হিটলারের উত্থানে আমেরিকার অবদান

আখতার হামিদ খান: আমেরিকা কেমন করে হিটলারকে দানবরূপে সৃষ্টি করেছিল তারই অনুসন্ধান করতে এই লেখা। এটি দুই ভাগে বিভক্ত। প্রথম ভাগের সময়কাল হিটলারের জার্মানীতে ক্ষমতায় আসার আগে অর্থাৎ প্রাক-১৯৩৩ সাল এবং দ্বিতীয়ভাগের আলোচনায় রয়েছে হিটলারের শাসনকাল অর্থাৎ ১৯৩৩ থেকে ৪৫ সাল পর্যন্ত। সবশেষে আছে বিখ্যাত নিউরেমবুর্গ বিচার সম্বন্ধে কিছু প্রাসঙ্গিক আলোচনা।
সাল ১৮৬৫, হিটলারের জন্মের দু’যুগ পূর্বে আমেরিকার গৃহযুদ্ধ অবসানের ভিতর দিয়ে কৃষ্ণাঙ্গ ক্রীতদাসেরা মুক্তি পায়। মুক্তি এল অবশ্যই, কিন্তু সেটা সম্পূর্ণ রাজনৈতিক কারণে, কোন মহানুভব প্রাণের, অর্থাৎ রাষ্ট্রপতি লিঙ্কনের দয়ায় নয়, যেমনটি বিশ্বাস করা হয় আমেরিকায়। আমেরিকার দক্ষিণের প্রদেশগুলি থেকে প্রচলিত ক্রীতদাস প্রথা বিলোপের অর্থনৈতিক কারণও ছিল। সব মিলিয়ে তাই আব্রাহাম লিঙ্কন স্পষ্ট ভাষায় বলেছিলেন “এই যুদ্ধের ফলে ক্রীতদাসেরা মুক্তি পেল কি না তাতে আমাদের বিন্দুমাত্র উৎসাহ নেই। আমরা শুধু দক্ষিণের উপর বিজয় চাই।” আমেরিকার ক্ষুদ্র ইতিহাস জানতে-উৎসাহী পাঠকের দৃষ্টিগোচর ভিডালের Inventing a Nation (ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয় প্রকাশনী) বইটির প্রতি আকর্ষণ করব। ১৮৬৫ সাল। চাবুক এবং শেকল থেকে কৃষ্ণাঙ্গরা মুক্তি যদিও বা পেল কিন্তু বর্ণবৈষম্যবাদের নিষ্ঠুরতা অব্যাহত থাকে। মুক্তি পেয়ে ভিক্ষাপাত্র হাতে যখন তারা উদ্বাস্তুর মত আমেরিকার বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে একটু সুস্থ জীবন ধারণের জন্য, ঠিক তখনই কৃষ্ণাঙ্গ বিধান (Black Codes) তৈরী হলো আমেরিকায়। এই বিধিবিধান দ্বারা আইন হলো যে, কৃষ্ণাঙ্গরা শ্বেতাঙ্গদের এলাকায় কোন প্রকার চাকরী এবং ব্যবসা করতে পারবে না। বসবাস করা তো দূরস্ত, তাদের মুখদর্শনও যেন শ্বেতাঙ্গরা না-করে। এই নিয়মাবলীর সঙ্কলনকে জিম ক্রো আইন বলা হয়, যার সম্বন্ধে বেশির ভাগ শ্বেতাঙ্গ আমেরিকানরা হয় জানে না বা জানতে আগ্রহী নয়।

এই জিম ক্রো আইন লঙ্ঘন করলে নিগ্রোদের প্রকাশ্য জনসমাবেশে জ্যান্ত পুড়িয়ে মারা হত। কাতারে কাতারে শ্বেতাঙ্গ পরিবার চড়ইভাতির আমেজে জড়াে হত এই নৃশংস হত্যাকাণ্ড দেখতে। সব থেকে আশ্চর্যের বিষয় হলো যে, আইন-শৃঙ্খলা বজায় রাখতে পুলিশও মোতায়েন করা হত, অবশ্যই শ্বেতাঙ্গ পুলিশ। ঐতিহাসিক ইভা. বি. ওয়েলস বারনেটের হিসেবে ১৮৮২ (হিটলারের জন্মের সাত বছর আগে) থেকে ১৮৯৯ (হিটলার যখন দশ বছরের বালক) সাল অবধি শুধু আমেরিকার দক্ষিণ প্রদেশগুলিতে আড়াই হাজারের অধিক নিগ্রোকে প্রকাশ্য জনসমাবেশে জ্যান্ত পোড়ানো হয়। এই জিম ক্রো আইনের আওতায়। নিগ্রোদের নিষিদ্ধ এলাকার মধ্যে ছিল শ্বেতাঙ্গদের-ব্যবহৃত জলাশয়, পার্ক, বাস, ট্রেন, হাসপাতাল, কবরস্থান এবং বেশ্যাপল্লী। আমেরিকায় প্রচলিত এই জিম ক্রো আইনের সঙ্গে প্রায় চার দশক পরে নাৎসী জার্মানীতে প্রণীত কুখ্যাত নিউরেমবুর্গ আইনের তুলনামূলক আলোচনা পরে করা হয়েছে। সাল ১৯০৭, হিটলার তখন আঠার বছরের কিশোর এবং ভিয়েনার একটি আর্ট স্কুলে পড়ার হওয়ার স্বপ্ন দেখছে। ঠিক সেই বছর আমেরিকার ২৯টি প্রদেশে বাধ্যতামূলক নির্বীর্যকরণ আইন চালু হলো। পরবর্তী দশ বছরে আমেরিকাব্যাপী, ২৭,০০০ মানুষ ‘দূষিত রক্ত’ বহনের অপরাধে নিবীর্য হলো। দূষিত রক্ত’ বহনের লক্ষণ হলো শারীরিক এবং মানসিক ভাবে বিকলাঙ্গ, মৃগী রোগী, অপরাধী (প্রধানতঃ ছিচকে চোর ধরনের দরিদ্র মানুষ) এবং সর্বোপরি দরিদ্র। এইসব মানুষদের যে শুধু নিবীর্যই করা হত তা নয়, আমেরিকার বড় বড় প্রদেশে যার মধ্যে ভার্জিনিয়া এবং ক্যালিফোর্নিয়া অন্যতম, সেখানে এদের গতিবিধি নিয়ন্ত্রণ করে সীমাবদ্ধ এলাকায় রাখা হত যা অনেকটা হিটলারের ‘গ্যেটো’র প্রচ্ছায়া। সাল ১৯১২, হিটলার তখন শান্তিপূর্ণ ইউরোপে তেইশ বছরের