প্রবাসী বাংলাদেশীদের দেশী রাজনীতি

Bishwaপ্রবাস জীবনে দেশের রাজনীতি চর্চায় ব্রিটেনের বাংলাদেশিরা অন্য যে কোন অভিবাসী জনগোষ্ঠীর চেয়ে অনেক বেশি এগিয়ে। বাংলাদেশের যে কোন রাজনৈতিক ইস্যুতে পাল্টাপাল্টি মিছিল, মিটিং, হুমকি, পুলিশ ডাকাডাকি লন্ডনে সাধারণ ঘটনা।
বিশেষ করে সাম্প্রতিক সময়ে যুদ্ধাপরাধের বিচার বা তত্বাবধায়ক সরকারের ইস্যুতে বাংলাদেশের রাজনীতি যত উত্তপ্ত হচ্ছে, ব্রিটেনে, বিশেষ করে লন্ডনের রাস্তায়, তার প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে। বাংলাদেশে তত্বাবধায়ক সরকারের আন্দোলনে দেশে বিরোধী বিএনপি যতটা তৎপর, ব্রিটেনেও কম কিছু নয়।
দেশপ্রেমের তাড়নায় রাজনীতি?
বিএনপির ইউকে শাখার নেতা কর্মীরা ঘন ঘন লন্ডনের নানা জায়গায় শেখ হাসিনার সরকারের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ সমাবেশ করছেন। প্রধানমন্ত্রী হাসিনা লন্ডনে এলে যেখান তিনি থাকেন, যেখানে যান, সেখানেই বিএনপি গিয়ে বিক্ষোভ করছে।
কয়সর আহমেদ, বিএনপির ইউ কে শাখার নতুন কমিটির সেক্রেটারি তিনি। সূত্রমতে, তারেক রহমানের পছন্দে এই পদ পেয়েছেন তিনি। লন্ডনের বাংলা টাউনে একটি রেস্টুরেন্টের মালিক তিনি। ১৯৯৮ সালে ব্রিটেন এসেছেন।
এদেশে স্থায়ী বসবাস করেন, ব্যবসা করেন, তারপরেও দেশের রাজনীতি এত কেন উৎসাহ তার?
উত্তরে বিবিসিকে বললেন, বাংলাদেশের মানুষের দেশপ্রেম অন্য সমস্ত জাতির চেয়ে বেশি।
প্রায় একই ধরণের ব্যাখ্যা দিয়েছেন আওয়ামী লীগের ইউকে শাখার সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ ফারুক। তার কথা, দেশ এবং ফেলে আসা স্বজনদের মঙ্গল চিন্তা থেকেই প্রবাসীদের মধ্যে রাজনীতি করার এই তাড়না।
“আমরা এদেশে স্থায়ী হয়েছি, কিন্তু আমাদের বৃহত্তর পরিবার বাংলাদেশে …তারপরেও মূল কথা প্রবাসীরা গণতন্ত্র প্রিয় মানুষ, দেশে গণতন্ত্রের ষড়যন্ত্র হলেই আমরা প্রতিবাদ করি।”
প্যাট্রন-ক্লায়েন্ট সম্পর্ক
বিশ, ত্রিশ, চল্লিশ বছর ধরে ব্রিটেনে বসবাস করেও ব্রিটিশ রাজনীতির চেয়ে তাদের অনেকেই বাংলাদেশের দলীয় রাজনীতি নিয়ে অনেক বেশি উৎসাহী। এর পেছনে কারণ কি?
এহতেশামুল হক লন্ডনে তার বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনার অংশ হিসাবে ব্রিটিশ বাংলাদেশিদের রাজনীতি নিয়ে গবেষণা করেছেন। লন্ডনে স্থানীয় সরকারের চাকরির পাশাপাশি বিভিন্ন ব্লগে এ প্রবাসী বাংলাদেশিদের বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে লেখালেখি করেন।
মি হক বিবিসিকে বলেন, বাংলাদেশী অভিবাসীদের মধ্যে দেশের রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ার পেছনে অনেকের মধ্যে একেবারেই ব্যক্তিগত স্বার্থ কাজ করে।
“তারা সবাই যে দলকে সেবা দিচ্ছে তা নয়, অনেকের মধ্যেই দেশে রাজনৈতিক প্রভাব তৈরি করার, দেশে গিয়ে নির্বাচন করার তাড়না কাজ করে।”
মি হক মনে করেন, দেশে বিভিন্ন দলের নেতা নেত্রীরাও নিজেদের স্বার্থেই বিদেশে নিজ নিজ দলের তৎপরতা নিয়ে উৎসাহী।
“এটা অনেকটা ক্লায়েন্ট-প্যাট্রন সম্পর্কের মত। এখানে ক্লায়েন্টরা থাকেন, তাদের অনেকের কাছে পয়সা আছে। বিদেশে দলের শাখা থাকলে নেতারা এখানে এসে কিছু সেবা, সুবিধা পান।”
দেশে নির্বাচনের আকাঙ্খা
দেশে গিয়ে নির্বাচন করার আকাঙ্ক্ষা থেকেও অনেকে এখানে রাজনীতি করেন বলে এহতেশামুল হকের যে পর্যবেক্ষণ, তার কিছু নজির তো অবশ্যই রয়েছে।
