ভারতের হাতছাড়া হচ্ছে অপরূপ সৌন্দর্যের লীলাভূমি

Kashmir১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর থেকে সংঘাত-সংঘর্ষে জর্জরিত পৃথিবীর ‘ভূ-স্বর্গ’ বলে খ্যাত অপরূপ সৌন্দর্য্যরে লীলাভূমি কাশ্মীর। ১৯৮০-৯০ দশকে এ সংঘর্ষ তীব্রতা ধারণ করে যখন পাকিস্তান সমর্থিত কাশ্মীরে স্বাধীনতার বিষয়টি মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। তবে ২০০০ সালের প্রথম দিকে সংঘর্ষের পরিমাণ কমতে থাকে এবং কাশ্মীর সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধানের সম্ভাবনা দেখা দেয়।
কিন্তু এখন সেই সম্ভাবনা মৃতপ্রায়। কাশ্মীরে আবারো সহিংসতার পুনুরুত্থান ঘটেছে এবং স্বাধীনতাকামীদের প্রতি সাধারণ জনগণের সমর্থনও প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি পাচ্ছে।
কাশ্মীরের সাধারণ জনগণের মধ্যে প্রতিনিয়ত ভারতের প্রতি জনসমর্থন হ্রাস পাচ্ছে এবং যদি ভারতের কাশ্মীর নীতিতে বড় ধরণের কোনো পরিবর্তন না আসে তাহলে জনপ্রিয়তা শূণ্যের কোঠায় নেমে আসার খুব বেশি দেরি নেই।
১৯৪৭ সালের দেশভাগের পর কাশ্মীর নিয়ে ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে তীব্র সংকটের সৃষ্টি হয়। শত শত বছর জম্মু ও কাশ্মীর ছিল একটি স্বতন্ত্র স্বাধীন দেশীয় রাজ্য। কাশ্মীর নিয়ে সৃষ্ট সংকট নিরসনে তৈরি হয় পৃথিবীর সবচেয়ে উত্তপ্ত সীমান্ত লাইন অব কন্ট্রোল। জাতিসংঘের মধ্যস্ততায় কাশ্মীরকে ভারত-পাকিস্তানের মাঝে ভাগ করে দেয়া হয়।
জাতিসংঘের তদারকিতে কাশ্মীরে একটি গণভোট অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্তের ভিত্তিতেই যুদ্ধবিরতি বলবৎ হয় এবং জাতিসংঘের মধ্যস্থতাকে ভারতই প্রথম স্বাগত জানায়। বরং ভারতই জাতিসংঘের দ্বারস্থ হয়ে যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব উত্থাপন করে।
কিন্তু ‘শান্তি-শৃঙ্খলার উন্নতি না হওয়া’ এবং অনুকূল অবস্থা তৈরি না হবার অজুহাতে ভারত ছয় দশকেরও বেশি সময় ধরে কাশ্মীরে গণভোট অনুষ্ঠান বাস্তবায়ন করেনি। এর মধ্যে কাশ্মীর নিয়ে পাক-ভারত একাধিক যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে। তাতে যুদ্ধবিরতি তথা ‘লাইন অব কন্ট্রোল’ রেখার কোন হের-ফের হয়নি। অর্থাৎ যুদ্ধের মধ্যদিয়ে কাশ্মীর সমস্যার সমাধান হয়নি। আঞ্চলিক উত্তেজনা বরং বেড়েছে।
এর মধ্যে স্বাধীনচেতা কাশ্মীরীরা রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা থেকে মুক্তির উপায় খুঁজতে বেছে নেয় স্বাধীনতার পথ। হাতে তুলে নেয় অস্ত্র। ভারত শাসিত কাশ্মীরে পাকিস্তানের পৃষ্ঠপোষকতায় শুরু হয় স্বাধীনতাকামীদের স্বাধীনতা সংগ্রাম।
এর জবাবে ভারত কাশ্মীরের ওপর চালায় ব্যাপক দমন-নিপীড়ন। কাশ্মীর উপত্যকা জুড়ে চলতে থাকে ভারতীয় বাহিনীর ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ। পাঁচ লাখ নিয়মিত সেনাবাহিনী এবং আরো কয়েক লাখ নিরাপত্তা রক্ষী নিয়োগ করেও কাশ্মীর উপত্যকার আগুন পুরোপুরি নেভাতে সক্ষম হয়নি দিল্লী। হত্যা, খুন, লুণ্ঠন, ধর্ষণ চালিয়ে মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন ঘটিয়েছে ভারতীয় বাহিনী।
