আমেরিকায় ৯ম শতকের কুরআনের পাণ্ডুলিপি আবিষ্কার

Quranবহু শতাব্দী ধরে এ কথা বিশ্বাস করা হতো যে, ক্রিস্টোফার কলম্বাস হলেন পুরনো মহাদেশের প্রথম ব্যক্তি যিনি আটলান্টিক মহাসাগরের অপর পাড়ের ‘নতুন বিশ্বকে’ আবিষ্কার করেছেন। তবে রোড আইল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক নতুন তথ্যপ্রমাণ থেকে মনে করেছেন, সম্ভবত মুসলিম নাবিকেরা সর্বপ্রথম আমেরিকার উপকূলে বসতি স্থাপন করেছিলেন। এর ফলে আমরা এত দিন যে ইতিহাস জেনেছি তা হয়তো নতুন করে লেখার প্রয়োজন হতে পারে। গবেষকদলের প্রধান অধ্যাপক ইভান ইউরেস্কো স্বীকার করেন, গবেষকেরা হঠাৎ এ বিষয়টি আবিষ্কার করেন।
তিনি বলেন, ‘আমরা আমেরিকার প্রাগৈতিহাসিক আদিবাসী বসতির সাক্ষ্যপ্রমাণ আবিষ্কারের আশা করছিলাম। কারণ আমরা বিগত কয়েক দশক ধরে ওই এলাকায় কর্মরত ছিলাম। তবে আমরা সেখানে নবম শতকে কাদামাটির ওপর আরবিতে লেখা কুরআনের পাণ্ডুলিপি দেখতে পাবো এমনটি আশা করিনি।’ সেখানে নবম শতাব্দীর নাবিকদের একটি বড় গণসমাধিসৌধ গবেষকদলের নজরে আসে। তারা সেখানে অনেক আগে থেকেই পচাগলা অবস্থায় চারটি কঙ্কাল দেখতে পান, যার ডিএনএ পরীক্ষা করা প্রায় অসম্ভব বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। অবশ্য তাদের দাঁতগুলো অসময়োচিত ক্ষয়প্রাপ্ত ছিল যা থেকে পুষ্টিহীনতা অথবা অজ্ঞাত কোনো রোগের কারণে তাদের মৃত্যু হয় বলে অনুমান করা হয়েছে। রোড আইল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকেরা এ ধরনের বিতর্কিত প্রকৃতির কোনো জিনিস আবিষ্কার করার আশা করেননি। তারা কিছু পোশাক, মুদ্রা ও দু’টি তলোয়ারসহ অন্যান্য বিভিন্ন জিনিসও সেখান থেকে আবিষ্কার করেছেন। তবে প্রাপ্ত এসব জিনিসপত্রের অবস্থা এতটাই খারাপ যে, সেগুলো চেনা সম্ভব নয়। মরিচা পড়ে তলোয়ারের ওপর লেখা বোঝা বা পাঠোদ্ধার একেবারে অসম্ভব হয়ে পড়েছে। মুদ্রাগুলোর অবস্থাও অনুরূপ। আর যুগ যুগ ধরে পড়ে থাকা ও ওই এলাকার আবহাওয়ায় আর্দ্রতা ব্যাপক হওয়ায় পোশাকের খণ্ডগুলো একেবারেই পচেগলে গেছে।
তবে বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, দু’টি কাদামাটির পট বেশ ভালো অবস্থায় পাওয়া গেছে। এর একটিতে অতি মূল্যবান পাণ্ডুলিপি এবং অপরটিতে অজ্ঞাত শুষ্ক মসলার মিশ্রণ রয়েছে। এসব জিনিস শনাক্ত করা গেলে ওই নাবিকদের শিকড় সম্পর্কে আরো প্রমাণ উপস্থাপন করা সম্ভব হবে। ম্যাসাচুসেটস বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামি মধ্যযুগ সম্পর্কিত বিশেষজ্ঞ করিম ইবনে ফাল্লাহ এ পাণ্ডুলিপির সময়কাল নির্ণয় করেছেন। তিনি জানান, এটি নবম শতকের কুফিক লিপির পাণ্ডুলিপি।
করিম বলেন, ‘বিভিন্ন ধরনের আরবি লিপির প্রাচীনতম ক্যালিওগ্রাফিক রূপ হলো কুফিক লিপি। বিভিন্ন ধরনের আরবি ও রূপান্তরিত প্রাচীন নাবাতিয়ান লিপির সমন্বয়ে এ লিপি গঠিত হয়।’ তিনি বেশ আবেগপ্রবণ ভাষায় বলেন, ‘সপ্তম শতকে ইরাকের কুফায় কুফিক লিপি আবিষ্কৃত হয়। কুফার থেকে এ লিপির নাম দেয়া হয়েছে কুফিক লিপি। কলম্বাস প্রাক-আমেরিকায় কুফিক পাণ্ডুলিপি আবিষ্কারের ঘটনা অত্যন্ত বিস্ময়কর ঘটনা।’
