বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ববিরোধী ষড়যন্ত্র এগিয়ে চলেছে!
সিরাজুর রহমান
একাত্তরের ২৫ মার্চের সে কাল রাত্রির পর আওয়ামী লীগ নেতাদের অসহায় অবস্থা কল্পনা করা মোটেই কঠিন নয়। প্রতিরোধ সংগ্রাম কিংবা হাতে অস্ত্র তুলে নিতে নয়, তাদের পালিয়ে যাওয়ার নির্দেশ শেখ মুজিবুর রহমান দিয়েছিলেন। সেদিন বিকেল ৪টায় মুজিব তার একান্ত সচিব (যিনি নিজেকে বলতেন ‘তল্পিবাহক’) জমির উদ্দিনকে ইন্টার কন্টিনেন্টাল হোটেলে পাঠান তার ফেডারেশন গঠনের প্রস্তাব সম্বন্ধে জুলফিকার আলী ভুট্টোর অভিমত জেনে আসতে। পরবর্তী বিবরণ জমির উদ্দিনের নিজের কথায় :
“তখন আমাকে মোস্তফা খার (ভুট্টোর প্রবক্তা) বললেন যে, ভুট্টো সাহেব এখন ঘুমাচ্ছেন, তুমি সন্ধ্যা ৮টায় এসো। আমি যখন ৮টার সময় গেলাম, উনি আমাকে সুইমিং পুলের দিকে নিয়ে যান। নিয়ে গিয়ে বলেন, ‘চিড়িয়া তো ভেগে গিয়েছে’। চিড়িয়া বলতে তিনি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানকে বুঝিয়েছেন। আমি তাড়াতাড়ি ফিরে এলাম। এসে মুজিব ভাইকে বললাম, মুজিব ভাই, প্রেসিডেন্ট তো চলে গেছেন। তিনি কথাটা হাঁ-করে শুনলেন। আর কিছু বললেন না আমাকে। আমাকে আবার বললেন, তুমি আবার যাও, ভুট্টো কী বলে শুনে আসো। আমি আবার গেলাম। তখন প্রায় ১০টা বাজে। মোস্তফা খার বললেন Ñ তোমার সঙ্গে দেখা করতে চান না, ভুট্টো সাহেব দেখা করতে চান না। আবার আসলাম, খুব ভারাক্রান্ত মনে শেখ মুজিবের বাড়িতে ঢুকলাম। তখন প্রায় সাড়ে ১০টা বাজে। আমি দেখলাম, (ব্যারিস্টার) আমির-উল ইসলাম সাহেব বেরিয়ে যাচ্ছেন। আর ছিলেন আমাদের পুলিশের আইজি জনাব মহিউদ্দিন সাহেব। তিনি আমাকে দেখে বেরিয়ে গেলেন। আমি দেখলাম, মুজিব ভাই একটা সোফার ওপর শুয়ে আছেন। আমার মনে হলো যে, তার প্রায় পাঁচ পাউন্ড ওজন কমে গিয়েছে, সকালে আমি যখন দেখি তখন থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত সময়ে। পাইপটা হাতে ছিল তার। আমি বললাম, ভুট্টো সাহেব তো দেখা করলেন না। উনি বললেন, জানিরে, ওরা আমাদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করল। এরপর আমি খুব নিকটে গিয়ে তার সোফার কাছে বসলামÑ কার্পেটের ওপরে। তার গায়ে হাত দিলাম। তিনি আমাকে বললেন, ‘আমি তাজউদ্দীনদেরকে বলেছি আন্ডারগ্রাউন্ডে যাওয়ার জন্য; কিন্তু আমি কী করি বল। যদি আমি ধরা না দিই ওরা তো পাগলা কুত্তার মতন আমার সব ওয়ার্কারের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে।”
