে সেখানে ক্ষমতার পরিবর্তন আনা যাবে না। তারা মনে করছেন, পারমাণবিক আলোচনার পথ ধরে অবরোধ প্রত্যাহারের পর ইরানে যে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি আসবে, তাতে উদারপন্থীরা এক দিকে জনপ্রিয়তার শীর্ষে পৌঁছবেন, অন্য দিকে প্রাচুর্য ইরানের জনগণের মধ্যকার বিপ্লবী শক্তিকে নরম করে ফেলবে। সংস্কারের পথ ধরে ইরানি ব্যবস্থায় ধর্মীয় নেতা ও কট্টরপন্থীদের প্রভাব কমানো যাবে।
ইরানের বর্তমান উদারপন্থী শাসক ও পাশ্চাত্য নেতাদের এক অভিন্ন স্বার্থ-সম্পর্ক তাদের জটিল আলোচনার পর্ব পেরিয়ে একটি সফল চুক্তিতে আবদ্ধ করেছে। চুক্তির খুঁটিনাটি বিশ্লেষণে এখান থেকে পাশ্চাত্যের প্রত্যক্ষ এজেন্ডা যতটা অর্জিত হয়েছে, তার চেয়ে ইরানের প্রাপ্তি অনেক বেশি বলে প্রতীয়মান হয়। এমনকি একসময় বিশ্বে যে দুই পরাশক্তি ছিল রোমান ও পারস্য সাম্রাজ্য, ৬ জাতি ও ইরানের আলোচনার মধ্যে ইরানি জনগণের অনেকে সেই দুই সভ্যতার সমঝোতা দেখতে পেয়েছে।
ওবামার মধ্যপ্রাচ্য প্রস্থান কৌশল!
আমেরিকান প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ইরান চুক্তিকে অনেক বড় মাপের সাফল্য হিসেবে দেখাতে চাইছেন। তিনি চুক্তি স্বাক্ষরের পর বলেছেন, ‘ইতিহাস দেখিয়েছে- আমেরিকাকে অবশ্যই নেতৃত্ব দিতে হবে, এটি শুধু আমাদের শক্তি দিয়ে নয়, একই সাথে আমাদের নীতি দিয়ে। এই চুক্তি দেখিয়েছে, শুধু আমরা যখন একলা তখনই নয়, বরং যখন বিশ্বকে একসাথে নিয়ে এগোই তখনো আমরা শক্তিমান। ভিয়েনার আজকের চুক্তির ঘোষণা অধিক নিরাপত্তা, অধিক সাহায্যকারী ও অধিক আশাবাদী বিশ্বের জন্য নতুন পরিচ্ছেদ সৃষ্টি করল।’
ওবামা তার বক্তব্যে যে আশাবাদের কথা বলেছেন তা নিয়ে তার নিজ দেশেই রয়েছে সংশয়। রিপাবলিকান সমালোচকদের মতে, এ চুক্তির মাধ্যমে জাতিসঙ্ঘ-যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য পশ্চিমা দেশের আটকে দেয়া ১৫০ বিলিয়ন ডলারের সম্পদকে ইরানের এমন এক শাসনের হাতে তুলে দেয়া হবে যারা নিজেদের অভ্যন্তরীণ অর্থনীতিকে অবহেলা করে সিরীয় একনায়কের সাহায্যের জন্য সম্পদ ব্যয় করছে এবং তার পক্ষে রণাঙ্গনে ঠেলে দিচ্ছে নিজ দেশের নাগরিকদের। সম্পদের প্রবাহ তাদের আরো বেপরোয়া করবে এ কাজে।
