রোহিঙ্গাদের আর্তনাদের শেষ কোথায়?

Rohingaসৈয়দ মাসুদ মোস্তফা: রোহিঙ্গাদের আর্তনাদে রাখাইন রাজ্যের আকাশ-বাতাস ভারী হয়ে ওঠেছে। গ্রামের পর গ্রাম পরিণত হয়েছে ধ্বংসস্তুপে। প্রতিনিয়ত স্বজনহারাদের আহাজারী শোনা যাচ্ছে। বর্মী বর্গীদের হাত থেকে রেহাই পাচ্ছে না নারী, শিশু ও বৃদ্ধরাও। অগণিত বনি আদম আশ্রয় নিচ্ছে বনে-জঙ্গলে বা কোন উন্মুক্ত স্থানে। জীবন বাঁচাতে কেউ কেউ সীমান্ত অতিক্রম করে বাংলাদেশে আসার চেষ্টা করছে। মনে হয় রোহিঙ্গাদের জন্য গোটা পৃথিবীই সংকুচিত হয়ে এসেছে। কোথাও দাঁড়াবার জায়গা তাদের নেই।
মিয়ানমার সেনাবাহিনীর কথিত অভিযানের নামে রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের উপর চালানো বর্বরতা ও নির্মমতা হালাকুখানের বাগবাদ ধবংসের নির্মমতাকেও হার মানিয়েছে। নির্বিচারে চলছে ইতিহাসের জঘন্যতম গণহত্যা। সেনাবাহিনী সহ স্থানীয় সন্ত্রাসীরা মুসলিম অধ্যুষিত এলাকার বাড়ীঘরে হামলা, লুট-তরাজ, অগ্নিসংযোগ ও নারীদের গণধর্ষণ চালাচ্ছে। পুরুষ সদস্যদের গ্রেফতার করে বর্বরোচিত নির্যাতন চালানো হচ্ছে। সর্বশেষ প্রাপ্ত তথ্য মতে, এ পর্যন্ত ৪ শতাধিক রোহিঙ্গা মুসলিমকে নির্মম ও নিষ্ঠুর নির্যাতন চালিয়ে হত্যা করা হয়েছে। গ্রেফতার করে নির্যাতন চালানো হচ্ছে শ’ শ’ মুসলমানকে। কিশোরীসহ অর্ধশতাধিক নারীকে ধর্ষণ করা হয়েছে। ধর্ষণের পর কাউকে কাউকে হত্যা করার ঘটনাও ঘটেছে। ঘাতকদের নারকীয় তান্ডব এখনো অব্যাহত আছে। মনে হয় তারা রোহিঙ্গা মুসলমানদের নিশ্চিহ্ন করেই ছাড়বে!
গত অক্টোবরের গোড়ার দিকে মংডুতে একটি সীমান্ত চৌকিতে কথিত অস্ত্র ও গোলাবারুদ লুটপাটের ঘটনার পর সন্দেহ করা হয় আরএসও-কে। পর্যবেক্ষকরা বলছেন, মুলত মুসলিম নিধনযজ্ঞের প্রেক্ষাপট তৈরির জন্য মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ নিজেরাই এই ঘটনা ঘটিয়েছে। এ ঘটনার সাথে যে আরএসও জড়িত তার কোন দালিলিক ও গ্রহণযোগ্য প্রমাণ মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে উপস্থাপন করতে পারেনি। আর সে অপ্রমাণিত ঘটনাকেই অজুহাত বানিয়ে ১০ অক্টোবর থেকে শুরু হয় সেনাবাহিনীর তথাকথিত চিরুনি অভিযান। এ অভিযান চালানো হচ্ছে সাধারণ নিরীহ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর। ইতোমধ্যে গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে। নির্বিচারে গুলী করে হত্যা করা হয়েছে চার শতাধিক মানুষকে। পথে-প্রান্তরে, বন-বাদাড়ে সারি সারি লাশ। লাশের মিছিল নাফ নদীতেও। বাতাসে ভেসে আসছে পোড়া লাশের গন্ধ।
‘হিউম্যান রাইটস ওয়াচ’ স্যাটেলাইটে ধারণ করা বিভিন্ন চিত্র বিশ্লেষণ করে বলেছে, মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের একটি গ্রামের এক হাজারেরও বেশি বাড়ী ধ্বংস করা হয়েছে। গত ২১ নভেম্বর এক প্রতিবেদনে রাখাইন রাজ্যের পরিস্থিতি তুলে ধরা হয়। জাতিসংঘ বলছে, সহিংসতার ঘটনায় এ পর্যন্ত সেখানকার ত্রিশ হাজার মানুষ গৃহহীন হয়ে পড়েছে। সেনাবাহিনী ৬৯ জন রাখাইনকে হত্যার কথা স্বীকার করেছে। তবে মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন, নিহতের সংখ্যা আরো অনেক বেশি। এ পর্যন্ত সহস্রাধিক নাগরিককে তারা আটক করেছে বলে রাষ্ট্রীয় মাধ্যমের খবরে জানানো হয়েছে।