২০০৮ সালের নির্বাচনে ব্রিটিশ নাগরিকত্ব ত্যাগ করে আওয়ামী লীগের এমপি হয়েছেন এক প্রবাসী।
এবারও ইউ কে আওয়ামী লীগের অন্তত দু জন নেতা দেশে গিয়ে নির্বাচন করার আগ্রহ প্রকাশ করেছেন দলের কাছে। একজন সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ ফারুক।
অন্যজন যুগ্ম সম্পাদক আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী। ১৮ বছর ধরে ব্রিটেনে থাকেন। রেস্টুরেন্ট ব্যবসায়ী। সিলেটের বিশ্বনাথ-বালাগঞ্জ-ওসমানি নগর আসনে নির্বাচন করার ইচ্ছা আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরীর।
খোলাখুলি বললেন, নির্বাচন করার তাড়না থেকেই গত বেশ কিছুদিন ধরে তিনি নিয়মিত এলাকার যাচ্ছেন। স্কুল, মাদ্রাসা সহ বিভিন্ন পর্যায়ে যোগাযোগ রাখছেন।
নির্বাচন করতে ব্রিটিশ নাগরিকত্ব ছাড়ার জন্যও একপায়ে প্রস্তুত তিনি। “সেটা কোন অসুবিধা নয়। বাংলাদেশে সংসদ নির্বাচন করতে ব্রিটিশ নাগরিকত্ব ছাড়তে হলে ছেড়ে দেব। এটা কোন বিষয়ই নয়।”
যে সব প্রবাসী বাংলাদেশী ব্রিটেনের রাজনীতি করেন তাদেরও বাংলাদেশের রাজনীতিকে বিবেচনায় রাখতে হয়, বিশেষ করে যে সব নির্বাচনী এলাকায় বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত ভোটাররা বসবাস করেন।
পূর্ব লন্ডনের টাওয়ার হ্যামলেটস এলাকার মেয়র নির্বাচনে লেবার পার্টির প্রার্থী কাউন্সিলর হেলাল আব্বাস মনে করেন, তার পরাজয়ের অন্যতম কারণ ছিল জামায়াতে ইসলামি।
খালেস উদ্দিন আহমেদ টাওয়ার হ্যামলেটসের আরেক লেবার কাউন্সিলর। বললেন, না চাইলেও বাংলাদেশের রাজনীতির কথা সবসময় মাথায় রাখতে হয় তাদের, বিশেষ করে নির্বাচনের সময়।
“অনেক সতর্কতার সাথে কথা বলতে হয়। বাংলাদেশের রাজনীতির সাথে ব্যাল্যান্স করে চলতে হয়। ইচ্ছা নেই, কিন্তু এড়ানোর কোন উপায় নেই।”
কোন পথে নতুন প্রজন্ম?
ব্রিটেনে অভিবাসী বাংলাদেশিদের দু-তিন প্রজন্ম হয়ে গেছে। যারা এখানে জন্ম হয়ে বড় হয়েছেন তারা বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে কতটা উৎসাহী ?
সাবেক কাউন্সিলর, কমিউনিটি নেতা হেলাল রহমান বললেন, নতুন প্রজন্মের উল্লেখযোগ্য একটি অংশ ইসলামি রাজনীতির সাথে জুড়ে গিয়ে প্রকারান্তরে দেশের রাজনীতিতেই জড়িয়ে পড়ছে।
“ব্রিটিশ সমাজের মূল ধারার সাথে সংশ্লিষ্ট না হতে পেরে, নতুন প্রজন্মের একটি অংশ ইসলামী রাজনীতিতে ঢুকে যাচ্ছে। আরবদের মত মুসলমান হচ্ছে।”
বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধের বিচারের বিরোধিতায় বা হেফাজতে ইসলামের সমর্থনে ব্রিটেনে যারা বিক্ষোভ সমাবেশ করেছে, তাদের বড় একটি অংশ দ্বিতীয় প্রজন্মের প্রবাসী বাংলাদেশী।
বিদেশে বসে দেশের রাজনীতি নিয়ে তোলপাড় করার এই প্রবণতাকে পছন্দ করেন না অনেক প্রবাসী বাংলাদেশী।
তাদের মধ্যে একজন শাহনুর মিয়া। পূর্ব লন্ডনের ব্রিক লেনে বাংলা বই, বাংলা সঙ্গীতের একটি দোকান চালান গত ১৭ বছর ধরে।
প্রসঙ্গ তুলতেই বিরক্তি প্রকাশ করলেন। কোন অর্থ নেই। কোন কিছু করার নেই বলে এখানে বসে দেশের রাজনীতি করছে অনেকে। বিশাল কমিটি। জনসভা। হাসি লাগে দেখে।
তবে শাহনুর মিয়া কোন অর্থ খুঁজে না পেলেও, বাংলাদেশে নির্বাচনের আগে রাজনীতি যত উত্তপ্ত হবে, ব্রিটেনের বাংলাদেশিরাও তার কমবেশি আঁচ পাবেন। -বিবিসি বাংলা

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button