আওয়ামী লীগ নেতারা ‘আন্ডারগ্রাউন্ড’ নয়, ‘ওভারগ্রাউন্ডে’ সদলবলে সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে চলে গিয়েছিলেন। কেউ কেউ সঙ্গীসাথী নিয়েছিলেন দু-একজন, কেউ কেউ বলতে গেলে এক বস্ত্রে। ভিন্ন দেশে থাকার আশ্রয়, অন্নবস্ত্রের সংস্থান ইত্যাদি কেমন দুরূহ, কাউকে বলে দিতে হবে না। তাদের কপাল ভালো ছিল। ভারত সরকার দু’বাহু বাড়িয়ে তাদের অভ্যর্থনা জানিয়েছিল। দয়া-দাক্ষিণ্যের কারণে নয়, বৈষয়িক স্বার্থে। এর কিছু ঐতিহাসিক কারণ ছিল। ২৪ বছর আগে ভারতবর্ষ বিভক্ত হয়ে হিন্দুস্তান (ভারত) ও পাকিস্তান হয়েছে Ñ হিন্দু অধ্যুষিত রাজনৈতিক সংস্থা কংগ্রেসের ঘোরতর বিরোধিতা সত্ত্বেও। কাশ্মির, জুনাগড়, হায়দরাবাদ প্রভৃতি রাজ্য এবং পূর্ব পাকিস্তানের এখানে-সেখানে বিতর্কিত ও অবাস্তব সীমান্ত নিয়ে দুই রাষ্ট্রের জন্মের সময় থেকেই অনেক বিরোধ সৃষ্টি হয়েছিল। ভারতীয়রা গোড়া থেকেই ধরে নিয়েছিল যে, বিভক্ত ও দুর্বল রাষ্ট্র পাকিস্তান বেশি দিন টিকতে পারবে না, অন্তত তারা টিকতে দেবে না;
কিন্তু বিশ্ব পরিস্থিতির বাস্তবতাকে তারা বিবেচনায় নেয়নি। কমিউনিস্ট সোভিয়েত সা¤্রাজ্য আর মার্কিন নেতৃত্বে ধনতান্ত্রিক পশ্চিমা বিশ্বের মধ্যে বিরোধ বিশাল একখানি কালো মেঘের মতো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর পৃথিবীর আকাশকে ঘনঘটাচ্ছন্ন করে রেখেছিল। নতুন স্বাধীন ভারত সোভিয়েতের পক্ষ নেয়ায় ধনতান্ত্রিক জোটের উদ্বেগ আরো বেড়ে যায়। সোভিয়েতকে ঘিরে সমরবলয় সৃষ্টির (এবং ভারতের সমরশক্তির পাল্টা হিসেবে) উদ্দেশ্যে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে গঠিত সমরজোট সেন্ট্রাল ট্রিটি অর্গানাইজেশন (সেন্টো) এবং সাউথইস্ট এশিয়ান ট্রিটি অর্গানাইজেশনে (সিটো) পাকিস্তানকে অন্তর্ভুক্ত করা হয় এবং বলতে গেলে, অঢেল সমরাস্ত্র দিয়ে পাকিস্তানকে প্রথম শ্রেণীর সমরশক্তিতে পরিণত করা হয়। তার মোকাবেলায় ভারতের প্রতিরক্ষা ব্যয় হু হু করে বৃদ্ধি পেতে থাকে। এ দিকে, কাশ্মির নিয়ে ১৯৪৮ এবং ১৯৬৫ সালের যুদ্ধে ভারত পাকিস্তানকে সম্পূর্ণ পরাজিত করতে পারেনি, তার বিজয় চূড়ান্ত হয়নি। পূর্ব ও পশ্চিম, দু’টি ফ্রন্টে সার্বক্ষণিক সমর প্রস্তুতি বজায় রাখার জন্য ক্রমবর্ধমান প্রতিরক্ষাব্যয় ভারতের জন্য দুঃসহ হয়ে দাঁড়ায়। ভারতের রণকৌশলীরা এর একমাত্র সমাধান দেখতে পান পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানকে বিভক্ত ও বিচ্ছিন্ন করার মধ্যে।
দৈব আশীর্বাদ
