কিডনির কালোবাজার বাংলাদেশ

Kidneyমানব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বিক্রির কালোবাজার বাংলাদেশ। অর্থের বিনিময়ে এ দেশে মানুষের শরীরের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ কিডনি পর্যন্ত কিনতে পাওয়া যায়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের রোগীরা দালালদের মাধ্যমে মানব অঙ্গ সংগ্রহ করেন। এমন তথ্য খোদ যুক্তরাষ্ট্রের এক দৈনিকের। এ বিষয়ে নির্মাণ করা হয়েছে ডকুমেন্টারি।
যুক্তরাষ্ট্রে বর্তমানে ১ লাখ ২৩ হাজারেরও বেশি রোগী কিডনি প্রতিস্থাপনের অপেক্ষায় রয়েছেন। তাদের জন্য ডোনার আছেন মাত্র ৫ হাজার। এই রোগীর মধ্যে ৪ হাজার মৃত্যুপথযাত্রী। কথিত এ ডোনারদের একটি অংশ বাংলাদেশের, যাদের অর্থের বিনিময়ে ডোনার বানানো হয়েছে। কিডনি কেনাবেচা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক চিকিৎসাবিষয়ক দৈনিক ‘পালস’-এ চলতি সপ্তাহে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়েছে।
মার্কিন টেলিভিশন চ্যানেল ‘ভাইস নিউজ’ এ নিয়ে সবাক প্রতিবেদন তৈরি করেছে। অন্য একটি চ্যানেলও সেটি প্রচার করেছে। ডকুমেন্টারিতে মানুষের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ, বিশেষ করে কিডনি বিক্রির ‘বড় কালোবাজার বাংলাদেশ’ বলে দেখানো হয়। বলা হয়েছে, এই অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বাংলাদেশ থেকে যায় যুক্তরাষ্ট্রসহ পৃথিবীর নানা দেশে।
প্রধানমন্ত্রীর সাবেক স্বাস্থ্যবিষয়ক উপদেষ্টা ডা. সৈয়দ মোদাচ্ছের আলী দেশে-বিদেশে অবৈধভাবে বাংলাদেশিদের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ কেনাবেচার বিষয়টি স্বীকার করে গতকাল আমাদের সময়কে বলেন, এটি একটি ভয়াবহ সংবাদ। বর্তমানে সাগরপথে যেসব ব্যক্তিকে পাচার করা হচ্ছে তাদের বড় একটা অংশের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বিক্রি করা হচ্ছে বলে আমার আশঙ্কা। মানব অঙ্গ বিক্রির কালোবাজার হিসেবে বাংলাদেশের নাম আসা কোনোভাবেই কাম্য নয়। তিনি বলেন, খোঁজ নিয়ে দেখুন যেসব জেলার মানুষ অভাবের তাড়নায় সাগরপথে মরণঝুঁকি নিচ্ছেন তারা সেসব জেলার মানুষ, যেসব জেলার মানুষ অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বিক্রির নির্মমতার শিকার। মানব অঙ্গ বিক্রির বিষয়টি দেশে তেমনভাবে আলোচনায় না এলেও বিদেশে বেশ আলোচিত ঘটনা। আমার জানামতে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের কাছে তালিকা রয়েছে। এ তালিকা হালনাগাদ করে অবিলম্বে অভিযানে নামা উচিত। বিদেশে দেশের ভাবমূর্তি যাতে কোনোভাবে ক্ষুণœ না হয় তা লক্ষ রাখা উচিত।
এদিকে খোদ বঙ্গবন্ধু মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের কিডনি রোগ বিভাগের দেয়ালে কিডনি বিক্রির জন্য বর্তমানে কমপক্ষে ২০টি বিজ্ঞাপন শোভা পাচ্ছে। এর একটি বিজ্ঞাপনে লেখা হয়েছেÑ একজন অসহায় মেয়ে আর্থিক কারণে তার কিডনি বিক্রি করবে। তার রক্তের গ্রুপ ‘বি’ পজিটিভ। বয়স ১৯ থেকে ২০ বছর। যোগাযোগের জন্য একটি মোবাইল ফোন নম্বরও দেওয়া হয়েছে। আরেকটি বিজ্ঞাপন শোভা পাচ্ছে স্টিকার আকারে। এতে বলা হয়, জরুরি ভিত্তিতে একটি ‘বি’ পজিটিভ কিডনি বিক্রি করা হবে। এ জন্য মোবাইল ফোন নম্বর দেওয়া হয়েছে। একটি স্যাটেলাইট টিভি চ্যানেলেও ‘বি’ পজিটিভ কিডনি চাই বলে বিজ্ঞাপন দিয়েছেন হাজারীবাগের এক ট্যানারি ব্যবসায়ী। যোগাযোগের জন্য তিনি দুটি মোবাইল ফোন নম্বর দিয়েছেন। রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে, এমনকি বেশ কিছু জাতীয় পত্রিকায় এ ধরনের বিজ্ঞাপনও চোখে পড়ে।
