রমজান-সিয়ামের গুরুত্ব

Ramadanএইচ এম মুশফিকুর রহমান: রমজান হলো আত্মশুদ্ধির মাস, ধৈর্যের মাস, সহানুভূতির মাস; কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ ও মাৎসর্য নামক ষড়রিপু বশীভূত করার মাস। রমজান রহমতের মাস, মাগফিরাতের মাস, দোজখ থেকে নাজাতের মাস। রমজান প্রতি বছর আসে পাপ-পঙ্কিলতায় জর্জরিত মানবজাতিকে সীমাহীন রহমতের ছায়ায় চিরশান্তির আবাস জান্নাতে প্রবেশ করিয়ে দিতে।
এই সে মাস, যে মাসে নাজিল হয়েছে পবিত্র কুরআন, যে মাসে মুমিনের রিজিক বৃদ্ধি করে দেয়া হয়, যে মাসে প্রত্যেকটি ফরজ ইবাদাতের সওয়াব অন্য মাসের চেয়ে সত্তর গুণ বৃদ্ধি করা হয়, যে মাসের প্রতি রাতে আল্লাহ পাকের তরফ থেকে মাগফিরাত দানের কথা ঘোষণা করা হয়, যে মাসে কবরের আজাব বন্ধ করে রাখা হয়।
শাবান মাসের বিদায়ের সাথে সাথে পশ্চিম আকাশে একফালি বাঁকা চাঁদ উদিত হওয়ার মাধ্যমে মুসলিম বিশ্বের মুসলমানদের দ্বারে ফিরে আসে মহিমান্বিত মাস রমজান। হিজরি বছরের নবম মাস রমজান বা মাহে রমজান।
রমজানই একমাত্র মাস, যার নাম উল্লেখ করে কুরআনে বলা হয়েছে, ‘রমজান মাস, ইহাতেই কুরআন মাজিদ নাজিল করা হয়েছে’ (সূরা বাকারা : ১৮৫)।
রহমত, বরকত আর নাজাতের সওগাত নিয়ে এটি ধনী-গরিব, ছোট-বড়, আরব-অনারব সবার কাছে ফিরে আসে। এ মাসে সিয়াম সাধনার মাধ্যমে মুমিন মুসলমানেরা তাদের ঈমানি চেতনা জাগ্রত করে এবং আত্মশুদ্ধি অর্জনের মাধ্যমে আল্লাহর নিবেদিত বান্দা হওয়ার মহান সুযোগ লাভ করে।
পবিত্র রমজানের ফজিলত প্রত্যেক মুসলমানের জন্য নিয়ামাতস্বরূপ। ইসলামের পাঁচটি রোকনের মধ্যে সিয়াম পালন তৃতীয় স্তম্ভ। পবিত্র রমজান মাসে সিয়াম পালন করা ফরজ করা হয়েছে। ইবাদাত পালনের মধ্যেই মানুষের সর্বাধিক ত্যাগ-সংযম, ধৈর্য ও সহিষ্ণুতার প্রমাণ মেলে এবং শারীরিক-মানসিক ও নৈতিকতাসহ সর্বক্ষেত্রে পবিত্র রমজানের রহমত, নিয়ামত ও সাওয়াব অর্জন হয়।
পবিত্র সিয়াম সাধনার মাস রমজান। বিশ্বের সব ধর্মপ্রাণ মুসলমানের কাছে এ মাসটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। পার্থিব লোভ-লালসামুক্ত থাকা, ত্যাগ-সহিষ্ণুতার সাধনা করা এবং মানবিক মূল্যবোধে তৈরি হওয়ার প্রশিক্ষণে এ মাসের গুরুত্ব অপরিসীম।
মানবিক জীবনকে সুন্দর ও পারলৌকিক মুক্তির নিশ্চয়তা দেয় রমজানের সিয়াম সাধনা। পারস্পরিক সহমর্মিতা ও সৌহার্দ্যবোধের মাধ্যমে আত্মশুদ্ধির মহান শিক্ষা অনুশীলনে পবিত্র রমজানের ভূমিকা অনস্বীকার্য। সত্য-অসত্য, পাপ-পুণ্য এবং ভালো-মন্দের যথার্থ উপলব্ধির মাধ্যমে মানবজীবনকে মহীয়ান ও সফল করে গড়ে তোলার লক্ষ্যেই রমজানের আগমন। এ মাসের ত্যাগ ও সংযমের মহান শিক্ষা আমাদের জন্য রহমত ও বরকতের পাল্লা ভারী করে। অন্য দিকে, সমাজ জীবনে সাম্য প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে রমজানের গুরুত্ব অপরিসীম। তারাবি আদায়, ইফতার, সেহরি, দান-খয়রাত, জাকাত-ফিতরা আদায়, লাইলাতুল কদর, ঈদ উদযাপনের মাধ্যমে ধনী-গরিবের মধ্যকার ভেদাভেদ ভুলে মুসলমান জাতি মহান এ মাসে একাত্ম হয়।
