“গ্রেটার ইসরায়েল”: আরব জাতীয় নিরাপত্তার জন্য এক বিশাল চ্যালেঞ্জ

ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু সম্প্রতি “গ্রেটার ইসরায়েল” ধারণার প্রতি তাঁর অটল অঙ্গীকার ঘোষণা করেছেন। তিনি স্পষ্টভাবে ইসরায়েলের ভবিষ্যৎকে এমন এক প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত করেছেন, যা বর্তমান সীমান্ত ছাড়িয়ে পার্শ্ববর্তী আরব ভূমিতে বিস্তৃত। ইসরায়েলের জনগণ যখন দৃঢ়ভাবে ডানপন্থার দিকে ঝুঁকেছে, তখন দীর্ঘতম মেয়াদি নেতা নেতানিয়াহুর মন্তব্য বিশেষ গুরুত্ব বহন করেছে। এই মন্তব্যের তাৎপর্য আরও স্পষ্ট হয় যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের আগের বক্তব্যে, যেখানে তিনি বলেছিলেন ইসরায়েল “খুব ছোট”; যার অর্থ এর সীমান্ত প্রসারিত হওয়া উচিত। এই দৃষ্টিভঙ্গি ওয়াশিংটনের নীতিনির্ধারণী মহলেও প্রায়ই প্রতিফলিত হয়।
নেতানিয়াহুর মন্তব্যে আঞ্চলিক প্রতিক্রিয়া দ্রুত এসেছে। সরকারগুলো তাঁর “গ্রেটার ইসরায়েল” প্রকল্পকে ঐতিহাসিক ও ধর্মীয় মিশন হিসেবে উপস্থাপনের নিন্দা জানিয়েছে এবং এটিকে তাদের সার্বভৌমত্ব ও আন্তর্জাতিক আইনের উপর সরাসরি আঘাত বলে অভিহিত করেছে। এককভাবে কিংবা যৌথভাবে জারি করা বিবৃতিগুলো আরব ও আন্তর্জাতিকভাবে কঠোর প্রতিক্রিয়ার আহ্বান জানিয়েছে। এদিকে সাম্প্রতিক আরব লীগ সম্মেলনে “যৌথ আরব নিরাপত্তা সমন্বয় কেন্দ্র” গঠনের অনুমোদন দেওয়া হয়, যা বাগদাদের নেতৃত্বে পরিচালিত হবে, সন্ত্রাসবাদ ও সংগঠিত অপরাধ মোকাবেলায়। যদিও এটি সীমিত পরিসরে একটি পদক্ষেপ, তবে এটি আরব দেশগুলোর সমষ্টিগত নিরাপত্তা কাঠামোর প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধির ইঙ্গিত দেয়।
নেতানিয়াহুর এই ঘোষণা এমন এক হুমকির কথা তুলে ধরে, যেটি আরব রাষ্ট্রগুলো বহুদিন ধরে এড়িয়ে যেতে চেয়েছে। এটি তিনটি বাস্তবতার একটি। বিশেষত, এটি আরব জাতীয় নিরাপত্তার বর্তমান কাঠামোর একটি পূর্ণাঙ্গ পুনর্মূল্যায়নের প্রয়োজনীয়তাকে সামনে আনে, সাম্প্রতিক নানা ঘটনা ও আঞ্চলিক পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে।
দ্বিতীয় বাস্তবতা হলো গাজা ও ইরানের ওপর ইসরায়েলের হামলা, পাশাপাশি লেবানন ও সিরিয়ায় পরিচালিত অভিযান, যা কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে স্পষ্ট করে। ইসরায়েল তার গোয়েন্দা ও সাইবার সক্ষমতার গভীরতা প্রকাশ করেছে, যা ব্যবহার করে তারা সফলভাবে গুপ্তচরবৃত্তি ও আঞ্চলিক দেশগুলোতে অনুপ্রবেশ ঘটিয়েছে। নিরীহ জনগণকে হত্যার মাধ্যমে—বিশেষ করে গাজায়, তবে লেবানন, সিরিয়া, ইরান এবং ইয়েমেনেও—ইসরায়েল একটি বড় সীমারেখা অতিক্রম করেছে। এর ফলে তাদের উদ্দেশ্য নিয়ে থাকা শেষ ভ্রান্ত ধারণাগুলোও ভেঙে গেছে এবং এটি এমন এক নীতিনির্ধারণী গোষ্ঠীকে উন্মোচন করেছে, যাদের কর্মকাণ্ড আরব, মুসলিম এবং অঞ্চলের খ্রিস্টানদের প্রতি গভীর শত্রুতার প্রতিফলন ঘটায়।
