ক্বওমি মাদ্রাসা : আমার শৈশবের জবানবন্দী

Rifat Hasanমাদ্রাসা শিক্ষা নিয়ে সঙ্গীত শিল্পী রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যার একটি মন্তব্যে শুরু হয়েছে ফেসবুক বিতর্ক। বন্যা বলেছেন, মাদ্রাসায় পড়ে মুক্তমনা মানুষ হওয়া যায় না। বন্যা কি ঠিক বলেছেন? না কি ভুল? আমরা আসলেই কতটুকু জানি মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের মন ও মনন?
কেবল রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা নয়, সমাজের আরও অনেকের মধ্যেই মাদ্রসা সম্পর্কে জানার চাইতে না-জানার পরিমাণই বেশি। আসলে কী পড়ায় কওমী মাদ্রাসায়? কওমী মাদ্রাসা থেকে কি তৈরী হতে পারে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বলিয়ান বাঙ্গালী? প্রশ্নগুলো থেকেই যাচ্ছে। প্রশ্নগুলোর উত্তর পাওয়া যেতে পারে কথাসাহিত্যিক রিফাত হাসানের লেখা স্মৃতিচারণমূলক নিবন্ধ থেকে। মাদ্রাসা শিক্ষা নিয়ে লেখা ও নিবন্ধটি পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো –

পাকিস্তান আমলে আমার বাবা ছিলেন সরকারী চাকুরে, পরে সওদাগর এবং দাদারা সম্ভবত কৃষিকাজ করতেন আর ছোটখাট ব্যবসা করতেন। সেই সময়ে লোকজন রেঙ্গুন থেকে জিনিশপত্তর এনে চট্টগ্রাম শহরে ব্যবসা করতো, মুরুব্বিদের কাছ থেকে শুনেছি। দাদাও তেমনতরো কিছু করতেন। তবে পাকা ব্যবসায়ী ছিলেন না, বাবাদের হাল হক্বিকত দেখে বুঝেছি। বাবা সম্ভবত বৃটিশ ভারতের শেষের দিকে, অথবা পাকিস্তান আমলের প্রথম দিকে, চট্টগ্রামের কানুনগো পাড়া কলেজ থেকে বিএসসি পাশ করেন। বাবা ছিলেন আমাদের গ্রাম বা চট্টগ্রাম শহরের প্রথম দিককার ইংরেজী শিক্ষিতদের একজন। চট্টগ্রামের একজন লেখকের পুরনো স্মৃতি কথামূলক বইয়ে পটিয়ার শোভনদণ্ডি গ্রামের বিদ্যৎজনদের তালিকায় আমার বাবার নাম পেয়েছিলাম, লেখক বাবার সাথে সময় কাটানো ও গল্প করার মধুর স্মৃতির কথা লিখেছেন একাত্তর পূর্ব সময়ে। তো, নিজের এই ঘটনা বাবা মনে রেখেছেন সবসময়। এই শিক্ষিত হওয়ার ঘটনা বাবার জীবনে কেমন প্রভাব ফেলেছে তার একটা নমুনা। বাবা ছিলেন আমার নানার বড় মেয়ের জামাই। তো, ছোট শালির বিয়ের কথা আসলো। অনেকেই আগ্রহী বাবার এই ছোট শালীকে বিয়ে করার জন্য। সুন্দরী, শিক্ষিত ছিলেন। বাবা ঘোষণা দিলেন, যারা আমার এই শালীকে বিয়ে করতে চান, তাদেরকে একটি পরীক্ষায় পাশ করতে হবে। পরীক্ষাটা হলো, বাবার কাছে তার ছোট শালীকে বিয়ে করার আগ্রহের কথা জানিয়ে চিঠি দিতে হবে। যার চিঠি বাবার পছন্দ হবে, বিয়ে সেখানেই হবে। প্রচুর চিঠি আসতে লাগল। পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা ভর্তি চিঠি, বাবা পড়েন আর ছিড়ে ফেলেন। মুর্খরা