অন্য দিকে, ডেমোক্র্যাটরা মনে করছেন, ওবামার পুরনো শত্রুর সাথে এটি নতুন এক মৈত্রীর সুযোগ এনে দেবে। এটি মধ্যপ্রাচ্যে সঙ্ঘাত নিরসনে সহায়তা করবে। ইরানের পারমাণবিক জ্বালানি সমৃদ্ধকরণকে এটি সীমিত করবে। এর মাধ্যমে আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থা নীতিগতভাবে সন্দেহভাজন সামরিক স্থাপনাগুলো পরিদর্শন করতে পারবে। ইরানের ইউরেনিয়াম খনি ও সমৃদ্ধকরণ ব্যবস্থায় আন্তর্জাতিক পরিদর্শন অনুমোদন করা হবে।
প্রশ্ন হলো, বিশ্বের অন্য অঞ্চলে কী বার্তা দিচ্ছে এ চুক্তি। বলার অপেক্ষা রাখে না, এটি কোনোভাবেই পারমাণবিক অস্ত্রমুক্ত বিশ্বের যে স্বপ্ন ওবামা দেখার কথা বলছেন, তার সুদৃঢ় ভিত্তি হতে পারবে না। আমেরিকান পররাষ্ট্র দফতর দীর্ঘ দিন যে ইরানকে সন্ত্রাসবাদে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতাদানের জন্য অভিযুক্ত করে আসছিল- ওবামার চুক্তি সে দেশকে সমৃদ্ধই করবে। এছাড়া ইরান তার ‘সন্ত্রাসী প্রক্সিদের’ সহায়তা করবে না, এ মর্মে কোনো অঙ্গীকার ছাড়াই এর রাজনৈতিক বৈধতা পেয়েছে এই চুক্তির মাধ্যমে।
আমেরিকান কৌশলবিদেরা মনে করেন, এত কিছুর পরও ওবামা যদি এ চুক্তির মাধ্যমে ইরানকে তার প্রতিশ্রুতির মধ্যে রাখতে পারেন এবং সময়ের পরিবর্তনে সরকারের পরিবর্তন আনতে পারেন, পারেন মধ্যপন্থীদের হাতে ক্ষমতা নিশ্চিত করতে, তবে ওবামা বিশ্বের ‘সবচেয়ে বিপজ্জনক’ শাসনের বিপজ্জনক অস্ত্রকে নিজ নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারবেন। কৌশলগত সুযোগ ইরানকে শত্রু থেকে বন্ধুতে রূপান্তর করতে পারে।
ওবামার দৃষ্টিকোণ থেকে চুক্তির সবচেয়ে বড় সুবিধা এই যে, আমেরিকা মধ্যপ্রাচ্যের নিয়ন্ত্রণ থেকে পুরোপুরি বিদায় নিতে পারবে। আমেরিকার এক দশকের বেশি সময় যুদ্ধ ও জাতি গঠন প্রয়াসের পর এ অঞ্চলটি নাইন-ইলেভেনের সময় যতটা অস্থির ও বিপজ্জনক ছিল, এখন তার চেয়েও অবস্থার অবনতি ঘটেছে। বিশ্বের এই অংশে আমেরিকা যা করতে পারে সম্ভবত তার প্রান্তসীমায় পৌঁছে গেছে। চূড়ান্ত বিচারে মনে হয়, এ চুক্তি আমেরিকার দৃঢ়চিত্তের কোনো স্মারক নয়, বরং যুক্তরাষ্ট্র যে ক্লান্তশ্রান্ত হয়ে পড়েছে, তারই লক্ষণ এখানে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
মধ্যপ্রাচ্যের নববিন্যাসে পরিণতি দেবে?