ইসরায়েল কেবল সামরিক প্রতিরক্ষা ও আক্রমণাত্মক সক্ষমতা ধ্বংস করেই এই দেশগুলোকে দুর্বল করার চেষ্টা করেনি, বরং তাদের অভ্যন্তরীণ বিভাজন উসকে দিয়ে অস্থিতিশীলতাও সৃষ্টি করেছে। লেবাননে, যুক্তরাষ্ট্র লেবাননের নেতৃত্বকে হিজবুল্লাহর অস্ত্র সরিয়ে নিতে চাপ দিয়েছে, যা দেশটিতে বড় সংঘাত উসকে দিতে পারে। সিরিয়ায়, ইসরায়েল দক্ষিণাঞ্চলের সুয়েইদায় দ্রুজ সম্প্রদায়কে সমর্থন দিয়েছে, তাদের সুরক্ষা দিয়েছে এবং সিরীয় সেনাদের লক্ষ্যবস্তু করেছে। আর ইরানে, তারা সরকার পরিবর্তনের যেকোনো প্রচেষ্টাকে প্রকাশ্যে সমর্থন করেছে। এসব তথ্য প্রথম বাস্তবতাকে সমর্থন করে—নেতানিয়াহুর “গ্রেটার ইসরায়েল” ঘোষণার হুমকি।
তৃতীয় বাস্তবতা হলো আমেরিকা ও পশ্চিমা দেশগুলোর প্রতিশ্রুতি, যা ইসরায়েলের অবস্থান নিশ্চিত ও এর স্বার্থ রক্ষায় নিবেদিত। ৭ অক্টোবরের গাজা যুদ্ধের পর থেকে এটি আরও সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়েছে। যদিও পশ্চিমা প্রতিশ্রুতি নতুন নয়, মিসর, জর্ডান ও উপসাগরীয় দেশগুলো এখন ইসরায়েল থেকে ক্রমবর্ধমান হুমকির সম্মুখীন। যেহেতু তাদের নিরাপত্তা ও সামরিক ব্যবস্থা একই পশ্চিমা কাঠামোর ওপর নির্ভরশীল, যা ইসরায়েলের আধিপত্য নিশ্চিত করে, তাই একটি বিপজ্জনক দ্বন্দ্ব তৈরি হয়েছে। এই তিন বাস্তবতা মিলে আরব জাতীয় নিরাপত্তার কার্যকারিতা নিয়েই গভীর প্রশ্ন তুলে দেয়।
আমেরিকা ও পশ্চিমা প্রতিশ্রুতি আইন, কৌশলগত চুক্তি এবং বিপুল পরিমাণ অর্থনৈতিক সহায়তার মাধ্যমে ইসরায়েলের সামরিক শ্রেষ্ঠত্ব নিশ্চিত করেছে। ইতিহাসও এই ধারা প্রমাণ করে। যদিও যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের মধ্যে কোনো আনুষ্ঠানিক প্রতিরক্ষা চুক্তি নেই, ইরান সংকট থেকে শুরু করে পূর্ববর্তী আঞ্চলিক যুদ্ধে দেখা গেছে, যুক্তরাষ্ট্র বাস্তবে ইসরায়েলের নিরাপত্তাকে নিজেদের নিরাপত্তা হিসেবে গণ্য করে। ১৯৭৯ সালের ক্যাম্প ডেভিড চুক্তি থেকে শুরু করে ১৯৮১ সালের রোনাল্ড রিগানের অধীনে কৌশলগত সহযোগিতা চুক্তি পর্যন্ত, নিয়মিত সামরিক সমন্বয়কে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়া হয়েছে। ২০১৬ সালের মধ্যে ওয়াশিংটন ইসরায়েলকে ১০ বছরের জন্য ৩৮ বিলিয়ন ডলার সামরিক সহায়তার প্রতিশ্রুতি দেয়, যা যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে অন্য কোনো রাষ্ট্রকে দেওয়া সবচেয়ে বড় প্রতিশ্রুতি। এর আওতায় আয়রন ডোম মিসাইল প্রতিরক্ষা থেকে শুরু করে উন্নত সাইবার ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবস্থা পর্যন্ত সবই অন্তর্ভুক্ত। এমনকি যুদ্ধের সময় ব্যবহারের জন্য আমেরিকান সামরিক মজুদ ইসরায়েলের ভেতরেও রাখা আছে।