রমজান মুমিন মুসলমানের কাছে মেহমানস্বরূপ আগমন করে। মেহমানের প্রতি ইজ্জত ও তাজিম একটি জরুরি বিষয়। রমজানের আগমন থেকে শাওয়ালের চাঁদ উদিত হওয়া পর্যন্ত প্রতিটি সেকেন্ড, প্রতিটি মুহূর্ত রহমত ও বরকতমণ্ডিত। প্রতি বছরের মতো এবারো পবিত্র রমজানুল মুবারক আমাদের মাঝে রহমত, মাগফিরাত ও নাজাতের বার্তা নিয়ে হাজির। রাসূল সা: রমজান মাস পাওয়ার জন্য প্রত্যেক বছর রজব মাস অর্থাৎ রমজানের দুই মাস পূর্ব হতে আল্লাহর কাছে দোয়া করতেন। সেই পবিত্র সুমহান মাসটিকে আমরা হৃদয়ের সব উষ্ণতা দিয়ে জানাই স্বাগতম। আহলান সাহলান মাহে রমজান।
রমজানের মাহাত্ম্য
এ মাসে সিয়াম পালন করা ফরজ করা হয়েছে : কুরআনুল কারিমে বলা হয়েছে, ‘সুতরাং তোমাদের মধ্যে যে মাসটিতে উপস্থিত হবে, সে যেন তাতে সিয়াম পালন করে ’ (সূরা আল বাকারাহ : ১৮৫)।
রমজান কুরআন অবতীর্ণের মাস : এ মাসেই বিশ্বমানবতার মুক্তির সনদ, চিরন্তন, শাশ্বত, সর্বজনীন জীবনবিধান, কল্যাণ ও সফলতার একমাত্র চাবিকাঠি কুরআনুল কারিম অবতরণ করা হয়। এ প্রসঙ্গে স্বয়ং আল্লাহু সুবাহানাহু তায়ালা বলেন, ‘এই রমজান মাসেই কুরআন নাজিল করা হয়েছিল’ (সূরা আল বাকারাহ : ১৮৫)।
রমজানের মধ্যেই রয়েছে হাজার মাসের চেয়ে শ্রেষ্ঠ ‘লাইলাতুল কদর’ : পবিত্র কুরআনুল কারিমে বলা হয়েছে ‘লাইলাতুল কদর’ (মহিমান্বিত রজনী) সহস্র মাস অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ। সে রাতেই ফেরেশতাগণ ও রূহ অবতীর্ণ হয় প্রত্যেক কাজে তাদের প্রতিপালকের অনুমতিক্রমে। শান্তিই শান্তি, সেই রজনী ঊষার আবির্ভাব পর্যন্ত’ (সূরা কাদর : ৩-৫)।
পুণ্যের প্রতিদান বহুগুণে বাড়িয়ে দেয়া হয় : সালমান ফারসি রা. থেকে বর্ণিত, ‘রাসূল সা: বলেন, যে রমজান মাসে নফল এবাদত আদায় করবে অন্য মাসের ফরজ এবাদতের সমতুল্য সওয়াব পাবে এবং যে ব্যক্তি রমজান মাসে একটি ফরজ আদায় করবে সে অন্য মাসের সত্তরটি ফরজ আদায় করার সমপরিমাণ সওয়াব পাবে’ (মিশকাত : ১/১৭৩)।
রমজান মাসে জান্নাতের দরজাগুলো খুলে দেয়া হয় এবং জাহান্নামের দরজাগুলো বন্ধ করে দেয়া হয় : রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘যখন রমজান আসে তখন জান্নাতের দরজাগুলো খুলে দেয়া হয় আর জাহান্নামের দরজাগুলো বন্ধ করে দেয়া হয় এবং শয়তানদের আবদ্ধ করা হয়’ (সহিহ মুসলিম :২৫৪৭)।
এ রমজান মাসে লাইলাতুল কদরের রাত রয়েছে : রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘এ মাসে আল্লাহ কর্তৃক একটি রাত প্রদত্ত হয়েছে, যা হাজার মাস হতে উত্তম। যে এর কল্যাণ হতে বঞ্চিত হলো, সে বঞ্চিত হলো (মহাকল্যাণ হতে)’ (সুনান তিরমিজি : ৬৮৩)।
এ মাসে দোয়া কবুল হয় : রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘রমজানের প্রতি দিনে ও রাতে আল্লাহ তায়ালা অনেককে মুক্ত করে দেন। প্রতি রাতে ও দিনে প্রতি মুসলিমের দোয়া কবুল করা হয়’ (সহিহ আত-তারগিব ওয়াত তারহিব : ১০০২)।
সিয়ামের মাহাত্ম্য
সিয়াম পালনকারীর মুখের গন্ধ আল্লাহর কাছে মিশ্কের চেয়েও উত্তম : আবু হুরায়রা রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘যার হাতে মুহাম্মাদ সা:-এর জীবন সে সত্তার শপথ করে বলছি, সিয়াম পালনকারীর মুখের গন্ধ আল্লাহ তায়ালার কাছে মিশকের ঘ্রাণের চেয়েও প্রিয় হয়ে যায়’ (মুসনাদ আহমাদ : ৭৪৮৫, সহিহ)।