পূর্ব পাকিস্তানের মুক্তিযুদ্ধ ভারতের জন্য যেন এক প্রকার দৈব আশীর্বাদ হয়েই এসেছিল। ’৭১ সালে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের আতিথেয়তার জন্য ভারত কোনো ব্যয়েই কুণ্ঠিত হয়নি। স্বাধীনতার পরে কলকাতায় গিয়ে শুনেছি, আওয়ামী লীগ নেতাদের কারো কারো বিনোদনের ব্যয়ও বহন করেছে ভারত সরকার; কিন্তু ভারতের বেনিয়া বুদ্ধি তখনো সক্রিয় ছিল। আওয়ামী লীগ নেতাদের আশ্রয়, আপ্যায়ন-বিনোদন দানের বিনিময়ে তারা ভবিষ্যতের জন্য যথাসম্ভব সব স্বার্থ আদায় করে নিতে চেয়েছিল। হয়তো দিল্লির লক্ষ্য ছিল পূর্ব পাকিস্তানকে সম্পূর্ণ স্বাধীন হতে না দিয়ে প্রথমে সিকিমের মতো ভারতের আশ্রিত রাজ্যে পরিণত করা। তার কাঠামো হিসেবেই ভারতাশ্রয়ী অসহায় অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদকে সাত দফা গোপন ভারত-বাংলাদেশ চুক্তি স্বাক্ষর করতে বাধ্য করা হয়।
সে চুক্তির মূল কথা ছিল, বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি ও প্রতিরক্ষা পরিচালিত হবে দিল্লি থেকে। সাউথ ব্লক (পররাষ্ট্র মন্ত্রক) বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি নির্ধারণ ও পরিচালনা করবে, আর ভারতীয় সেনাবাহিনী বাংলাদেশের বহির্দেশীয় প্রতিরক্ষার দায়িত্ব নেবে। চুক্তিতে বলা হয় যে, বাংলাদেশের নিজস্ব কোনো সেনাবাহিনী থাকবে না। সে জন্যই স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ থেকে ভারতীয় বাহিনীর অপসারণ দিল্লির কাম্য ছিল না। চুক্তিতে আরো বলা হয়, বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিডিআরকে (যারা একাত্তরে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রথমেই অস্ত্র ধারণ করেছিল) ভেঙে দেয়া হবে এবং তার স্থলে ভারতের সীমান্তরক্ষী বিএসএফ বাহিনীর তত্ত্বাবধানে একটি সীমান্ত রক্ষীবাহিনী গঠন করা হবে।
পাকিস্তান থেকে লন্ডন হয়ে দেশে ফেরার পথে দিল্লিতে স্বল্পকালীন যাত্রাবিরতিকালেই শেখ মুজিবুর রহমানকে সাত দফা চুক্তিটির কথা জানানো হয়েছিল; কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর পদ গ্রহণ করার পরেই মুজিব স্থির করেছিলেন যে, সাত দফা চুক্তিটি কিছুতেই তিনি গ্রহণ করবেন না। ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহারের জন্য তিনি পীড়াপীড়ি শুরু করেন। এমনকি ’৭২-এর মার্চে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী স্বয়ং ঢাকা সফর করেও মুজিবকে মত পরিবর্তনে রাজি করাতে পারেননি। মুক্তিযুদ্ধে বিশ্বসমাজ বাংলাদেশকে পূর্ণ সমর্থন দিয়েছিল। শেখ মুজিবুর রহমানের জনপ্রিয়তাও তখন তুঙ্গে। সে পরিস্থিতিতে তার সাথে প্রত্যক্ষ সংঘর্ষে যাওয়া ভারত বিজ্ঞজনোচিত মনে করেনি।
ওরা মুজিব হত্যার সুযোগ নিতে চেয়েছিল
