অবর্ণনীয় দুর্ভোগের শিকার রোহিঙ্গারা

Ruhingaচরম দুর্দশা আর নৃশংসতার শিকার মিয়ানমারের মুসলিম সম্প্রদায়। এর হাত থেকে তাদের রক্ষা পাওয়ার কোন উপায় নেই। নিউ ইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এসব কথা বলা হয়েছে। এতে আরও বলা হয়, এ নির্যাতনের হাত থেকে বাঁচার জন্য পালাচ্ছেন তারা। কিন্তু তাতেও রেহাই মিলছে না। মিয়ানমারে কট্টরপন্থি বৌদ্ধদের অত্যাচারে গত ১৮ মাসে হাজার হাজার রোহিঙ্গা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দেশ থেকে পালিয়েছেন। কখনও তারা পাচারকারীর খপ্পরে পড়েছেন। তাদের মালয়েশিয়ায় নিয়ে যাওয়ার প্রলোভন দেয়া হয়েছে। মুসলিম দেশ মালয়েশিয়া বেপারোয়া এসব অভিবাসীকে মেনে নিয়েছে। মালয়েশিয়া যেতে তাদের প্রথমে যেতে হয় থাইল্যান্ডে। সেখানে দালালের অধিক অর্থ দিতে পারলে তাদের দ্রুত পৌঁছে দেয়া হয় মালয়েশিয়ায়। কিন্তু যারা পাচারকারীদের অর্থ দিতে পারেন না তাদের দক্ষিণ থাইল্যান্ডের বিভিন্ন জঙ্গলে লুকিয়ে রাখা হয়। অথবা তারা ধরা পড়ে থাইল্যান্ডের অভিবাসন কর্মকর্তাদের হাতে। এরপর তাদের ঠাঁই হয় অন্তঃহীন দুর্ভোগের বন্দিশিবিরে।
থাইল্যান্ডের প্রতিবেশী দেশ ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়ার শরণার্থীদের ও মিয়ানমারের জাতিগোষ্ঠীর কিছু সদস্যকে আশ্রয় দেয়ার দীর্ঘ ইতিহাস আছে। কিন্তু তারা রোহিঙ্গাদের আশ্রয় বা মৌলিক সুবিধা দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিতে অস্বীকৃতি জানায় থাইল্যান্ড। মানবাধিকার গ্রুপগুলো বলছে, তাদের বন্দিশিবিরে মানবেতর পরিবেশে রাখা হয়। ফলে সেখানেই নিরাপত্তা হেফাজতে থাকা অবস্থায় অনেকে মারা যান। এ বিষয়ে থাইল্যান্ডে নিয়োজিত জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক হাইকমিশনার আহ্বান জানিয়ে বলেছে, থাইল্যান্ডের উচিত অন্য শরণার্থীদের মতো রোহিঙ্গাদের সঙ্গে আচরণ করা। কিন্তু থাইল্যান্ড সরকার তা মানছে না। থাইল্যান্ড এ ক্ষেত্রে যা করছে তা হলো-তারা বন্দিশিবির থেকে বন্দিদের বের করে আনছে। তারপর তাদের নিয়ে যাচ্ছে দক্ষিণের রানোং বন্দরে। সেখানে কাঠের তৈরী নৌকায় তুলে দিচ্ছে। এরপর তাদের ভাসিয়ে দেয়া হয় আন্দামান সাগরে। এরপর তারা পড়েন পাচারকারীদের কবলে। তাদের সঙ্গে যোগাযোগ থাকে থাইল্যান্ডের অনেক কর্মকর্তার। নৌকার আরোহী রোহিঙ্গা শরণার্থীরা যখন তাদের অর্থ দিতে ব্যর্থ হন তখন তাদের থাইল্যান্ডে বৃক্ষায়ন ও জেলে নৌকায় দাসের মতো ব্যবহার করা হয়। দক্ষিণ থাইল্যান্ডের সংখলা এলাকায় নিয়োজিত অভিবাসন বিষয়ক কমান্ডার মেজর জেনারেল থাতচাই পিতানিলাবুত বলেছেন, রোহিঙ্গাদের নাগরিক হিসেবে মিয়ানমার মেনে নিক- এমনটাই চায় থাই সরকার। তার মতে, থাইল্যান্ডের বন্দিশিবিরগুলো শরণার্থীতে ভরা। তিনি বলেন, তারা এ দেশে এসেছে অবৈধভাবে। অনুমোদনহীন অবস্থায়। তাদের ফেরত পাঠানো হবে। সাম্প্রতিক সহিংসতায় অনেক রোহিঙ্গা তাদের জীবন-জীবিকা হারিয়েছেন। এরপর মিয়ানমার থেকে তাদের পালিয়ে যাওয়া ছাড়া কোন পথ নেই। সহজেই তারা থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া ও রোহিঙ্গা পাচারকারীদের শিকারে পরিণত হন। ২০১২ সালের জুন থেকে এ পর্যন্ত সমুদ্রে নিখোঁজ, পানিতে ডুবে জীবন হারিয়েছেন কমপক্ষে ২০০০ রোহিঙ্গা।