যুবক। লন্ডনে আয়োজিত হলো প্রথম আন্তর্জাতিক সুপ্রজননবিদ্যা কংগ্রেস। ব্রিটিশ দার্শনিক ফ্রান্সিস গলটনের সৌজন্যে বানানো এই সুপ্রজননবিদ্যার (ইউজেনিকস) সারমর্ম হলো এই যে, প্রকৃতিতে জীবন সংগ্রামের দরুণ যেমন উন্নত অভিযোজন প্রাণী ও উদ্ভিদ জগতে বেঁচে থাকার সাফল্য বর্ধন করে সেই রকম মানুষের মধ্যেও উন্নত প্রকৃতির মানুষ তুলনামূলকভাবে ‘নিকৃষ্ট মানের মানুষদেরকে জীবন-সংগ্রামে পরাজিত করে উৎকৃষ্ট মানব প্রজাতির অর্থাৎ শ্বেতাঙ্গ মানুষের সৃষ্টি করেছে। প্রসঙ্গে আসি, ১৯১২ সালে আয়োজিত সুপ্রজননবিদ্যা কংগ্রেসে খ্যাতিমান ব্যক্তিবর্গের মধ্যে ছিলেন খোদ চার্লস ডারউইনের পুত্র লিওনার্ড ডারউইন, ব্রিটিশ রাষ্ট্রীয় নৌ-বাহিনীর তত্ত্বাবধায়ক প্রধান (Lord of Admiralt) তথা ভাবী ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল এবং আলেকজান্ডার গ্রাহাম বেল ।
শ’চারেক বিজ্ঞানী প্রতিনিধি পাঁচদিনের এই কংগ্রেসে সমাজবিজ্ঞান এবং বংশপরম্পরায় চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যাদির পুনরাবৃত্তি প্রভৃতি বিষয়ে তুলকালাম আলোচনা করলেন। জার্নাল অব আমেরিকান মেডিক্যাল এসোসিয়েশনে লেখা হলো যে, সুপ্রজননবিদ্যার কংগ্রেসের মাধ্যমে মানব অভিব্যক্তিবাদের জ্ঞান শাখায় এক গৌরবময় অধ্যায়ের সূচনা হয়েছে। বৈজ্ঞানিক সংবাদদাতারা সোচ্চারে লিখেছিলেন যে, ডারউইনবাদের সামাজিক প্রেক্ষাপটে যেসব মানুষ অযোগ্য তাদের প্রতি সহানুভূতি জানিয়ে দান-খয়রাৎ করা এবং বিকলাঙ্গের চিকিৎসা করা এক পরম ভ্রম। তাঁরা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হলেন যে, গরীব তথা অপরাধপ্রবণ, রুগ্ন এবং বিকলাঙ্গের উন্নতি এবং পরিত্রাণের প্রচেষ্টা পরিত্যাগ করে শুধুমাত্র তাদের বংশবৃদ্ধি রোধ করার মধ্যেই আছে নিকৃষ্ট মানের মানুষের থেকে রক্ষা পাবার আশা। সেই সঙ্গে ঘটবে ‘উচ্চতর’ মানব প্রজাতির (অর্থাৎ শ্বেতাঙ্গদের) স্বচ্ছন্দ অভিব্যক্তি, যার মধ্যে নিহিত আছে মানব জাতির সর্বাঙ্গীণ মঙ্গল। অবশ্য আমেরিকান মেডিক্যাল এ্যাসোসিয়েশনের এই রিপোর্টের কোথাও উল্লেখ ছিল না যে, সামাজিক ডারউইনবাদের ভিত্তি কোন সুচারুরূপে-সম্পাদিত বৈজ্ঞানিক গবেষণা প্রসূত নয়। এর মূল ভিত্তি ছিল আমেরিকান শ্বেতাঙ্গদের ধর্মীয় কুসংস্কার এবং বর্ণবিদ্বেষী হীনমন্যতা যার মধ্যে আমেরিকার গৃহযুদ্ধের পর অবলুপ্ত দাস প্রথার হাহুতাশ ও ক্রন্দনই যেন শোনা যায়। সাল ১৯১৪, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালে ইউরোপে এক থমথমে ভাব। পঁচিশ বছরের হিটলার তখন জীবনে প্রতিষ্ঠাহীন যুবক এবং নবগঠিত ভাইমার গণরাজ্যে কাইজারের হুকুমাধীন এক নগণ্য সৈন্য। আমেরিকায় তখন সুপ্রজননবিদ্যার অপপ্রচার এতই তুঙ্গে যে এইসব জাল-ভুয়া গবেষণাকৃত ফল শিক্ষার মূলস্রোতে প্রবেশ করেছে। শ্বেতাঙ্গরা যে জন্মসূত্রে অপরাপর বর্ণের মানুষদের থেকে উৎকৃষ্টমানের এইসব ডাহা মিথ্যে কথা সুপ্রজননবিদ্যার নাম করে হার্ভার্ড, কলম্বিয়া, কর্নেল, ব্রাউন ইত্যাদি নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচীতে অন্তর্ভুক্ত হলো। – সাল ১৯১৬, হিটলার তখন প্রথম বিশ্বযুদ্ধ যে-নিষ্ঠুরতার জন্য খ্যাত, অর্থাৎ ট্রেঞ্চ যুদ্ধ, তাই করছেন। আমেরিকা তখনো যুদ্ধে লিপ্ত হয় নি। সেই বছর স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার অধ্যাপক লুইস টারম্যান স্ট্যানফোর্ড-বিনেট মেধাশক্তি পরীক্ষার (Stanford-Binet Intelligence Test) প্রচলন করলেন। সেই বছরেই লুইস টারম্যান এই পরীক্ষার বিষয় নিয়ে The Measurement of Intelligence (মেধাশক্তির পরিমাপ) নামে একটি বই লিখলেন, যা তৎক্ষণাৎ কলেজ পাঠ্যসূচীর অন্তর্ভুক্ত হলো। নিতান্তই কুৎসিত রূপকথামার্কা বইটির সারমর্ম ছিল এই যে, “খেটে খাওয়া মানুষ বা দাসী শ্রেণীর মেয়েরা, যারা হাজারে হাজারে আমেরিকায় রয়েছে, তারা দুর্বল-মানসিকতার এবং স্বল্পমেধার হলেও ভীষণভাবে বংশবৃদ্ধি করতে সক্ষম। মেধাশক্তির পরীক্ষায় দেখা গেছে যে, তাদের যতই স্কুলে পড়ানো হোক কেন এরা যেমনি বোকা তেমনি থাকবে। এই সমস্ত অশ্বেতাঙ্গ মানুষদের ইউরোপীয়ানদের মত উন্নত মানুষ করার চেষ্টা বৃথা, অতএব সরকার যেন এই প্রচেষ্টায় কোনরকম অর্থের অপব্যয় না করে। উপরন্তু এইসব ‘নিম্নজাতীয় মানুষদের বংশবৃদ্ধি অবিলম্বে রোধ করাতেই রয়েছে আমাদের মঙ্গল।”