সে হিসেবে ’৭৫-এর ১৫ আগস্টের ঘটনাবলিতে সাউথ ব্লকের খুব বেশি অসন্তুষ্টির কারণ ঘটেনি। কিন্তু বিদ্রোহী সেনা কর্মকর্তারা যখন খোন্দকার মোশতাককে রাষ্ট্রপতির আসনে বসায়, তখন দিল্লি প্রমাদ গুনেছিল। তারা অবশ্যই জানত যে, মোশতাক কিছুতেই সাত দফা চুক্তি ফিরিয়ে আনতে রাজি হবেন না। তাজউদ্দীন আহমদ যখন সে চুক্তিতে সই করতে বাধ্য হন, খোন্দকার মোশতাক তখন নির্বাসিত সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী। চুক্তির বিরুদ্ধে তার দৃঢ় অবস্থান ভারত সরকারের বিরক্তি এবং তাজউদ্দীনের বিব্রত হওয়ার কারণ ঘটিয়েছিল। ভারতপন্থী ব্রিগেডিয়ার জেনারেল খালেদ মোশাররফের সামরিক অভ্যুত্থান এসব কারণেই ঘটেছিল বলে অনেকে তখন মনে করতেন। লে: জেনারেল জিয়াউর রহমানের প্রবল জাতীয়তাবাদী অবস্থানের পরিচয় পেতেও ভারতের বিলম্ব হয়নি। সে কারণেই জিয়া প্রশাসনের সাথে ভারত সরকার সহযোগিতা সামান্যই করেছে। এমনকি রাষ্ট্রপতি জিয়ার উদ্যোগে গঠিত সার্ক সংস্থার বিকাশেও ভারত তেমন উৎসাহ দেখায়নি।
শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা গভীর শোকের সময় ভারতে আশ্রয় পেয়েছিলেন। দিল্লির প্রতি তাদের কৃতজ্ঞতা খুবই স্বাভাবিক। দিল্লিতে তাদের তত্ত্বাবধান করেছিল তাদের বিশেষ সংস্থা। দিল্লির সমাজজীবনের সাথে তাদের মেলামেশার সুযোগ ইন্দিরা গান্ধীর সরকার রাখেনি। অর্থাৎ বাংলাদেশের সে সময়ের ইতিহাস তারা জেনেছিলেন অন্যের বয়ান অনুযায়ী। আরো অনেক পরে, ২০০৬-২০০৯ সালে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ঘটনাবলির নিয়ামক ছিল ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র। একটি পত্রিকা গোষ্ঠী এবং তৎকালীন সেনাপ্রধান মইন উ আহমেদ তাদের সহযোগিতা দিয়েছেন। আর শেখ হাসিনা তো নিজেই বলেছেন, বর্ণচোরা ওই সামরিক সরকার ছিল তারই ‘আন্দোলনের ফসল‘। তা ছাড়া কারোই এখন অজানা নেই যে, আওয়ামী লীগ ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে ক্ষমতাসীন হয়েছিল এই যোগসাজশেরই ফলে।
তার গদি লাভের দু’মাসের মধ্যেই বিডিআরের বিদ্রোহ ঘটে এবং যেন অকস্মাৎ একাত্তর সালের সাত দফা চুক্তিটির ’৭১-এর একাংশ বাস্তবায়ন হয়ে যায়। শেখ হাসিনা অতি সম্প্রতি সে বিদ্রোহের জন্য বিএনপির ও ২০ দলের নেতা খালেদা জিয়াকে দোষী বলে ঘোষণা করেছেন। বাস্তবে দেশে এবং বিদেশে তার এ দাবি কেউ বিশ্বাস করার কথা নয়। খালেদা জিয়ার জনপ্রিয়তা আওয়ামী লীগকে বিদ্বেষপ্রবণ করেছে। দলটি নিজের কৃত অপকর্মগুলোর দায় খালেদা জিয়ার ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে স্বস্তি পেতে চায়।
সন্দেহের আঙুল উল্টো দিকে