প্রাপ্ত তথ্যে জানা গেছে, বিদেশী সাংবাদকিদেরও অকুস্থলে  ঢুকতে দেয়া হচ্ছে না। রাখাইন রাজ্যে ১০ লাখের বেশি রোহিঙ্গা মুসলিম বাস করে। দেশটির সরকার রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারের নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি দেয়নি। দেশটির জনগণ রোহিঙ্গাদেরকে প্রতিবেশী রাষ্ট্র বাংলাদেশ থেকে আসা অবৈধ অভিবাসী মনে করে। কিন্তু তাদের এ দাবি পুরোপুরি ভিত্তিহীন। রোহিঙ্গারা মিয়ানমানের অধিবাসী একথা দালিলিক ভাবেই স্বীকৃত। কিন্তু মিয়ানমারের ধর্মান্ধ ও সাম্প্রদায়িক সরকার তা মানতে নারাজ।
জানা গেছে, গত মাসে সমন্বিত হামলায় ৯ পুলিশ কর্মকর্তা নিহত হওয়ার পর রাজ্যটির বৌদ্ধ ও মুসলিমদের মধ্যে উত্তেজনা তীব্র হয়। পুলিশ ওই হামলার জন্য রোহিঙ্গাদের দায়ী করছে। ওই ঘটনার পর  সৈন্যরা রাখাইন রাজ্যের বেশ কিছু অংশ অবাধ চলাচলের জন্য বন্ধ করে দিয়েছে এবং সেখানে ত্রাণকর্মী ও স্বাধীন পর্যবেক্ষকদের যেতে দেয়া হচ্ছে না। ফলে রাখাইন রাজ্যে এক ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃর্ষ্টি হয়েছে। কিন্তু জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, পশ্চিমী রাষ্ট্রগুলো ও ওআইসি, আরবলীগ, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সহ বিশ্বসংস্থাগুলো এ বিষয়ে রহস্যজনকভাবে নীরব।
জাতিসংঘ রোহিঙ্গাদের জন্য বাংলাদেশের সীমান্ত খুলে দেয়ার আহবান জানালেও মিয়ানমারে গণহত্যা বন্ধে এখন পর্যন্ত কোন কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেনি। এমনকি শান্তিতে নোবেল বিজয়ী মিয়ানমারের ক্ষমতাসীন দলের শীর্ষ নেত্রী অং সান সুচীরও এ বিষয়ে তেমন কোন প্রতিক্রিয়া নেই। আন্তর্জাতিক বোদ্ধামহল মুসলিম নিধনযজ্ঞে সুচীর রহস্যজনক নিরবতা উগ্রবাদীদের সমর্থনের শামিল বলেই মনে করছেন।
সৃষ্ট পরিস্থিতিতে রোহিঙ্গা মুসলিমদের হত্যা ও নিপীড়ন চালানোর প্রেক্ষাপটে মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের জন্য বাংলাদেশের সীমান্ত খোলা রাখার আহ্বান জানিয়েছে জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা- ইউএনএইচসিআর। বিবৃতিতে মিয়ানমারের সরকারকে সেখানকার  মানুষদের নিয়ম অনুযায়ি রক্ষা করার আহ্বান জানিয়েছে ইউএনএইচসিআর। একই সঙ্গে সেখানকার সহিংস পরিস্থিতি থেকে বাঁচতে যারা বাংলাদেশে আসার চেষ্টা করছেন, তাদের জন্য বাংলাদেশ সরকার যেন নিরাপদ আশ্রয়ের ব্যবস্থা করে সে বিষয়ে আহ্বান জানানো হয়।