এইসব কী লেখে। শেষমেষ একটা চিঠি অসল, খুব সংক্ষিপ্ত, কয়েক লাইনের। বাবা চিঠি পড়ে আনন্দের হাসি হাসলেন, এবং সেখানেই বিয়ে দিলেন। যিনি নির্বাচিত হইছিলেন, তিনি ছিলেন একটি প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক। বাবা বলতেন, মুর্খরা যা বলার জন্য পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা নষ্ট করে, জ্ঞানীরা তা অল্প বাক্যেই বলে ফেলতে পারে। জ্ঞানীরা বাচাল হয় না।
যাই হোক, তারপরে জিপিওতে সরকারী চাকুরি থেকে যথা সময়ের আগেই অবসর নিয়ে বাবা স্বাধীনতাপূর্ব চট্টগ্রাম শহরে এসে একটা ছোট দোকান নিয়ে ব্যবসা শুরু করেছিলেন। বাবার এই দোকানের আর একটি ইতিহাস আছে। আমাদের গ্রামের স্থানীয় মহাজন মনিন্দ্রনাথ ঠাকুর এর কাছ থেকে ৪৭ এর দেশ ভাগের সময়ে আমার দাদা স্বল্প মূল্যে কিছু সম্পত্তি কিনে নেন। এর একটির নাম, মনীন্দ্রনাথের ঘোনা, আমাদের বিহান বাজার, মহাজন হাটের পাশে। এই জায়গাটির আয়তন কত, তা আমার জানা নেই। তবে ছোটবেলায় একবার এই জাগাটিতে ঢুকে হারিয়ে গিয়েছিলাম। বিশাল বনের মত বাগান জুড়ে তখন সুপারি আর নারকোল গাছের সারি, আর ঘন ঝোপ জঙ্গল। পরে দাদা চট্টগ্রাম শহরে একটি দোকান কিনেছিলেন। বাবাদের দুই ভাইয়ের ভিতরে সম্পত্তি ভাগের সময়ে বাবা শহরের দোকানটিই বেছে নিলেন, বাবার অপর ভাই নিলেন সেই মনীন্দ্রনাথের ঘোনা। মনীন্দ্রনাথ থেকে কেনা কোন সম্পত্তিরই ভাগ নেন নি বাবা। বাবা বলতেন, গুনাহ। দাদাকে আমরা দেখি নাই খুব একটা। যতটুকু দেখেছি, স্মৃতি মনে নেই। ৭১ সালে, স্বাধীনতা ঘোষণার পরে, কোন একদিন সেই দোকানের উপরে বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়ে দিয়েছিলেন বাবা। মুসলিম লিগের একটি মিছিল থেকে সেই দোকানটি জ্বালিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা হল পরদিন। সেই মিছিলে বাবার একজন বন্ধু ছিলেন, তিনি দোকানটি জ্বালিয়ে দেওয়ার থেকে বাঁচালেন। শুধু পতাকাটি নামিয়ে জ্বালিয়ে দিলো মিছিলকারীরা। এইসব পরবর্তীতে বাবার সেই বন্ধুর মুখ থেকে শোনা। বাবা কখনো বলেন নাই। মুখচোরা, গম্ভীর, ভীতু, ন্যায়বাদী সিভিল পার্সন ছিলেন বাবা। দেখা গেছে, বাবা এইসব কাণ্ড করলেও সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন নাই।
২.
অনেকদিন পর, হঠাৎ একদিন ব্যবসা ফেলে চাষ-বাষ শুরু করে দিলেন বাবা। আমি ছিলাম মা-বাবার শেষ বয়সের সন্তান। যে অর্থে আজকে মাদ্রাসা পড়ুয়াদের সাথে প্রান্তিক অর্থনৈতিক জনগোষ্ঠির তত্ত্ব দেওয়ার চেষ্টা করছেন অনেকেই, আমাদের ফ্যামিলি সেই অর্থে অসচ্ছল ছিল না। যদিও, আমার জন্মের সময় বা এর পরবর্তী সময়টা একটু কঠিনই ছিল আমাদের। শুনেছি, স্বাধীনতার