আফ্রিকার ‘অন্ধকার তথ্যপ্রযুক্তিতে’ আলো ফেলছেন যে বাংলাদেশি তরুণ

africaআফ্রিকার কেনিয়া ও উগান্ডা তথ্যপ্রযুক্তিতে অনুন্নত, কিছু কিছু খাত রয়েছে একেবারে অন্ধকারে। সেইসব অন্ধকার কোণে আলো ফেলছেন এক বাংলাদেশি তরুণ রাশেদ কামাল।
জাতিসংঘের মনোনীত পরামর্শক হয়ে তিনি কেনিয়া ও উগান্ডার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বিশেষ করে সফটওয়্যার ও সেবা পণ্য নির্মাতাদের নিত্য ব্যবহার্য সফটওয়্যার তৈরি, মান নিয়ন্ত্রণ, আধুনিক বাজারজাতকরণ পদ্ধতি ও কৌশল ইত্যাদি বিষয়ে পরামর্শ দিচ্ছেন। তথ্যপ্রযুক্তি নিয়ে কাজ করলেও উগান্ডা ও কঙ্গোর সফটওয়্যার নির্মাতা ও প্রোগ্রামাররা ততোটা পরিষ্কার ধারণা রাখেন না স্থানীয়ভাবে সফটওয়্যারের চাহিদা, স্থানীয় বাজার, আফ্রিকার বাজার, ইউরোপের বাজার ও বৈশ্বিক বাজার বিষয়ে।
রাশেদ কামাল এসব বিষয়ে কেনিয়া ও উগান্ডায় যারা তথ্য প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করছেন, সম্ভাবনাময় এমন ৩০টি কোম্পানির প্রতিনিধিদের হাতে কলমে শেখাচ্ছেন ‘একাধিক পণ্য নয় বরং একটি বিশেষ পণ্য বা সেবা নিয়ে কাজ করে প্রথমে নিজেকে পরে বিশ্বকে বদলে দিন।’ রাশেদ কামাল বললেন, ‘কথাটি লুফে নিয়েছেন ওখানকার তরুণরা। আসলে তাদেরকে গাইড করার কেউ নেই।’
রাশেদ কামাল নিজেও একজন সফটওয়্যার নির্মাতা। দেশে তার রয়েছে ডাটাবিজ ইনকরপোরেশন নামের একটি সফটওয়্যার প্রতিষ্ঠান। জানালেন, কেনিয়া ও উগান্ডায় পরামর্শক হওয়ার আগে তাকে বেশ কয়েকটি ধাপ (পরীক্ষা) সাফল্যের সঙ্গে উত্তীর্ণ হতে হয়েছে। কেন আপনাকে ওরা বেছে নিয়েছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এই খাতে আমার ১৭-১৮ বছরের অভিজ্ঞতা, পড়াশোনার (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএতে পড়াশোনা করেছেন), কমিউনিটিতে কাজ করার অভিজ্ঞতা ইত্যাদি কাজে দিয়েছে। এছাড়া আমি নিজেও আগে এই প্রশিক্ষণ (এখন তিনি যে প্রশিক্ষণ দেন) নিবিড়ভাবে নিয়েছি। কয়েকটি ধাপে ভালো করার পরে তিনি ডাক পেয়েছেন জাতিসংঘের আইটিসি (ইন্টারন্যাশনাল ট্রেড সেন্টার) থেকে ‘ইন্টারন্যাশনাল কনসালট্যান্ট অ্যান্ড আইটি ইন্ডাস্ট্রি এক্সপার্ট’ হিসেবে। তিনি জানালেন, তার সঙ্গে রয়েছেন একজন ডাচ প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ ফ্রেড জেনসন। একেকটা প্রশিক্ষণ ৬ মাসের একটি প্রজেক্ট। এটা শেষ হলে হয়তো আবার অন্য কোনও দেশে প্রশিক্ষণ শুরু হবে। তিনি জানালেন, একেকটি দেশে ২ দিনের প্রশিক্ষণ ও ২ দিনের কোচিং করানো হয়। ৩ মাস পরে হয় মিড সেশন। এরইমধ্যে প্রশিক্ষণের দুটি পর্ব শেষ হয়েছে।
রাশেদ কামাল বললেন, দুটি সেশনে তারা প্রভূত উন্নতি করেছে। প্রথম প্রশিক্ষণে আমরা যা শিখিয়েছিলাম তা ওরা বেশ আয়ত্ব করেছে। যেসব হোমওয়ার্ক (নিজেদের উন্নয়নের জন্য যেসব কাজ) দিয়েছিলাম সেগুলোও ওরা বেশ গুছিয়ে রেখেছিল।
কি শেখানো হয় তাদের? এ প্রশ্নের উত্তরে রাশেদ কামাল জানান, ‘আমরা আসলে ওদের সফটওয়্যার ও সার্ভিস এক্সপোর্ট মার্কেটিং স্ট্র্যাটেজিটা শেখাই। ওরা ছোটখাটো কাজ করে। আমরা সেগুলোকে আরও বড় স্কেলে কীভাবে নিয়ে যাওয়া যায়, অন্যদেশে ঢোকার পথ কীভাবে তৈরি করা যায় সে বিষয়ে মার্কেটিং প্ল্যান তৈরি করে দেই। প্রশিক্ষণ নেওয়ার পরে তারা নিজেরা ছোট ছোট প্ল্যান করে আমাদের কাছে পাঠিয়ে দিচ্ছে। আমরা দেশে থাকি আর যেখানেই থাকি, সেসব প্ল্যান দেখে ঘষেমেজে ঠিক করে পাঠিয়ে দেই। নবেম্বরে ওদের ফিনিশিং সেশন।’ তিনি জানালেন, কেনিয়া এবং উগান্ডা বাংলাদেশের তুলনায় তথ্যপ্রযুক্তিতে অন্তত ১০ বছর পিছিয়ে আছে। ১০ বছর আগে বাংলাদেশে তথ্যপ্রযুক্তির যে অবস্থা ছিল এখন ওদের সেই অবস্থা। কিন্তু সুবিধা হলো, ওরা ইংরেজিতে বেশ দক্ষ। এই একটা বিষয়কে পুঁজি করে ওরা এগিয়ে যাওয়া শুরু করেছে। ওরা বিপিও (বিজনেস প্রসেস আউটসোর্সিং) ও মেডিকেল ওয়েব অ্যাপ্লিকেশন তৈরিতে বেশ ভালো করছে। আইটিসি হয়তো এ কারণেই আফ্রিকার এই দুটি দেশকে বেছে নিয়েছে, প্রশিক্ষণ দিলেই ওরা ভালো করবে।
রাশেদ কামালের কথার সূত্র ধরে জানা গেল, কেনিয়া ও উগান্ডার প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করা লোকজন বেশ আরাম প্রিয়। তাদের মধ্যে তাড়াহুড়ো কম। সময়মতো মিটিংয়ে আসতে অনীহা। দেরি করে মিটিংয়ে এলেও তারা এজন্য দুঃখ প্রকাশ করতেও অভ্যস্ত নয়। প্রথম ট্রেনিং সেশনের পরে তাদের এই অবস্থার পরিবর্তন হতে শুরু করেছে। ট্রেনিংয়ের শুরুতে যে অবস্থা ছিল তার থেকে তারা শতভাগ উন্নতি করেছে। তবে এই দুই দেশের লোকজনের সঙ্গে বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে কিছুটা মিল লক্ষ্য করা গেলেও তাদের মধ্যে সাপ্লাই চেইনের গ্যাপ রয়েছে। ‘টেকনিক্যাল নো হাউ’ খুবই কম। এ কারণে তারা ধীরগতিতে উন্নতি করছে।
কেনিয়া ও উগান্ডার প্রযুক্তিপ্রেমীরা তাদের সফটওয়্যার ও সেবা পণ্য নিয়ে ইউরোপের বাজারে প্রবেশের স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে। রাশেদ কামাল বলেন, আমরা তাদের বুঝিয়েছি আগে তাদের নিজের দেশের বাজার এবং আফ্রিকার আঞ্চলিক বাজারে ভালো করে তবেই ইউরোপের বাজারে যেতে হবে। তারা যেসব পণ্য নিয়ে ইউরোপের বাজারে যেতে চায় ইউরোপে এরই মধ্যে সেসব পণ্য রয়েছে এবং কয়েকটি প্রতিষ্ঠান বেশ ভালো করছে। এ কারণে এখনই কেনিয়া ও উগান্ডা ইউরোপের বাজারের জন্য প্রস্তুত নয়। এই প্রশিক্ষণ গ্রহণ করলে হয়তো ওরা ইউরোপের বাজারে প্রবেশের আত্মবিশ্বাস পাবে। রাশেদ কামাল উল্লেখ করলেন, এই দুটি দেশের মধ্যে কেনিয়া বেশ এগিয়েছে। দেশটির রাজধানী নাইরোবিতে অটোমেটেড কার পার্কিংয়ের ব্যবস্থা রয়েছে। মোবাইল মানি (ব্যাংকিং) এম-পেসা সেখানে খুবই জনপ্রিয়। চালু হয়েছে উবারের সেবা। বাংলাদেশেরও সেখানে কাজ করার অনেক সুযোগ রয়েছে বলে তিনি মন্তব্য করেন। রাশেদ কামাল বলেন, আমি বিশেষভাবে উল্লেখ করতে চাই কেনিয়ার দুটি প্রতিষ্ঠান এবং উগান্ডার একটি প্রতিষ্ঠানের কথা। কেনিয়ার প্রতিষ্ঠান দুটি (শর্তের কারণে নাম প্রকাশ করেননি তিনি) অনেকগুলো আইটেম নিয়ে কাজ করত। একটি প্রতিষ্ঠান করত ১৬টি সেবা পণ্য নিয়ে। রাশেদ কামাল প্রতিষ্ঠান দুটিকে একটি বিশেষ পণ্য নিয়ে কাজ করতে পরামর্শ দেন। একটি প্রতিষ্ঠানকে ওয়েব অ্যাপ্লিকেশন এবং অপর প্রতিষ্ঠানকে ডিস্ট্রিবিউন চ্যানেল পোর্টালের প্রতি মনোযোগ দিতে বলেন। আর উগান্ডার একটি প্রতিষ্ঠানকে তিনি ‘মেডিসিন সফটওয়্যার’ তৈরির পরামর্শ দেন। কেনিয়ার ১৫ এবং উগান্ডার ১৫ কোম্পানিকে কাজ করছেন রাশেদ কামাল। দুটি প্রশিক্ষণের অভিজ্ঞতা থেকে তিনি বলেন, দুটি দেশের তথ্যপ্রযুক্তির বাজার খুবই ছোট। তারা জানেই না আন্তর্জাতিক বাজার এখন কোথায় গেছে। তাদের আরও উন্নতি করতে হলে তাদের অ্যাটিচিউড বদলাতে হবে, সাংস্কৃতিক পরিবর্তন দরকার তাদের। তবে তারা ফাইট দিতে জানে। এই যোদ্ধা মনোভাবই তাদের অনেক দূর এগিয়ে নেবে বলে তিনি বিশ্বাস করেন। -ইন্টারনেট

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button