বঙ্গবন্ধুর মহাকাব্য এবং আল মাহমুদ’র নিশিডাক

খোরশেদ মুকুল: সাহিত্যে যুগবিভাগ ইতিহাসের আলোকে রচিত। ইতিহাসবেত্তারা তা বিভিন্নভাবে চিহ্নিত করেছেন। সাহিত্যে সর্বব্যাপী প্রভাব কিংবা নতুন ধারার প্রবর্তনের উপর ভিত্তি করেই মূলত এই বিভাজন। মধ্যযুগে চৈতন্যবাদের সর্বব্যাপী প্রভাবের কারণে একে ‘চৈতন্য যুগ’ (পনের শতক) কিংবা আধুনিক যুগে রবীন্দ্রনাথের প্রভাব বিস্তারকারী বিশদ সাহিত্যকর্মের জন্য সেটাকে ‘রবীন্দ্রযুগ’ বলে অবহিত করা হয়। অন্যদিকে ‘কল্লোল’ পত্রিকাকেন্দ্রিক সাহিত্যে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য সৃষ্টির কারণে একটি নির্দিষ্ট সময়কে (১৯২৩-১৯৩০) ‘কল্লোল’ যুগ হিসেবেও চিহ্নিত করা হয়। রাজনৈতিক পট পরিবর্তন কিংবা শাসকগোষ্ঠীর প্রভাব অনেকসময় সাহিত্য-সংস্কৃতির উপর এসে পড়ে। এতে সৃজনশীল এই জগতেও আমুল পরিবর্তন ঘটে। বিশ্বজুড়ে যেমন আমরা এই নজির দেখতে পাই ঠিক তেমনি বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। তবে যুগ বিভাজনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যতিক্রম। ইংরেজি সাহিত্যে ইংল্যান্ডের রানি প্রথম এলিজাবেথের (১৫৩৩-১৬০৩) প্রভাবের কারণে ‘এলিজাবেথীয় যুগ’ এবং রানি ভিক্টোরিয়ার (১৮৩৭-১৮৮০) নামানুসারে ব্রিটেনে ‘ভিক্টোরীয় যুগ’ কিংবা ভারতীয় সাহিত্যে গান্ধীর জীবন ও কর্মের যে প্রভাব সে কারণেই ১৯২০ সাল থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত দু’যুগের বেশি সময়কে ‘গান্ধী যুগ’ এর মত বাংলাদেশে তেমন কোনো যুগের প্রচলন এখনও পর্যন্ত হয়নি।

বায়ান্নর রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন, চুয়ান্নর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, আটান্নর সামরিক শাসন বিরোধী আন্দোলন, বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলন, ছেষট্টির ছয় দফা, ঊনসত্তরের মহান গণ-অভ্যুত্থান, সত্তরের নির্বাচন এবং একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধ এই দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় সার্থকতার সাথে সফল নেতৃত্ব এবং বাংলা সাহিত্যের অকৃত্রিম পৃষ্ঠপোষক, সাহিত্যানুরাগী ও সাহিত্যে তাঁর জীবন-কর্ম-দর্শনের ব্যপক প্রভাবের কারণে অনেকেই ১৯৫২ সাল থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত সময়কে ‘বঙ্গবন্ধু যুগ’ প্রচলনের পক্ষপাতি। ঢাকা টাইমস’র রিপোর্ট ( ০৯ আগস্ট, ২০১৭) অনুযায়ী বঙ্গবন্ধুর জীবন ও কর্মের উপর প্রায় ১৩ শতাধিক মৌলিক বই প্রকাশিত হয়েছে। বর্তমানে এই সংখ্যা কত হতে পারে তা সহজেই অনুমেয়। তবে বঙ্গবন্ধুর রচিত ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ এবং ‘কারাগারের রোজরামচা’ বইয়ের ব্যপকতা সবারই জানা।
আল মাহমুদ একজন কবি। যদিও তিনি সব্যসাচী লেখক। অনেকেই তাঁকে রাজনীতির নোংরা মারপ্যাঁচে ফেলার ব্যর্থ চেষ্টা করেছে। কিন্তু তিনি বারবার দৃঢ়কণ্ঠে উচ্চারণ করেছেন, “আমি রাজনীতিবিদ নই, কবি।” বঙ্গবন্ধুর ছয় দফার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে এবং ৭ মার্চের ভাষণে অনুপ্রাণিত হয়ে তিনি মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণ করেন। আল মাহমুদকে যুদ্ধকালীন সময়ে গঠিত মুজিবনগর সরকারের ৮ নং থিয়েটার রোডে প্রতিরক্ষা বিভাগের স্টাফ অফিসার হিসেবে নিয়োগ দেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ। যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে ‘গণকণ্ঠ’র সম্পাদক থাকাকালে রাজনৈতিক বিরোধিতার জের ধরে শেখ মুজিব তাঁকে জেলে পাঠান। প্রায় দশমাস কারাভোগের পর তিনি মুক্তি পান। মুক্তি পাওয়ার পর শেখ মুজিবের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় তিনি শিল্পকলা একাডেমিতে চাকরি পান। সেসময় যেখানে বঙ্গবন্ধু বিরোধীদের সহ্যই করতে পারতেন না সেখানে আল মাহমুদকে চাকরি প্রদান সত্যিই বিস্ময়কর। এইতো একজন কবির প্রাপ্তি। তাঁর নিয়োগপত্রে শেখ মুজিবের স্বাক্ষর রয়েছে। যেটি এখনও সেখানে সংরক্ষিত আছে। এই ঋণের তাড়নায় আল মাহমুদ লিখেছেন মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক কালজয়ী উপন্যাস ‘কাবিলের বোন’। যদিও ততদিনে আল মাহমুদের আদর্শগত পরিবর্তন প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু তিনি ভুলেননি তাঁর জীবনে বঙ্গবন্ধুর ভূমিকা।

