রোহিঙ্গাদের দুই বিকল্প : নিজ দেশে নির্মূল হওয়া অথবা সমুদ্রে ‘আশ্রয়’

Mayanmarতারা অসহায়ভাবে সাগরে ভেসে বেড়াচ্ছেন। অনেকে অপুষ্টিতে প্যারালাইজড হয়ে গেছেন। বাকিরা একেকটি জীবন্ত কংকাল। অথৈ সমুদ্রে কখনো রোদে পুড়ছেন, আবার বৃষ্টিতে ভিজছেন। খাবার নেই, পানি নেই। নিজেদের মূত্র পান করেও বেঁচে থাকার চেষ্টা করছেন অনেকে। ইতোমধ্যে মারাও গেছেন বহু। জাতিসংঘ মাসের পর মাস ধরে উদ্দেশ্যহীনভাবে ভেসে বেড়ানো নৌকাগুলোকে বলছে ‘ভাসমান কফিন’।
১৯ বছর বয়সী তরুণী মানু আবদুল সালাম চোখের সামনে ভাইকে মারা যেতে দেখেছেন। সেদিন তাদের নৌকার চালক একটি স্পিডবোটে করে পালিয়ে গিয়েছিল। তখন সেখানে ৮০০ জনের বেশি যাত্রী। খাবার-পানি শেষ হওয়ার পথে। চালক পালানোর পরে যাত্রীদের মধ্যে এক ভয়ংকর মারামারিতে মানুর ভাই মারা যায়। ইন্দোনেশিয়ার উপকূলে মানুদের নৌকা ডুবে যাচ্ছিল। এ সময় কিছু জেলের সেটা দেখে দয়া হয়। তারা তাদের নৌকায় করে মানুষগুলোকে উদ্ধার করে তীরে নিয়ে আসেন।
মানু তখন সাংবাদিকদের বলছিলেন, ‘যদি জানতাম নৌকায় এই ভয়ানক কষ্ট হবে তাহলে এখানে না এসে মিয়ানমারে থেকেই মারা যেতাম।’
উত্তর বার্মার রোহিঙ্গা এই তরুণী মোটেও বাড়িয়ে কিছু বলেনি। লন্ডন ইউনিভার্সিটির কুইন মেরি ইনস্টিটিউটের গবেষকদের  তৈরি একটি প্রতিবেদন দেখলে বোঝা যায় মানুর সমগোত্রীয়রা কিভাবে দেশটিতে রাষ্ট্র পরিচালিত গণহত্যার শিকার।
মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের অবস্থা নিয়ে গত কয়েক মাস ধরে গবেষণা করা একটি গ্রুপের সদস্য প্রফেসর পেনি গ্রীন বলছিলেন, ‘রোহিঙ্গাদের সামনে দুটি বিকল্প আছে। এক. দেশে অবস্থান করে ধীরে ধীরে নির্মূল হওয়ার জন্য অপেক্ষা করা। দুই. পলায়ন করে সমুদ্রে আশ্রয় নেয়া!
‘যদি আমরা গণহত্যাকে একটা সামগ্রিক প্রক্রিয়া হিসেবে দেখি, তাহলে মিয়ানমারে সেটাই হচ্ছে। একটা প্রক্রিয়াগত আয়োজনের মধ্য দিয়ে একটা জাতিগোষ্ঠীর লাখো মানুষকে ধীরে ধীরে মেরে ফেলা হচ্ছে’ বলেন প্রফেসর গ্রীন।
তিনি আরো বলেন, ‘যারা সেখানে অবস্থান করছেন তাদেরকে দারিদ্র্য, ক্ষুধা, অপুষ্টি, শারীরিক-মানসিক অসুস্থতা, চলাফেরায় নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদির মধ্যে বাঁচতে হচ্ছে। তাদের জন্য কোনো শিক্ষার ব্যবস্থা নেই, চিকিৎসা নেই। জমিতে মালিকানার অধিকার নেই। এছাড়া সবসময় মারধর-নির্যাতনের শিকার হওয়ার আশংকা তো রয়েছেই।’
১৯৮২ সাল থেকে মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের সে দেশের নাগরিক মনে করে না। আইন করে তাদের নাগরিকত্ব নিষিদ্ধ করা হয়েছে। সেখানকার সরকার তাদেরকে এমনকি ‘রোহিঙ্গা’ বলে ডাকতেও নারাজ। মিয়ানমার তাদের এসব নাগরিককে ডাকে ‘বাঙালি’ বলে!
গত সপ্তাহে অভিবাসী ইস্যু নিয়ে থাইল্যান্ড একটি সম্মেলন আহ্বান করার পর ‘রোহিঙ্গা’ শব্দ ব্যবহার করায় মিয়ানমারের পক্ষ থেকে সম্মেলনে যোগ না দেয়ার হুমকি দেয়া হয়।
অথচ প্রায় সাতশ’ বছর ধরে রোহিঙ্গারা বসবাস করে আসছেন রাখাইন রাজ্যে। সেখানে তাদের মোট সংখ্যা প্রায় ১৩ লাখ। জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী,  নিপীড়ন সহ্য করতে না পেরে গত তিন বছরে ১,২০,০০০ রোহিঙ্গা সাগর পথে দেশ থেকে পলায়ন করেছে।
তাদের অনেকে বাংলাদেশ, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া এবং মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে আশ্রয় নিয়েছে। উল্লেখ্যযোগ্য সংখ্যক মানুষ সমুদ্র পাড়ি দিতে গিয়ে নিহতও হয়েছেন।
২০১২ সাল থেকে মিয়ানমার সরকারের সাথে স্থানীয় বৌদ্ধরাও রোহিঙ্গা মুসলিমদের ওপর নির্যাতনে যোগ দেয়। একই বছর কয়েকশ’ রোহিঙ্গাকে হত্যা করা হয় বলে মানবাধিকার  সংস্থাগুলোর প্রতিবেদনে জানানো হয়। বাড়িছাড়া করা হয় কয়েক হাজারকে।
অসহায় এসব মানুষ আশ্রয়ের সন্ধানে ঘুরতে ঘুরতে অনেকে পড়েছেন মানব পাচারকারী চক্রের কবলে। কোনো দেশে আশ্রয় এবং কাজ পাইয়ে দেয়ার নামে তাদেরকে নিয়ে বন্দী করে রাখতো পাচারকারীরা। অনেককে সেখানে বন্দী রেখে মুক্তিপণ দাবি করতো। না দিতে পারলে নির্যাতন করে মেরে ফেলা হতো।
সম্প্রতি থাইলান্ডের এক জঙ্গলে এমন মানুষের গণকবর এবং পরে একে একে বহু বন্দী শিবিরের সন্ধান পাওয়ার পর আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আলোচনায় আসে রোহিঙ্গা সংকটটি। যদিও এসব বন্দী শিবিরে পাওয়া লোকজনের প্রায় অর্ধেক বাংলাদেশী বলে পরে জানা যায়। এসব বাংলাদেশী কাজের সন্ধানে সমুদ্র পাড়ি দিয়ে অন্য দেশে যেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাদেরও স্থান হয় রোহিঙ্গাদের সাথে।
বর্তমানে সাগরে ভেসে বেড়ানো এমন রোহিঙ্গা ও বাংলাদেশীর সংখ্যা ৮ হাজারের মতো বলে ধারণা করা হচ্ছে। এদের মধ্যে প্রায় দুই হাজার গত এক সপ্তাহে ইন্দোনেশিয়াসহ কয়েকটি দেশের তীরে আশ্রয় পেয়েছেন। -গার্ডিয়ান

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button