ইতিহাসের পাতায় লিপিবদ্ধ করতে চলেছেন ঋষি সুনাক

ঋষি সুনাক একজন সুপার হিরো অর্থমন্ত্রী

পরবর্তী ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তার সম্ভাব্যতা নিয়ে জল্পনাকল্পনা শুরু হয়ে গিয়েছে

কঠিন এক পরিস্থিতির মধ্যে চ্যান্সেলর অব এক্সচেকারের (ব্রিটিশ অর্থমন্ত্রী) দায়িত্ব গ্রহণ করেন ঋষি সুনাক। নভেল করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ওই সময় যুক্তরাজ্যকে ঠেলে দেয় ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ মন্দার দিকে। অস্বাভাবিক রকমের কঠিন এ পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে গিয়ে সাহস, ধৈর্য, ধীশক্তি ও যোগাযোগ দক্ষতা প্রদর্শন করে চলেছেন ঋষি সুনাক। এরই মধ্যে সংকট মোকাবেলায় ব্রিটিশ ক্যাবিনেটে নিজের অন্যান্য সহকর্মী বিশেষত প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনের চেয়েও ভালো পারফরম্যান্স দেখিয়েছেন তিনি।

কভিড-১৯ সংকটের শুরুতেই ঋষি সুনাকের প্রতিশ্রুতি ছিল, ব্রিটিশ অর্থনীতিকে বাঁচাতে যেকোনো পদক্ষেপ গ্রহণের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক মতাদর্শ কোনো ধরনের বাধা হয়ে দাঁড়াবে না। সেই প্রতিশ্রুতি পূরণের পথে লাখ লাখ মানুষের চাকরি এবং হাজার হাজার ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানকে বাঁচাতে এখন পর্যন্ত ১৯ হাজার কোটি পাউন্ডের (প্রায় ২৪ হাজার কোটি ডলার) রাষ্ট্রীয় অনুদান প্যাকেজ ঘোষণা করেছেন তিনি, যা যুক্তরাজ্যের ইতিহাসে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বরাদ্দকৃত সবচেয়ে বড় রাষ্ট্রীয় প্যাকেজ।
অর্থনীতিতে করোনার ধাক্কা মোকাবেলায় গৃহীত পদক্ষেপগুলো এরই মধ্যে ঋষি সুনাককে কনজারভেটিভ পার্টির সবচেয়ে জনপ্রিয় রাজনীতিবিদদের একজনে পরিণত করেছে। গত সপ্তাহেও অতিরিক্ত ৩ হাজার কোটি পাউন্ডের একটি মিনি বাজেট বেইলআউট প্যাকেজ ঘোষণা করেছেন তিনি। ব্রিটিশ একটি সংবাদমাধ্যমের দাবি, সংকট মোকাবেলায় এসব পদক্ষেপ পর্যাপ্ত কিনা তা সময়ই বলে দেবে, তবে তার সাহসী এসব পদক্ষেপ অনেকটা জুয়ার শামিল। যাই হোক না কেন, নিজেকে ইতিহাসের পাতায় লিপিবদ্ধ করতে চলেছেন ঋষি সুনাক।
ব্রিটিশ ওই গণমাধ্যমটির প্রতিটি দাবির সপক্ষে যুক্তিও রয়েছে। এসব প্যাকেজ বাস্তবায়ন করতে গিয়ে যুক্তরাজ্যের সরকারি ঋণের মাত্রাও বেড়ে চলেছে ব্যাপক হারে। এপ্রিলে অর্থবছরের শুরুতে যেখানে দেশটির সরকারি ঋণের পরিমাণ ছিল ৬ হাজার ২০০ কোটি পাউন্ড, সেখানে চলতি ২০২০-২১ অর্থবছর (এপ্রিল-মার্চ) শেষে দেশটির বার্ষিক ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়াতে পারে ৩৫ হাজার কোটি পাউন্ডে। সেক্ষেত্রে ষাটের দশকের শুরুর বছরগুলোর পর এবারই প্রথম যুক্তরাজ্যের সরকারি ঋণ দেশটির অর্থনীতির ব্যাপ্তিকেও ছাড়িয়ে যাওয়ার শঙ্কা রয়েছে।

অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক ঋষি সুনাক গোল্ডম্যান স্যাকসে চাকরি করেছেন তিন বছর। পরবর্তী সময়ে ক্যালিফোর্নিয়ার স্যানফোর্ড থেকে এমবিএ ডিগ্রি অর্জন করেন তিনি। রাজনৈতিক ক্যারিয়ারে খুব দ্রুত উত্থান হয়েছে তার। গত বছরও তিনি ছিলেন পার্লামেন্টারি আন্ডার-সেকেন্ডারি অব স্টেট ফর লোকাল গভর্নমেন্ট।

এর পরও সংকট মোকাবেলায় শুরু থেকেই একের পর এক সাহসী পদক্ষেপ নিয়ে চলেছেন ঋষি সুনাক। সম্প্রতি ব্রিটিশ পার্লামেন্টে এক বক্তব্যে তিনি বলেন, যেকোনো সরকারের পক্ষে নিজেকে সংজ্ঞায়িত করার সুযোগ খুব কমই থাকে। কিন্তু আমরা এ সংকট দিয়ে সংজ্ঞায়িত হব না, হব এটিকে মোকাবেলায় আমাদের গৃহীত পদক্ষেপগুলো দিয়ে।
মহামারীজনিত অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে গিয়ে গত সপ্তাহেই সবচেয়ে বড় সংকটের মুখোমুখি হন ঋষি সুনাক। বুধবারই তিন মাসের লকডাউন থেকে বেরুনোর পর ব্রিটিশ জনগণের ব্যয় সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য ৩ হাজার কোটি টাকার একটি প্যাকেজ ঘোষণা করেন তিনি। আসন্ন শারদীয় বাজেটে এ ধরনের আরো পদক্ষেপ ঘোষণা করা হবে বলেও এ সময় ঘোষণা দেন তিনি।
আগামী কয়েক মাসেই পরিষ্কার হয়ে যাবে, ১ কোটি ২০ লাখেরও বেশি কর্মীর মজুরি পরিশোধের মাধ্যমে ব্রিটেনে কর্মসংস্থানের সংকট কাটানোয় কতটা সাফল্য অর্জন করতে পারবেন ঋষি সুনাক। বুধবার ঘোষিত প্যাকেজটির অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য ছিল করোনাকালে ছুটিতে থাকা কর্মীদের চাকরি বাঁচানো, অল্পবয়সী কর্মীদের নতুন ভূমিকায় উঠিয়ে আনা এবং ধুঁকতে থাকা অতিথি সেবা ও প্রপার্টি খাতের পুনরুজ্জীবনে ভূমিকা রাখা।
ডানপন্থী রক্ষণশীল দলের অর্থমন্ত্রী ঋষি সুনাকের পদক্ষেপগুলো এরই মধ্যে ব্যবসায়ী মহলের মতো প্রশংসিত হয়েছে বামপন্থীদের মধ্যেও। দেশটির বামপন্থী ইউনিয়ন নেতা লেন ম্যাকক্লাসকি এবং আটলান্টিকের ওপারে যুক্তরাষ্ট্রে ডেমোক্রেটিক ফায়ারব্র্যান্ড হিসেবে পরিচিত বার্নি স্যান্ডার্সও তার প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়েছেন। বার্নি স্যান্ডাসের মতে, ঋষি সুনাক যেভাবে অর্থনৈতিক সংকট মোকাবেলা করছেন, সেটিই সবচেয়ে যথাযথ পদ্ধতি।
শুরু থেকেই একের পর এক সমস্যা এসে দাঁড়িয়েছে ঋষি সুনাকের সামনে। ফেব্রুয়ারিতে ব্যাংক অব ইংল্যান্ড দেশটির শিল্প খাতসংশ্লিষ্টদের প্রস্তুত থাকার আহ্বান জানিয়ে বলেছিল, চলতি অর্থবছর দেশটির জিডিপির পতন হতে পারে ২ শতাংশ। প্রকৃতপক্ষে, এ পতনের হার হতে যাচ্ছে সবার ধারণার চেয়েও অনেক বেশি। অন্যদিকে সরকারি ব্যয় ও কর আহরণের মধ্যে তৈরি হয়েছে ব্যাপক ব্যবধান।

