ইসলামিস্ট-সেকুলারিস্ট সঙ্ঘাতের নেপথ্যে

মাসুমুর রহমান খলিলী: মধ্যপ্রাচ্য থেকে আরব বসন্তকে বিদায় করতে মিসরের পর দ্বিতীয় লক্ষ্য করা হয়েছে তিউনিসিয়াকে। এ লক্ষ্যে বামপন্থী উদারনৈতিক বিরোধীদলীয় নেতা মোহাম্মদ ব্রাহিমিকে তার পরিবারের সদস্যদের সামনেই গুলি করে হত্যা করা হয়। সাথে সাথেই এর প্রতিক্রিয়া ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে। বিক্ষোভকারীরা সেনাবাহিনীর প্রতি নির্বাচিত সরকার উৎখাতের আহ্বান জানাতে শুরু করে। হত্যার জন্য দায়ী করা হয় আননাহদার নেতৃত্বাধীন কোয়ালিশন সরকারকে। তিউনিসিয়ার সরকার বলছে, এর আগে বিরোধীদলীয় প্রধান নেতা চকর বেলাইদকে যারা যেভাবে হত্যা করেছে, একইভাবে হত্যা করা হয় ব্রাহিমিকে। ক্ষমতাসীন ইসলামি দল আননাহদার নেতা ড. রশিদ ঘানুশির এ প্রসঙ্গে দেয়া বক্তব্যটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। তিনি তুর্কি দৈনিক জামানের সাথে এক সাক্ষাতকারে বলেছেন, তার দেশের সেকুলারপন্থী নেতাদের হত্যাকাণ্ডের লক্ষ্য হচ্ছে তিউনিসিয়ার গণতান্ত্রিক অগ্রগতির পথ বন্ধ করে দেয়া। আরব দেশগুলো গণতন্ত্র, আধুনিকতা ও স্বাধীনতা ভোগ করুক তা যারা চায় না সেই চক্রটিই ব্রাহিমি ও বেলাইদ উভয়কে হত্যা করেছে। সরকারি সূত্রগুলো থেকে স্পষ্টভাবে বলা না হলেও হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে অস্থিরতা সৃষ্টির জন্য ইঙ্গিত করা হয় কট্টরপন্থী সালাফিদের একটি গ্রুপকে। আলকায়েদার সাথে তাদের যোগসূত্র দেখা যায় বিভিন্ন ক্ষেত্রে। আলকায়েদা গঠনের সাথে যুক্ত ব্যক্তিরা যেসব বক্তব্য দেয় তা পর্যালোচনা করলে কয়েকটি বিষয় স্পষ্ট হয়। প্রথমত, তারা পাশ্চাত্যের যে গণতন্ত্র সেটার তীব্র সমালোচনাকারী। দ্বিতীয়ত, শাসন পরিবর্তনের নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতির পরিবর্তে সশস্ত্র পন্থাকে গ্রহণযোগ্য মনে করে। তৃতীয়ত, লক্ষ অর্জনের জন্য নিরীহ মানুষের প্রাণহানিকে গ্রহণযোগ্য মনে করে। এই তিনটি প্রশ্নে বিশ্বে সক্রিয় ইসলামী আন্দোলনের সাথে আলকায়েদার স্পষ্ট মতপার্থক্য রয়েছে। মধ্যপন্থী ইসলামী আন্দোলন যে নিয়মতান্ত্রিক ও গণতান্ত্রিক ধারার কর্মকৌশল গ্রহণ করে তাতে যে কোন দেশের বিভিন্ন মতাদর্শের মধ্যে সহাবস্থানে কোনো বাধা থাকে না। ইসলামী দল জনগণের ভোটে ক্ষমতায় যেতেও পারে আবার ক্ষমতা থেকে বিদায়ও নিতে পারে। এ ভাবধারা মধ্যপ্রাচ্যে ছড়িয়ে পড়লে তা পারিবারিক শাসনের জন্য চ্যালেঞ্জ তৈরি হতে পারে। এ চ্যালেঞ্জের কারণে মূল ধারার ইসলামী আন্দোলনকে ক্ষমতাচ্যুত করতে অথবা তাদের বিরুদ্ধে আলকায়েদাকে ব্যবহার করার ঝুঁকি ক্রমেই বাড়ছে। সিরিয়ায় বিরোধিদের প্রতিরোধ সফল না হবার পেছনে আলকায়েদা সংশ্লিষ্ট গোষ্ঠির কর্তত্ব প্রতিষ্ঠার চেষ্টাকে অনেকেই দায়ী করেন। মধ্যপ্রাচ্য পরিস্থিতির অনেকগুলো তাৎপর্যপূর্ণ বিষয়ের একটি হলো মিসরের মুসলিম ব্রাদারহুড যেভাবে দেশটি পরিচালনার চেষ্টা করেছিল, সেভাবে করেনি তিউনিসিয়ার আননাহদা। নির্বাচনে জয়লাভ করার পরও তারা লিবারেল সেকুলার ও বাম দলগুলোর সাথে