মোটের উপর ১৯১৬ সালে আমেরিকার মনস্তাত্ত্বিক তথা শিক্ষাবিদদের ভুয়ো গবেষণার সারমর্ম এই ছিল যে, গরীবরা (প্রায় ৯০ শতাংশ নিগ্রো এবং রেড ইন্ডিয়ান) গরীব, কারণ তাদের বুদ্ধির বিকাশ ঘটে নি। অতএব তাদের বুদ্ধি বিকশিত করার চেষ্টা বৃথা। মানুষের মত দেখতে হলেও, মানুষের ভাষায় কথা বললেও, মানুষের মত কাঁদলেও এদেরকে কিছুতেই ইউরোপীয়ানদের মতো সভ্য করা যাবে না। তাই এদের দিয়ে দাসত্ব না-করাতে পারলে এদের অস্তিত্বের কোন মূল্য নেই।
এই সময়ে আমেরিকায় সুপ্রজননবিদ্যার প্রসার শুধু শিক্ষায়তনগুলিতে এবং কেতাবি। মানুষদের মধ্যেই সীমিত ছিল না, এর সুদূরপ্রসারী প্রভাব শিল্পপতি হেনরি ফোর্ডকেও গভীরভাবে স্পর্শ করেছিল। পৃথিবী বিখ্যাত মোটরগাড়ি বানাবার কারখানা ফোর্ড কোম্পানীর মালিক হেনরি ফোর্ড একজন সুপরিচিত ইহুদী-বিদ্বেষী ছিলেন। ফোর্ডের এই ইহুদী-বিদ্বেষ এতই প্রবল ছিল যে, তিনি ১৯১৫ সালে দি ভিয়ারবর্ণ ইনডিপেনডেন্ট নামে একটি সংবাদপত্র প্রকাশ করে তাতে যারপরনাই ইহুদী-বিদ্বেষ প্রচার করে চললেন। রাশিয়ায় বলশেভিক বিপ্লব এবং ইউরোপে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সূত্রপাত থেকে নিয়ে আমেরিকায় মাদকদ্রব্য পাচার পর্যন্ত অনেক কিছুর দোষ ইহুদীদের ঘাড়ে চাপিয়ে দিলেন ফোর্ড। ১৯৩০ সালে তিনি তার কোম্পানীর উচ্চপদে বেছে বেছে ফ্যাসিস্টদের প্রতি সহানুভূতিসম্পন্ন জার্মান আমেরিকানদের নিযুক্ত করেছিলেন।
১৯১৫-১৬ সালেই আটকে আছি আমরা। কারণ ওই দুই বছরে আমেরিকার মাটিতে সুপ্রজননবিদ্যার প্রসার এবং শ্বেতাঙ্গ বর্ণবৈষম্যবাদের ব্যাপ্তি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূচক হিসেবে পরবর্তীকালে যাকে দায়ী করা হয় সেই অ্যাডােল হিটলারের অভ্যুদয়ের দার্শনিক মদত যুগিয়েছিল। পাঠক মনে রাখবেন এই সময়ে হিটলার এক নগণ্য সৈনিক হিসেবে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে লড়াই করছেন। সেই সময়ে, অর্থাৎ ১৯১৬ সালে, নিউ ইয়র্ক জুলজিক্যাল সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতা ম্যাডিসন গ্রান্ট The Passing of the Great Race নামে একটি বই লিখলেন। ওই সময়কার রচিত এই বিষয়ের অপরাপর বইয়ের সঙ্গে এর বিশেষ কোন পার্থক্য ছিল না। মত এবং নীতি প্রচারের শ্লোগানে-ভরা, পাণ্ডিত্যহীন এই বইটির সারমর্ম হলো এই যে, আমেরিকায় ক্রমবর্ধমান বস্তি এবং বস্তিবাসীদের চাপে শ্বেতাঙ্গ মানুষের বিপদের সম্ভাবনা রয়েছে। এইসব গরীব বস্তিবাসীরা শুয়োরের মত বংশবৃদ্ধি করছে, যারা সবাই অপরাধী। অতএব সরকারের পক্ষে এই বস্তিবাসী-মানুষদের বংশবৃদ্ধি রোধ করা একান্ত কর্তব্য। এ বইটি যদিও ১৯১৬ সালে লেখা হয়েছিল তবু হিটলারকে এ-বইয়ের জার্মান অনুবাদের জন্য ১৯২৫ সাল অবধি অপেক্ষা করতে হয়েছে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে পরাজয়ের কলঙ্ক মাথায় নিয়ে যখন ক্ষতিপূরণ দেওয়ার ঋণের ভারে জার্মানী জর্জরিত, সেই সময়কার রাজনৈতিক এলোপাথাড়ি অবস্থার রাশ-টানার অভিপ্রায়ে-পাতা কুখ্যাত মিউনিখ ষড়যন্ত্রে ধরা-পড়ে হিটলার কারারুদ্ধ হন। বন্দী থাকাকালীন হিটলার যে আত্মজীবনী (মাইন কেমফ) রচনা করেছিলেন তাতে অগুণতি সেলাম জানিয়েছিলেন ম্যাডিসন গ্রান্টের ওই বইটিকে। জেলে থাকাকালীন হিটলার এইসব বর্ণবৈষম্যবাদী তথা সুপ্রজননবিদদের কাছে প্রশংসাসূচক চিঠি লিখতেন। এইসব চিঠিতে হিটলার মার্কিনী সুপ্রজননবিদদের কাছ থেকে মানব জাতির সুদূরপ্রসারী হিতকারিতা সম্বন্ধে যে দ্বিধাহীন আস্থা পেয়েছেন তা অকপটে, পঞ্চমুখে স্বীকার করেছেন।
