ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর প্রতি এক মুসলিম নারীর খোলা চিঠি

Cameronব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন সম্প্রতি পার্লামেন্টে রেডিকেলাইজেশনের ওপর যে বক্তৃতা দিয়েছেন, তাতে অনেক মুসলিম ক্ষুব্ধ ও মর্মাহত হয়েছেন। ব্রিটিশ মুসলিম নারী সিমা ইকবাল প্রধানমন্ত্রী বরাবর এক খোলা চিঠিতে বলেন, আমার জীবনে প্রথমবারের মতো মনে হচ্ছে আমি ব্রিটেনের অধিবাসী নই। আপনি চরমপন্থী মোকাবেলার যে পরিকল্পনা করেছেন- সে ব্যাপারে ব্রিটিশ মুসলিমরা অত্যন্ত উদ্বিগ্ন। খোলা চিঠিটি গার্ডিয়ান থেকে অনুবাদ করেছেন মুহাম্মদ খায়রুল বাশার।
প্রিয় মি. ক্যামেরন, আপনি আমূল সংস্কারের বিষয়ে চলতি সপ্তাহে যে বক্তৃতা দিয়েছেন- সত্যিকার অর্থে আমার মতো নাগরিকদের কাছে এই বক্তৃতার অর্থ কী?
মানচেস্টারে জন্মগ্রহণ এবং এখানে বেড়ে ওঠা সত্ত্বেও এবং মানচেস্টারের একজন অধিবাসী হিসেবে আমি গর্ববোধ করলেও (লিভারপুল এফসির জন্য বা পক্ষে আমার সমর্থনের কথা না হয় নাইবা বললাম) গত ৩৭ বছরের মধ্যে এই প্রথমবার আমার মনে হচ্ছে, আমি ভাবছি, আমি এখানকার অধিবাসী নই। এবং হ্যাঁ, আমি একজন মুসলিম, কেবল একজন ব্রিটিশ মুসলিম। আমি এখানে ‘মুসলিম কমিউনিটি বা সম্প্রদায়’ পরিভাষাটি শুনে আসছি। আমরা মনে করি, এই কমিউনিটি একটি শান্তিপূর্ণ ও কঠোর পরিশ্রমী- যারা তাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য অধিকতর ভালো ভবিষ্যৎ বিনির্মাণের লক্ষ্যে যুক্তরাজ্যে স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন। এখন আমি শুনছি এবং দেখছি একটি ভুলভাবে উপস্থাপন করা, হামলার মুখে থাকা একটি ভীত সম্প্রদায়ের মতো করে মুসলিমদের একটি প্রতিচ্ছবি সমাজে পেশ করা হচ্ছে। তাদের সদাসর্বদা ক্ষমা প্রার্থনা করার প্রয়োজনীয়তা এবং তাদের ধর্মীয় বিশ্বাসকে রক্ষা করার জন্য পেরেশানির মধ্যে রাখা হচ্ছে।
অনেকেই আপনার বক্তৃতা বা ভাষণে সাড়া দিয়েছেন এবং কেউ কেউ এই বক্তৃতা নিয়ে ভালোভাবে গবেষণা ও বিশ্লেষণ করছেন। কিন্তু, আমি আপনাকে আমার মতো কারো কারো কথা বলতে বা শুনাতে চাই। আপনি এবং আপনার সরকার আরোপিত বা চাপিয়ে দেয়া আইনের মাধ্যমে আমার সন্তানদের ভবিষ্যতের ব্যাপারে যে পরিকল্পনা আরোপ করছেন, সে ব্যাপারে আমার আস্থা বা বিশ্বাস থাকা দরকার।