অনেক কারণে সন্দেহের আঙুল বরং উল্টো দিকেই নির্দেশিত হয়। প্রথমত, আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতা (প্রধানত তাপস, আজম আর নানক) বিদ্রোহের কয়েক দিন আগে থেকে মুঠোফোনে বিদ্রোহীদের সাথে যোগাযোগ করছিলেন বলে তখনো খবর রটেছিল। দ্বিতীয়ত, প্রথম দফা খুনের পর বিদ্রোহীরা গণভবনে প্রধানমন্ত্রীর সাথে দীর্ঘ আলোচনা করছিল এবং তারপর প্রধানমন্ত্রী তাদের জন্য সাধারণ ক্ষমার ঘোষণা দেন। তৃতীয়ত, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন এবং আরো দু-তিনজন মন্ত্রী এরপর পৃথক পৃথকভাবে পিলখানায় যান এবং সেদিন সন্ধ্যায় নতুন করে হত্যাযজ্ঞ শুরু হয়ে যায়। চতুর্থত, সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন থেকে মেজর জেনারেল পর্যন্ত ৫৭ জন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা পিলখানায় সমূহ বিপদের মধ্যে ছিলেন। তাদের উদ্ধারের জন্যও সেনাবাহিনীকে পিলখানায় যেতে দেয়া হয়নি। স্বয়ং সরকারপ্রধান মাঝপথে তাদের থামিয়ে দিলেন কেন? তা না হলে সে অফিসারদের অনেকেই হয়তো প্রাণে বেঁচে যেতে পারতেন। একখানি রহস্যঘেরা বাসভর্তি মাথায় রুমাল বাঁধা কিছু রহস্যজনক ব্যক্তির হঠাৎ আবির্ভাব এবং হত্যাকাণ্ডগুলোর পর হঠাৎ করেই অদৃশ্য হয়ে যাওয়া নিয়ে বহু জল্পনা হয়েছে। বিডিআরের শত শত সদস্যের শাস্তি হয়েছে, বন্দী অবস্থায় অনেকে মারা গেছে।
একটা তদন্তও হয়েছে। কিন্তু উপরিউক্ত বহুল প্রচারিত অভিযোগগুলোর কোনো সদুত্তর পাওয়া যায়নি।
অন্য দিকে বাংলাদেশের মানুষের প্রাণের সাথে সম্পৃক্ত বিডিআর বাহিনীটি ভেঙে দেয়া হয়েছে (একাত্তরের সাত দফা চুক্তিতে যে শর্ত ছিল) এবংএকই ধারায় বিজিবি বাহিনী গঠন করা হয়েছে। ৫৭ জন উচ্চপদস্থ অফিসারের হত্যাযজ্ঞের বিরাট ক্ষতি বাংলাদেশ সেনাবাহিনী কোনো দিন পূরণ করতে পারবে কিনা একমাত্র ভবিষ্যতই বলতে পারবে। এনএসআই নামের গোয়েন্দা বাহিনীতে বহু ছাত্রলীগ সদস্যকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে বলে পত্রিকাতে খবর উঠেছে।
বিজিবি (বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ) বাহিনীর মহাপরিচালক মেজর জেনারেল আজিজ আহমেদ গত সপ্তাহে সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ বিজিবি বাহিনীকে প্রশিক্ষণ দেবে। আরো উল্লেখ্য, মাত্র কয়েক দিন আগে খবর পাওয়া গিয়েছিল যে, বিএসএফ কয়েকজন বিজিবি সদস্যকে তাদের কার্যক্রম দেখাতে কাশ্মির সীমান্তে নিয়ে গিয়েছিল। আলোচ্য দুটো খবর থেকে অনেকের মনেই এমন সন্দেহ হতে পারে যে, ভারত প্রকৃতই ১৯৭১ সালের সাত দফা চুক্তি (শেখ হাসিনার পিতা যে চুক্তি অগ্রাহ্য করেছিলেন) বাস্তবায়নে তৎপর হয়ে উঠেছে।
