পারমাণবিক শক্তি করোনার কাছে মাথানত করছে

ড. মো. নূরুল আমিন: বিশ্বের পারমাণবিক শক্তিধর দেশগুলো করোনা ভাইরাসের কাছে অতি দুর্বল বলে প্রমাণিত হয়েছে বলে মনে হয়। তাদের এই শক্তি খোদায়ী গযব করোনা ভাইরাসের সামনে মাথানত করতে বাধ্য হচ্ছে, পারমাণবিক বোমার মালিকানা অথবা অর্থ-বিত্ত-সমৃদ্ধি তাদের কোন কাজেই লাগছে না। এ যাবত প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী বিশ্বব্যাপী মহামারী আকারে আক্রান্ত করোনা রোগীর সংখ্যা ৪৭ লাখ ছাড়িয়ে গেছে। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের করোনা রোগীর সংখ্যা প্রায় ১৫ লাখ, রাশিয়ার ২.৭৫ লাখ, স্পেনের ২.৭৬ লাখ, যুক্তরাজ্যের ২.৪৬ লাখ, ইতালীর ২.২৫ লাখ, ফ্রান্সের ১.৭৯ লাখ জার্মানীর ১.৭৬ লাখ এবং ব্রাজিলের ২.৩৩ লাখ মৃতের সংখ্যার দিক থেকে একক সুপার পাওয়ার যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান শীর্ষে, এক লাখের কাছাকাছি যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, চীন, ফ্রান্স, জার্মানী, যুক্তরাজ্য জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের এই স্থায়ী সদস্য দেশগুলোর প্রত্যেকটিই পারমাণবিক শক্তিধর দেশ। যুক্তরাষ্ট্র এবং রাশিয়াকে বলা হয়ে থাকে যে তাদের যে শক্তি আছে তা যদি প্রয়োগ করা হয় এবং তারা যদি পৃথিবীর দুই মেরুতে দুটি পারমাণবিক বোমার বিস্ফোরণ ঘটায় তাহলে দুই মেরুর বরফ গলে সারা দুনিয়াকে ভাসিয়ে দিতে পারে। বস্তুতঃ তারা গত দু’টি বিশ্বযুদ্ধে এবং আঞ্চলিক যুদ্ধসমূহে তাদের শক্তির ধ্বংসাত্মক পরিণাম দুনিয়াবাসীকে দেখিয়েও দিয়েছে।

উল্লেখ্য যে, স্টকহম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্স ইনস্টিটিউটের হিসাব অনুযায়ী ২০১৯ সালে সারা বিশে^ পারমাণবিক অস্ত্রের সংখ্যা ছিল ১৩৮৬৫টি। এর মধ্যে ৩৭৫০টি বিভিন্ন দেশে সেনাবাহিনীসহ মোতায়েন ছিল। ২০১৯ সালের প্রথমদিকে এই ১৩৮৬৫টি পারমাণবিক অস্ত্রের ৯০ মালিকানাই ছিল রাশিয়ার। বলাবাহুল্য, সাবেক সোভিয়েত প্রজাতন্ত্র বেলারুশ, কাজাকিস্তান ও ইউক্রেনের মালিকানাধীন অস্ত্রসমূহ রাশিয়ায় নিয়ে আসার ফলে এই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।
এই পারমাণবিক অস্ত্রগুলো সম্পর্কে একটা সাধারণ ধারণা পাওয়ার জন্য এগুলো তৈরি বাবদ যে অর্থ ব্যয় হয়, সে সম্পর্কে একটি ধারণা পাওয়া দরকার। হোয়াউট হাউসের দেয়া এক তথ্য অনুযায়ী নিউ মেক্সিকো মরুভূমিতে পরীক্ষা করা যুক্তরাষ্ট্রের ট্রিনিটি প্লুটোনিয়াম ইমপ্লোসিভ বোমা, হিরোশিমায় ব্যবহৃত লিটল বয় ইউরেনিয়াম বোমা, ফ্যাটম্যান প্লুটোনিয়াম বোমা এবং অব্যবহৃত ইউরেনিয়াম বোমার ন্যায় অস্ত্রগুলো বাবদ দেশটি খরচ করেছে প্রত্যেকটির পেছনে ২৪.১ বিলিয়ন ডলার। আবার তাদের বাইও-নিউক্লিয়ার বোমার প্রত্যেকটির ডিসপ্লেজিং ব্যয় হচ্ছে সাড়ে সাত বিলিয়ন ডলার। