গাজায় শোকের পাহাড়ে ত্যাগের ঈদ

Gazaশাহ মুহাম্মদ মোশাহিদ: অনেকেই পশু জবাই করে কোরবানি দিয়েছেন। কেউ দিতে পারেননি। তবে না দেয়ার অংশটাই বেশি। বলছি যুদ্ধবিধ্বস্ত উপত্যকা গাজার কথা। শনিবার সেখানে উদযাপন হলো পবিত্র ঈদুল আজহা। আর এতে পশুর রক্ত ঝড়িয়ে অনেকের হয়তো কোরবানী দেয়ার সামর্থ হয়নি। তবে ইসরাইলের আগ্রাসনে নিজেদের রক্ত ঢেলে কোরবানী হয়ে গেছেন অনেক মুসলমান।
গাজায় শনিবার যারা ঈদ উদযাপন করেছেন। সাত সপ্তাহের যুদ্ধে তাদের হারানোর তালিকা দীর্ঘ। ইসরাইলের বোমা কেড়ে নিয়েছে কারো স্বজনদের জীবন। কাতরাতে কাতরাতে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছে অসংখ্য নিষ্পাপ শিশু। ধ্বংস হয়েছে বসতবাড়ি, পথ ঘাট, হাসপাতাল এবং বাগান।
সাত সপ্তাহের নৃশংস হামলা মাটিতে গুড়িয়ে দিয়েছে গাজার অর্থনীতি। যুদ্ধের সরাসরি প্রভাবে গাজার ঈদটা কেটেছে নিরানন্দ। মহান আল্লাহ তায়ালার উদ্দেশে ত্যাগ করে উৎসব করতে পারেন নি অনেকেই। এ ধ্বংশ উপত্যকার বাচ্চারা কিনতে পারেনি নতুন জামা।
১১ বছরের কিশোর মাহমুদ সেতাত। গাজায় অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের কারণে চাকরি হারিয়েছেন তার বাবা। তাই সংসারে অভাব অনটন লেগেই আছে। সেতাত সে অনটনের কথা বুঝতে পারছে। তাই বলে ঈদের আনন্দটা একেবারে ধুলোয় মিশিয়ে দেয়া যায় না।
ঈদের আগে কাপড়ের দোকানে গিয়ে সে একটি শার্ট ও প্যান্ট পছন্দ করে এসেছিলো। কিন্তু এ দুটোও কিনে দিতে পারলেন না বাবা। তাই ভীষণ মন খারাপ।
ঈদের আগে সংবাদ সংস্থা এ এ কে সেতাত বলেছিলো, আমি চাই না ঈদটা আসুক। যদি নতুন জামা গায়ে দিয়ে একটু আনন্দই করতে না পারলাম, তো সেটা আবার কিসের ঈদ?
সেতাত বলে, এ বছর ঈদে আমাদের পরিবারের কেউ নতুন জামা কিনতে পারিনি। বাবা বলছেন, কিনে দেয়ার মতো টাকা নেই তার কাছে।
সেতাতের  বন্ধুদের কয়েকজন ঈদের জামা কিনেছে। তাই ঈদের এ কয়টা দিন একেবারেই ঘর থেকে বের হচ্ছে না সে।
গাজার এক বাবা খালেদ জামান। তিনি আগে একটি দোকানের মালিক ছিলেন। তার অবস্থাও ভালো নয়। তিন সন্তানদের কারো জন্য পোশাক কিনে দিতে পারেন নি।
জামান বলেন, বাচ্চারা তো নতুন জামা গায়ে দিয়ে একটু ঈদের আনন্দ করতে চায়। আমিও চাই ওদের হাসিমুখ দেখতে। কিন্তু চেষ্টা করেও বাচ্চাদের দাবি মেটাতে পারছি না।
পাঁচ সন্তানের জননী খেতাম আল জামালি। প্রতি বছর ঈদ এলেই সন্তানদের কুকিজ বিস্কুট খাওয়াতে হয় তার। কিন্তু প্রথমবারের মতো এবারের ঈদে কুকিজ বিস্কুট কিনতে পারেননি তিনি। কিনে দিতে পারেন নি নতুন জামা।
জামালি জানান, তার স্বামী সরকারি চাকরি করেন। কিন্তু পাঁচ মাস ধরে বেতন আটকে আছে। হাতে অবশিষ্ট যে টাকা আছে, সেগুলো নিয়ে কুকিজ বিস্কুট কেনাটা তাদের জন্য স্বপ্নের মতো।
তিনি বলেন, আমার স্বামী যখন বেতন পেতেন, তখনো পুরোটা হাতে পেতেন না। অল্প টাকা দিয়ে টেবিলে প্রতিদিনের খাবারের যোগান দিতেই হিমশিম খেতে হতো তার।
শুধু জামালির স্বামীই নন, গাজায় এমন ৪৫ হাজার চাকরিজীবির বেতন বন্ধ রয়েছে। আর বেতন বন্ধ থাকলে কেনাকাটাও বন্ধ। কৃষিজমিগুলো তছনছ করায় চাষবাষেরও ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। লণ্ডভণ্ড করা হয়েছে বাগান। আর সামগ্রিক অর্থনৈতিক ধকল টানতে হচ্ছে ব্যবসায়িদেরও।
ইসাম আল সাওয়াফিরি। গাজার একটি পোশাকের দোকানের মালিক। কিন্তু দোকানে বিক্রিবাট্টা নেই। ঈদ উপলক্ষ্যেও হাতে গোনা কয়েকটি পোশাক বেচতে পেরেছেন।
তিনি জানান, দিন দিন অর্থনৈতিক অবস্থা নিচের দিকেই নামছে। গাজার ৯০ শতাংশ অর্থনীতি স্থবির হয়ে আছে। আর এসবের ভোক্তভোগি আমরা।
তিনি অর্থনৈতিক স্থবিরতার কারণ হিসাবে সরাসরি এ যুদ্ধকে দায়ি করছেন। তবে গাজায় সাত বছরের ইসরাইলের অবরোধের কারণে দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পড়েছে বলে জানান।
আর গাজা শ্রমিক ইউনিয়ন জানিয়েছে সরাসরি যুদ্ধের প্রভাবে ৩০ হাজার গাজাবাসী কাজ হারিয়েছেন। বেকারত্বের পরিমাণ দুই লাখ থেকে বেড়ে নয় লাখে পৌঁছেছে।
ফিলিস্তিনী সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় বলেছে, এ যুদ্ধের ফলে গাজায় দরিদ্র লোকের সংখ্যা দ্বিগুণ হয়েছে। তাদের হিসাবে দরিদ্রর সংখ্যা ছিলো ৬০ হাজার। এখন এটি দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ২০ হাজারে।
এই হলো গাজাবাসীর হালচাল। তাছাড়া বড় একটি ধকলের পর এদের মাথার ওপর এখন শোকের পাহাড়। আর সামনে নীল বিষের আহ্বান। এ অবস্থায় কি ঈদের আনন্দ ছুঁয়ে যেতে পারে?
তবুও সেখানে ঈদুল আজহা উদযাপন হয়েছে।। শত বোঝা মাথায় নিয়েও ঈদের নামাজটুকু আদায় করেছেন। অনেকে কোরবানী দিয়েছেন। স্বজনদের খোঁজ নিয়েছেন। আনন্দও করেছেন। যাকে বলা যায়, শোকের পাহাড়ে ত্যাগের আনন্দ। -সূত্র: ডেইলি সাবাহ

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button