ইরানের সাথে সম্পাদিত পারমাণবিক চুক্তির গতানুগতিক ব্যাখ্যার বাইরে যারা কৌশলগত দিকের ওপর বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন, তাদের একজন হলেন ব্রিটিশ ইন্ডিপেন্ডেন্ট পত্রিকার মধ্যপ্রাচ্য প্রতিনিধি রবার্ট ফিস্ক। তার মতে, ভিয়েনা চুক্তি নিয়ে ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ও উপসাগরীয় রাজারা যতই ক্ষুব্ধ হন না কেন, মধ্যপ্রাচ্যে চলমান গোষ্ঠীগত যুদ্ধে আমেরিকানরা যে শিয়া মুসলমানদের পক্ষ নিলো, এই সত্য নিয়ে আরবদের সংশয় কমই থাকবে।
ফিস্কের মূল্যায়ন অনুযায়ী, চুক্তির মাধ্যমে সুন্নি মুসলমান জাতিগুলোর ব্যাপক প্রভাবের অবসান ঘটবে, যাদের সন্তানেরা ৯/১১-এর মানবতাবিরোধী অপরাধে নিজেদের উৎসর্গ করেছিল; যার কারণে পৃথিবীতে ওসামা বিন লাদেনের উত্থান হয়েছিল। আর যে যে উপসাগরীয় আমির ও রাজপুত্ররা আইসিসকে সমর্থন দিয়েছিলেন, শেষমেশ তাদেরও বিদায় নিতে হবে। ওয়াশিংটন উপসাগরীয় জরাগ্র— রাজপুত্রদের ব্যাপারে ক্লান্ত— হয়ে পড়েছে, বিরক্ত হয়ে পড়েছে।
ফিস্ক বলেছেন, মহাপ্রলয়তুল্য সুন্নি মুসলিম সংগঠন আইসিস ইরানের এই চুক্তিতে নেতানিয়াহুর মতো বিতৃষ্ণ হবে। এরা ইরানকে সব সময়ই ‘খারেজি’ রাষ্ট্র হিসেবে গণ্য করে। আর ইরানের ‘রক্তপিপাসু’ আগ্রাসনের নিন্দাও তারা সব সময়ই করেছে। অন্য দিকে, নেতানিয়াহু বলেছেন, ইরান এখন তার ‘রক্তপিপাসু আগ্রাসন’ চালাতে পারবে। খুবই সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য হলেও একই চুক্তিতে বেনিয়ামিন ও আইসিসকে পাওয়া তো অসামান্য ব্যাপার। আর যেহেতু সৌদি আরবও ইরান সম্বন্ধে একই দৃষ্টিভঙ্গি লালন করে, সেহেতু আমরা পরবর্তীকালে নানা ঘটনা ঘটতে দেখব। আর একজন সৌদি প্রিন্স তো ইরানকে নির্দয়ভাবে ‘সাপের মাথা’ আখ্যা দিয়েছেন। কিন্তু ইরানের নতুন মর্যাদার ব্যাপারে অন্যথা হওয়ার সম্ভাবনা নেই। সিগনোরা ফেদেরিকা মগেরিনি ভিয়েনায় বেশ সূক্ষ্মভাবে বলেছেন, ইরানের সামনে এখন ঐতিহাসিক সুযোগ এসেছে, তারা এখন মধ্যপ্রাচ্যে কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালনে আগ্রহ দেখাতে পারে। ইরান এ অঞ্চলেই দ্ব›দ্ব-বিবাদ মীমাংসা করার লক্ষ্যে তার প্রভাব কাজে লাগাতে পারে।
ফিস্ক মনে করছেন, ‘চুক্তির পর ওবামার পক্ষ থেকে উপসাগরীয় শাসকদের হয়তো বলা হবে, কোনো চিন্তা নেই, সবকিছু ভালোর জন্যই, আমাদের বিশ্বাস করুন প্রভৃতি। কিন্তু বেনিয়ামিনসহ সবাই মনে রাখবেন, ধ্বংস দেখেও উদ্ধারকারীদের না ডেকে হেঁটে চলে যাওয়ার অভ্যাস ওবামার আছে। জন কেরির কয়েক মাস আগে ফিলিস্তিন-ইসরাইলের প্রাচীন দ্বন্দ্ব মীমাংসা করার চেষ্টার সময় ওবামা যখন বুঝতে পারলেন, এই নৈরাশ্যজনক উদ্দেশ্য সাধন তার অমর ভাবমূর্তিকে উজ্জ্বল করবে না, তিনি তখন স্রেফ হেঁটে চলে গেলেন। এমনকি তিনি উদ্ধারকারীদেরও ডাকেননি। আর যে শব্দটি ভিয়েনায় গত আড়াই সপ্তাহে উচ্চারণই করা হয়নি, সেটা হলো ‘ফিলিস্তিন’।