এদিকে মিয়ানমারের উত্তরাঞ্চলীয় সংখ্যালঘু মুসলিম রাখাইন রাজ্যের অবস্থাকে নরকের সঙ্গে তুলনা করেছেন আরাকান রোহিঙ্গা ন্যাশনাল অর্গানাইজেশনের চেয়ারম্যান নূরুল ইসলাম। তিনি বলেছেন, সেখানে গত প্রায় দেড় মাস ধরে নিরাপত্তা বাহিনীর অভিযানে কমপক্ষে ৩৫০ জন নিহত হয়েছে। বহু নারীকে ধর্ষণ করা হয়েছে। পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে সাড়ে তিন হাজার ঘরবাড়ি। গৃহহীন হয়ে পড়েছেন ৩০ হাজারেরও বেশি মানুষ। সব মিলিয়ে সেখানে সৃষ্টি হয়েছে নারকীয় এক পরিস্থিতির। এ অবস্থায় রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেয়ার জন্য তিনি বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।
তিনি বলেন, ‘সেনাবাহিনী বিভিন্ন পাড়ার বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে তল্লাশি চালাচ্ছে। লোকজনকে গুলি করে মেরে ফেলছে। ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে লোকজন যখন বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়ে যাচ্ছে, তখন হেলিকপ্টার গানশিপ থেকে গুলিবর্ষণ করে তাদের হত্যা করা হচ্ছে।’ মি. ইসলাম বলেন, ‘রোহিঙ্গারা যেখানে গিয়ে লুকাচ্ছে, সেখানে রাস্তা দিয়ে পালিয়ে যাওয়ার সময়ে পথেঘাটে, খালে নদীতে তাদের মেশিনগান দিয়ে গুলি করে মেরে ফেলা হচ্ছে।’
মিয়ানমান সেনাবাহিনী রাখাইন রাজ্যে নির্বিচার মুসলমানদের হত্যা করলেও পশ্চিমি বিশ্বকে তেমন সোচ্চার হতে দেখা যাচ্ছে না। অমুসলিম দেশে সংখ্যালঘু মুসলমানদের ওপর হত্যা-নির্যাতনের বিষয়ে জোরালো কোনো পদক্ষেপ এখনও চোখে পড়ছে না। যদিও পশ্চিমা দেশগুলো সংখ্যালঘু ইস্যুসহ নানা অজুহাতে মুসলিম দেশগুলোর ওপর চাপ প্রয়োগ করে থাকে। ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ খামেনেয়ী  আহ্বানে ইরান সরকার এ পর্যন্ত রোহিঙ্গা মুসলমানদের রক্ষায় বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে। প্রতিনিধিদল পাঠিয়েও মিয়ানমার সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টির চেষ্টা চালিয়েছে। সর্বোচ্চ নেতার মিয়ানমার অঞ্চল বিষয়ক প্রতিনিধিও এ ক্ষেত্রে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছেন। এরপরও মিয়ানমার সরকারের মদদে রাখাইন রাজ্যে মুসলিম নিধন থেমে নেই।
উদ্ভূত পরিস্থিতিতে যেসব রোহিঙ্গা ইতোমধ্যে রাখাইন প্রদেশ ছেড়ে  যেভাবে এবং যেদিকে পারে পালিয়েছে তারাও অনাহারে অর্ধাহারে ঝোপঝাড়ে, জঙ্গলে এবং মিয়ানমার সীমান্ত ছাড়িয়ে আত্মরক্ষা করার ব্যর্থ চেষ্টা করছে। গত ২০ নভেম্বর পর্যন্ত প্রাপ্ত খবর অনুযায়ী গত ১০ অক্টোবর থেকে সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে যে চিরুনি অভিযান চলছে তাতে প্রায় চার শ’ রোহিঙ্গা প্রাণ হারিয়েছে। ধর্ষিত হয়েছে প্রায় অর্ধশত নারী। শত শত বাড়িঘর জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে দেয়া হয়েছে। গ্রেফতার করা হয়েছে সহ¯্রাধিক রোহিঙ্গাকে।
