১৯৭০ এর নির্বাচন ও মুক্তিযুদ্ধ

আবদুল হামিদ মানিক: বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসে ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি মাইলফলক। সামরিক শাসন এবং পাকিস্তানী সামরিক জান্তার গণতন্ত্র বিরোধী অপশাসনের বিরুদ্ধে দীর্ঘ আন্দোলনের পথ বেয়ে আসে ঐ নির্বাচন। প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান আন্দোলনের মুখে পদত্যাগ করে জেনারেল এহিয়া খানের হাতে ক্ষমতা প্রদান করেন। আইয়ুব বিরোধী আন্দোলন ছিল গণতন্ত্র উদ্ধারের আন্দোলন। এ আন্দোলনে শাসকগোষ্ঠি বুঝে নেয় যে, রক্তচক্ষু দেখিয়ে, হত্যা নির্যাতনের মাধ্যমে এ দেশের মানুষকে দমিয়ে রাখা যাবে না। এই বাস্তবতায় পাকিস্তানে সাধারণ নির্বাচন ঘোষণা করা হয়। কেন্দ্র ও প্রদেশের নির্বাচন ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে বাংলার সর্বত্র শুরু হয় প্রস্তুতি।
পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের নির্বাচনের তারিখ ছিল ১৯৭০ এর ৭ ডিসেম্বর। ঐ বছর সামুদ্রিক ঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে পূর্ব পাকিস্তানের উত্তরাঞ্চলে হাজার হাজার লোকের প্রাণহানি ঘটেছিল। নির্বাচনের পূর্বে প্রাকৃতিক এই দুর্যোগ জনগণকে বিমর্ষ করে তুলেছিল। দুর্গত এলাকায় পশ্চিম পাকিস্তানের কেউ উদ্ধার ও ত্রাণ কার্যে এগিয়ে আসেনি। মাওলানা ভাসানী এক জনসভায় হাত তুলে অঙ্গুলি নির্দেশ করে বলেছিলেন, ওরা কেউ আসেনি। তাঁর ছবিসহ কথাটি পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয় এবং বাঙালি জনগণকে প্রবলভাবে তাড়িত করে। এ অঞ্চলে নির্বাচনের তারিখ পিছিয়ে ১৯৭১ এর ১৭ জানুয়ারি নির্ধারণ করা হয়। সাধারণ নির্বাচন যথারীতি সমগ্র পাকিস্তানে অনুষ্ঠিত হয় ৭ ডিসেম্বর ১৯৭০।
নির্ধারিত তারিখ অনুযায়ী কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক আসনগুলোর নির্বাচন শান্তিপূর্ণভাবে শেষ হয়। ফলাফল ছিল পাকিস্তানী শাসকচক্রের জন্য অবিশ্বাস্য বিস্ময়কর। কেন্দ্রের মোট আসন ছিল তিন শ। আওয়ামীলীগ লাভ করলো ১৬০টি আসন। পিপলস পার্টি ৮১টি এবং বাকী আসনগুলি স্বতন্ত্র ও অন্যান্য দল লাভ করে। মহিলাদের সংরক্ষিত সাতটি আসনসহ একা আওয়ামীলীগেরই আসন হলো ১৬৭টি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন আওয়ামীলীগের একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের একটি প্রেক্ষাপট রয়েছে। বঙ্গবন্ধু ১৯৫২ এর ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ১৯৭০ এর নির্বাচন পর্যন্ত বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনে ছিলেন সোচ্চার। পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠির শোষণের বিরুদ্ধে ছিলেন লড়াকু সৈনিক। ১৯৬৬ সালে সে লক্ষ্যেই ঘোষণা করেন ঐতিহাসিক ছয় দফা। ছয় দফা আন্দোলনের সঙ্গে যোগ হয় ছাত্র সমাজের এগার দফার আন্দোলন। ১৯৬৯ সালে বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে সাজানো হয় আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা। বন্দী হন বঙ্গবন্ধু এবং তাঁর সহযোগী ঘনিষ্ঠ কয়েকজন নেতা। আন্দোলনের মুখে বন্দীদের মুক্তিদান এবং মামলা প্রত্যাহারে বাধ্য হয় সরকার। এ সব কারণে বঙ্গবন্ধু তখন বাঙালির একক নেতার আসন লাভ করেন। জনগণ তাকে মুক্তির দিশারী হিসেবে গ্রহণ করে। এরই প্রতিফলন ঘটে নির্বাচনে।