মধ্যপ্রাচ্যের এখনকার বাস্তবতা আসলেই কী? এখন ইরাকের শাসকরা ইরানের নির্দেশনা অনুসারে কাজ করছেন। বাশার আল আসাদ টিকেই আছেন ইরানের সহযোগিতা অবলম্বন করে। ইয়েমেনের হুতিদের ক্ষমতা দখল লড়াই চালিয়ে যাওয়া সব কিছু ইরানের কল্যাণে। লেবাননের হিজবুল্লাহ বিরাট শক্তি হয়ে আঞ্চলিক পর্যায়ে লড়াইয়ে মদদ জুগিয়ে যাচ্ছে ইরানের পৃষ্ঠপোষকতায়। বাহরাইনে সুন্নি শাসকদের উৎখাত করার আন্দোলনে মদদ দিয়ে যাচ্ছে ইরানি শক্তি। সৌদি আরবের ভেতরের শিয়াদের সংগঠিত করা এবং সুবিধামতো সময়ে বিদ্রোহী করে তোলার গোপন কাজ করার অভিযোগ রয়েছে ইরানের বিরুদ্ধে। ইরান এসব কাজ করছে এমন এক সময়ে যখন গোটা বিশ্বের অবরোধ ও চাপের মুখে নানা সঙ্কটে দেশটি হাবুডুবু খাচ্ছিল। দেড় হাজার কোটি ডলারের আটকে থাকা সম্পদ অবমুক্ত হওয়ার পর গোটা বিশ্ব যখন ইরানিদের বাণিজ্যের জন্য উন্মুক্ত হয়ে যাবে তখন এই শক্তি যে মধ্যপ্রাচ্য নিয়ন্ত্রণের নিয়ামক হবে তাতে সন্দেহের অবকাশ সামান্যই থাকবে।
প্রশ্ন হতে পারে ইরান-আমেরিকা দৃশ্যমান নানামুখী বৈরী সম্পর্কের পর তারা পরিপূরক শক্তি হয়ে উঠবে কিভাবে? যারা গত দেড় দশকের আফগানিস্তান এবং ইরাকের ঘটনাগুলো কাছ থেকে বোঝার চেষ্টা করেছেন, তারা দেখবেন আলকায়েদা অনুসারী অনেক সৌদি নাগরিকের বিরুদ্ধে যখন নাইন ইলেভেনের সন্ত্রাসী হামলার অভিযোগে মার্কিন মিত্র শক্তি আফগানিস্তানে তালেবান সরকারকে উৎখাত করেছে, তখন সবচেয়ে বেশি সহযোগিতা করেছে ইরান এবং শিয়া হাজারাহ গোষ্ঠী। ইরাকে সাদ্দামকে উৎখাত এবং সাদ্দাম-পরবর্তী শাসন প্রতিষ্ঠায় ইরান ও ইরাকি শিয়ারা সহযোগিতা করেছে আমেরিকাকে। আর আমেরিকানরা বিনিময়ে ইরাকি শাসনকে ইরানি প্রভাবের কাছে সমর্পণ করেছেন। আজকের যে পারমাণবিক চুক্তি তার ভিত্তি সেই সহযোগিতার মধ্যে প্রতিষ্ঠিত।
ঐতিহাসিকভাবে শিয়া মুসলিম শক্তির সাথে পাশ্চাত্যের প্রত্যক্ষ দ্বন্দ্ব কম দেখা যায়। এ ধরনের দ্বন্দ্ব ইরানি জনগোষ্ঠীর ওপর স্বৈরাচারী শাহের নির্দয় পদক্ষেপগুলোকে আমেরিকার সমর্থনের কারণে প্রথম প্রকটভাবে লক্ষ করা যায়। ইরানি নেতাদের ফেদাইন দিয়ে নির্মূল করার প্রচেষ্টার পেছনে হাত দেখতে পেয়ে আমেরিকান কূটনীতিকদের পণবন্দি করার ঘটনায় এই প্রত্যক্ষ সক্সঘাত বিশেষভাবে বৃদ্ধি পায়। এরপর ইরানের ওপর অবরোধ ও যুদ্ধ চাপিয়ে দেয়া থেকে নানা পদক্ষেপ নেয় আমেরিকানরা। কিন্তু ইরান কখনো নিজ দেশের বাইরে আমেরিকাকে আঘাত করেনি। সুন্নি আলকায়েদা যেখানে আমেরিকান স্বার্থে আঘাত হানার ঘোষণা দিয়ে দাপিয়ে বেড়িয়েছে, সেখানে আমেরিকার বিরুদ্ধে ইরানি নেতাদের বক্তব্য ছিল রেটরিকের