প্রাপ্ত তথ্যে জানা গেছে, রাখাইন প্রদেশের মংডু জেলার উত্তরে ঘটনার ভয়াবহতা অতীতের সকল রেকর্ডকে ছাড়িয়ে গেছে। প্রায় সাত দশক আগে থেকে রাখাইন প্রদেশে অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে রোহিঙ্গা নিধনযজ্ঞের সূত্রপাত। নানান অজুহাতে ছলচাতুরিতে সে দেশের সেনাবাহিনী, পুলিশ ও সীমান্তরক্ষীরা বারবার নিপীড়ন চালিয়েছে সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা মুসলিম জনগোষ্ঠীর ওপর। বর্বর অমানবিকতার সকল রেকর্ড ছাড়ানোর কথা বিশ্বজুড়ে পৌঁছে গেছে। উদ্বেগ উৎকণ্ঠা প্রকাশ করা হয়েছে। অনুরোধও জানানো হয়েছে জাতিসংঘসহ বিশ্বের শক্তিশালী সরকারের পক্ষ থেকে। কিন্তু মিয়ানমার সরকার উদ্বেগ উৎকণ্ঠা ও অনুরোধকে উপেক্ষাই করে চলেছে। উপরন্তু রোহিঙ্গা নিধন অভিযানের মাত্রা বাড়িয়ে দিয়েছে।
উদ্ভূত পরিস্থিতিতে রাখাইন প্রদেশের মংডুর উত্তরে চলমান এ পরিস্থিতিতে প্রতিটি গ্রাম নারী-পুুরুষ শূন্য হয়ে যাচ্ছে। রোহিঙ্গাদের বড় একটি অংশ বাংলাদেশে প্রবেশের চেষ্টায় সীমান্তের কাছাকাছি জঙ্গলে অবস্থান করছে। সাহায্য সংস্থাগুলোর পক্ষ থেকে তাদের কাছে খাদ্য সামগ্রীও পৌঁছতে দেয়া হচ্ছে না। বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকেও রোহিঙ্গারা যাতে নতুন করে সীমান্ত গলিয়ে এদেশে আসতে না পারে এজন্য বিজিবির কড়া নজরদারি আরোপ করা হয়েছে। ফলে সৃষ্টি হয়েছে মানবিক বিপর্যয়।
রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা নারী ও কিশোরীদের নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা নির্বিচারে ধর্ষণ করছে। গত ১৯ নভেম্বর বিকেলে মংডুর উত্তরে কেয়ারিপ্রাং এলাকার তিন রোহিঙ্গা যুবতীকে ধর্ষণ করে দেশটির নিরাপত্তা বাহিনীর লোকজন। ওই গ্রামের কাছাকাছি স্থান ধুদাইং এলাকার একটি পাড়া  ঘিরে ফেলে সেনাসদস্যরা। পরক্ষণে যুবতী-কিশোরীদের প্রত্যেককে একেকটি ঘরে প্রবেশের জন্য বাধ্য করে। মহিলারা ঘরে প্রবেশ না করে ভয়ে এক স্থানে একত্রিত হয়। এদের মধ্যে থেকে ধুদাইং এলাকার হাজী করিমুল্লার মেয়ে ওয়াজেদা বেগমকে (১৭) নির্জন স্থানে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। সকালে ওই কিশোরীর লাশ পাওয়া যায়।
বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, রোহিঙ্গারা সেনাসদস্যদের অত্যাচার থেকে নিজেদের রক্ষা করতে পাহাড়ের পাদদেশে বা লবণের মাঠে নিজেদের ব্যবহৃত কাপড়ের তাঁবু গেড়েছে। যেসব রোহিঙ্গা পরিবার পুরনো বসতভিটা ছেড়ে যায়নি, তাদের বাড়িঘরে গিয়ে তল্লাশির নামে সেনাসদস্যরা ঘর ও দোকানের মূল্যবান মালামাল-পণ্য লুট করার পাশাপাশি গৃহপালিত গরু-ছাগল পর্যন্ত ধরে নিয়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে মংডুর উত্তরে হাতিরপাড়া, নাইছাপ্রাং, কেয়ারিপ্রাং, ধুদাইং, জাম্বুনিয়া, গৌজুবিল, রাম্ম্যাউবিল, কুজাবিল, রাহবাইল্যা, বুড়াসিকদারপাড়া, লংডুং ও বলিবাজার এবং রাচিদং জেলার মেরুংলোয়া, ধুংছে, ওয়াস্যং, রড়ছড়া, আন্দাং, কেয়ান্দং এলাকায় রোহিঙ্গাদের ওপর অত্যাচার-নির্যাতন-নিপীড়ন চলছে বেশি। ওই সব এলাকায় শুক্রবার মসজিদগুলোতে জুমার নামাজ আদায় করতে অধিকাংশ রোহিঙ্গাকে যেতে দেয়া হয়নি।