কোয়ালিশন করেছে। আননাহদা সংবিধান প্রণয়ন প্রক্রিয়ায় দলটির ইসলামিক এজেন্ডাগুলোকে সামনে না এনে একটি গণতান্ত্রিক তিউনিসিয়া গড়ার জন্য বিরোধী দলগুলোর সাথে একসাথে কাজ করছে। কিন্তু ফেব্রুয়ারিতে বিরোধীদলীয় নেতা চকরি বেলাইদের হত্যার বিষয়টি অনিষ্পন্ন থাকার পর নতুন করে ব্রাহিমি হত্যাকাণ্ডে পরিস্থিতি আবার উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। বলা যায়, পরিস্থিতি উত্তপ্ত করতে এ হত্যাকা ঘটানো হয়েছে। তিউনিসিয়া ইরাক বা সিরিয়া নয় যে সেখানে এ ধরনের হত্যাকাণ্ড ঘটতে পারে। এসব রাজনৈতিক হত্যা এ কারণে ঘটানো হয়েছে যে যাতে ইসলামিস্ট ও সেকুলারিস্টরা সহ-অবস্থানের মাধ্যমে গণবিপ্লবকে সংহত করতে না পারে। এই দুই শক্তির একসাথে অবস্থানই আরব দেশগুলোকে অগণতান্ত্রিক শক্তির বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ জাগরণ সম্ভব করে তুলেছিল। এ কারণে আরব জাগরণে হোসনি মোবারকের পতনের পর মিসরে কখনোই মুসলিম ব্রাদারহুডকে লিবারেলদের সাথে ঐকমত্যের সরকার করতে দেয়া হয়নি। এক দিকে উপসাগরীয় শাসকদের পৃষ্ঠপোষকতাপ্রাপ্ত কট্টর সালাফিদের মাধ্যমে ইসলামিক শাসন কায়েমের জন্য চাপ তৈরি করা হয়েছে, অন্য দিকে প্রেসিডেন্ট মুরসির ঐক্যের জন্য প্রতিটি আলোচনার আহ্বানকে প্রত্যাখ্যান করেছে সেকুলারিস্টরা। আর মুরসির পতন ঘটানোর আন্দোলনে এই কট্টর ইসলামিস্ট ও কট্টর সেকুলারিস্ট দুই পক্ষ রহস্যজনকভাবে এক হয়ে গেছে। তিউনিসিয়ায় আননাহদা নেতা ড. রশিদ ঘানুশি শুরু থেকে এ ব্যাপারে ছিলেন বিশেষভাবে সতর্ক। তিনি নির্বাচনে জয়ের পর নিজে তো ক্ষমতা নেনইনি, সেই সাথে তিনি আরব জাগরণের জয়কে সব দলের হিসেবে চিহ্নিত করে ঐকমত্যের সরকার গঠনের চেষ্টা করে গেছেন। কিন্তু এ প্রচেষ্টায় তাকে বারবার বাধাগ্রস্ত হতে হচ্ছে। তিনি ডিসেম্বরে সাধারণ নির্বাচনের কথা বলছেন। কিন্তু আন্দোলনকারীরা চাইছেন সেনা হস্তক্ষেপের মাধ্যমে সরকারের ক্ষমতাচ্যুতি। আসলে তাদের এভাবে চাইতে প্ররোচিত করা হচ্ছে। তিউনিসিয়ার ঘটনা নিয়ে বিশ্লেষকেরা যেভাবে হত্যাকাণ্ডে আলকায়েদার সম্পৃক্ততার বিষয় তুলে আনছেন, তাতে নতুন নতুন বিস্ময়ের সৃষ্টি হচ্ছে। আলকায়েদার লক্ষ্য এর আগে বরাবরই পশ্চিমা লক্ষ্যবস্তু হতে দেখা গেছে। কিন্তু আরব জাগরণের পর এর ভূমিকা নানা স্থানে ভিন্ন কিছু ইঙ্গিত দিচ্ছে। বৈধ লক্ষ্য অর্জনের জন্য নিরীহ মানুষ নিহত হয় এমন পন্থার ব্যাপারে ইসলামি বিশেষজ্ঞদের মধ্যে বরাবরই তীব্র বিতর্ক ছিল। কিন্তু ইসলামি দেশগুলোর মধ্যে মধ্যপন্থী ইসলামি দলগুলো যেখানে ক্ষমতায় রয়েছে, সেসব দেশে অস্থিরতা তৈরির জন্য হত্যাকাণ্ড চালানোর ঘটনার সাথে আসলেই যদি আলকায়েদা যুক্ত থাকে তাহলে এর প্রতিক্রিয়া যে অনেক সুদূরপ্রসারী বিষয় হবে তাতে সন্দেহ নেই। মধ্যপ্রাচ্যের চারটি দেশে একই সময়ে একই ধরনের কিছু ঘটনা ঘটেছে। মিসরে নির্বাচিত সরকারকে পতন ঘটিয়ে সেনাবাহিনী ক্ষমতা দখল করেছে। প্রতিদিন ডজন ডজন মানুষের মৃত্যু ঘটছে। লিবিয়ায় মুসলিম ব্রাদারহুডের সমালোচনাকারী এক ধর্মীয় নেতাকে গুলি করে হত্যা করার পর তাকে কে