তুরস্কে যদি অভ্যুত্থান সফল হতো…

robert fiskরবার্ট ফিস্ক: রিসেপ তাইয়্যেপ এরদোগান টের পেয়ে গিয়েছিলেন। এই লোকটি যেখানে অটোমান সাম্রাজ্যের পুনরুভ্যুদয় ঘটাচ্ছিল, প্রতিবেশীদের শত্রুতে পরিণত করছিল, এমনকি তার দেশকে হাস্যাপদ বিষয়ে পরিণত করছিল, সেখানে তুর্কি সেনাবাহিনী কখনই তার প্রতি অনুগত থাকতো না। কিন্তু দুটো বিষয় বিবেচনা করাটা হবে ভীষণ বিপজ্জনক। এক. একটি সামরিক অভ্যুত্থান দমন করার প্রক্রিয়া হবে ক্ষণস্থায়ী এবং এরপর তুর্কি সেনাবাহিনী তাদের সুলতানের বাধ্য থাকবে। দুই. অন্তত ১৬১ জনের মৃত্যু ও ২৮৩৯ জন আটকের ঘটনা মধ্যপ্রাচ্যের জাতিরাষ্ট্রসমূহের (নেশন-স্টেট) পতনের সঙ্গে সম্পর্কহীন।
ধারণা করা হয়, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর স্থায়ী ইনস্টিটিউশন ও সীমান্ত রয়েছে। ইস্তাম্বুল ও আঙ্কারায় সপ্তাহান্তে যা ঘটলো, তা সীমান্ত ও রাষ্ট্রের ধারণা ভেঙে পড়ার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে সম্পর্কিত। সীমান্ত ও রাষ্ট্রের ধারণার কারণেই বরং ইরাক, সিরিয়া, মিশর ও আরব বিশ্বের অন্যান্য দেশে একই ধরনের ক্ষত সৃষ্টি হয়েছে। এ অঞ্চলে দুর্নীতির মতো সংক্রামকে পরিণত হয়েছে অস্থিতিশীলতা। বিশেষ করে ক্ষমতাশালী ও একনায়কদের মধ্যে এটি বেশি দেখা যাচ্ছে। এরা হলো স্বৈরাচারীদের একটি শ্রেণি। যেদিন নিজ স্বার্থ হাসিলে তুরস্কের সংবিধানে পরিবর্তন আনেন এরদোগান এবং কুর্দিদের সঙ্গে বিদ্বেষপূর্ণ সংঘাতে অবতীর্ণ হন, তখন থেকেই তিনি এ শ্রেণির সদস্যে পরিণত হয়েছেন।
এ কথা বলার প্রয়োজন নেই, বিদ্রোহের পর ওয়াশিংটনের প্রথম প্রতিক্রিয়া ছিল জ্ঞানগর্ভ। তুর্কিদের অবশ্যই তাদের ‘গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকার’কে সমর্থন দিতে হবে। গণতন্ত্র শব্দটি গলাধঃকরণ করাটা বরং কঠিন ছিল, মনে করাটা ছিল আরো যন্ত্রণাদায়ক, যখন ওয়াশিংটনই মিশরে ২০১৩ সালে মোহাম্মদ মুরসির ‘গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত’ সরকারকে উৎখাতের প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিল। সেদিন ওয়াশিংটন মিশরের মানুষকে মুরসির প্রতি সমর্থন জানাতে বলেনি। বরং, খুব দ্রুতই অভ্যুত্থানের প্রতি সমর্থন ঘোষণা করে। অথচ, তুর্কিতে যে চেষ্টা চালানো হয়েছিল, তার চেয়েও অনেক বেশি প্রাণঘাতী ছিল মিশরের অভ্যুত্থান। যদি তুর্কি সেনাবাহিনী সফল হতো, নিশ্চিত থাকুন বাতিল মালের মতো এরদোগানকে বিবেচনা করা হতো, যেমনটি করা হয়েছিল মুরসিকে।
কিন্তু পশ্চিমা দেশগুলোর কাছে যখন স্বাধীনতা ও মর্যাদার চেয়ে স্থিতিশীলতার অগ্রাধিকার বেশি, তখন আপনি কি আশা করেন? এ কারণেই ইরানের সৈন্য গ্রহণে তারা আজ প্রস্তুত। বিশ্বস্ত ইরাকি মিলিশিয়ারা আজ আইএসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে যোগ দিচ্ছে। পাশাপাশি, ফালুজা পুনর্দখলের পর ৭০০ নিখোঁজ সুন্নি আজ ‘বিলীন’ হয়ে গেছে। এবং এই একই কারণে ‘আসাদকে অবশ্যই যেতে হবে’ নামক আপ্তবাক্যটি নীরবে বাদ পড়েছে। এমনকি ডেভিড ক্যামেরনের প্রধানমন্ত্রিত্ব শেষ হলেও, আজও টিকে আছেন বাশার আল আসাদ। প্রায় নিশ্চিতভাবে ওবামার প্রেসিডেন্সি পর্যন্তও টিকে থাকবেন তিনি। দামেস্কের সরকার এখন বিস্মিত চোখে তুর্কির এ সপ্তাহান্তের ঘটনাপ্রবাহ পর্যবেক্ষণ করবে।