স্মিথসোনিয়ানের জাদুঘর বিজ্ঞানী বায়রন কেন্ট স্বীকার করেন, এ আবিষ্কার হলো একটি অত্যন্ত বিব্রতকর বিষয়। তিনি তার সুচিন্তিত অভিমত ব্যক্ত করে বলেন, ‘এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, আরব মানচিত্র হচ্ছে বিশ্বের সেরা মানচিত্র, তবে এর আগের বিদ্যমান কোনো মানচিত্রই আমেরিকা সম্পর্কে তাদের জ্ঞান থাকার বিষয় প্রকাশ পায়নি।’ কলম্বাসের আগে মুসলমানেরা আটলান্টিক মহাসাগর পাড়ি দিয়ে আমেরিকা ভ্রমণ করেছিলেন এমন বিষয় বিদ্যমান ইতিহাসের ধারণার পরিপন্থী। ‘নতুন বিশ্ব’ আবিষ্কারের ক্ষেত্রে মুসলমানেরা সম্ভবত কলম্বাসকে পরাজিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন, এ ধারণার ব্যাপারে কোনো বিশেষজ্ঞ হয়তো বিতর্ক করবেন না। কেন্ট স্বীকার করেন, এ কথা নিশ্চিত যে, এমনটি করার মতো প্রযুক্তিগত বিশেষ জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন তারা তবে তারা যে তা করেছেন এমন কোনো নির্ভরযোগ্য তথ্যপ্রমাণ নেই। বর্তমান আবিষ্কার অবশ্য তাদের সেই কৃতিত্বের একটি শক্তিশালী প্রমাণ হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে। উইলামেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও ‘ফার বেয়ন্ড দ্য ওয়েস্টার্ন সি অব দ্য অ্যারাবস…’ সর্বোচ্চ বিক্রীত বইয়ের লেখক রিচার্ড ফ্রাংকাভিজলিয়াও স্বীকার করেছেন, ‘এ আবিষ্কার এক নজিরবিহীন ঘটনা।’ তিনি বলেন, ‘কলম্বাস-পূর্ব ‘নতুন বিশ্বে’ ইসলামের প্রমাণ একটি অতি চমকপ্রদ বিষয় কারণ বিষয়টি বেশ বিশ্বাসযোগ্য। এ ছাড়া মুসলমানদের সমুদ্র ভ্রমণের তাৎপর্যপূর্ণ সাফল্যগাথা রযেছে। নানা তথ্যপ্রমাণ থেকে জানা যায়, তারা নবম ও দশম শতকে পুরনো পৃথিবীর বিশাল অঞ্চলকে দ্রুত আবিষ্কার ও সেখানে বসতি স্থাপন করেছিলেন। সমুদ্রভ্রমণের ব্যাপারে কলম্বাস নিজেও সমুদ্রভ্রমণে দক্ষতার জ্ঞান অর্জনের জন্য তাদের কাছে ঋণী। তাই মুসলমানদের নতুন বিশ্বে যাওয়ার মতো প্রযুক্তি ও দক্ষতা যে ছিল তাতে কোনো সন্দেহ নেই।’ মুসলিম ঐতিহাসিক ও ভূগোলবিদ আবুল হাসান আলি ইবনে আল হুসাইন আল মাসুদি (৮৭১-৯৫৭ খ্রিষ্টাব্দ) তার বই মুরুজ আজ জাহাব ওয়া মাদিন আলজাওয়াহের (মণিমুক্ত ও হিরাজহরতের খনি) বইটি লিখেন স্পেনের খলিফা আবদুল্লাহ ইবনে মুহাম্মাদের (৮৮৮-৯১২ খ্রিষ্টাব্দে)। এই বইয়ে তিনি লিখেছেন, স্পেনের কর্ডোবার নাবিক খাসখাস ইবনে সায়িদ ইবনে আসওয়াদ ৮৮৯ সালে ডেলবা (পালোস) থেকে জাহাজযোগে আটলান্টিক মহাসাগর পাড়ি দিয়ে অজানা ভূখণ্ডে (আর্দ মাজহুলা) গিয়ে পৌঁছেন। এরপর জাহাজে রাশি রাশি মণিমুক্তা বোঝাই করে তিনি দেশে ফিরে আসেন। আল-মাসুদির বিশ্ব মানচিত্রে বিরাট মহাসাগরের বিশাল এলাকাকে অন্ধকার ও কুয়াশায় আবৃত বলে দেখানো হয়েছে। এটি হলো অজ্ঞাত ভূখণ্ড। অনেক বিশেষজ্ঞ এই অজ্ঞাত ভূখণ্ডকে আমেরিকা মহাদেশ বলে মনে করেন।

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button