১৯৯৯ সালে মানবদেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সংযোজন আইন প্রণয়ন করা হয়। তাতে স্পষ্ট বলা হয়েছে, মানবদেহের যে কোনো অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ক্রয়-বিক্রয় বা এর বিনিময়ে কোনো ধরনের সুবিধা লাভ এবং সেই উদ্দেশ্যে কোনো প্রকার বিজ্ঞাপন প্রদান বা অন্য কোনোরূপ প্রচারণা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। কোনো ব্যক্তি এই আইনের কোনো বিধান লঙ্ঘন করলে অথবা লঙ্ঘনে সহায়তা করলে তিনি অনূর্ধ্ব সাত বছর এবং অন্যূন তিন বছর মেয়াদি সশ্রম কারাদ- অথবা অন্যূন ৩ লাখ টাকা অর্থদ-ে অথবা উভয় প্রকার দ-ে দ-িত হবেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজধানীতে কিডনি কেনাবেচার একটি বিশাল চক্র দেয়ালে বিজ্ঞাপন সেঁটে বিক্রেতার খোঁজ করছে, পেয়েও যাচ্ছে। তারপর দেশে বা বিদেশেÑ যেখানে সুবিধাজনক দাম, সেখানেই পাচার করা হচ্ছে কিডনিসহ বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ। বর্তমানে মাত্র ২ লাখ থেকে আড়াই লাখ টাকায় মিলছে কিডনি। দালালরা অনেক বিক্রেতার কিডনির এইচএলএ রিপোর্টও তৈরি করে রাখে। রোগীর সঙ্গে মিলে গেলে এক ঘণ্টার মধ্যে পাওয়া যায় তরতাজা কিডনি। এর আগে কিডনি চক্রের পান্ডা পার্থ চৌধুরীকে কলকাতার গোয়েন্দা পুলিশ বাংলাদেশ-সংলগ্ন সন্দেশখালী থেকে আটক করে। পার্থ বাংলাদেশেও তার চক্রের কথা স্বীকার করে। এ ঘটনার পর পশ্চিমবঙ্গ সরকার কিডনি প্রতিস্থাপনে কড়াকড়ি আরোপ করে। ফলে চক্রটি এখন বাংলাদেশে তাদের ব্যবসা বিস্তার করছে। অবশ্য এই চক্র সম্পর্কে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এরই মধ্যে অবগত হয়ে তৎপরতা শুরু করেছে।
মানবদেহে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সংযোজন আইনে বলা হয়েছে, ১৮ বছরের কম ও ৬৫ বছরের বেশি বয়সের কোনো ব্যক্তি অঙ্গ দান করতে পারবেন না (‘অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ’ হিসেবে মানবদেহের কিডনি, হৃৎপি-, যকৃত, অগ্ন্যাশয়, অস্থি, অস্থিমজ্জা, চর্ম ও টিস্যুসহ মানবদেহে সংযোজনযোগ্য যে কোনো অঙ্গ বোঝানো হয়েছে)। অথচ যারা এই নির্মমতার শিকার হচ্ছেন, তাদের ক্ষেত্রে বয়সকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করা হয়। তথ্যটি মার্কিন দৈনিকে উল্লেখ করা হয়েছে।
মার্কিন টিভি চ্যানেল ভাইস নিউজের ওই ডকুমেন্টরির এক মিনিট পাঁচ সেকেন্ডের একটি ক্লিপ আগাম বিজ্ঞাপন হিসেবে দেখানো হচ্ছে সোশ্যাল মিডিয়ায়। এতে দেখা যায়, বাংলাদেশের একটি এলাকার এক যুবক বলছেন, আমি, আমার স্ত্রী, মা-বাবা, ভাই-বোন সবাই কিডনি বিক্রি করে দিয়েছি। আমার স্ত্রী কিডনি বিক্রির পর মারা গেছে। ওই যুবকের মা বলেছেন, পরিবারেরর সবার কিডনি বিক্রির পর আর কোনো উপায় না থাকায় আমারও একটি কিডনি বিক্রি করেছি।
প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে কালোবাজারে একটি কিডনি বিক্রি করে ২ থেকে আড়াই লাখ টাকা পান ডোনার। এ কিডনি স্থানান্তরের জন্য আছে কিছু নির্দিষ্ট হাসপাতাল। যারা কিডনি বিক্রি করেছেন, তারা একটি কিডনি নিয়ে নানা শারীরিক সমস্যায় ভুগছেন। তাদের একজন জানান, মেয়ের বিয়ের জন্য কিডনি বিক্রি করা ছাড়া আমার আর কোনো উপায় ছিল না। জানা গেছে, একাধিক গোয়েন্দা সংস্থার সমন্বিত একটি প্রতিবেদন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে জমা পড়ে। এতে ২০ দালাল ও পাচারকারীর নাম-ঠিকানা রয়েছে। -আমাদের সময়

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button