সাল ১৯২৯, নাৎসী পার্টি তখনো জার্মানীতে ক্ষমতায় আসতে পারে নি। ১৯২৮ সালের নির্বাচনে তারা মাত্র তিন শতাংশ জাতীয় ভােট লাভ করে। হিটলার তখন জার্মানীর আকাশছোঁয়া বেকারত্ব এবং প্রায়-দেউলিয়া শিল্পকারখানার হাল ফেরাতে অসম্ভব ব্যস্ত, অবশ্য এইসব দুরবস্থার সমস্ত দোষ ইহুদীদের ঘাড়ে চাপিয়ে। আমেরিকায় তখন সুপ্রজনন আন্দোলন তুঙ্গে, আমেরিকান ইউজেনিক সোসাইটির ইশতেহার ব্যাপকভাবে ছড়ানো হচ্ছে বাজারে মেলাতে, যাতে লেখা থাকতো, “প্রতি ১৫ সেকেন্ডে তোমার ১০০ ডলার ব্যয় হচ্ছে সেইসব মানুষের যত্নার্থে যারা বদ-বংশোদ্ভূত এবং পাগল, হীন-মানসিকতা সম্পন্ন, অপরাধী অথবা শারীরিক বা মানসিকভাবে ত্রুটিপূর্ণ।” । সাল ১৯৩০, আমেরিকার সুপ্রজনন সোসাইটির প্রেসিডেন্ট ম্যাডিসন গ্রান্টের সঙ্গে দেখা করতে এলেন আর-এক মার্কিনী সুপ্রজননবিদ, লিন্ডন হুইটনি। লিন্ডন হুইটনির সুপ্রজননবিদ্যার জগতে খ্যাতির অন্যতম কারণ ছিল এই যে, তিনি ১৯৩৪ সালে নরওয়েতে আমেরিকাম ছাঁচে নিবীর্যকরণ আইন চালু করিয়েছিলেন জিপসীদের উপর। ড. হুইটনি যখন ড. গ্রান্টের সঙ্গে দেখা করতে এলেন ড. গ্রান্ট তখন সুপ্রজনন আবাসন কমিটির চেয়ারম্যান এবং আমেরিকাতে উত্তর-পশ্চিম ইউরোপের নরডিক এবং অ্যাংলোস্যাক্সন ছাড়া অন্যকোন দেশের মানুষের আবাসন বন্ধ করার আইন প্রণয়ন করে গর্বিত। হুইটনির সুপ্রজননবিদ্যার ক্রিয়া-কলাপের স্তুতিবাদ জানিয়ে জার্মানীর এক উঠতি এবং জনপ্রিয় নেতা ১৯৩০ সালে হুইটনিকে একটি চিঠি লেখেন, যা দেখাতে তিনি ম্যাডিসন এ্যান্টের কাছে আসেন। নিঃসন্দেহে হুইটনি খুবই গর্বিত বোধ করছিলেন। কিন্তু তাঁর গর্ব অত্যন্ত ক্ষণস্থায়ী হয়েছিল, কারণ গ্র্যান্ট ওই চিঠিতে পত্রলেখকের নামটি দেখে মৃদুহাস্যে নিজের চিঠির ফাইল থেকে পাচ বছর আগের একটি চিঠি বের করে হুইটনিকে দেখান। সেই চিঠিতে হুইটনিকে লেখা পত্রের লেখক জেল থেকে গ্র্যান্টকে তাঁর লেখা The Passing of the Great Race বইটির জন্য অভিনন্দন জানিয়ে উল্লেখ করেছেন যে, বইটা তার কাছে বাইবেলের সমান। এই পত্রলেখকই হলেন অ্যাডােলফ হিটলার। আর হিটলারের মানুষ-মারার ব্যাপক প্রকল্পের কাজ শুরু হতে তখনো কয়েক বছর বাকি। । সাল ১৯৩৩, হিটলার জার্মানীর চ্যানসেলর হলেন। এই সময় থেকে হিটলারের বর্ণবৈষম্যবাদী কর্মকাণ্ডকে তিনটি সময় অনুযায়ী ভাগ করা যায়। ১৯৩৩-৩৫-এ আইন করে ইহুদীদের বিভিন্ন সরকারি এবং বেসরকারি পেশায় প্রবেশ করার পথ রুদ্ধ করা হয়; ১৯৩৫-৩৮-এ নাৎসী পার্টি কর্তৃক নিউরেমবুর্গ আইন পাশের ফলে ইহুদীদের নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করে জার্মানী ত্যাগ করতে বাধ্য করা হলো; ১৯৩৯-৪৩-এ পোল্যান্ড আক্রমণ করে নাৎসীরা যখন ১৯৩৯-এর সেপ্টেম্বরে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সরকারিভাবে সূচনা করল তারপর থেকে পরবর্তী চার বছরে নাৎসী-অধিকৃত ইউরোপের বিভিন্ন দেশে মোট পঞ্চাশ লক্ষের অধিক ইহুদী, জিপসী ও স্লাভিককে দূষিত রক্ত’ বহনের অভিযোগে হত্যা করা হলো। । এখানে আমরা শুধু প্রসঙ্গের কারণে সব থেকে তাৎপর্যপূর্ণ বিষয়টি আলোচনা করব। যা হলো নিউরেমবুর্গ আইন। ১৮৭৭ সালে আমেরিকায় যে জিম ক্রো আইন চালু হয়েছিল তার মধ্যেই যে ১৯৩৫ সালে প্রণীত হিটলারের কুখ্যাত নিউরেমবুর্গ আইনের বীজ নিহিত ছিল তার দুটো প্রমাণ দিচ্ছি।
১.
ক. নিউরেমবুর্গ আইন প্রথম অনুপূরক আইন (ধারা ৪)। ইহুদীদের সরকারি স্কুলগুলিতে শিক্ষক ও ছাত্রদের অবশ্যই ইহুদী ধর্মাবলম্বী হতে হবে।
খ. জিম ক্রো আইন-কৃষ্ণাঙ্গদের জন্য পৃথক স্কুল স্থাপন করা হবে। কোন ও কৃষ্ণাঙ্গের পক্ষে শ্বেতাঙ্গদের স্কুলে যাওয়া কিংবা কোন শ্বেতাঙ্গের পক্ষে কৃষ্ণাঙ্গদের স্কুলে যাওয়া বেআইনী।
২.