বিএসএফ কী শেখাবে বিজিবিকে
শিক্ষক, এমনকি গৃহশিক্ষক নিয়োগের বেলাতেও প্রার্থীর যোগ্যতা ও চরিত্র বিবেচনা করা হচ্ছে নিয়ম। তাই এ প্রশ্ন অবশ্যই উঠতে পারে, বিএসএফের কাছ থেকে বিজিবি কী শিক্ষা নেবে? বিএসএফের অতীত ইতিহাসও অবশ্যই বিবেচিত হওয়া প্রয়োজন। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সৃষ্টির পর এ সংস্থাটি কখনো তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের সীমান্তবর্তী মানুষকে শান্তিতে থাকতে দেয়নি। ভারতীয়রা পূর্ব পাকিস্তানে এবং পরবর্তীতে বাংলাদেশে ঢুকে গরু-ছাগল ধরে আর ফসল কেটে নিয়ে গেছে, বাংলাদেশীদের জমি দখলও করে নিয়েছে বহুবার। এবং প্রায় সময়ই এসব অপকর্ম করেছে বিএসএফের সংরক্ষণে থেকে। বিএসএফ সদস্যরা অনেকবার বাংলাদেশ সীমান্তের ভেতরে ঢুকে পড়েছে। কুড়িগ্রামে একটি ঘটনায় তাদের একটি দল বাংলাদেশের কয়েক মাইল অভ্যন্তরে ঢুকে বিডিআরের সাথে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়লে কয়েকজন মারা যায়।
বিগত ছয় বছরে সীমান্তে বিএসএফের ঔদ্ধত্য বিশ্বসংবাদ সৃষ্টি করেছে। প্রায় প্রতিদিনই সীমান্তে বাংলাদেশীদের গুলি করে হতাহত করা হয়েছে। ফেলানীর নাম তাদের প্রতীক হিসেবে ইতিহাসে লেখা হয়ে থাকবে। বাংলাদেশ এবং ভারত সরকারের মন্ত্রী, কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বহুবার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন যে, ‘সীমান্তে মারণাস্ত্র ব্যবহার অবিলম্বে বন্ধ হবে’, বাংলাদশীদের আর হত্যা করা হবে না। সাড়ে পাঁচ বছর পর মনে হয় বন্দুকের ব্যবহার যেন কমেছে। গুলির পরিবর্তে পিটিয়ে মারা হচ্ছে বাংলাদেশীদের। ভাবছি, যে লোকটা মারা গেল, রাইফেলের গুলির পরিবর্তে লাঠিপেটা খাওয়ায় তার মৃত্যু যন্ত্রণায় কোনো ইতর-বিশেষ হলো কিনা।
যত দূর জেনেছি, যেসব ছিঁচকে চোরাচালানি ভারত থেকে সামান্য কিছু জিনিস এনে বাংলাদেশে বিক্রি করে, ঘুষের অঙ্ক নিয়ে বিরোধের কারণেই বিএসএফের জওয়ানরা এই দরিদ্র হতভাগ্য মানুষগুলোকে অবলীলায় খুন করছে। অন্য দিকে দেখুন, বাংলাদেশের ইলিশ শত শত টনে সীমান্ত পেরিয়ে যাচ্ছে। ইলিশের দেশের মানুষের জন্যে মৎস্যরানী ইলিশ এখন অতীতের স্মৃতি মাত্র। সে জন্য কি কোনো চোরাচালানি গুলি কিংবা লাঠিপেটা খাচ্ছে? মারা যাচ্ছে কোনো ইলিশ চোরাচালানি? বিএসএফের কাছ থেকে কি এটাই শিখতে হবে যে, বিএসএফ যেমন বিনাবাধায় বাংলাদেশী ইলিশ ভারতে চলে যেতে দিচ্ছে, তেমনি ভারতীয় ফেনসিডিলও যেন বিনাবাধায় বাংলাদেশে আসতে দেয়া হয়?