সিয়াম পালনকারীর জন্য রয়েছে দু’টি বিশেষ আনন্দ মুহূর্ত : রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘সিয়াম পালনকারীর জন্য দু’টি বিশেষ আনন্দ মুহূর্ত রয়েছে। একটি হলো ইফতারের সময়, দ্বিতীয়টি হলো তার রবের সাথে সাক্ষাতের সময়’ (সহিহ মুসলিম :২৭৬৩)।
সিয়াম পালনকারীর পূর্বেকার গুনাহ মাফ করে দেয়া হয় : আবু হুরায়রা রা: বলেন, রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে সাওয়াব হাসিলের আশায় রমজানে সিয়াম পালন করবে, তার অতীতের সব গুনাহ মাফ করে দেয়া হবে (সহিহ বুখারি : ৩৮, সহিহ মুসলিম : ১৮১৭)।
সিয়াম কিয়ামতের দিন সুপারিশ করবে : রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘সিয়াম ও কুরআন কিয়ামতের দিন মানুষের জন্য এভাবে সুপারিশ করবে যে, সিয়াম বলবে, হে আমার রব, আমি দিনের বেলায় তাকে (এ সিয়াম পালনকারীকে) পানাহার ও যৌনতা থেকে বিরত রেখেছি। তাই তার ব্যাপারে তুমি আমার সুপারিশ কবুল করো। অনুরূপভাবে কুরআন বলবে, হে আমার রব, আমাকে অধ্যয়নরত থাকায় রাতের ঘুম থেকে আমি তাকে বিরত রেখেছি। তাই তার ব্যাপারে তুমি আমার সুপারিশ কবুল কর। তিনি বলেন, অতঃপর উভয়ের সুপারিশই কবুল করা হবে’ (সহিহ আত-তারগিব ওয়াত তারহীব :১৪২৯)।
আল্লাহ স্বয়ং নিজে সিয়ামের প্রতিদান দেবেন : আবু হুরায়রা রা: বলেন, রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘মানুষের প্রতিটি ভালো কাজ নিজের জন্য হয়ে থাকে, কিন্তু সিয়াম শুধু আমার জন্য। অতএব, আমি নিজেই এর প্রতিদান দেব’ (সহিহ বুখারি : ১৯০৪)।
রমজান ও সিয়াম পালন আমাদের জীবনে বয়ে আনতে পারে অপরিসীম কল্যাণ। রমজান ও সিয়ামের উদ্দেশ্যাবলি অর্জন করতে পারলে আমাদের জীবন হয়ে উঠবে সুন্দর, পূত-পবিত্র ও মহিমান্বিত। রমজান ও সিয়াম থেকে যথার্থ কল্যাণ পেতে হলে, আমাদের ব্যক্তিগত ও সামাজিকভাবে সিয়ামের যথার্থ অনুশীলন করতে হবে। রমজানের পবিত্রতা বিরোধী সব অপতৎপরতা বন্ধ করতে হবে। মানুষের প্রতি বিশেষ করে সমাজের অসচ্ছল-অভাবী মানুষের প্রতি সহানুভূতিশীল-দয়ার্দ্র হতে হবে। সমাজে ও রাষ্ট্রে দ্বীনি পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। সর্বত্র পাপ ও দুষ্কৃৃতির বদলে পুণ্য ও খোদাভীতির পরিবেশ তৈরি করতে হবে। শোষণ ও নির্যাতনমূলক সব কার্যক্রম যেমন- দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, ভেজাল দেয়া, ধোঁকা-প্রতারণা, মুনাফাখোরি ইত্যাদি বন্ধ করতে হবে। রমজানে বিভিন্ন প্রকার অপচয় বন্ধ করে প্রয়োজনের অতিরিক্ত অভাবী শ্রেণীকে দিতে হবে। সব মুসলমানের মধ্যে রমজানের শিক্ষা ও ভাবধারার প্রসার ঘটানো এবং সবাইকে সিয়ামের যথার্থ আনুশীলনে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। রমজানের প্রতিটি মুহূর্তকে কাজে লাগানোর জন্য সচেষ্ট হতে হবে। এসব কাজ করতে পারলেই এবারের রমজানের সিয়াম আমাদের দান করবে অফুরন্ত নিয়ামত।
লেখক : প্রাবন্ধিক

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button