সাদাম্পটনে জন্মগ্রহণকারী ঋষি সুনাকের পূর্বপুরুষ ষাটের দশকে পূর্ব আফ্রিকা থেকে যুক্তরাজ্যে অভিবাসন নেন। তার পিতা ইয়াশভির ছিলেন ব্রিটিশ ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিসের একজন জেনারেল প্র্যাকটিশনার। মা উষা সাদাম্পটনে একটি ফার্মেসি চালাতেন।

সুনাক শুরু থেকেই ব্রেক্সিট সমর্থক হিসেবে পরিচিত। বর্তমান পরিস্থিতিতে দেখা যাচ্ছে এ ব্রেক্সিটই এখন হয়ে দাঁড়িয়েছে যুক্তরাজ্যের লাইফলাইন। অন্য কারো প্রতি কোনো জবাবদিহিতা ছাড়াই যুক্তরাজ্য চাইলেই এখন প্রয়োজনমতো মুদ্রা ছাপাতে সক্ষম, যে সুবিধাটুকু ইইউভুক্ত দেশগুলোর নেই।
যুক্তরাজ্যের অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারে এখন পর্যন্ত অর্থনীতির ভিন্ন ভিন্ন ক্ষেত্রে অন্তত ১০টি পুনরুদ্ধার স্কিম ঘোষণা করেছেন ঋষি সুনাক। এসব স্কিমের মধ্যে অন্যতম হলো করোনাভাইরাস জব রিটেনশন স্কিম (সিজেআরএস)। এটি কার্যকর হয় ২০ এপ্রিল। কার্যকরের সঙ্গে সঙ্গেই প্রায় সব এক অভূতপূর্ব মাত্রায় এটিকে লাইফলাইন হিসেবে লুফে নেন আকার-আকৃতির ব্যবসায়ীরা।
সুনাকের প্যাকেজ পোর্টফোলিওর উল্লেখযোগ্য একটি অংশ হলো বহুল প্রশংসিত ফিউচার ফান্ড। মূলত অলাভজনক-অনুদাননির্ভর গবেষণা ও উদ্ভাবনীমূলক এবং জীববিজ্ঞানসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোকে টিকিয়ে রাখার জন্য এ তহবিলের ঘোষণা দেন ঋষি সুনাক। অলাভজনক হওয়ায় এসব প্রতিষ্ঠানের পক্ষে সরকারি অন্য স্কিমগুলোর আওতায় সহায়তা পাওয়ার কোনো সুযোগ ছিল না।
ফিউচার ফান্ড স্কিমের কিছুদিন পরই প্রজেক্ট বার্চের ঘোষণা দেন ঋষি সুনাক। এ স্কিমের উদ্দেশ্য হলো কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ কোম্পানিগুলোকে শেয়ারের বিনিময়ে তহবিল সরবরাহ করা। এছাড়া স্বল্পমেয়াদি ঋণ ক্রয়ের মাধ্যমে বড় বড় কোম্পানিকে সহায়তা করার জন্য কভিড-১৯ করপোরেট ফিন্যান্স ফ্যাসিলিটি (সিসিএফএফ) ছাড়াও করোনাভাইরাস লার্জ বিজনেস ইন্টারাপশন লোন স্কিম (সিএলবিআইএলএস), করোনাভাইরাস বিজনেস ইন্টারাপশন লোন স্কিম (সিবিআইএলএস), বাউন্স ব্যাক লোন স্কিম (বিবিএলএস), আত্মকর্মসংস্থানকারীদের জন্য সেল্ফ এমপ্লয়মেন্ট ইনকাম সাপোর্ট স্কিম, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের জন্য হার্ডশিপ গ্র্যান্টস স্কিম এবং খুচরা ব্যবসায়ী ও অতিথি সেবা খাতের প্রতিষ্ঠানগুলোকে চলতি বছরের জন্য করছাড় ইত্যাদি স্কিমও ঘোষণা করেছেন সুনাক। এছাড়া ২৫ বছরের কম বয়সীদের জন্য অস্থায়ী ভিত্তিতে কর্মসংস্থান তৈরির জন্য ২০০ কোটি পাউন্ডের আরেকটি কর্মসূচির ঘোষণা দিয়েছেন তিনি।