আশির দশক থেকে চলতে থাকা এ সংঘর্ষে হাজার হাজার মানুষের মৃত্যু প্রত্যক্ষ করেছে বিশ্ব। অবশেষে একবিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে অস্ত্রের পরিবর্তে সংলাপের মাধ্যমে কাশ্মীর সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ গ্রহণ করে পাক-ভারত নেতৃত্ব। তৎকালীন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারি বাজপেয়ী ও পাকিস্তানী প্রেসিডেন্ট জেনারেল পারভেজ মোশাররফের আলোচনা ফলপ্রসূ কোনো সমাধান দিতে পারেনি কাশ্মীরবাসীকে।
২০১০ সালে আবারো উত্তপ্ত হয়ে ওঠে কাশ্মীর উপত্যকা। ভারতীয় শাসনের বিপক্ষে রাস্তায় নামে কাশ্মীরী জনগণ। জবাবে উপত্যকা বাসীর ওপর নেমে আসে নির্মম নির্যাতন। ভারতীয় বাহিনী স্বাধীনতাকামীদের দমনের নামে নির্বিচারে হত্যাকাণ্ড চালানো শুরু করে।
এর ধারাবাহিকতায় কাশ্মীরের তরুণরা আবারো হাতে তুলে নেয় অস্ত্র। এসব তরুণের অধিকাংশই শিক্ষিত ও ভালো পরিবারের সন্তান। তরুণদের অধিকাংশই যোগ দেয় কাশ্মীর আন্দোলনের অন্যতম দল হিজবুল মুজাহিদীনে।
হিজবুল মুজাহিদীন ইতিমধ্যেই কাশ্মীরের জনগণের কাছে বিপুল জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে এবং প্রতিনিয়তই বাড়ছে তাদের সদস্য সংখ্যা। ফেসবুক, টুইটারসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তাদের কার্যক্রমের প্রতি সমর্থনের চিত্র স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয়।
স্বাধীনতাকামী কাশ্মীরের জনগণের মাঝে স্বাধীনতা আন্দোলনের যতই জনপ্রিয়তা বাড়ছে ভারত সরকারের প্রতি তাদের সমর্থন ততই কমছে। পুরো কাশ্মীরজুড়ে ভারত বিদ্বেষী মনোভাব তুঙ্গে।
২০১৩ সালে লস্কর-ই-তৈয়বার শীর্ষস্থানীয় কমান্ডার আবু কাসিম ভারতীয় বাহিনীর হামলায় নিহত হন। তার জানাযায় হাজার হাজার মানুষ অংশগ্রহণ করেছে। কাশ্মীরীরা ফুলেল শ্রদ্ধায় শেষ বিদায় জানিয়েছে এই স্বাধীনতাকামী নেতাকে।
এছাড়া গত বছরে কাশ্মীরের শ্রীনগরে ভারতীয় বাহিনীর সাথে মুজাহিদ বাহিনীর এক যুদ্ধে দুই তরুণ মুজাহিদ ফাঁদে পড়ে যান। ভারতীয় বাহিনীর গুলীতে নিশ্চিত মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা ছাড়া তাদের কিছুই করার ছিল না। এমন সময় স্থানীয় কিছু বাসিন্দা অস্ত্র হাতে ভারতীয় বাহিনীর মোকাবেলায় ঝাঁপিয়ে পড়ে ওই দুই তরুণ মুজাহিদকে উদ্ধার করে।
এসব ঘটনাই প্রমাণ করে ভারতীয় শাসনের প্রতি কাশ্মীরীদের ঘৃণা-বিদ্বেষ কতদূর ছাড়িয়েছে। সম্প্রতি আইএস তাদের কার্যক্রম কাশ্মীর পর্যন্ত বৃদ্ধির ঘোষণা দিয়েছে। যদিও স্থানীয় কাশ্মীরীরা এ বিষয়ে তেমন আগ্রহী নয়। তবে বছরের পর বছর ধরে চলতে থাকা শোষণে দেয়ালে পিঠ ঠেকে গিয়েছে তাদের। তাই আইএসের ডাকে সাড়া দেয়াও বিচিত্র নয়।
ভারত যদি কাশ্মীরে চলতে থাকা সংঘাত-সংঘর্ষ বন্ধ করে উপত্যকায় শান্তি স্থাপন করতে চায় তবে তাদের কাশ্মীর নীতিতে পরিবর্তন আনতে হবে এবং কাশ্মীরের বাসিন্দাদের রাজনৈতিক সুযোগ বৃদ্ধি করতে হবে। বিশেষ করে সশস্ত্র বাহিনী (বিশেষ ক্ষমতা) আইন এবং পাবলিক সেফটি অ্যাক্টের মত কুখ্যাত আইনগুলো বদলাতে হবে এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের সাথে জড়িত সৈন্যদের শাস্তির আওতায় আনতে হবে। সর্বোপরি, শান্তি প্রক্রিয়া ফলপ্রসূ করার জন্য কাশ্মীর ও পাকিস্তানের কর্তৃপক্ষের সাথে যৌথভাবে কাজ করতে হবে।
কিন্তু ভারত শান্তি স্থাপন প্রক্রিয়া শুরু করতে যত বিলম্ব করবে কাশ্মীরীদের নিকট তারা ততটাই জনপ্রিয়তা হারাবে এবং কাশ্মীরের আকাশে-বাতাসে ভেসে বেড়াবে স্বাধীনতার দামামা।
ফরেন পলিসি ম্যাগাজিন অবলম্বনে

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button