পাসপোর্টের ব্যাপারে যে প্রস্তাব দেয়া হয়েছে, সেটা দিয়ে শুরু করা যাক। চলতি সপ্তাহে আপনি বলেছেন- পিতা-মাতা যদি আশঙ্কা করে তাদের সন্তান আইসিসের পক্ষে যুদ্ধ করার জন্য সিরিয়া অথবা ইরাক যাবে তাহলে সন্তানদের পাসপোর্ট বাতিল করার ক্ষমতা পিতা-মাতার থাকবে। কোনো মাতা-পিতাই তাদের সন্তানদের যুদ্ধে যেতে দিতে চায় না, এটা কেবল মুসলিম পিতা-মাতার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য নয়। আইসিসে কেউ কেন যোগ দেবে তা আমার বুঝে আসে না। সুতরাং একজন পিতা-মাতা হিসেবে আমার সন্তানকে ক্ষতিকর কাজে যাওয়া বন্ধ করলে বা থামিয়ে দিলে সেটাকে স্বাগত জানানো হবে। কিন্তু কেবল অনুসন্ধিৎসা থেকে জানতে চাই, আমার সন্তানের পাসপোর্ট বাতিল করা হলে তাদের কি তারপর অহিংস চরমপন্থী হিসেবে চিহ্নিত করা হবে? যদি তাই হয়, ভবিষ্যতে তাদের পরিণাম কী হবে? এই মুহূর্তে ‘আইডোলজি বা আদর্শ’ সম্পর্কে বেশ কথাবার্তা হচ্ছে। স্পষ্টত জেনে রাখুন যে, ‘আদর্শ’ আমাকে বিচ্ছিন্ন করে রাখতে পারবে না। ‘আদর্শ’ ব্যাপক সংস্কার বা আমূল সংস্কার করতে পারবে না। ইসলাম ফোবিয়া বা ইসলাম ভীতি, পররাষ্ট্রনীতি এবং দ্বিমুখীনীতি আমাকে বিচ্ছিন্ন এবং আতঙ্কগ্রস্ত করেছে। ব্যাপক সংস্কার বা আমূল সংস্কার করার পেছনে ফারাক রয়েছে, সে ব্যাপারে আমার সন্দেহ জাগে। টনি ব্লেয়ারসহ অন্যদের মতো আপনি বলেছেন, আপনার লক্ষ্য মুসলিম এবং ইসলাম নয়- লক্ষ্য হলো ভয়ঙ্কর জিহাদি ইজম। আপনার আন্তরিকতা নিয়ে বিশ্বাস করা আমার জন্য কঠিন। কারণ, এমন এক সমাজ আপনি তৈরি করেছেন যেখানে ইসলামের কোনো বিষয় নিয়ে আলোচনা করলেই চরমপন্থী হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
মুসলিম এবং ইসলামকে অন্যায়ভাবে উপস্থাপনের মাধ্যমে এর মানহানি করা হচ্ছে এবং সমাজ ও মিডিয়া ইসলামকে পৈশাচিকভাবে উপস্থাপন করে বিভ্রান্ত ছড়াচ্ছে।
ইসলামের ব্যাপারে আতঙ্ক সৃষ্টি করে হামলার ঘটনা বৃদ্ধি পেয়েছে। এখনো অবশ্য আমি ইসলামফোবিক হামলার টার্গেট হইনি। অবশ্য আমি মাথায় স্কার্ফ পরিধান করি না অথবা আমি অধিকতর পশ্চিমা স্টাইলের পোশাক পরিধান করে থাকি, সে কারণে হয়তো আমার ওপর হামলা হচ্ছে না বা সমালোচনা হচ্ছে না। আমি অবশ্য এটাকে এভাবে চিন্তা করি না। কিন্তু আমি যখন পত্র-পত্রিকায় নিউজ দেখি তখন দেখতে পাই পক্ষপাতদুষ্ট হেডলাইন বা শিরোনাম।
আপনি ইসলাম ফোবিয়া তথা ইসলাম নিয়ে আতঙ্ক ছড়ানোর কথা উল্লেখ করেছেন- কিন্তু এর পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে আপনি কি পদক্ষেপ নিয়েছেন? আপনার বক্তৃতার ওই অংশটি কি আমি মিস করেছি? সাধারণ নির্বাচনের আগে ইসলাম নিয়ে আতঙ্ক সৃষ্টি করাকে একটি পৃথক অপরাধ হিসেবে রেকর্ড করার প্রস্তাব করা হয়েছিল। কিন্তু এ ব্যাপারে কি কোনো পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে?