আগে আমাদের ফ্যামিলি শহরেই থাকতো। পরে, আবার গ্রামে চলে এসেছিল। সেটা ঠিক কোন সময় বলতে পারবো না। আমার বাবা বেঁচে নেই এখন, ২০০৬ সালে ইন্তিকাল করেছেন। আমার মা আমার সাথে থাকেন, কিন্তু স্মৃতি শক্তি লোপ পেয়েছে। তবে একটা জিনিশ সত্য, আমাকে মাদ্রাসায় পড়তে দেবার কারণ কোন অস্বচ্ছলতা নয়। পরিবারের অন্তত একটা ছেলে যাতে কুরআন হাদিস পড়ে বরকত হাসিল করে, সেইরকম একটি ভাব ছিল। আমি একই সাথে গ্রামের কওমি মাদ্রাসায় পড়তাম, আবার স্থানীয় সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়েও ভর্তি ছিল আমার। এই ঘটনায় সম্ভবত আমার মরহুম দাদীরও প্রভাব ছিল। আমার দাদী ছিলেন বুজর্গ মানুষ। পরীর মত সুন্দরী মহিলা, কিন্তু তল্লাটের কোন অমোহররম পুরুষ দাদীর চেহারা দেখেন নাই। পটিয়া জমিরউদ্দীন সাহেব হুজুরের মুরিদ ছিলেন দাদী। দাদীর পুরো নাম ছিল শ্রীমতি ইসলাম খাতুন। এই নামটি যখন বলতেন, আমরা দাদীকে ঠাট্টা করতাম। নামের আগে শ্রীমতি কেন? দাদী এই শ্রীমতির মানে জানতেন না। প্রায়ান্ধ ছিলেন দাদী। বিশাল বড় হরফের একটা কোরান শরিফ ছিল দাদীর, এখনো আমাদের বাড়িতে রক্ষিত আছে। হরফের সাথে চোখ লাগিয়ে রেখে কোরআন শরিফ পড়ার চেষ্টা করতেন। তাজকেরাতুল আউলিয়া, আবার বিষাদ সিন্ধু- এইসব বই আমরা দাদীর লাইব্রেরীতেই পড়েছি। মনে আছে, ছোটবেলাটা বিষাদসিন্ধু পড়েই সাহিত্যপিয়াস মিটিয়েছি আমি। দাদী তসবিহ নিয়ে বসে থাকতেন। আর আমাদেরকে বিষাদ সিন্ধু পড়ে শুনাতে বলতেন। তাজকিরাতুল আউলিয়াও পড়ে শুনাতাম। আউলিয়াদের কাহিনী, সীমারের নিষ্ঠুরতা, হাসান হোসেনের মহাপ্রয়ান, এইসব শুনে শুনে, অশ্রু বিসর্জন করতেন দাদী। আমাকে সম্বোধন করতেন, চটুল্যা মওলভি, কোন দুষ্টুমি করলে তখন, আদর করে। দাদীর আর একটা গুণ ছিল, কথায় কথায় শ্লোক বলতেন। বেশির ভাগই আশকর আলী পণ্ডিতের শ্লোক। আশকর আলী পণ্ডিতের নাম সম্ভবত অনেকেই শুনে থাকবেন। বিশ শতকের সেই পুঁথি পণ্ডিতের বাড়ি আমাদের পাশেই ছিল। প্রতি বছর ওরস হতো। এখনো হয়। তবে, সেই পুরনো জৌলুস নিয়ে নয়। আমার মায়ের বয়ানে, আমার নানাও ছিলেন বুজর্গ মানুষ। নানাকে কখনো দেখি নাই, আমার জন্মের চল্লিশতম দিনে ইন্তেকাল করেন। নানা নাকি অসম্ভব সুন্দর ছিলেন। ছোটবেলায় নাকি আমি নানার মত সুন্দর ছিলাম। নানার বাপ ছিলেন জমিদার। নাম মুসলিম খাঁ। নানার নাম সৈয়দ আহমদ খাঁ। তিনিও সেই জমিদারি উত্তরাধিকার সূত্রে পেযেছিলেন। সেই নানার পুত্র আমার বড় মামা, চিরকুমার। বর্তমানে বাম রাজনীতি করেন। একাত্তরে মামা সশস্ত্র যুদ্ধ করেছেন। নানার বাড়িতে ছিল মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্প। মামার মুখে শুনেছি সেই গল্প।
৩.