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের জয়ীপক্ষ অটোমান সাম্রাজ্য ধ্বংস করে দিয়েছে। অটোমানরা জার্মানির পক্ষ নেয়ার মতো প্রাণঘাতী ভুল করার পর, এটা (অটোমান সাম্রাজ্যের ধ্বংস) অবশ্য ১৯১৪-১৮ ব্যাপী এই সংঘাতের অন্যতম উদ্দেশ্যও ছিল। সাম্রাজ্যের ধ্বংসাবশেষ এরপর কয়েক টুকরো করে মিত্রপক্ষ। সেসব ভাগ করে দেয়া হয় নিষ্ঠুর রাজা, অসৎ কর্নেল ও স্বৈরশাসকদের মাঝে। এরদোগান ও সেনাবাহিনীর যে অংশবিশেষ তাকে ক্ষমতায় বহাল রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে আপাতত, তারাও ভাঙা রাষ্ট্রের ধারণার সঙ্গে মানানসই।
অথচ, এরদোগান ও পশ্চিমাদের জন্য সতর্কতামূলক লক্ষণ আগে থেকেই ছিল, যদি তারা পাকিস্তানের অভিজ্ঞতা স্মরণ করতে পারতেন। রাশিয়ানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধরত ‘মুজাহিদীন’দের অর্থায়ন, অস্ত্র ও মিসাইল যোগানের জন্য আমেরিকানদের হাতে লজ্জাজনকভাবে ব্যবহৃত হয়েছিল পাকিস্তান। এ রাষ্ট্রটিও আরেক সাম্রাজ্যের (ভারতীয়) একটা টুকরো, যেটি পরে ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত হয়। পাকিস্তান এরপর বিপুল বোমা পড়ে নিজেদের শহরগুলো বিধ্বস্ত হতে দেখেছে। দেশটির দুর্নীতিগ্রস্ত সেনাবাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থা তালেবান সহ রাশিয়ার শত্রুদের সহযোগিতা করেছিল। এরপর দেশটিতে অনুপ্রবেশ করে চরমপন্থিরা যারা খোদ রাষ্ট্রের জন্যই হুমকি হয়ে দাঁড়ায়।
সিরিয়ায় যখন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য একই ভূমিকা পালন করতে শুরু করে তুরস্ক, তখনই এ দেশটিও ব্যর্থ রাষ্ট্রের পথ ধরে। দেশটি সিরিয়ার অভ্যন্তরে বিদ্রোহীদের জন্য অস্ত্র পাঠাচ্ছিল, তাদের দুর্নীতিগ্রস্ত গোয়েন্দা সংস্থা ইসলামিস্ট জঙ্গিদের সহযোগিতা করছিল। পাশাপাশি সিরিয়ার ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে লড়ছিল। এখন তুরস্কের শহরগুলোও বোমায় বিধ্বস্ত। গ্রামাঞ্চলে ঢুকে গেছে চরমপন্থিরা। পার্থক্য হচ্ছে, তুরস্ক দক্ষিণ-পূর্বের কুর্দিদের বিরুদ্ধে পুনরায় যুদ্ধ শুরু করেছে। সেখানকার দিয়াবাকির শহরের অনেক অংশ সিরিয়ার হোমস ও আলেপ্পোর মতোই ক্ষতবিক্ষত। খুব দেরিতে এরদোগান উপলব্ধি করেছেন দেশের জন্য তারই বেছে নেয়া পন্থার চড়া মূল্য। পুতিনের কাছে দুঃখপ্রকাশ করা ও বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর সঙ্গে স¤পর্ক মেরামত করা এক জিনিস। কিন্তু যখন আপনি খোদ নিজের সেনাবাহিনীকেই আর বিশ্বাস করতে পারবেন না, তখন বুঝতে হবে মনোযোগ দেয়ার মতো আরো গুরুতর জিনিস রয়ে গেছে।
তুর্কি সেনা কর্মকর্তারা, যারা মনে করেন ইস্তাম্বুলের সুলতান দেশকে ধ্বংস করে দিচ্ছেন, তাদের মধ্যে অবশ্যই খুব অল্পসংখ্যক হলেন আটককৃত ২০০০ কর্মকর্তা। এটা স্রেফ ক্ষতির মাত্রা পরিমাপের বিষয় নয়, যা ন্যাটো ও ইইউ অনুভব করবে। আসল প্রশ্ন হলো, এই সংক্ষিপ্ত সফলতার দরুন আরো বেশি বিচার, আরো সাংবাদিক আটক, আরো সংবাদপত্র বন্ধ, আরো কুর্দি হত্যা এবং ১৯১৫ সালের আর্মেনিয়ায় গণহত্যার কথা অস্বীকার করার কত মাত্রার সাহস পাবেন এরদোগান?
