সাহসিকতার জন্য ক্ষমা চাই

A Hamidহামিদ মীর: পাকিস্তান এতটা দুর্বল নয়, যতটা কিছু পাকিস্তানি ভাবে। কিছু পাকিস্তানির ভাবনা হলো, বিশ্বের সপ্তম পারমাণবিক শক্তিধর রাষ্ট্র আরব দেশগুলোর চাপ সহ্য করতে পারবে না। পরিশেষে পাকিস্তানকে সৌদি আরবে সৈন্য পাঠাতেই হবে। এটাও বলা হচ্ছে যে, ইয়েমেন সঙ্কটের ব্যাপারে পাকিস্তানের পার্লামেন্টের প্রস্তাবের কোনো মূল্যই নেই। কেননা প্রস্তাবে বলা হয়েছে, পাকিস্তান ইয়েমেনের বিদ্রোহী ও সৌদি আরবের মধ্যে চলমান বিরোধে কোনো পক্ষ অবলম্বন না করে মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা পালন করবে। সৌদি সরকারের মন্ত্রীরা মধ্যস্থতার প্রস্তাবকে হাস্যকর আখ্যায়িত করে প্রত্যাখ্যান করেছেন। পাকিস্তানের ওপর যখন চাপ বাড়ল, তখন প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ পার্লামেন্টের প্রস্তাবের ব্যাখ্যা প্রদান করেন।
তিনি আরব বন্ধুদের বলেন, যদি সৌদি আরবের ওপর কোনো প্রকার হামলা হয়, তাহলে পাকিস্তান আপনাদের পাশে গিয়ে দাঁড়াবে। তবে বর্তমানে আমরা ইরানের মাধ্যমে অস্ত্রবিরতির জন্য ইয়েমেনের বিদ্রোহীদের ওপর চাপ সৃষ্টি অব্যাহত রাখব। আমি এ কথা বলতে চাই, পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ ইয়েমেনের বিদ্রোহীদের পক্ষে নেই। বরং তারা সৌদি আরবের সাথে আছে। তবে ইয়েমেনের গৃহযুদ্ধে তারা কোনো পক্ষের হতে রাজি নয়। আফসোস হয়, কিছু দয়ালু মানুষ এ বিষয়ে সতর্কতার সাথে কাজ করছেন না। কিছু মুহতারাম আলেম পার্লামেন্টের প্রস্তাবকে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র সাব্যস্ত করেছেন এবং পাকিস্তানিদেরকে হারামাইন শরিফাইন রার নামে বিভক্ত করার চেষ্টা করেছেন।
কাউকে পাকিস্তানের চেয়ে সৌদি আরব আবার কাউকে ইরানের জন্য নিবেদিতপ্রাণ দেখা যাচ্ছে। কেউ তো মুসলমানদের মাঝে গৃহযুদ্ধকে ইসলাম ও কুফরের লড়াইয়ে রূপ দান করেছেন। আবার কেউ বলেছেন, সৌদি আরবে নওয়াজ শরিফের ব্যক্তিস্বার্থ পাকিস্তানকে কোনো বড় বিপদে ফেলে দেবে। একটা বেশ গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন রয়েছে। সেটা হচ্ছে, সৌদি আরব, মিসর, জর্দান, সুদান, কুয়েত, কাতার, বাহরাইন ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের সৈন্যদের সম্মিলিত করলে তাদের সংখ্যা ১০ লাখের চেয়ে বেশি হবে। তাদের কাছে কয়েক হাজার ট্যাঙ্ক ও যুদ্ধবিমানও রয়েছে। তারপরও সৌদি আরব পাকিস্তানের সৈন্যদের কেন নিতে চাচ্ছে? এ যুক্তি-প্রমাণও দেয়া হচ্ছে যে, সৌদি আরবের পক্ষ থেকে