মানবাধিকার বিষয়ক সংগঠন আরাকান প্রজেক্টের সমন্বয়ক ক্রিস লিওয়া বলেন, ওই সময় থেকে প্রায় ৮০ হাজার রোহিঙ্গা মিয়ানমার থেকে পালিয়ে গেছেন সমুদ্রপথে। পালানোর এই যে পথ তা অনেক সহজ নয়। অনেক ছোট ছোট প্রণালী দিয়ে তাদের যেতে হয়। তারপর সমুদ্রের বিস্তৃত পথ। উত্তাল জলরাশির সঙ্গে লড়াই করতে করতে তারা শীর্ণ হয়ে পড়েন। অপুষ্টিতে ভোগেন। এর ফলে যখন মালয়েশিয়ায় পৌঁছেন তখন তাদের বেশির ভাগেরই দেখা দেয় প্যারালাইসিস। এমনই একজন আবদুল মুসিদ (৩০)। তিনি একটি হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন। বলেছেন, রাখাইন বৌদ্ধরা তার কৃষিজমি ও মাছ ধরার সরঞ্জাম কেড়ে নেয়ার পর মিয়ানমার ছাড়ার সিদ্ধান্ত নেন। এ জন্য তাকে মালয়েশিয়া নিয়ে যাওয়ার প্রলোভন দেখায় দু’রোহিঙ্গা। তারা বলে, ৬০০ ডলার দিলেই তাকে তারা মালয়েশিয়া নিয়ে দিতে পারবে। মুসিদের এত অর্থ ছিল না। ডাউন পেমেন্ট হিসেবে জমা দেন ৩৫ ডলার। বাকি অর্থ মালয়েশিয়ায় চাকরি পেলে বা কাজ পেলে শোধ করে দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেন। তাকে ও অন্য কিছু লোককে একটি কাঠের নৌকায় তুলে ভাসিয়ে দেয়া হয় সমুদ্রে। ভাসতে ভাসতে তারা চলে আসেন বাংলাদেশ উপকূলের কাছে আন্তর্জাতিক জলসীমায়। সেখানে ৫ দিন সমুদ্রে ভাসেন। তাদের খাবার ও পানি কমে আসে। আস্তে আস্তে তাদের নৌকা নোঙর করে থাইল্যান্ডের দক্ষিণ উপকূলে। সেখানে তারা অবস্থান করেন দু’দিন। জঙ্গলে একটি ক্যাম্প গড়েন। তারপর তাদেকে একটি পিকআপ ট্রাকের পিছনে তুলে নেয়া হয়। তার ভিতর গাদাগাদি করে ছিলেন আবদুল মুসিদ। গাড়িটি গিয়ে থামে মালয়েশিয়া সীমান্তের কাছে। বন্দিদের অনেকে তখন ভীষণ দুর্বল হয়ে পড়েন। এর ফলে তাদের ৫ জনের মৃত্যু ঘটে। অন্য রোহিঙ্গা মুসলমানের সঙ্গে তাকে নিয়ে যাওয়া হয় আরেক দালালের কাছে। মালয়েশিয়ায় চূড়ান্ত যাত্রার আগে তার কাছে আরও অর্থ চাওয়া হয়। এ সময় আবদুল মুসিদ বলেন, তার কাছে কোন অর্থ নেই। তার এমন কোন আত্মীয়ও নেই যাদের কাছ থেকে তিনি অর্থ ধার নিতে পারেন। এ সময় তার কাছে আবার অর্থ দাবি করা হয়। এক দালাল তাকে একটি মোবাইল ফোন ধরিয়ে দেয়- মালয়েশিয়ায় কারও কাছে ফোনে অর্থ চাইতে। মুসিদ বলেন, মালয়েশিয়ায় তার পরিচিত এমন কেউ নেই যার সঙ্গে তিনি কথা বলতে পারেন। এ কথা বলতেই তার ওপর হামলা চালায় পাচারকারীরা। তারা তার কুঁচকিতে আঘাত করে। এতে তিনি পড়ে যান। তাকে পড়ে থাকতে হয় জঙ্গলে। সেখানেই তাকে ফেলে সবাই চলে যায়। সম্প্রতি চালুং গ্রামে দাফন করা হয়েছে পাঁচটি মৃতদেহ। তাদের মৃত্যু হয়েছে ক্ষত থেকে। -মানবজমিন

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button