গণমাধ্যমের ‘সন্ত্রাসবাদ’ পরিভাষাটির ক্ষতিকর ব্যবহার বিশ্ব মুসলিম ও সন্ত্রাসবাদের মধ্যে সম্পর্ক বা যোগসূত্র সৃষ্টি করেছে। জনগণের মনমানসিকতায় সন্ত্রাসবাদকে সম্পৃক্ত করে মুসলিম সম্প্রদায়ের ব্যাপারে ঘৃণা ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। দাইলান রৌফকে অনেকে সাধারণ একজন ‘শুটার’ হিসেবে বর্ণনা করেছে, অথচ সে ঘৃণা ছড়িয়ে দেয়ার ব্যাপারে লিখিত ঘোষণা দিয়েছে। আমার সন্তানদের খবর দেখা এবং পত্র-পত্রিকা পড়া বন্ধ করে দেয়া উচিত কেন? যারা সুস্পষ্টভাবে ইসলামের অর্থ বোঝেন না, ইসলাম সম্পর্কে সঠিক ধারণা যাদের নেই, মিডিয়া সে ধরনের কিছু সংখ্যক লোকের কাজকর্মকে ইসলামের বিরুদ্ধে ব্যবহার করছে। বিশ্বব্যাপী ১০৬ কোটি মুসলমানকে কলঙ্কিত ও একটি শান্তিপূর্ণ ধর্মকে দৈত্যরূপে মানুষের কাছে পেশ করার জন্য মিডিয়াকে ব্যবহার করা হচ্ছে। যুক্তরাজ্যে মুসলমানদের সাথে কী ধরনের ব্যবহার করা হচ্ছে এবং ইসলামের ব্যাপারে ভুল বোঝাবুঝির মাধ্যমে আতঙ্ক সৃষ্টি করার জন্য মিডিয়াকে কিছু দায়দায়িত্ব বহন করতে হবে।
ডেভিড, আপনাকে মিডিয়ায় সঠিক রিপোর্টিং অর্থাৎ সঠিকভাবে খবরাখবর প্রচারের বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। মিডিয়ায় সঠিকভাবে খবরাখবর প্রচার না করার যে দ্বিমুখী নীতি, নিয়মিত আইপিএসও বা স্বাধীন ও নিরপেক্ষ সংস্থা কর্তৃক অপর্যাপ্তভাবে পর্যবেক্ষণের ব্যাপারে আপনাকে নজর দিতে হবে। আপনি পররাষ্ট্রনীতির বিষয়টি উল্লেখ করতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছেন। অসংখ্য ও ব্যাপক বোমা বর্ষণের রাজনীতি নিয়ে আমি কথা বলব না। কিন্তু গত বছর ৫১৯টি ফিলিস্তিনি শিশুকে যে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে সেটা আমি আমার দু’সন্তানের কাছে কিভাবে ব্যাখ্যা করব? যুক্তরাজ্য সে ব্যাপারে কিছুই করেনি। যখন ইরাকে ব্যাপক ধ্বংসাত্মক অস্ত্র খোঁজার নামে প্রায় পাঁচ লাখ মানুষকে নির্বিচারে হত্যা করা হলো অথচ সেখানে ওই ধরনের কোনো অস্ত্র ছিল না। এই বিষয়টি কি আপনি আমার দুই সন্তানের কাছে ব্যাখ্যা করতে পারবেন?