ক. নিউরেমবুর্গ, জার্মান-নরডিক রক্তের সংরক্ষণÍকোন ইহুদী এবং নরডিক-শ্বেতাঙ্গ জার্মানের মধ্যে বিবাহ বেআইনী। যদি এই বিবাহ বিদেশে সম্পন্ন হয় তাহলে । জার্মানীতে তা অগ্রাহ্য করা হবে এবং নিয়ম লঙ্ঘনের অপরাধে শাস্তি দেওয়া হবে।
খ. জিম ক্রো আইন কোন শ্বেতাঙ্গের সঙ্গে নিগ্রো, মোঙ্গল, রেড ইন্ডিয়ান প্রভৃতি বর্ণের মানুষের বৈবাহিক সম্পর্ক বেআইনী। অদৃষ্টের এমনি পরিহাস যে, জিম ক্রো আইনের-নকলে প্রণীত নিউরেমবুর্গ আইনের হোতারা যখন যুদ্ধে জার্মানীর পরাজয়ের প্রাক্কালে এবং হিটলারের আত্মহত্যার পর অগ্রসররত সোভিয়েত রেড আর্মির হাত থেকে বাঁচার জন্য পলায়ন শুরু করলো তখন তারা নিজেদেরকে আমেরিকার হাতে সঁপে দেওয়াই শ্রেয় মনে করেছিল । ভাবটা বোধ হয় এই রকমের ছিল যে, ‘দূষিত রক্ত পরিষ্কারের প্রকল্পের দার্শনিক মদদ যারা দিয়েছে তারা নিশ্চয়ই নাৎসীদেরকে সহানুভূতির চোখে দেখবে। সেটা পরবর্তীকালে ঠাণ্ডা লড়াইয়ের সূত্রপাত ঘটাতে সফল হলেও ১৯৪৫ সালে মিত্রশক্তির, অর্থাৎ আমেরিকা-ব্রিটেন-ফ্রান্স-রাশিয়ার, দ্বারা অভূতপূর্ব আন্তর্জাতিক আদালত গঠিত হয়েছিল সেই নিউরেমবুর্গ শহরেই। এ বিচারের প্রথম পদক্ষেপে বর্বরোচিত আচরণের জন্য প্রথম সারির নাৎসী নেতাদের বিচার হয়। এইসব নেতাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্যরা ছিলেন জার্মান বায়ুসেনাধ্যক্ষ হারমান গ্যেরিং (ফাসির কয়েকঘণ্টা আগে সায়নাইড খেয়ে আত্মহত্যা করেছিলেন), নাৎসী বিদেশমন্ত্রী রিবেট্রপ, নাৎসী জার্মানীর গােয়েন্দা পুলিশ বাহিনীর প্রধান আরনেস্ট ক্যালটেনার, সেনাধ্যক্ষ কাইটেল এবং নাৎসী নীতির প্রচারকার্যের প্রধান জুলিয়াস স্ট্রাইকার। প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য যে, জুলিয়াস স্ট্রাইকারের কৌসুলি তার মক্কেলের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের খণ্ডনে যে-বক্তব্য পেশ করেছিলেন তাতে আমেরিকান আইনজীবী ঘর্মাক্ত কলেবর হয়েছিলেন, যা বিচারের উপস্থিতি সুধীদের দৃষ্টি এড়ায় নি। স্ট্রাইকারের কৌসুলি আমেরিকায়-প্রচলিত সেই সমস্ত বর্ণবৈষম্যবাদী আইনের উদাহরণ দিয়েছিলেন যেগুলো সম্বন্ধে ওপরে আলোচনা করা হয়েছে। অবশ্য এইসব তথ্যের উপস্থাপন দ্বারা। আখেরে কোন লাভ হয় নি, স্ট্রাইকারের ফাঁসি হয়েছিল। স্ট্রাইকারের বিরুদ্ধে দেয়া রায়ে আদালত যা বলেছিলেন তা হলো যে, “স্ট্রাইকার গত পঁচিশ বছর ধরে তার বক্তৃতা এবং লেখনীর দ্বারা ইহুদীদের বিরুদ্ধে এমন সব ঘৃণ্য প্রচার চালিয়েছিলেন যে তার ফলে সাধারণ জার্মানদের মন ইহুদীদের সম্বন্ধে ভীষণরকম বিষাক্ত হয়ে উঠেছিল। স্ট্রাইকার প্রকাশ্যে ইহুদীদের সম্পূর্ণ বিলোপ করার আহ্বান জানিয়েছিলেন।” স্ট্রাইকারের মত অপরাধীর শাস্তি অবশ্যই সমর্থনযোগ্য। কিন্তু সেক্ষেত্রে আমেরিকান সুপ্রজননবিদ পণ্ডিত এবং দার্শনিকরা কেন রেহাই পাবেন? হিটলারের বায়ুসেনাধ্যক্ষ হারমান গ্যেরিং যতই ঘৃণ্য মানুষ হোন না কেন এই প্রশ্নের উত্তর তিনিই ঠিক দিয়েছিলেন। গ্যেরিং নিউরেমবুর্গ বিচার সম্বন্ধে বলেছিলেন যে, “আজ আমাদের বিচার হচ্ছে কারণ যুদ্ধে আমরা পরাস্ত হয়েছি।”
নিউরেমবুর্গ বিচারে নাৎসী নেতাদেরকে ইহুদী গণহত্যার দোষে অভিযুক্ত করা হয়েছিল এই কারণে যে তারা সত্যি সত্যি অপরাধী ছিল। আদালতে আমেরিকান তরফের কৌসুলি বব জ্যাকসন আবেগভরা কণ্ঠে ঘৃণ্য গণহত্যার চিত্রানুগ বর্ণনা দিয়েছিলেন। মনে হলো যেন আমেরিকায় ইহুদীদের প্রতি কত করুণা!
এইবার আলোচনা করব হিটলারের শাসনকালে খােদ আমেরিকায় ইহুদীদের কি অবস্থা ছিল তা নিয়ে।

আমাদেরকে স্মরণে রাখতে হবে যে, ১৯৩০ সালের আগেই আমেরিকায় সুপ্রজননবিদদের তৎপরতায় আবাসন আইনের পরিবর্তন করে ইউরোপের উত্তর-পশ্চিমের দেশগুলি থেকে অ্যাংলো-স্যাক্সন এবং নরডিক জাতির মানুষ ছাড়া অন্য কাউকেই আমেরিকাতে স্থায়ীভাবে বসবাসের অনুমতি দেওয়া হচ্ছিল না। ফলে ইহুদীরা এই আইনের শিকার হয়। কিন্তু এই আইনের দ্বারা আঘাতপ্রাপ্ত হওয়া ছাড়াও ইহুদী-বিদ্বেষ আমেরিকার সর্বোচ্চ মানুষটির মধ্যে তখন সব থেকে প্রবল ছিল।