সেনাসদস্যরা গত ১৭ নভেম্বর থেকে দেশটির রাখাইন যুবকদের সামরিক প্রশিক্ষণ বা ট্রেনিং দেয়া শুরু করেছে। এতে রোহিঙ্গাদের মধ্যে আরও বেশি ভীতি ও আতঙ্ক বিরাজ করছে। অনুরূপ প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে বৌদ্ধভিক্ষুদেরও। গত ১০ অক্টোবর থেকে বেসরকারী পরিসংখ্যান অনুযায়ী এ পর্যন্ত ১০টি পাড়ার ৪শ’ ঘর জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে। নিহতের সংখ্যা সর্বশেষ ১৪০ জনে উন্নীত হয়েছে। খোদ ইউএনএইচসিআর থেকে তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে- ৩০ হাজারেরও বেশি রোহিঙ্গা বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়েছে। এদিকে মিয়ানমারে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর নির্যাতন ও নির্বিচারে হত্যার বিপরীতে সুচির সরকার কার্যকর কোন পদক্ষেপ না নেয়ায় তার নোবেল পুরস্কার বাতিল বা ফিরিয়ে নেয়ার দাবিতে গণস্বাক্ষর সংগ্রহ করেছে চেঞ্জ ও আরজি নামের ইন্দোনেশীয়ভিত্তিক একটি সংগঠন। ইতোমধ্যে লক্ষাধিক মানুষের স্বাক্ষরে এ ধরনের আবেদন নোবেল কমিটির কাছে পৌঁছানো হয়েছে। বর্তমান সুচির সরকার ক্ষমতায় আসার আগে দশকের পর দশক সে দেশের সেনাবাহিনী ও নিরাপত্তা কর্মীরা রোহিঙ্গাদের ওপর বর্বর নির্যাতন চালিয়ে আসছে। ওই সময়ে সুচির পক্ষে জোরালো কোন বক্তব্য ছিল না। বর্তমানে ক্ষমতায় আসার পরও একই অবস্থা বিরাজ করছে। নিপীড়ন নির্যাতনে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে যেমন এসেছে, তেমনি দেশান্তরী হয়েছে মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়াসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে।
বৌদ্ধরা নিজেদের ধর্মকে অহিংস বলে দাবি করলেও  বৌদ্ধ ধর্মীয় নেতা তথা ভিক্ষুরাই শতাব্দীর এই নির্মম হত্যাযজ্ঞে মূখ্য ভূমিকা পালন করছেন। Ashin Wirathu.. মায়ানমারে রোহিঙ্গা মুসলিমদের উপর বর্বর নির্যাতনের প্রধান আসামী! তিনি একজন বৌদ্ধ ধর্মগুরু।  ২০০৩ সালে ধর্মীয় বিদ্বেষ ছড়ানোর দায়ে তার ২৫ বছরের জেল হয়। পরবর্তীতে ২০১০ সালে জেল থেকে মুক্তি লাভ করে তিনি নিজেকে মায়ানমারের ” ওসামা বিন লাদেন” হিসেবে প্রচার করে! তখন থেকে সে ইউটিউব ও ফেসবুকের মত মিডিয়াতে ব্যাপক ব্যাপক মুসলিম বিরোধী প্রচারণা চালাতে থাকেন এবং সাম্প্রদায়িক উম্মাদনা সৃষ্টি করেন। ফলে রোহিঙ্গা পরিস্থিতির মারাত্মক অবনতি ঘটতে শুরু করে।
জানা যায়, ২০০১ সালে তিনি মুসলিম বিদ্বেষী গোষ্ঠী ‘969 movement’ এ যোগ দেন। তার বিরুদ্ধে মুসলমানদের বিরুদ্ধে  উৎপীড়ন চালানোর জন্য প্রচারণা চালানোর অভিযোগ থাকলেও তিনি নিজেকে একজন শান্তিপ্রিয় ধর্মযাজক হিসেবেই দাবি করে! অবশ্য তিনি প্রকাশ্যে মুসলমানদেরকে শত্রু বলে দাবি করে!!