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রযুক্তিগত দিক থেকে অত্যন্ত উন্নত একটি দেশ হিসেবে পরিচিত। এই হিসাবে অন্যান্য দেশের তৈরি বোমাগুলোর ব্যয় বরাদ্দ কত ছিল তা সহজেই অনুমেয়। বলাবাহুল্য এই বোমা তৈরি, তার পেছনে প্রযুক্তি ও অর্থ ব্যয় তার কোনটিই মানুষের কল্যাণের জন্য নয়, প্রতিদ্বন্দ্বী দেশ ও তার জনগণকে ধ্বংস করা, ত্রাসের মধ্যে রাখা এবং আধিপত্য বিস্তারের জন্য। আল্লাহ তায়ালা জ্ঞান-বিজ্ঞান প্রযুক্তি দিয়েছেন মানুষের কল্যাণের জন্য। কিন্তু শক্তিধর দেশগুলোসহ আমরা তাকে ব্যবহার করছি ধ্বংসাত্মক কাজে। করোনার গযব ছড়িয়েছে প্রায় ছয় মাস হতে চলেছে। শক্তিধর দেশগুলোর শক্তি ও প্রযুক্তি আজ পর্যন্ত এর কোনও প্রতিষেধক উদ্ভাবন করতে পারেনি। তারা কুপোকাৎ হয়ে পড়েছে। সম্ভবত এটা তাদের অতীত অপরাধেরই প্রতিদান।
এএফপির এক রিপোর্ট অনুযায়ী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এ যাবত ইরাকে যে রক্ত ঝরিয়েছে তা দিয়ে সে দেশে তৃতীয় একটি নদীর সৃষ্টি হতে পারে। রিপোর্ট অনুযায়ী গোটা ইরাক আজ নিরাপত্তাহীন একটি দেশ। মৃত্যু এই দেশের প্রত্যেকটি স্থানে ওঁৎ পেতে রয়েছে। যেকোন মুহূর্তে যেকোন লোক বোমা বিস্ফোরণ বা বোমা বর্ষণের শিকার হতে পারে। এই কারণে ২৫ লক্ষ ইরাকী দেশ ত্যাগ করে শরণার্থী হয়েছে। মৃত ব্যক্তিদের দাফনের জন্য সেখানে কবরস্থানের জায়গা ছিল না। মানবতার আর্তনাদ সেখানে আকাশে-বাতাসে ভেসে বেড়িয়েছে। ভুল স্বীকার করে পশ্চিমা বিশ্ব ও যুক্তরাষ্ট্র কি গণহত্যার দায় থেকে মুক্তি পেতে পারে? এটা কি সভ্যতার সংঘর্ষ? টুইন টাওয়ার হামলার জন্য বিন লাদেনকে দায়ী করে তার গ্রেফতার ও হত্যার জন্য একটি দেশ ও তার বাসিন্দাদের ধ্বংস করে একইভাবে এফবিআই এখন রিপোর্ট দিয়েছে যে, টুইন টাওয়ারে হামলার জন্য বিন লাদেনের সম্পৃক্ততার কোনও প্রমাণ পাওয়া যায়নি, তারা তা পাননি। অর্থাৎ অভিযোগটি মিথ্যা, যারা অভিযোগ করেছেন তারাই এখন বলছেন, অভিযোগটি মিথ্যা। আর হান্টিংটন এই মিথ্যা অভিযোগ চাপিয়ে দেয়া আফগান ও ইরাক যুদ্ধকে সভ্যতার দ্বন্দ্ব থিওরির প্রমাণ হিসাবে উপস্থাপন করার চেষ্টা করেছেন। তিনি এবং তার সহযোগীরা ইসলাম ও মুসলমানদের উপর সন্ত্রাসের দায়ও চাপিয়েছেন। যে কোন বিচারে এটা বর্বরতার লক্ষণ। অবশ্য এ সত্যটি যে হান্টিংটন নিজেই জানেন না তা নয়, তিনি নিজে younth Bulge Theory নামক আরেকটি তত্ত্ব উদ্ভাবন করেছেন। এতে তিনি বলেছেন, “I don’t think that Islam is anymore violent than any other religion and I suspect if you added it all up, more peope have been slaughtered by christians over the centuries than by muslims. But the key factors is the demographic factor. Generally speaking the people who go out and kill other people are makes between the ages of 16 and 30.