আল মাহমুদের ‘নিশিডাক’ কবিতার কোথাও বঙ্গবন্ধু কিংবা ৭ মার্চের ভাষণের উল্লেখ না থাকলেও কবিতার বিষয়বস্তুর দিকে একটু নজর দিলেই বুঝা যায় এটি সেই মহাকাব্যের প্রেক্ষাপট নিয়ে রচিত। এমন উচ্চমার্গীয় লেখা সত্যিই বিরল। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের গুরুত্ব এবং এর সুদূরপ্রসারী প্রভাব নিয়েই ‘নিশিডাক’ কবিতা।

বঙ্গবন্ধুর প্রশংসাসূচক গদ্যের মত আল মাহমুদ খুব বেশি কবিতা লেখেননি। মাত্র একটি কবিতা তিনি লেখেন। যেটি বেবী মওদুদ সম্পাদিত বইয়ে উল্লেখ আছে। কবিতাটি তাঁর কোনো বইয়ে না থাকার কারণে অনেক বিরুদ্ধবাদীই এর কঠোর সমালোচনা করেছেন। যেমনিভাবে আক্রমণের শিকার হয়েছেন কম কবিতা লেখার কারণে। কিন্তু আমরা ভুলে যাই অন্যান্য হাজার কবিতার চাইতে শিল্পগুণ এবং ঐতিহাসিক গুরুত্বের বিচারে এই কবিতার স্থান অনেক উপরে। আগেই উল্লেখ করেছি বঙ্গবন্ধুর ছয় দফার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে এবং ৭ মার্চের ভাষণে অনুপ্রাণিত হয়ে তিনি মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণ করেন। বঙ্গবন্ধুর আহবানে যে কয়জন কবি-সাহিত্যিক মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি ঝাঁপিয়ে পড়েন আল মাহমুদ তাদের মধ্যে অন্যতম।
আল মাহমুদের ‘নিশিডাক’ কবিতার কোথাও বঙ্গবন্ধু কিংবা ৭ মার্চের ভাষণের উল্লেখ না থাকলেও কবিতার বিষয়বস্তুর দিকে একটু নজর দিলেই বুঝা যায় এটি সেই মহাকাব্যের প্রেক্ষাপট নিয়ে রচিত। এমন উচ্চমার্গীয় লেখা সত্যিই বিরল। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের গুরুত্ব এবং এর সুদূরপ্রসারী প্রভাব নিয়েই ‘নিশিডাক’ কবিতা। ‘তার আহবান ছিল নিশিডাকের শিসতোলা তীব্র বাঁশীর মত।’ পাকিস্তানিদের শোষণের কারণে বাংলার আপামর জনতা অতিষ্ঠ হয়ে গিয়েছিল। ক্ষোভ আর ঘৃণার সমস্তটায় ঢেলে দিয়েছেল সামরিক শাসকের প্রতি। তখনই বঙ্গবন্ধুর ভাষণকাব্যে মানুষের রক্তে মুক্তি প্রবাহ জাগ্রত হয়। মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে শেখে নির্যাতিত বাংলাদেশীরা। বেরিয়ে পড়ে ঘর ছেড়ে। স্বাধীনতার স্বাদ আস্বাদনের জন্য। একযোগে ঝাঁপিয়ে পড়ে মুক্তিসংগ্রামে। বঙ্গবন্ধুর প্রেরণাদায়ক ও উজ্জ্বীবনীমূলক ভাষণের কারণেই মানুষ জীবনের মায়া ভুলে গিয়ে পতঙ্গের মতো ঝাঁকে ঝাঁকে অগ্নিকু-ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। পোয়েট অব পলিটিক্স খ্যাত মহানায়কের সেদিনের ভাষণ কবির ভাষায়-