কেন হত্যা করল এসব বাছবিচার ছাড়াই এর প্রতিবাদের নামে বেনগাজিসহ বিভিন্ন স্থানে ব্র্রাদারহুডের অফিসে হামলা করা হয়েছে। অথচ ব্রাদারহুড সেখানকার ক্ষমতায়ও নেই আর দলটির সাথে প্রত্যক্ষ কোনো সংঘর্ষে এই ব্যক্তি মারা গেছেন, তাও নয়। ঠিক এ সময়েই মরক্কোতে ব্রাদারহুডের কোয়ালিশন সরকার থেকে রাজতন্ত্রপন্থী উদার দলটি কোয়ালিশন থেকে বেরিয়ে এসে অচলাবস্থা সৃষ্টি করেছে। মধ্যপ্রাচ্যে এখন যেসব ঘটনা ঘটছে তাতে ব্রাদারহুড ঘরানার মধ্যপন্থী ইসলামিক দলগুলোর বিরুদ্ধে একটি সর্বাত্মক ও সমন্বিত অভিযান যে শুরু হয়েছে, তাতে সন্দেহ নেই। আর এ অভিযানে কয়েকটি উপসাগরীয় দেশের সরকারের বিশেষ ইন্ধন রয়েছে বলে উল্লেখ করছেন বিশ্লেষকেরা। তিউনিসিয়ার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্যে কট্টরপন্থী সালাফিদের একটি গ্রুপের দুই বিরোধী নেতার হত্যার সাথে যুক্ত থাকার ব্যাপারে ইঙ্গিত পাওয়া যায়। আর প্রকাশ্যে তাদের সিনেমা হল, বার, রেস্তোরাঁ ও আমেরিকান দূতাবাসে হামলার ঘটনায় সম্পৃক্ত থাকতে দেখা গেছে। এসব ঘটনার মাধ্যমে একটি দেশের সরকারের গণতন্ত্র ও সহিষ্ণুতার পথে অগ্রসর হওয়ার চেষ্টাকে বাধাগ্রস্তÍ করা হচ্ছে।। আরেকটি কাজ মিসরে বেশ জোরালোভাবে করা হয়েছে, যা তিউনিসিয়ায়ও চলছে। সেটি হলো অর্থনীতি ও সেবা খাতে অচলাবস্থা তৈরি করে জনগণকে বিুব্ধ করার চেষ্টা। বিদ্যুৎ, গ্যাস, পানি সরবরাহে এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিতে অচলাবস্থা সৃষ্টি করা। বিনিয়োগ পরিবেশকে বাধাগ্রস্তÍ করে বেকারত্ব বাড়ানো। এ ক্ষেত্রে আইএমএফ, বিশ্বব্যাংক ও অন্যান্য বিনিয়োগ সক্ষম দেশগুলোকে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যের নেপথ্য ঘটনা যারা প্রত্যক্ষ করেন, তারা ইঙ্গিত দিয়েছিলেন মিসরের পর তিউনিসিয়া লক্ষ্যবন্তু হবে। কিন্তু সেই জন্য ডিসেম্বর নাগাদ সময় অপেক্ষা করা হতে পারে বলে মনে করা হয়েছিল।্ এখন এ সময়কে নেপথ্য খোলোয়াড়েরা দ্রুত এগিয়ে আনতে চাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে। মধ্যপ্রাচ্যের চলমান এ ধরনের কর্মকাণ্ডে দৃশ্যত মনে হচ্ছে উপসাগরীয় দেশগুলোর মধ্যে যেখানে রাজতন্ত্র বা পারিবারিক শাসনের পাশাপাশি অভাব দারিদ্র্য ও বৈষম্য তীব্রভাবে বিদ্যমান, সেসব দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলনকে কোনোভাবে শাসকেরা সহ্য করবে না আর তাকে গণতান্ত্রিক বিশ্ব হিসেবে পরিচিত পশ্চিমাশক্তি কৌশলে সমর্থন দিয়ে যাবে। পাশ্চাত্যের এ দ্বিমুখী নীতির কারণে মধ্যপ্রাচ্যে আরো অনেক রক্তঝরার মতো দ্বন্দ্ব-সঙ্ঘাত সৃষ্টি হতে পারে। শেষ পর্যন্ত মধ্যপ্রাচ্যের শক্তিশালী দেশগুলোকে খণ্ড-বিখণ্ড করতে কয়েক বছর আগে আমেরিকান ডিফেন্স জার্নালে যে নিবন্ধ ও মানচিত্র প্রকাশ করা হয়েছিল, তা বাস্তবায়নের পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে। সেটি হয়ে থাকলে শুধু তিউনিসিয়াই নয়, অন্যান্য আরব দেশেও নানামুখী সঙ্ঘাত ও অস্থিরতা তৈরি করা হতে পারে।

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button