হিটলারের শাসন-সময়কার আমেরিকার রাষ্ট্রপতি ফ্যাঙ্কলিন রুজভেল্টের কথাই বলছি। রুজভেল্টই একমাত্র ব্যক্তি যিনি আমেরিকার ইতিহাসে তিন তিনবার রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। অতএব আমেরিকানদের মধ্যে তাঁর জনপ্রিয়তা যে কতখানি ছিল তা সহজেই অনুমেয়। এই রুজভেল্ট রাষ্ট্রপতি হিসেবে আমেরিকার সুপ্রীম কোর্টে দুই দাগী বর্ণবৈষম্যবাদীকে নির্বাচিত করেন। এই দুইজনের একজন হুগো ব্ল্যাক সুপ্রীম কোর্টের বিচারপতির পদে দীর্ঘ ৩৪ বছর আসীন ছিলেন। বিচারপতি ব্ল্যাক অ্যালাবামার জঘন্য কু-ক্লক্স-ক্ল্যান নামক গোষ্ঠীর সঙ্গে জড়িত ছিলেন, যে-গোষ্ঠীর সদস্যরা হিটলারের নাৎসী গােয়েন্দা পুলিশের (গেস্টাপো) মতই কৃষ্ণাঙ্গদের জ্যান্ত পোড়ানো থেকে নিয়ে এমন কোন নিষ্ঠুর কাজ ছিল না যা করত না। কু-ক্লক্স-ক্ল্যান এবং গেস্টাপোর মধ্যে পার্থক্যটা ছিল শুধু সময়ের। কু-ক্লক্সক্ল্যান আমেরিকায় ১৮৬৬ সাল থেকে নিয়ে প্রায় একশ বছর সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ চালিয়ে গেছে। পক্ষান্তরে গেস্টাপোরা ১৯৩৫ থেকে ১৯৪৪ অবধি জার্মানী এবং নাৎসী অধিকৃত ইউরোপের দেশগুলিতে ইহুদীদের সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করতে উদ্যত হয়েছে। ওইসব দেশের ইহুদীরা মরিয়া হয়ে আমেরিকায় আবাসনের আবেদন জন্য জানিয়েছে। রুজভেল্ট এই অভাবনীয় সঙ্কট মুহূর্তে ম্যাডিসন গ্র্যান্ট-প্রণীত বর্ণবৈষম্যবাদী আবাসন আইনের অজুহাত দেখিয়ে আবাসনের জন্য ইউরোপীয় ইহুদীদের আবেদন খারিজ করে দিলেন। এর শোচনীয় ফলশ্রুতি দাঁড়াল এই যে, পরবর্তী তিন মাসে কয়েক লক্ষ ইহুদীর বিনাশ ঘটল । শুধু তাই নয়, ১৯৪৩-এর জানুয়ারিতে যখন হিটলারের ইহুদী-নিধন চরমতম মাত্রায় চলছে তখন রাষ্ট্রপতি রুজভেল্ট স্পেনের ক্যাসাব্ল্যাঙ্কার একটি কনফারেন্সে উত্তর-আফ্রিকার ফরাসী উপনিবেশের দায়িত্বে দুই ফরাসী সেনাধ্যক্ষ নগু এবং জিরোকে পরামর্শ দিয়েছিলেন যে, উত্তর-আফ্রিকার ফরাসী শাসনাধীন দেশগুলিতে ইহুদীদের প্রভাব সংযত করতে তারা যেন হিটলারের পথ অনুসরণ করেন। অর্থাৎ হিটলারের নিউরেমবুর্গ আইনের মতন ইহুদীদের নাগরিক অধিকার খর্ব করার আইন-প্রণয়ন করতে ফরাসীরা যেন সচেষ্ট হন।
১৯৪২-৪৩ সাল, আমেরিকার দক্ষিণের একটি সুন্দর দ্বীপ পুয়েট্ররিকো। প্রাণরক্ষার জন্য নাৎসী-অধিকৃত ইউরোপ থেকে বেশ কিছু ইহুদী পালিয়ে আসে এই দ্বীপে। পুয়েট্ররিকোতে ইহুদীদের সংখ্যাবৃদ্ধিতে রাষ্ট্রপতি রুজভেল্ট হোয়াইট হাউসে মন্তব্য করেছিলেন যে, “এই পালিয়ে আসা ইহুদীদের ওই দ্বীপে ভবিষ্যত-বংশবৃদ্ধি রোধ করা হিটলারের পদ্ধতি অনুযায়ী অতিসহজ। বিদ্যুৎ-চালিত একটা ছোট মেশিন মাত্র কুড়ি সেকেন্ডে পুরুষদের নিবীর্য করে দেবে।”
সাল ১৯৪৩। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে আমেরিকার প্রধান শত্রু জাপান। কারণ বিনা প্ররোচনায় জাপান পার্ল হারবারে বোমা বর্ষণ করে আমেরিকার প্রশান্ত সাগরীয় নৌ বাহিনী প্রায় ধ্বংস করে দিয়েছিল। বর্ণবৈষম্যবাদী মার্কিন শ্বেতাঙ্গরা তখন জাপানীদেরকে ‘পীত আপদ’ বলে সম্বােধন করছে এবং আমেরিকার প্রশান্ত সাগরের উপকূলবর্তী পশ্চিমের প্রদেশগুলিতে জাপানী-বংশোদ্ভূত কিন্তু আমেরিকার স্থায়ী-নিবাসী জাপানীদের সঙ্গে হিটলারের গেস্টােেপা বাহিনীর মত আচরণ করে এবং তাদের সমস্ত সম্পত্তি আত্মসাৎ করে, নাগরিক অধিকার খর্ব করে, তাদেরকে বন্দী করা হয়। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল একটাই যে তারা জাপানী বংশোদ্ভূত এবং বংশপরম্পরায় আমেরিকায় বসবাস করলেও বিশ্বাসযোগ্য নয়। কোনো দেশের নাগরিকদের প্রতি এই মনোভাব পোষণের বর্ণবৈষম্যবাদ ছাড়া অন্য ব্যাখ্যা খুঁজে পাওয়া যায় না, আর এই বৈষম্যবাদের প্রমাণ দিয়েছেন স্বয়ং আমেরিকার রাষ্ট্রপতি রুজভেল্ট। ১৯৪৩ সালে রুজভেল্ট স্মিথসোনিয়ান সংস্থার নৃতত্ত্ববিদ্যার অধ্যাপক অ্যালেস হারডলিকাকে পত্র-মারফৎ প্রশ্ন করেছিলেন যে, জাপানীদের হীন মানসিকতার পিছনে নৃতাত্ত্বিক কারণটা কি? নৃতত্ত্ববিদ্যার এই অধ্যাপকটিও ছিলেন বেশ তালেবর ব্যক্তি। তিনি রাষ্ট্রপতিকে বোঝালেন যে, গত দু’হাজার বছর ধরে নাকি জাপানীদের মস্তিষ্ক শ্বেতাঙ্গদের তুলনায় কম উন্নত হয়েছে। তাই জাপানীরা স্বভাবতঃই নিকৃষ্ট । এই ব্যাখ্যা শুনে খুশি হয়ে রাষ্ট্রপতি সেই অধ্যাপককে পীত বর্ণের মানুষদের হীন চারিত্রিক গুণাবলী নিয়ে একটি বই লিখতে আদেশ দিয়েছিলেন। রুজভেল্টের এই আদেশের পেছনে অভিসন্ধিটি অবশ্যই বর্ণ-বৈষম্যের দোষে দুষ্ট। অধ্যাপক হারডুলিকা পরম উৎসাহে এই কাজে হাত দিয়েছিলেন, কিন্তু ওই বছরের শেষের দিকে অকস্মাৎ তাঁর মৃত্যু হওয়াতে ইতিহাস অন্ততঃ একটি মনুষ্যত্ব-বিরোধী লিখিত জঞ্জালের হাত থেকে রেহাই পেয়েছে। জাপান কর্তৃক ১৯৪১-এর ডিসেম্বরে হাওয়াইতে বোমা বর্ষণের ফলে