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে খুন রাহাজানিতে এমনকি স্কুলছাত্ররাও যে কত নিবিড়ভাবে সম্পৃক্ত তা সকলেরই জানা। যুব উচ্ছৃঙ্খলতা এবং অপরাধ প্রবণতা পাশ্চাত্যের জীবনী শক্তিকে এখন ধ্বংস করে দিচ্ছে।
পাশ্চাত্যের দেশগুলো ইসলামের উপর সন্ত্রাস ও মানুষ হত্যার কল্পিত অপরাধ চাপিয়ে আসছে। অথচ ইসলাম বহির্ভূত পাশ্চাত্য শক্তিগুলো সাম্প্রতিক অতীতে সারা দুনিয়ায় যে ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে তার তথ্য লোমহর্ষক। কঙ্গো ফ্রি স্টেটে ১৮৮৬ থেকে ১৯০৮ পর্যন্ত বেলজিয়ামের নির্যাতনে ৬৫ হাজার লোক নিহত হয়েছে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে (১৯১৪-১৮) ৮৫ লাখ লোক, রাশিয়ার গৃহযুদ্ধে (১৯১৭-২২) ২৮ লাখ ২৫ হাজার, স্ট্যালিন শাসনামলে (১৯২৪-৫৩) ২ কোটি লোক, আবিসিনিয়ায় ইতালীর অভিযানে (১৯৩৫-৩৬) ১ লাখ ৬০ হাজার লোক, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে (১৯৩৯-৪৫) ৭ কোটি ১০ লাখ লোক, যুদ্ধোত্তরকালে পূর্ব ইউরোপ থেকে জার্মানদের বিতাড়নের ফলে ২৩ লাখ ৮৪ হাজার, চীনা গৃহযুদ্ধে (১৯৪৫-৪৯) ৩০ লাখ লোক মাও সেতুং এর শাসনামলে (১৯৪৯-৭৫) চীনে ৪ কোটি লোক, কোরিয়ান যুদ্ধে (১৯৫০-৫৩) ১২ লাখ লোক, মার্শাল টিটোর শাসনামলে যুগোশ্লাভিয়ায় (১৯৪৪-৮০) ২ লাখ ৫০ হাজার লোক, আলজেরিয়ায় ফরাসী নির্যাতনে (১৯৫৪-৬১) ১০ লাখ লোক, ভিয়েতনামের উপর যুক্তরাষ্ট্রের চাপিয়ে দেয়া যুদ্ধে (১৯৬৫-৭৩) ১০ লাখ ৩৩ হাজার, ক্যাম্বোডিয়ার খেমাররুজ শাসনামলে (১৯৭৫-৭৮) ১৫ লাখ, সোভিয়েত আফগান যুদ্ধে (১৯৭৯-৮৯) ২০ লাখ, ইরান-ইরাক যুদ্ধে (১৯৮০-৮৮) ১০ লাখ, উপসাগরীয় যুদ্ধে (১৯৯০-৯১) ১ লাখ ৫০ হাজার এবং বসনিয়ার যুদ্ধে (১৯৯২-৯৫) ২ লাখ ৮০ হাজার সামরিক ও বেসামরিক লোক নিহত হয়েছে। সূত্র: Britenica and other internet sources including http:llusersesols.com/ m.white28/warstatx.htn)