মাদকের কারখানা কেন আমাদের সীমান্তে?
আরেকটা খবর যেন চিনাবাদামের খোসার মতো অবহেলায় ফেলে দেয়া হয়েছে আলোচ্য সংবাদ সম্মেলনে। বাংলাদেশের সীমান্ত বরাবর ফেনসিডিল তৈরির কারখানাগুলো ভারত বন্ধ করবে না। অজুহাত হিসেবে বলা হয়েছে, ফেনসিডিল নাকি ভারতে ওষুধ হিসেবে ব্যবহার করা হয়। ওষুধের প্রয়োজন যদি বিশাল ভারতের হয়, তাহলে কারখানাগুলো কেন বাংলাদেশের সীমান্তের লাগোয়া নির্মাণ হয়েছে এবং হচ্ছে? কারখানাগুলো কেন ভারতের অন্যত্র নির্মাণ হচ্ছে না, যেমন করে বিয়ার, হুইস্কি ইত্যাদি সুরাজাতীয় পানীয়ের অজ¯্র কারখানা ছড়িয়ে আছে ভারতের সর্বত্র?
কিছু দিন আগে বাংলাদেশের এক শিল্পপতি ব্যবসায় উপলক্ষে ইউরোপ আর যুক্তরাজ্যে এসেছিলেন এবং আমার সাথে দেখা করে যান। তিনি বলছিলেন, উত্তর বাংলাদেশসহ যেসব সীমান্তবর্তী এলাকায় বিএনপির প্রভাব বেশি, ফেনসিডিলের চালান সেখানেই আসছে। এই আশায় যে, বিষাক্ত মাদক সেবন করে বিএনপি কর্মীরা প্রথমে কিছু চেঁচামেচি ও মাতলামি করে ধীরে ধীরে তারা সব কর্মোন্মাদনা হারিয়ে ফেলবে। অন্য দিকে ক্ষমতাসীন দলের ক্যাডারদের জন্য আসে সস্তা ভারতীয় হুইস্কি। সে হুইস্কি পান করে তারা রাতে ফুর্তি করে, আর দিনেরবেলায় লুঙ্গি ও টুপি পরে অনেকে নাকি ‘মসজিদের চাঁদা’ তুলতে যায়।
বাংলাদেশকে সিকিমে পরিণত করার সব পথ সুগম করে দেয়া হয়েছে। ২০১০ সালের জানুয়ারিতে দিল্লিতে গিয়ে কতকগুলো গোপন চুক্তির মাধ্যমে বাংলাদেশের সড়ক, রেল, নদী ও বন্দরগুলো বিনামাশুলে ব্যবহারের অধিকার ভারতকে দিয়ে আসা হয়েছে। তখন থেকেই বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে ভারতের হস্তক্ষেপ বেড়েছে। সাধারণ নির্বাচনের ব্যাপারে গত বছর দিল্লি যেমন অশোভনভাবে হস্তক্ষেপ করেছে, আধুনিককালে তার নজির সত্যিই বিরল। ৫ জানুয়ারির তামাশার নির্বাচনের পরে অবৈধ সরকারের পক্ষে স্বীকৃতি আদায়ের জন্য ভারতীয় কূটনীতিকরা বিশ্বব্যাপী দাপাদাপি করেছেন। এর থেকে প্রমাণিত হয় যে, আমাদের পররাষ্ট্রনীতিও সাউথ ব্লক থেকে পরিচালনা করতে চায় নয়াদিল্লি।