আমেরিকা যখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণ করে, তখন থেকে যুদ্ধ শেষ-হওয়া পর্যন্ত মার্কিনী সেনাবাহিনীর সর্বস্তরে সরকারিভাবে শ্বেতাঙ্গ এবং নিগ্রো বিভেদ বজায় রাখা হয়েছিল। নিগ্রো রেজিমেন্ট ছিল সম্পূর্ণভাবে শ্বেতাঙ্গ সৈন্যবিহীন। আর সব থেকে দুঃখের বিষয় এই ছিল যে, আমেরিকান রেড ক্রস নিগ্রোদের রক্ত সংগ্রহ করতে সম্মত হয় নি। রেড ক্রসের এই ঘৃণ্য ঔদ্ধত্য আরো বেশী চোখে পড়ে যখন ১৯৪০ সালে এক নিগ্রো, ড, চার্লস রিচার্ড ড্র প্রথম ব্লাড ব্যাঙ্ক’ প্রথার প্রচলন করেন। তিনি রেডক্রসের পরিচালক হওয়া সত্ত্বেও সেখানে নিগ্রো রক্ত অস্পৃশ্য ছিল। ড. চার্লস ডু এই জঘন্য নীতির প্রতিবাদ করে রেডক্রসের পরিচালক পদ থেকে পদত্যাগ করলেও এই নিগ্রোরক্ত-বিদ্বেষী নীতির কোনো পরিবর্তন ঘটে নি। নিগ্রো রেজিমেন্টে আহত সৈন্যদের রক্তের যখন অভাব ঘটল তখন নিগ্রো এবং শ্বেতাঙ্গ রক্ত আলাদা করে সংগ্রহ ও সরবরাহ করার প্রচলন হয়। হিটলার যখন ইহুদীদের দূষিত রক্ত পরিষ্কারের জন্য গণহত্যা করে চলেছেন তখন আমেরিকা নিগ্রোদেরকে দিয়ে যুদ্ধ করাচ্ছে নিগ্রো-বিদ্বেষী সকল নিয়ম অক্ষুন্ন রেখেই। রক্ত পর্যন্ত তা থেকে অব্যাহতি পায় নি।
১৯৪৫ সালের বসন্তকাল। সোভিয়েত সৈন্যের জার্মানীতে প্রবেশ, হিটলারের আত্মহত্যা, নাৎসী নেতাদের প্রথমে সোভিয়েতদের হাত থেকে পলায়ন এবং পরে আমেরিকানদের কাছে আত্মসমর্পণ। এইভাবে ইউরোপে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে। যুদ্ধ শেষে শুরু হয় বিচার, বিজয়ীর দ্বারা বিজিতের বিচার। ১৯৪৫-৪৬ সালে প্রথম আন্তর্জাতিক সামরিক বিচারসভায় নাৎসীদের যুদ্ধাপরাধ এবং আগ্রাসনের বিচার হয়েছিল। নিউরেমবুর্গে আয়োজিত আন্তর্জাতিক সামরিক বিচার সভা আইন শাস্ত্রের ইতিহাসে এক অভিনব ঘটনা। একজন আমেরিকান কৌসুলি যদি কতিপয় ব্রিটিশ, ফরাসী ও রুশ কৌসুলির সাহায্যে একজন জার্মান সামরিক অফিসারের পোল্যান্ডে-সাধিত যুদ্ধাপরাধের বিচার করে তাহলে সেটা কতখানি বৈধ তা নিয়ে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে। এই বিচার সভা গঠন আন্তর্জাতিক হলেও এর মুখ্য ভূমিকায় ছিল আমেরিকা। কারণ আমেরিকার । দাবী হচ্ছে আমেরিকানদের আইনের উপর সর্বাধিক আস্থা রাখতে হবে। সি. বি. এস.-এর সংবাদদাতা হাওয়ার্ড স্মিথ এই বিচার সম্বন্ধে বেতার মারফৎ আমেরিকানদের যা বলেছিলেন তা বিশেষভাবে অনুধাবনযোগ্য। স্মিথ বলেছিলেন যে, নিউরেমবুর্গে এক সঙ্গে তিনটে বিচার চলছে। প্রথমত, আমেরিকানদের দ্বারা বিচার, যার উদ্দেশ্য হলো দুনিয়াকে আইনের সেই সব অনুশাসন বুঝিয়ে দেওয়া যার দ্বারা পরবর্তীকালের যে-কোনো আগ্রাসী শক্তি এবং যুদ্ধপরাধীদের শাস্তি দেওয়া সম্ভব হবে। দ্বিতীয়ত, ইউরোপীয়ানদের দ্বারা জার্মানদের বিচার, যার আসল উদ্দেশ্য ছিল নিতান্তই প্রতিহিংসাপরায়ণতা, বিশেষ করে রুশ এবং ফরাসীদের মধ্যে। এবং সবশেষে রয়েছে আসামী পক্ষ, যারা এই বিচারকে ন্যায্য ও নিরপেক্ষ মনে করে প্রাণপণে নিজেদের ফাঁসিকাষ্ঠ থেকে বাঁচাবার চেষ্টা করছে।
১৯৪৫-৪৬-এর এই নিউরেমবুর্গ বিচার নিঃসন্দেহে ন্যায্য, অনেকাংশে নিরপেক্ষও বটে, যেমন নাৎসী আসামীদেরকে শুধু যে বিনা খরচায় কৌসুলি দেওয়া হয়েছে তাই নয়, সেই সঙ্গে কৌসুলিদের বিনা খরচায় অফিস, টাইপিস্ট, স্টেনোগ্রাফার, সেক্রেটারি, অনুবাদ সাহায্য এবং যে কোনো সময়ে আইনজীবীদের তাদের মক্কেলদের সাথে পরামর্শ করার সুবিধা দেওয়া হয়েছিল। নাত্সী আসমীদেরকে প্রদত্ত এরকম’ সুবিধা কোনো সাধারণ নিগ্রো অপরাধী আমেরিকাতে তখন কল্পনাও করতে পারত না। অতএব প্রশ্নটা বিছারের ন্যায্যতা নিয়ে নয়, বরং আমেরিকার প্রতারণা নিয়ে। এই বিচার চলাকালীন সময়ে ফরচুন ম্যাগাজিনে মন্তব্য করা হয়েছিল যে, অ্যাটম বোমার ধ্বংসাত্মক ক্ষমতা দেখার পর গণহত্যার। কোনটা আইনসম্মত এবং যথার্থ পদ্ধতি এবং কোনটা নয়, তার বিচার করা নিতান্তই হাস্যকর।
আর-একটি উদাহরণ। জুলিয়াস স্ট্রাইকারকে এই বিচারে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিল ইহুদীদের বিরুদ্ধে ঘৃণাব্যঞ্জক এবং হিংসা উদ্রেককারী প্রচারের জন্য। তাহলে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে, সেক্ষেত্রে নাৎসীদের সাংস্কৃতিক এবং দার্শনিক গুরুরা অর্থাৎ মার্কিনী সুপ্রজননবিদরা কিভাবে আমেরিকায় বহাল তবিয়তে বিরাজ করছিলেন? এই প্রসঙ্গে সব থেকে মজার ঘটনা ঘটেছিল আমেরিকার ওহায়ো প্রদেশের কলম্বাস শহরে। এই শহরের একটি স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে হিটলারকে নিয়ে কি করা যায়? এই বিষয়ে রচনা-প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়েছিল। ১৬ বছরের এক নিগ্রো বালিকা তাতে লিখেছিল, “হিটলারের পক্ষে কঠোরতম শাস্তি হবে যদি তাকে কালো চামড়া পরিয়ে সারা জীবন আমেরিকায় কাটানোর জন্য পাঠানো হয়।”