মধ্যে সীমিত। তারা কেবল নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার মধ্যে সামরিক ভূমিকা সীমিত রেখেছে। এ অবস্থায় পরমাণু চুক্তির পর মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকান ‘মানচিত্র বিন্যাস’ পরিকল্পনার সাথে ইরানের প্রভাব বিস্তারের বিষয়টি একই রেখায় এগোতে থাকলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। এ ক্ষেত্রে ইসরাইলের নিরাপত্তার বিষয়টির নিশ্চয়তা চাইতে পারে আমেরিকা। সেই নিশ্চয়তা নিশ্চয়ই এর মধ্যে নিশ্চিত হওয়া গেছে, যার ইঙ্গিত ফিস্ক দিয়েছেন আড়াই সপ্তাহের আলোচনায় ফিলিস্তিন ইস্যুটি একবারেই অনুচ্চারিত থাকার বিষয়টি উল্লেখ করে।
মধ্যপ্রাচ্যের সুন্নি শাসকদের অসুবিধার দিকটি হলো, ইরানের রাষ্ট্র এবং জনগণের শক্তি যেখানে প্রায় একই রেখায় চলছে, সেখানে আরব শাসকদের সাথে জনগণের সম্পর্ক সেই মাত্রায় নেই। মধ্যপ্রাচ্যে সুন্নি জনগণের দুই প্রধান শক্তি হলো মুসলিম ব্রাদারহুড এবং সালাফিরা। সালাফিদের একাংশ আলকায়েদা এবং আইএসের সাথে সম্পর্কিত। বাদশাহ আবদুল্লাহর রাজত্বকালের শেষ দিকে সৌদি আরব এই দুই শক্তির সাথে এমন দূরত্ব তৈরি করে, যা ঘুচানো পরবর্তী বাদশাহ সালমানের পক্ষে বেশ কঠিন হচ্ছে। মিসরে সিসি নামের যে দৈত্যটি নেতানিয়াহু-আবদুল্লাহ যৌথভাবে সৃষ্টি করেছিলেন, সেটি এখন বিভিন্ন সময় ফণা উচ্চকিত করতে চাইছে খোদ রিয়াদের দিকে। আর আইএস যে প্রক্রিয়ায় নিজের খেলাফত প্রতিষ্ঠা করেছে, তার প্রতি সমর্থন জোগানো এবং রাষ্ট্র হিসেবে ইরানি প্রভাবের সামনে সেটাকে টিকিয়ে রাখার কোনো সুযোগ আরব শাসকদের থাকছে না। বরং অনেক সময় তারা বুঝে উঠতে পারেন না তাদের সামনে বড় হুমকি কি ইরান নাকি আইএস ।
মধ্যপ্রাচ্যের ভবিষ্যৎ গতি-প্রকৃতির একটি ইঙ্গিত রবার্ট ফিস্ক ও অন্য বিশ্লেষকেরা দিয়েছেন। এই গতি-প্রকৃতির রূপরেখা কেউ স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেননি। কেবল একটি চিত্র প্রকাশ করেছিল আমেরিকান আর্মড ফোর্সেস জার্নাল বেশ কয়েক বছর আগে, যেখানে মধ্যপ্রাচ্যের এখনকার বড় বড় দেশগুলোকে ভেঙে বহুধাবিভক্ত করা এবং ছোট দেশগুলোর কয়েকটিকে জোড়া লাগানো হয়। সেটি সহজে বা স্বল্প সময়ে বাস্তবায়ন হয়ে যাবে এমনটি মনে করার কারণ নেই। তবে পাশ্চাত্য নিয়ন্ত্রকরা মধ্যপ্রাচ্যে শিয়া-সুন্নি শক্তির দ্বন্দ্ব আরো অনেক দিন লাগিয়ে রাখতে চাইবে। আইএস রাষ্ট্রও সহসা হয়তো শেষ হবে না। ইরান ও তার প্রক্সি মিত্ররা শক্তিশালী হবে, তবে মাঠে একতরফা আধিপত্য বিস্তারকে মেনে নেয়া হবে বলে মনে হয় না। এর মধ্যে, চাপে থাকা মুসলিম ব্রাদারহুডের মতো দল নতুন শক্তিমত্তা নিয়ে আবিভূত হতে পারে মধ্যপ্রাচ্যে।

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button