২০১৩ সালের জুন মাসে প্রকাশিত টাইম ম্যাগাজিনের কাভার পেজে তাকে ‘The Face of Buddhist Terror’ হিসেবে অভিহিত করা হয় ! “ তুমি দয়ামায়া-ভালোবাসায় পরিপূর্ণ হতে পারো, কিন্তু তুমি পাগলা কুত্তার পাশে ঘুমাতে পারো না”– মুসলিমদের উদ্দেশ্য করে বলা তার এটি আপত্তিকর মন্তব্য ! তিনি আরো বলেন যে আমরা যদি দুর্বল হয়ে যাই, তবে আমাদের ভূমি একদিন মুসলিমদের হয়ে যাবে ! এভাবে গোটা মিয়ানমারে মুসলিম বিদ্বেষ ছড়িয়ে দেন বৌদ্ধ ভিক্ষু নামের এই বিড়াল তপসী।
মূলত মগদস্যু আর সেনাবর্বরতায় কবর রচিত হচ্ছে মানবাধিকারের, উৎপীড়নের লেলিহান শিখায় জ্বলছে গ্রামের পর গ্রাম। আরাকানের সবুজ নিসর্গে বইছে রক্তস্রোত। নাফ নদীতে মানুষের লাশ। লাশ পড়ে আছে পথে-প্রান্তরে। লাশগুলো বিকৃত, মাথা বিচ্ছিন্ন দেহ থেকে। অঙ্গপ্রত্যঙ্গ কেটে বিকৃত করা হয়েছে। আগুনে পোড়ানো কয়লা সদৃশ্য লাশ। ওরা ধর্ষণ করেছে এবং হত্যা করেছে রোহিঙ্গা নারীদের।ওরা হাত – পা বেধেছে এবং ফেলে দিয়েছে সাগরে। কিন্তু বিশ্ববিবেক রহস্যজনকভাবে পুরোপুরি নীরব। আসলে মুসলমানদের কি মানবাধিকার বলতে কিছু নেই ?
মিয়ানমারে যখন গণহত্যা চলছে, তখন জাতিসংঘ তো একটা বিবৃতি দিয়েই সব দায় শেষ করেছে। বাংলাদেশকে সীমান্ত খুলে দেয়ার আহবান জানালেও গণহত্যা ও বর্বরতা বন্ধে জাতিসংঘের কার্যকর কোন পদক্ষেপ নেই। এখন তো পূর্বতিমুরের স্পৃহা তো পুরোপুরি অনুপস্থিত। দক্ষিণ সুদানের সংবেদনশীলতা তো দেখা যাচ্ছে না। আফগানিস্তানের বামিয়ানে এক মূর্তির জন্য কতই না আহাজারী কথিত মানবতাবাদীদের। কিন্তু রোহিঙ্গাদের ক্ষেত্রে সকলইে যেন মুখে কুলুপ এঁটেছেন। আমেরিকা-ব্রিটেন বা ইউরোপিয় ইউনিয়ন তো মানবাধিকার ইস্যুতে খুবই সোচ্চার! নির্যাতিত মুসলমানদের জন্য তাদেরকে এগিয়ে আসতে দেখা যাচ্ছে না। রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে বাংলাদেশকে শুধু আশ্রয় প্রদানের চাপ দিয়ে সব দায়িত্ব তাদের শেষ করছেন। মানবতার সাথে এর চেয়ে নির্মম পরিহাস আর কি হতে পারে ?
ইতিহাসের বর্বরতম হত্যাযজ্ঞ ও নিধনযজ্ঞ চালানো হচ্ছে রোহিঙ্গাদের উপর। কিন্তু বিশ্বসংস্থাসহ শক্তিধর রাষ্ট্রগুলো শুধুই গলাবাজি করে নিজেদের দায় সারছেন। এ বিষয়ে মুসলিম বিশ্বকেও তেমন জোড়ালো ভূমিকা রাখতে দেখা যাচ্ছে না। ইসলামী সম্মেলন সংস্থা (ওআইসি)র ভূমিকা অনেকটাই অন্যদের সমান্তরালে। রোহিঙ্গাদের সাহায্যার্থে কেউ কার্যকরভাবে এগিয়ে আসছে না। তাই বিশ্বের শান্তিপ্রিয় মানুষের উদ্বেগ-উৎকন্ঠা ক্রমেই বাড়ছে। আসলে রোহিঙ্গাদের আর্তনাদের শেষ কোথায় তা বলা বেশ কষ্টসাধ্যই।

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button