ইয়েমেনের এক বৈধ সরকারের সহায়তা করা হচ্ছে, যার বিরুদ্ধে বিদ্রোহীরা যুদ্ধের ঘোষণা দিয়ে রেখেছে। এই বৈধ সরকারের সাহায্য করা মানে কোনো বিরোধে কারো পাবলম্বন নয়। এ যুক্তিটা বাস্তবিকই বেশ ওজনদার। আর সম্ভবত এ জন্য প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফও মনসুর হাদির সরকারের সহায়তা করেছেন। তবে এখানে আরো একটা প্রশ্ন জন্ম নেয়। এ প্রশ্ন তোলার উদ্দেশ্য কারো আবেগকে আঘাত দেয়া বা কাউকে তুচ্ছ করা নয়, বরং সাংবাদিক ও রাজনৈতিক দায়িত্ববোধ পালন করা। এ সাহসিকতার জন্য ক্ষমা চাচ্ছি।
সাহসিক প্রশ্নটা হচ্ছে, ২০১২ সালে মিসরে মুহাম্মদ মুরসির নেতৃত্বে একটি সাংবিধানিক বৈধ সরকার গঠিত হয়। মুহাম্মদ মুরসির সাথে রাজনৈতিক মতবিরোধ করা হয়েছে। তারপরও তিনি প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে মতায় আসেন। ২০১৩ সালে ফিল্ড মার্শাল আবদুল ফাত্তাহ সিসি মুরসির বৈধ সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেন। কায়রোতে ইখওয়ানুল মুসলিমিনের (মুসলিম ব্রাদারহুড) সমর্থকদের ওপর ট্যাঙ্ক চালিয়ে দেয়া হয়। মুহাম্মদ মুরসির বৈধ সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের ওপর আরব দেশগুলোর বেশির ভাগই নীরব থাকে। গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের ধ্বজাধারী আমেরিকাও নীরব থাকে। জাতিসঙ্ঘের নিরাপত্তা পরিষদও ঘুমিয়ে থাকে। তবে নওয়াজ শরিফ সরকারের পক্ষ থেকে মিসরে সেনাবিদ্রোহের নিন্দা জানিয়ে এক বিবৃতি প্রকাশ করা হয়েছিল। অল্প বললাম, আরো যা আছে তা বুঝে নিন। যদি আরব দেশগুলোর নেতারা মুহাম্মদ মুরসির সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহে নীরব না থাকতেন, তাহলে সম্ভবত ইয়েমেন সঙ্কটে পাকিস্তানের জনমতের অবস্থানও ভিন্ন হতো। আজ মিসরে একজন সেনা স্বৈরশাসকের অবৈধ সরকার প্রতিষ্ঠিত, যে সরকার কিনা ইয়েমেনের বৈধ সরকারকে সাহায্য করার অভিনয় প্রদর্শনে ব্যস্ত। মিসরের সেনা স্বৈরশাসক আর ইয়েমেনের বিদ্রোহীর মাঝে কোনো পার্থক্য নেই। সেনা স্বৈরশাসক আমেরিকার সহায়তায় মুহাম্মদ মুরসির বৈধ সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে। আর ইয়েমেনের বিদ্রোহীরা ইরানের সহায়তায় মনসুর হাদির বৈধ আইনগত সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছে। যদি মনসুর হাদির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ অন্যায় হয়, তাহলে মুহাম্মদ মুরসির বিরুদ্ধে বিদ্রোহও অন্যায় ছিল। সাহস নিয়ে বলা আমার এই কথাগুলো যদি অপছন্দ হয়, তাহলে আমায় ক্ষমা করে দেবেন।