সে যখন বলল, ‘ভাইসব।’
অমনি অরণ্যের এলোমেলো গাছেরাও সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে গেল
সে যখন ডাকলো, ‘ভাইয়েরা আমার।’
ভেঙে যাওয়া পাখির ঝাঁক ভীড় করে নেমে এল পৃথিবীর ডাঙায়
এমন শক্তিশালী প্রকাশ সত্যিই কল্পনাতীত। সাধারণ মানুষ ছাড়াও কবি-সাহিত্যিকরা অংশ নেয় এই যুদ্ধে। তাঁরা ভুলে যায় বন্দুক এবং কলমের পার্থক্য। একটাই লক্ষ্য, একটাই পথ। মুক্তি। স্বাধীনতা মহাকাব্যের মহাকবির হৃদয়স্পর্শী সেই ভাষণ কবি হৃদয়ে যে প্রাণের সঞ্চার করে তা কবির ভাষায়-
কবিরা কলম ও বন্দুকের পার্থক্য ভুলে হাঁটতে লাগল
খোলা ময়দানে।
আল মাহমুদ নিজেই সক্রিয় মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। ছিলেন সরকারি কর্মকর্তা। নারী ও প্রেমের কবি হিসেবে পরিচিত সেই আল মাহমুদই মুক্তিযুদ্ধের সময় লিখেছেন ‘ক্যামোফ্লাজ’ নামের অসাধারণ কবিতা। সেই ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা কবির ভাষায়-
‘এই আমি,
নগন্য এক মানুষ
দেখি, আমার হাতের তালু ফুঁড়ে বেরিয়ে এসেছে
এক আগুনের জিহ্বা।
এটিই চিরন্তন সত্য যে, বঙ্গবন্ধুর আহ্বানেই মানুষ ঝাঁপিয়ে পড়েছিল মুক্তির সংগ্রামে। চিন্তা করেনি কী পরিণতি অপেক্ষা করছে। নিশ্চিত মৃত্যু জেনেও মানুষ হাতে তুলে নিয়েছিল আগ্নেয়াস্ত্র। নিরীহ নারী-পুরুষ সাহসী হয়ে পাকিস্তানিদের রুঁখে দাঁড়াবার ধৃষ্টতা দেখিয়েছিল। কী মোহ সেই ভাষণের! কবির ভাষায়-
বলো, তোমার জন্যই কি আমরা হাতে নিইনি আগুন?
নদীগুলোকে ফুা ধরতে শেখায়নি কি তোমার জন্য-
শুধু তোমারই জন্য গাছে গাছে ফুলের বদলে ফুটিয়েছিলাম ফুলকি,
আম গাছে গুচ্ছ গুচ্ছ ফলেছিল
গ্রেনেড ফল। আর সবুজের ভেতর থেকে ফুৎকার দিয়ে
বেরিয়ে এলো গন্ধকের ধোঁয়া।
মানুষ মরে গেলেও বেঁচে থাকে তাঁর কর্ম। কর্মগুণেই মানুষ অমর হয়। অনেকেই সেই অমরত্বে হিংসা করে। কিন্তু তারা ভুলে যায় হিংসা মানুষকে ধ্বংস করে। কালের গর্বে হারিয়ে যায় হিংসুকেরা। অম্লান থাকে বীর। উঁচু যার শির। অমর বঙ্গবন্ধু। আর অমর আল মাহমুদ।

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button