ইউরোপীয় ইউনিয়নও ইসরায়েলের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক অংশীদারিত্ব বজায় রেখেছে। যদিও ব্রাসেলস মাঝে মাঝে বসতি স্থাপনের নীতির সমালোচনা করে, তবুও প্রযুক্তি, গবেষণা ও নিরাপত্তার ক্ষেত্রে ইসরায়েলকে কৌশলগত অংশীদার হিসেবে বিবেচনা করে। হরাইজন গবেষণা কর্মসূচি, গ্যালিলিও স্যাটেলাইট সিস্টেম এবং ইউরোপল সন্ত্রাসবাদবিরোধী চুক্তি এই দৃঢ় সম্পর্কের উদাহরণ। ন্যাটোতেও, যদিও ইসরায়েল সদস্য নয়, ১৯৯৪ সাল থেকে তাদের “মেডিটারেনিয়ান ডায়ালগ”-এর একটি কেন্দ্রীয় অংশীদার করা হয়েছে। ভূমধ্যসাগরে নৌ অভিযান থেকে শুরু করে যুক্তরাজ্য ও জার্মানির সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক প্রতিরক্ষা চুক্তি পর্যন্ত, ইসরায়েলের গভীর প্রাতিষ্ঠানিক সম্পর্ক রয়েছে, যা মানবিক সংকট সত্ত্বেও স্থগিত করা অত্যন্ত কঠিন।
অন্যদিকে, আরব প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা কাঠামোগতভাবে সীমাবদ্ধ। যুদ্ধবিমান থেকে শুরু করে ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ও সাইবার নিরাপত্তা পর্যন্ত অধিকাংশ আরব সেনাবাহিনী আমেরিকান বা ইউরোপীয় সরবরাহকারী, চুক্তি এবং তদারকির ওপর নির্ভরশীল। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চুক্তিগুলোতে প্রায়ই স্পষ্টভাবে উল্লেখ থাকে যে এসব অস্ত্র ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা যাবে না, বরং নিশ্চিত করতে হবে যে ইসরায়েল প্রযুক্তিগত শ্রেষ্ঠত্ব বজায় রাখবে। উপসাগরীয় রাষ্ট্রগুলোর বিমান প্রতিরক্ষা নেটওয়ার্ক পশ্চিমা প্রাথমিক সতর্কীকরণ ব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত, আর মিসরও (যা ইসরায়েলের পর মার্কিন সামরিক সহায়তার দ্বিতীয় বৃহত্তম গ্রহীতা) কিছু কৌশলগত ব্যবস্থা হালনাগাদ বা মোতায়েন করতে পারে না ওয়াশিংটনের অনুমতি ছাড়া। এই পারস্পরিক নির্ভরশীলতা আরব কৌশলগত স্বায়ত্তশাসন ক্ষুণ্ণ করে এবং যুক্তরাষ্ট্রকে কার্যত আরব সামরিক প্রতিক্রিয়ার ওপর ভেটো ক্ষমতা দেয়। এছাড়া, আরব-ইসরায়েল স্বাভাবিকীকরণকে উৎসাহিত করার মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র এই নির্ভরশীলতাকে আরও গভীর করেছে, যা আরব সামরিক সক্ষমতা ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে এমন কাঠামোর সঙ্গে বেঁধে ফেলেছে, যা ইসরায়েলি শ্রেষ্ঠত্বকে টিকিয়ে রাখে।