রাজনৈতিক ও ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে তাকালে দেখা যায়, সৌদি আরব সর্বদা সব দুঃসময়ে পাকিস্তানকে সাহায্য করেছে। কিন্তু এটাও এক ঐতিহাসিক সত্য যে, যখন পাকিস্তান সৃষ্টি হয়নি, তখন কোনো আরব বাদশাহ পাকিস্তান আন্দোলনের সহায়তা করেননি। বরং ওই সময় ইখওয়ানুল মুসলিমিনের প্রতিষ্ঠাতা হাসানুল বান্না পাকিস্তান আন্দোলনের সহায়তাকারীদের মধ্যে আগে আগে ছিলেন। হাসানুল বান্না ও কায়েদে আযমের মাঝে সরাসরি যোগাযোগ ছিল। ১৯৪৭ সালের ২৮ মে হাসানুল বান্না কায়েদে আযমের নামে লেখা তার পত্রে পাকিস্তান আন্দোলনের প্রতি পূর্ণ সমর্থন ব্যক্ত করে বলেছিলেন, সমগ্র নীল উপত্যকা বিশ্বাস করে যে, আপনি অতি দ্রুত স্বাধীনতার গন্তব্যে গিয়ে পৌঁছবেন। আল্লামা ইকবালের কবিতা ও রচনাবলী অধ্যয়ন করলে জানা যায় যে, তিনি আরব বাদশাহদের ব্যাপারে নিরাশ ছিলেন। তিনি খেলাফত ও রাজতন্ত্রের মাঝে কী পার্থক্য, তা মুসলমানদের বোঝানোর চেষ্টা করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন-আরাব খোদ রা বে নূরে মুসতাফা সুখ্ত্/চেরাগে মুরদেয়ে মাশরিক বার আফ্রুখ্ত্/ওয়ালিকেন্ অন্ খেলাফাত রাহ্ গোম্ কার্দ/কে আরোয়াল্ মুমিনান্ রা শাহি অ’মুখ্ত্। আরব নিজেদেরকে নূরে মুস্তফায় প্রজ্বলিত করেছিল/তারা পাশ্চাত্যের মৃত প্রদীপ জ্বালিয়েছিল।/তবে তারা (এখন) খেলাফতের রাস্তা হারিয়ে ফেলেছে/যা মুমিনদেরকে রাজ্যশাসন শিখিয়েছিল।
অর্থাৎ প্রথম যুগে আরবরা নিজেরা নিজেদের রাসূলুল্লাহ সা:-এর আনীত ঈমানের আলোয় আলোকিত করে পাশ্চাত্যের মৃত প্রদীপকে প্রজ্বলিত করেছিল। কিন্তু এখন তারা ওই খেলাফতের রাস্তা হারিয়ে ফেলেছে, যে খেলাফত মুসলমানদের শাসন পরিচালনার ধরন ও পদ্ধতি শিখিয়েছিল।
ইকবাল আরো বলেন-
চিস্ত তাকদিরে মুলুকিয়াত? শেকাক্
মোহকামি জুস্তান্ যে তাদ্বিরে নেফাক্।
রাজতন্ত্রের নিয়তি কী? শত্রুতা
দ্বিমুখী কর্মকৌশল দ্বারা দৃঢ়তা অনুসন্ধান।
অর্থাৎ রাজতন্ত্রের শাসন পরিচালনার ধরন ও পদ্ধতি কী ? শত্রুতা ও মতানৈক্য সৃষ্টি করা এবং কপটতা ও দ্বিমুখী কর্মকৌশল দ্বারা দৃঢ়তা অর্জন করা।
ইকবাল এক দিকে রাজতন্ত্রের বিরোধী ছিলেন, অপর দিকে পশ্চিমা গণতন্ত্রকেও তিনি পছন্দ করতেন না। তিনি তার বক্তৃতায় আধ্যাত্মিক গণতন্ত্রের কথা বলেছেন। কিছু সমালোচকের ধারণা, ইকবাল এক দিকে রাজতন্ত্রের বিরোধিতা করেছেন, অপর দিকে আফগানিস্তানের বাদশাহর প্রশংসায় কাসিদা রচনা করেছেন। আফগান বাদশাহ গাজী আমানুল্লাহ ও নাদের শাহের সাথে