কুর্দি জঙ্গিবাদের যেকোনো ধরনকে তুর্কিরা কী ভীতি ও প্রায় জাতিগত ঘৃণার সঙ্গে বিবেচনা করে, তা উপলব্ধি করাটা বহিরাগতদের জন্য মাঝেমধ্যে কঠিন। আমেরিকা, রাশিয়া, ইউরোপ, অর্থাৎ পশ্চিমারা ‘সন্ত্রাসী’ শব্দটিকে এতটাই সাধারণ করে ফেলেছে যে, আমরা মাঝে মধ্যে অনুধাবন করতে পারি না, তুর্কিরা কী তীব্রতা নিয়ে কুর্দিদের ‘সন্ত্রাসী’ ডাকে এবং তুর্কি রাষ্ট্রের অস্তিত্বের প্রতি হুমকিস্বরূপ হিসেবে দেখে। ঠিক একইভাবেই প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় তারা আর্মেনিয়ানদের বিবেচনা করতো। মোস্তাফা কামাল আতাতুর্ক হতে পারেন পুরনো আমলের ভালো ধর্মনিরপেক্ষ একনায়ক, যাকে এমনকি অ্যাডলফ হিটলারও শ্রদ্ধা করতেন। কিন্তু তুর্কি জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করতে তার সংগ্রামের কারণও ছিল সেই একই গোষ্ঠী যারা সবসময়ই তুর্কিকে তাড়া করে ফিরতো। সঙ্গে দেশটির বিরুদ্ধে পশ্চিমা দেশগুলোর ষড়যন্ত্র করার গূঢ় ও যৌক্তিক সন্দেহ তো ছিলই।
এ সপ্তাহান্তে যে ঘটনা ঘটেছে, তা প্রথম দেখায় যতটা মনে হবে, বাস্তবে তার চেয়ে অনেক বেশি নাটকীয়। ইইউ’র সীমান্ত থেকে শুরু করে তুরস্ক, সিরিয়া, ইরাক, মিশরের সিনাই পেনিনসুলার বিরাট অংশের মধ্য দিয়ে, লিবিয়া ও তিউনেশিয়ায় অরাজকতা ও ব্যর্থ রাষ্ট্রের পদচিহ্ন কেবল। আর্থার বেলফরের সাহায্যে স্যার মার্ক সাইকস ও ফ্রাঁসোয়া জর্জ-পাইকট অটোমান সাম্রাজ্যের বিভাজন শুরু করেছিলেন। কিন্তু আজও এটি অব্যাহত আছে।
এই ভয়ানক ঐতিহাসিক কাঠামোতেই আঙ্কারায় এই না হওয়া অভ্যুত্থানকে দেখতে হবে আমাদের। সামনের মাস কিংবা বছরগুলোতে অপেক্ষায় থাকুন আরেকটি ঘটার।
-রবার্ট ফিস্ক ব্রিটেনের দ্য ইন্ডিপেন্ডেন্টের লেবাননভিত্তিক সাংবাদিক। ওপরের লেখাটি দ্য ইন্ডিপেনডেন্টে প্রকাশিত তার নিবন্ধের অনুবাদ। অনুবাদ করেছেন নাজমুল আহসান

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button