নির্বাচনের পর সবাই খুশি। গণতান্ত্রিক রীতি অনুযায়ী সংখ্যাগরিষ্ঠ দলই ক্ষমতায় যাবে, সরকার গঠন করবে। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানে ৮১ আসন লাভকারী পিপলস পার্টির নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো ও ইয়াহিয়া খান গোপন ষড়যন্ত্রে মেতে উঠলেন। ক্ষমতা হস্তান্তরে টালবাহানা শুরু হলো। ইয়াহিয়া খান ঘোষণা করলেন ঢাকায় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বসবে ৩রা মার্চ। কিন্তু ১লা মার্চ ভিন্নসুর। বেতার ভাষণে জানালেন জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত রাখতে হচ্ছে। এর সঙ্গে সঙ্গেই বিক্ষোভে ফেটে পড়ে সারা পূর্ব পাকিস্তান। শহর বন্দরে রাজপথে জনতার ঢল। কারফিউ অগ্রাহ্য করে মানুষ নেমে এলো রাস্তায়। সেনাবাহিনীর গুলিতে প্রাণ হারালো অনেকে। ৩ মার্চ পল্টন ময়দানে সর্বদলীয় ছাত্র পরিষদের সমাবেশে বঙ্গবন্ধু দাবি জানালেন-সামরিক বাহিনীকে ব্যারাকে ফিরিয়ে নিতে হবে, সামরিক আইন প্রত্যাহার করতে হবে এবং নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা দিতে হবে। দাবি না মানলে ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে চূড়ান্ত কর্মসূচী ঘোষণা করা হবে।
অপরদিকে সামরিক জান্তাও বাঙালি নিধনের প্রস্তুতি নিতে থাকে। উড়োজাহাজে ছদ্মবেশী পাকিস্তানী সৈন্যদের ঢাকায় নিয়ে আসা হয়। গভর্ণর ও সামরিক প্রশাসক হয়ে আসেন টিক্কা খান। এতে জনগণ আরো ক্ষেপে ওঠে। ছাত্র শিক্ষক কৃষক শ্রমিক নেমে আসে পথে। উত্তাল হয়ে উঠে সারা দেশ। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে সরকারী বেসরকারী সকল ভবনে কালো পতাকা উড়তে লাগলো। রেডিও টিভিতে বাংলার উদ্দীপনাময় সঙ্গীত পরিবেশন শুরু হলো। সবাই ৭ মার্চের অপেক্ষায়। এভাবেই এলো ৭ মার্চ। লক্ষ লক্ষ জনতার সমাবেশে বঙ্গবন্ধু বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা করলেন- ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’
সমগ্র জাতি এর পরই স্বাধীনতা যুদ্ধের মানসিক প্রস্তুতি গ্রহণ করে। চলতে থাকে অসহযোগ আন্দোলন এবং শাসকগোষ্ঠির সঙ্গে বৈঠক। কিন্তু বৈঠকের নামে কালক্ষেপনই ছিল ইয়াহিয়া ভুট্টোর উদ্দেশ্য। তাই ২৫ মার্চ রাত্রিতে হানাদার বাহিনী শুরু করে নির্বিচার গণহত্যা। বঙ্গবন্ধুকে আটক করে নিয়ে যায় পাকিস্তানে। রুখে দাঁড়ায় বাঙালি বীর জনতা। শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। প্রতিবেশী ভারতে আশ্রয় নিয়ে বাঙালি নেতৃবৃন্দ গড়ে তুলেন মুক্তিবাহিনী। গঠিত হয় প্রবাসী সরকার। এই পথ ধরেই লক্ষ লক্ষ শহীদের আত্মদানে ১৬ ডিসেম্বর সূচিত হয় চূড়ান্ত বিজয়। আসে বহু কাক্সিক্ষত মহান স্বাধীনতা।
লেখক: নির্বাহী সম্পাদক, সিলেটের ডাক

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button