আল্লামা ইকবালের অবশ্যই সম্পর্ক ছিল। তবে ওই দুই বাদশাহ ও আরব বাদশাহদের মধ্যে বেশ পার্থক্য ছিল। আরব বাদশাহ ব্রিটিশ উপনিবেশবাদের সহায়তায় ক্ষমতায় এসেছিলেন। পক্ষান্তরে গাজী আমানুল্লাহ ১৯১৯ সালে আফগানিস্তানে ব্রিটেনের প্রভাব থেকে বের হওয়ার জন্য ব্রিটিশ সৈন্যের ওপর হামলা করেন। তিনি আফগানিস্তানে সংস্কারমূলক গণতন্ত্র চালু করেন। আল্লামা ইকবাল নাদের শাহের কাছের মানুষ হওয়ার কারণ ছিল, নাদের শাহ ভারতের স্বাধীনতাকামীদের আফগানিস্তানে আশ্রয় দিয়েছিলেন। আল্লামা ইকবাল ১৯২৯ সালে আফগানিস্তানে ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে নাদের শাহকে পরিপূর্ণরূপে নৈতিক ও আর্থিক সাহায্য করেছিলেন। তিনি তার সারা জীবনের সঞ্চয় ১০ হাজার রুপি তাকে প্রদান করেছিলেন। ১৯৩৩ সালে আল্লামা ইকবাল আফগানিস্তান গেলে নাদের শাহ ব্রিটিশ সরকারের গ্রেফতারি পরোয়ানাপ্রাপ্ত হাজী সাহেব তুরাঙ্গজায়িসহ রেশমি রুমাল আন্দোলনের নেতা মাওলানা মুহাম্মদ মিয়া ও মাওলানা মুহাম্মদ বশিরের সাথে তার সাক্ষাৎ করিয়ে দেন। নাদের শাহ ব্রিটিশ সরকারের বিদ্রোহীদের আশ্রয় দিয়েছিলেন। অথচ একটু ভেবে দেখুন, আজ ফিলিস্তিনি স্বাধীনতাকামীরা দ্বারে দ্বারে মাথা ঠুকরে যাচ্ছে। ইসরাইল গাজায় যখন বর্বরোচিত বোমাবর্ষণ করে, তখন আরব লিগের কোনো জরুরি বৈঠক হয় না। ইয়েমেনে যখন মনসুর হাদির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ হলো, তখন আরব লিগ তাৎক্ষণিক জরুরি বৈঠক ডেকে মাত্র ৪০ হাজারের যৌথ বাহিনী গঠনের ঘোষণা করেছে। আর বাকি সৈন্য পাকিস্তানের কাছে চেয়েছে। পাকিস্তান তার অভ্যন্তরীণ সমস্যার কারণে সৈন্য প্রেরণে অপারগতা প্রকাশ করলে কিছু আরব শেখ পাকিস্তানের ব্যাপারে ভ্রাতৃত্বসুলভের পরিবর্তে প্রভুসুলভ ভাষা ব্যবহার করেন। প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের ব্যাখ্যার পর আরো বেশি স্পষ্ট ব্যাখ্যার জন্য শাহবাজ শরিফকে সৌদি আরব পাঠানো হয়। তিনি সৌদি আরবকে শতভাগ সাহায্যের আশ্বাস দিয়েছেন। জনাব, তাদের কাছে এ প্রশ্ন করার সাহসটুকু দেখান, যদি ইয়েমেনে মনসুর হাদির সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ অবৈধ হয়, তাহলে মিসরে মুহাম্মদ মুরসির সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ কিভাবে বৈধ হয় ?
পাকিস্তানের জাতীয় উর্দু পত্রিকা দৈনিক জং ১৬ এপ্রিল ২০১৫ থেকে ভাষান্তর ইমতিয়াজ বিন মাহতাব
লেখক : পাকিস্তানের জিও টিভির নির্বাহী সম্পাদক

আরও পড়ুন

আরও দেখুন...
Close
Back to top button