এই হত্যাযজ্ঞের মোট যোগফল দাঁড়ায় ১৬ কোটি ২৭ লক্ষ ৮২ হাজার। এই সংখ্যা বৃটেনের ন্যায় প্রায় তিনটি দেশের মোট জনসংখ্যার সমান। এই হত্যাকাণ্ডগুলো ঘটেছে একটি শর্তাদিতে, বিংশ শতাব্দিতে এবং এতে ইসলাম এবং মুসলমানদের সম্পৃক্তি ছিল না। এসব যুদ্ধ বিগ্রহ ও ধ্বংসযজ্ঞে যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, যুক্তরাজ্যসহ বিশ্ব শক্তিগুলোর সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল। অসহায় ও নিরাপরাধ মানুষ হত্যার এই যজ্ঞ কখনো তাদের অন্তরে অপরাধ বোধ জাগায়নি। আধিপত্য ও মতবাদ প্রতিষ্ঠার এই যজ্ঞ তাদের সর্বদা উৎসাহ যুগিয়েছে বলে মনে হয়।
শক্তিধর দেশগুলোর মানবতাবিরোধী অপরাধের এখানেই শেষ নয়। এশিয়া, আফ্রিকা, ল্যাটিন আমেরিকা ও অস্ট্রেলিয়ার বিভিন্ন দেশে উপনিবেশ প্রতিষ্ঠায় ও তারা মানুষের উপর চরম নির্যাতন চালিয়েছে, স্বাধীন মানুষকে ক্রীতদাসে রূপান্তরিত করে তাদের জাতীয় উন্নয়নে এসব মানুষকে ব্যবহার করেছে এবং এমনকি এখনো করছে।
ফিলিস্তিন, কাশ্মীর, চীনের উইঘুর প্রভৃতি তথাকথিত এই বিশ্ব শক্তিগুলোরই সৃষ্টি এবং এক্ষেত্রে শুধু পাশ্চাত্য নয়, প্রাচ্যেরও দুটি বড় দেশ ও শক্তি ভারত ও চীন জড়িত। তাদের অত্যাচার নির্যাতনে এসব অঞ্চলের মানুষ নিগৃহীত। ভারতের মুসলমানদের উপর নির্যাতন তো চলছেই।
নৈতিক চরিত্রের দৃষ্টিকোণ থেকে উন্নত দেশগুলো অধঃপতনের চরমসীমায় পৌঁছে গেছে। তাদের অনুকরণে ও উৎসাহে অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোও এই রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়েছে। যে সডোমীর জন্য প্রাচীন আদ জাতিকে আল্লাহতায়ালা ধ্বংস করে দিয়েছিলেন। সেই সডোমী পাশ্চাত্যের দেশগুলোতে জীবনাচারের অংশ হয়েছে। সমলিঙ্গে বিয়ে এখন সেখানে বৈধ। মদ, জুয়া, যৌনাচারে তারা স্বাধীন। আল্লাহর প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠা এই ভূপৃষ্ঠকে অত্যাচার, অবিচার ও অনাচারের কেন্দ্রভূমিতে পরিণত করেছে। তার জবাবে বহু শতাব্দি পর খোদায়ী আজাব করোনা ভাইরাসের আবির্ভাব ঘটেছে। এর ফলে বিশ্বব্যাপী উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা বিরাজ করছে। স্রষ্টার পথে প্রত্যাবর্তন এবং আগামী দিনের পৃথিবীতে হানাহানি ও ইসলাম বৈরিতা নয়, শান্তির নীড় প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতিই ধ্বংসের হাত থেকে আমাদের রক্ষা করতে পারে বলে আমার বিশ্বাস।

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button