অর্থনীতির সংকট মোকাবেলা করতে গিয়ে ঋষি সুনাক একদিকে হয়ে উঠেছেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ ও বিশ্বস্ত সহযোগীদের একজন, অন্যদিকে তার জনপ্রিয়তাও বেড়েছে ব্যাপক মাত্রায়। নিজেকে এতটাই বলিষ্ঠ ও প্রত্যয়ীভাবে উপস্থাপন করেছেন তিনি ব্রিটিশ ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন গণমাধ্যমে এরই মধ্যে পরবর্তী ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তার সম্ভাব্যতা নিয়ে নানা ধরনের জল্পনাকল্পনা শুরু হয়ে গিয়েছে।

অর্থনীতির সংকট মোকাবেলা করতে গিয়ে ঋষি সুনাক একদিকে হয়ে উঠেছেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ ও বিশ্বস্ত সহযোগীদের একজন, অন্যদিকে তার জনপ্রিয়তাও বেড়েছে ব্যাপক মাত্রায়। নিজেকে এতটাই বলিষ্ঠ ও প্রত্যয়ীভাবে উপস্থাপন করেছেন তিনি ব্রিটিশ ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন গণমাধ্যমে এরই মধ্যে পরবর্তী ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তার সম্ভাব্যতা নিয়ে নানা ধরনের জল্পনাকল্পনা শুরু হয়ে গিয়েছে। রক্ষণশীল দলের ওয়েবসাইট কনজারভেটিভহোমে পরিচালিত এক জরিপে ৯২ শতাংশ অ্যাপ্রুভাল রেটিং পেয়েছেন তিনি। এখানে বরিস জনসনের চেয়ে ৩৫ পয়েন্ট এগিয়ে রয়েছেন ঋষি সুনাক।
চ্যান্সেলর অব এক্সচেকারের দপ্তরে অধিষ্ঠিত হওয়ার আগেই পূর্বপুরুষের দেশ ভারতে বেশ পরিচিত নাম হয়ে উঠেছিলেন সাবেক হেজ ফান্ড ম্যানেজার ঋষি সুনাক। ২০০৯ সালে ভারতীয় টেক বিলিয়নেয়ার এবং আইটি জায়ান্ট ইনফোসিসের অন্যতম প্রতিষ্ঠাকা এনআর নারায়ণ মূর্তির মেয়ে অক্ষত মূর্তিকে বিয়ের মধ্য দিয়ে আলোচনায় আসেন তিনি।
সাদাম্পটনে জন্মগ্রহণকারী ঋষি সুনাকের পূর্বপুরুষ ষাটের দশকে পূর্ব আফ্রিকা থেকে যুক্তরাজ্যে অভিবাসন নেন। তার পিতা ইয়াশভির ছিলেন ব্রিটিশ ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিসের একজন জেনারেল প্র্যাকটিশনার। মা উষা সাদাম্পটনে একটি ফার্মেসি চালাতেন।
অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক ঋষি সুনাক গোল্ডম্যান স্যাকসে চাকরি করেছেন তিন বছর। পরবর্তী সময়ে ক্যালিফোর্নিয়ার স্যানফোর্ড থেকে এমবিএ ডিগ্রি অর্জন করেন তিনি। রাজনৈতিক ক্যারিয়ারে খুব দ্রুত উত্থান হয়েছে তার। গত বছরও তিনি ছিলেন পার্লামেন্টারি আন্ডার-সেকেন্ডারি অব স্টেট ফর লোকাল গভর্নমেন্ট। অন্যদিকে নিজ নির্বাচনী আসন রিচমন্ডে রক্ষণশীল দলের এমপি হিসেবে নির্বাচিত হওয়াটাও ছিল তার জন্য চ্যালেঞ্জের বিষয়। ওই এলাকায় এশীয় বংশোদ্ভূত ভোটার রয়েছে মাত্র দেড় শতাংশ।

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button