তাদের ভবিষ্যৎ কী হবে সে ব্যাপারে আমি উদ্বিগ্ন ও বিস্মিত। তারা কি তাদের যে বিশ্বাস তা কি মেনে চলতে বা অনুশীলন করতে পারবে? বর্তমান আইনানুযায়ী শিক্ষকেরা তাদের যেসব তথ্য দিচ্ছেন সে অনুযায়ী তারা কি সুচারুভাবে ধর্মকর্ম পালন করতে পারবে? এই আইনের অধীনে ধর্মচর্চা তথা ধর্মীয় কর্মকাণ্ডকে বৃদ্ধির যেকোনো লক্ষণ দেখা গেলে সেটাকে কি রেডিকেলাইজেশন আমূল সংস্কার বা ব্যাপক সংস্কার হিসেবে দেখা হবে? চলতি মাসে ব্রিটিশ শিক্ষাবিদেরা এই আইনকে একটি ব্যর্থতা বলে উল্লেখ করে ব্রিটেনের প্রধান প্রধান সংবাদপত্রে খোলা চিঠি দিয়েছিলেন। তারা ওই আইনকে কেবল মুসলিমদের ক্ষেত্রেই একটি ব্যর্থতা বলে উল্লেখ করেননি, যেকোনো মানুষ তিনি একজন শিক্ষক অথবা চিকিৎসক যাই হোন না কেন, অন্যের ক্ষতি করা বন্ধ করবেন। একজন জিপি হিসেবে এই আইন দ্বারা আমি অপমানিত বোধ করছি। আপনি কি মনে করেন আমি আমার ক্যারিয়ারের গত ১২ বছর সময় ক্ষতিকর কোনো কিছু ঘটার বিষয়টি অনুমোদন করেছি।
আমার সন্তানদের জন্য চাকরির কি সুযোগ সুবিধা থাকবে? যারা মনে করে ‘মুসলমানরা সরকারের ওপর কর্তৃত্ব গ্রহণ বা প্রভাব বিস্তার করেছে’- এ ধরনের বক্তব্যের ব্যাপারে আপনি নিদারুণ বিরক্তি প্রকাশ করেছেন। কর্মক্ষেত্রে বর্তমানে মুসলমানেরা যে বৈষম্যের শিকার হচ্ছে সেটা কিভাবে নিয়ন্ত্রণ করবেন, সে ব্যাপারে কোনো কিছু উল্লেখ করতে আপনি ব্যর্থ হয়েছেন। মুসলমানেরা নিজেদের এ দেশের অধিবাসী হিসেবে ভাবতে পারবে- এ ধরনের পরিবেশ সৃষ্টির বিষয়টি কিভাবে আপনি নিশ্চিত করবেন?
আপনি বলেছেন, আপনি ব্রিটিশ মুসলিমদের মধ্যে উদারপন্থীদের ক্ষমতায়ন বা ক্ষমতার অধিকার দিতে চান। এটাকে আমি সর্বান্তকরণে স্বাগত জানাই। কখন আপনি কুইলিয়াম ফাউন্ডেশনে এমন মানুষদের প্রতিস্থাপিত করবেন যারা আমার প্রতিনিধিত্ব করে এবং ব্রিটিশ মুসলিমদের মধ্যে তাদের প্রতি আস্থা ও সম্মান রয়েছে। রেডিকেইলাইজেশন বা আমূল সংস্কারের হুমকি মোকাবেলায় আপনার সাথে কাজ করতে আগ্রহী বহু উদার মুসলিম এবং বহু সংগঠন রয়েছে। এরা যুক্তরাজ্যে বসবাসরত ২৭ লাখ ব্রিটিশ মুসলিমের প্রতিনিধি। চিন্তাভাবনা এবং উদ্বেগ উৎকণ্ঠার শেষ নেই। ব্রিটেনে মুসলিম হিসেবে বেঁচে থেকে এই মুহূর্তে এটাই হচ্ছে বাস্তবতা। সত্যিই আপনি ‘চরমপন্থা’ মোকাবেলা করতে চাইলে যারা দায়িত্বশীল ব্যক্তি তাদের সাথে কথা বলুন।
আপনার জবাবের অপেক্ষায় রইলাম।
– সিমা ইকবাল

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button