বর্তমান দ্বিধা অত্যন্ত স্পষ্ট: আরব নিরাপত্তা কাঠামো পশ্চিমা ব্যবস্থার অধীনস্থ, যা আইনগত ও কৌশলগতভাবে ইসরায়েলের সামরিক শ্রেষ্ঠত্ব রক্ষায় বাধ্য। সুতরাং, নেতানিয়াহুর “গ্রেটার ইসরায়েল” ধারণা কেবল রাজনৈতিক বক্তৃতা নয়; এটি আরব সার্বভৌমত্বের সরাসরি চ্যালেঞ্জ। বহু বছর ধরে আরব সরকারগুলো তাদের জাতীয় নিরাপত্তা কৌশলে ইসরায়েলি হুমকিকে পাশ কাটিয়ে এসেছে, বরং অভ্যন্তরীণ বা অন্যান্য আঞ্চলিক সমস্যার ওপর মনোযোগ দিয়েছে। কিন্তু সাম্প্রতিক ঘটনা—গাজার যুদ্ধ থেকে শুরু করে ইরান, লেবানন ও সিরিয়ার ওপর হামলা, এবং সুস্পষ্টভাবে সম্প্রসারণবাদী উচ্চাশার প্রকাশ—এই হুমকিকে সামনে এনেছে। এখন ঝুঁকির বিষয় কেবল হুমকির সংজ্ঞা নয়, বরং কীভাবে আরব রাষ্ট্রগুলো স্বাধীন নিরাপত্তা কাঠামো গড়ে তুলবে, যা এর মোকাবিলা করতে সক্ষম হবে। এ ধরনের পুনঃসমন্বয় ছাড়া আরব জাতীয় নিরাপত্তা এমন একটি কাঠামোর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে, যা বাইরের হুমকির বিরুদ্ধে রক্ষার জন্য নয়, বরং এমন একটি আঞ্চলিক শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য নকশা করা হয়েছে, যেখানে ইসরায়েলের শ্রেষ্ঠত্ব নিশ্চিত। তবুও এই চ্যালেঞ্জ বিশাল। তিন বাস্তবতার সংযোগ—ইসরায়েলের সম্প্রসারণবাদী কর্মসূচি, ইসরায়েলের প্রতি নিঃশর্ত মার্কিন-পশ্চিমা সমর্থন এবং আরব নিরাপত্তা ব্যবস্থার কাঠামোগত নির্ভরশীলতা—একটি প্রায় অসম্ভব পরিস্থিতি তৈরি করেছে স্বাধীন আরব প্রতিক্রিয়ার জন্য। -ড. সানিয়া ফয়সাল আল-হুসেইনি, ফিলিস্তিনের আরব-আমেরিকান বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক। তিনি একজন লেখক ও গবেষক, যিনি বহু রাজনৈতিক প্রবন্ধ ও গবেষণা প্রকাশ করেছেন। আল-হুসেইনি দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে ফিলিস্তিনি জাতীয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে তথ্য ও কূটনৈতিক দায়িত্বে কাজ করেছেন। ২০০৮ সাল থেকে তিনি ফিলিস্তিনের বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছেন, যার মধ্যে রয়েছে বিরজেইত বিশ্ববিদ্যালয় এবং আল-কুদস বিশ্ববিদ্যালয়। ২০১৩-২০১৪ সালে তিনি অক্সফোর্ড সেন্টার ফর ইসলামিক স্টাডিজ এবং ২০১৭-২০১৮ সালে জর্জটাউন বিশ্ববিদ্যালয়ে একাডেমিক ভিজিটর হিসেবে আমন্ত্রিত হন। সম্প্রতি তিনি আরব-আমেরিকান বিশ্ববিদ্যালয়ের সংঘাত সমাধান বিভাগ এবং কূটনীতি ও আন্তর্জাতিক আইন বিভাগের ফ্যাকাল্টি সদস্য হিসেবে যোগদান করেছেন।

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button