নিউরেমবুর্গ বিচারের আগেই আমেরিকার নেতৃত্বে গঠিত এই বিচারের অন্তঃসারশূন্যতা এবং প্রতারণা এই কিশোরী যদি বুঝে ফেলতে পারে তাহলে বাকী দুনিয়ার মানুষকে এটা বুঝতে নিশ্চয় উচ্চ শিক্ষার প্রয়োজন হবে না। আমেরিকার লক্ষ্য ছিল, নিউরেমবুর্গ বিচারের মধ্য দিয়ে এমন কতকগুলো অনুশাসন তৈরী করা যাদের দ্বারা ভবিষ্যতে এই ধরনের আন্তর্জাতিক যুদ্ধপরাধ ঘটলে অপরাধীদের শাস্তি প্রদান করা যায়। কিন্তু ১৯৪৬-এর পর কোরিয়ান উপদ্বীপে, ভিয়েত্নামে, গ্রানাডায়, পানামায়, এল সালভাদোরে, নিকারাগুয়ায়, হন্ডুরাসে, কিউবাতে, লিবিয়াতে, লেবাননে যেসব নারকীয় যুদ্ধাপরাধ হয়েছে সেজন্য পেন্টাগনের বা সি.আই.এ.-এর রিবেট্রপ, হারমান গ্যেরিং, কাইটেল, ক্যালটেনার প্রমুখদের কোন বিচার হয়েছে না হবে?
মানব সুপ্রজননবিদ্যা হলো এক আপাত-দার্শনিক, ধর্মীয় এবং আপাত-সমাজতাত্ত্বিক মতবাদ যা খ্রিস্টধর্মে-বিশ্বাসী, প্রােটেস্টান্ট সম্প্রদায়ের নরডিক, অ্যাংলো-স্যাক্সনরা উনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ভাগ থেকে নিয়ে পরবর্তী সত্তর-আশি বছর ধরে নির্লজ্জের মতো ব্যবহার করেছে। যদিও এই মতবাদের জনকেরা, যথা ফ্রান্সিস গলটন, হার্বাট স্পেনসর প্রমুখেরা ব্রিটিশ ছিলেন, তবুও এই আপাত-বিজ্ঞান শাখাটির প্রয়োগ এবং অভ্যাসের তীর্থস্থান ছিল আমেরিকা। কারণ গােত্র এবং বর্ণের প্রশ্নে শ্বেতাঙ্গ প্রােটেস্টান্ট আমেরিকানরা (সংখ্যাগরিষ্ঠ) অপরিবর্তিত মনোভাব পোষণ করে। এই মনোভাবটি হলো এই যে, কৃষ্ণাঙ্গদের পণ্যসামগ্রীর মত বেচাকেনা এবং দাস করে রাখা যাবে, কারণ তারা শ্বেতাঙ্গদের থেকে নিম্নস্তরের মানুষ। সরকারিভাবে তাদের দাসত্ব যখন ঘুচে গেল তখন তাদেরকে অধীন করে রাখার সর্বোত্তম পন্থা হলো বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে কৃষ্ণাঙ্গ এবং সেই সঙ্গে সমস্ত অশ্বেতাঙ্গ বর্ণের মানুষকে নিকৃষ্ট ও হীন প্রতিপন্ন করা। কারণ বিজ্ঞানের মোড়ক দেওয়া গেলে ভুয়ো বিষয়বস্তুর গ্রহণযোগ্যতা ব্যাপকভাবে বেড়ে যায়। আর হীনমন্যতার জীবাণু যদি একবার কোনো মানবগোষ্ঠীর মধ্যে দানা বাঁধে তাহলে তাকে অতিসহজে সম্পূর্ণরূপে হত্যেদ্যাম করে একেবারে পঙ্গু বানিয়ে ছাড়ে। বক্তব্যটা ছিল এই যে, যদি অশ্বেতাঙ্গ মানুষরা শ্বেতাঙ্গদের দাস হয়ে না-থাকে তাহলে তাদের পক্ষে বেঁচে থাকাটা অর্থহীন। আর এই বর্বরোচিত মতবাদ বিজ্ঞানের মাধ্যমে প্রচার করতে আমেরিকায় যে বিপুল অর্থের ব্যয় হয়েছিল তা ভাবলে শিউরে উঠতে হয়। পৃথিবী সত্যিই শিউরে উঠেছিল যখন আমেরিকার সুপ্রজননবিদ্যার অভ্যাস ও প্রচারের সরাসরি পরিণতি দাঁড়িয়েছিলেন অ্যাডােলফ হিটলার।
গ্রন্থপঞ্জি:
William E. Barker, Aryan America : Race, Revolution, and the Hitler
Legacy J. David Smith, The Eugenic Assault on America Edwin Black, War Against the Weak: Eugenics and America’s Campaign to Create a Master Race Nancy Ordover, American Eugenics Race, Queer Anatomy, and the Science of Nationalism Stefan Kuhl, The Nazi Connection : Eugemics, American Racism, and
German National Socialism y G. K. Chesterton, Michael, W. Perry (editors) Eugenics and other Evils :
An Argument Against the Scientifically Organized State 9. Ronald E. Hall, The Scientific Fallacy and Political Misuse of the
Concept of Race b. Katheryn K. Russell, The Color of Crime a. E. Axel Carlson, The Unfit : A History of Bad Idea Jo. Richard Drinnon, Keeper of Concentration Camps : Dillon S. Maver and
American Racism ». John W. Dower, War Without Mercy; Race & Power in the Pacific War 33. Joscph E. Persico, Nuremberg : Infamy on Trial so. G. M. Gilbert, Nuremberg Diary
* H. Van Straelen, The Far East Must be Understood, London : Luzac & Co., 1945, p 86

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button