তো, বাবা পাকিস্তান আমলের একটি গল্প বলতেন। সেটি হল, বাবাদের অফিসের সরকারী ভাষা ছিল দুটি। এক. ইংরেজি। দুই. উর্দু। বাবা উর্দু অপছন্দ করতেন। তাই ইংরেজিটাকেই বেছে নিয়েছিলেন কম্যুনিকেশনের মাধ্যম হিশেবে। এই কাহিনী বলার একটা কারণ আছে। ক্বওমি মাদ্রাসায় পড়ার সময়ে আমাদের একটি ভাষা বেশ আয়ত্তে এসে গিয়েছিল। উর্দু। কারণ চট্টগ্রামের কওমি মাদ্রাসাগুলোর পড়ালেখার মাধ্যম তখন পর্যন্ত ছিল উর্দু এবং চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষা। কোন কোন জায়গায় ফার্সি ছিল। হাটহাজারীর মেখল মাদ্রাসা ফার্সি মাধ্যমে পড়াত। আবার কোন কোনটিতে আরবীও। চট্টগ্রামের দারুল মা আরিফ মাদ্রাসা ছিল আরবী মাধ্যম। আমাদের মাদ্রাসায় হাটহাজারির মেখল মাদ্রাসার একজন ছাত্র পড়াতেন। সেই ছাত্রটির সুবাদে আমরা সেই সময়ে অনেক দিন ফারসি ভাষায় কথা বলেছি। উর্দু, ফারসি এবং আরবী এই তিনটা ভাষায় আমাদের মোটামোটি দখল ছিল। গুলিস্তা, বুসতাঁ ও পন্দনামা ফারসি ভাষার এইসব কালজয়ী সাহিত্য গ্রন্থ আমাদের মুখস্ত ছিল, সেই সময়েই। আবার আমি যেহেতু একই সাথে স্কুলে পড়তাম, হুজুররা চাইতেন আমি ওদেরকে এইসব কথা শুদ্ধ বাংলায় বুঝাই। বুঝাতে গেলে আমার ওখানকার বন্ধুরা হাসত। কী সব আজগুবি জাপানি ভাষা। তো, আমরা উর্দুতে প্রচুর শের পড়তাম। শের পড়ে পড়ে দাদীকে শুনাতাম। দাদী খুশি হতেন। বাবা অপছন্দ করতেন এই উর্দু শের, যেমন অপছন্দ ছিলো পাকিস্তানে তার উর্দু ভাষা।
বাবার এই অপছন্দের কারণ তখন আমার বুঝার কথা নয়। উর্দু ভাষা সম্পর্কে বাংলা ভাষা ভাষিদের যে একটা রক্তাক্ত অভিজ্ঞতা আছে, সেই ইতিহাসের পাঠ আরো অনেক পরে হয়েছে, বাংলাদেশের সরকার অনুমোদিত ক্লাসিক্যাল পাঠ্য বই এর মাধ্যমে। পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠি কর্তৃক উর্দুকেই একমাত্র রাষ্ট্র ভাষা হিশেবে চাপিয়ে দেওয়ার যে আধিপত্যচিন্তা, তার জন্য স্বয়ং উর্দু ভাষাকেই শত্রু ও প্রতিপক্ষ জ্ঞান করা, ভাষা বিদ্বেষ- এইসব। আধুনিক ইংরেজি শিক্ষিত মানুষ হিশেবে বাবাও সেই অভিজ্ঞতার অংশ। সরকারী চাকুরে হবার সুবাদে সেই আধিপত্যবাদি ভাষা ও রাষ্ট্রের সাথে তার কায় কারবার ছিল। সেইমতো, বাংলা ভাষাভাষি একজন হিশেবে ঘৃণা। তবে, মনে রেখেছি পরে, বাবা ইংরেজি শিক্ষিত ও ইংরেজি ভাষার ভাব ও সাংস্কৃতিক হেজিমনি দ্বারা আলোকিত। তাই, ইংরেজী ভাষা বিষয়ে বাবার কোন আপত্তি ছিল না। আমাদেরকে গভীর মমতা সহকারে ইংরেজি ভাষা পড়াতেন। বাবার এই অপছন্দ ও পক্ষপাত আমাকেও গ্রাস করেছিল। প্রশ্ন হলো, ক্বওমি মাদ্রাসাগুলি কেন উর্দু ভাষাকেই পড়ালেখার প্রধান মাধ্যম হিশেবে জারি রাখল? এইটা একটা দীর্ঘ আলোচনার দাবী রাখে, এখানে ছোট একটা নোক্তা হল, ওদের কোন ভাষা বিদ্বেষ গড়ে উঠে নাই। আবার কোন এক ঔপনিবেশিক ভাষার প্রতি প্রেম অনুভব করার মত যে কালচারাল হেজিমনি, তার থেকে ওরা নিজেদের তফাতে রেখেছিল, ইংরেজ উপনিবেশের শুরু থেকেই। বাংলা ভাষায় ওদের পা্ঠ্য বিষয়সমূহের পর্যাপ্ত রসদ ছিল না, তাই ওরা সেই শুরু থেকেই যে পাঠাভ্যাস রয়ে গিয়েছিল, তাই ধরে রেখেছে। যদিও এখন তার কিছু পরিবর্তন হচ্ছে।
৪.
আমাদের গ্রামের মাদ্রাসাটি ছিল খুব ছোটখাট, মাটির ঘর। ছাত্রসংখ্যা সবে মিলে ১৫ থেকে বিশ জন। অন্যান্য সব কওমি মাদ্রাসার মত, সমাজের মুষ্টি ভিক্ষা দিয়ে চলত এই মাদ্রাসাও। এই মুষ্টি ভিক্ষায় অংশগ্রহণ সব ছাত্রের জন্য বাধ্যতামূলক ছিল। ধানের দিনে ধান, কোরবানির সময় খাল তোলা, জাকাত, এইসবই হল মাদ্রাসার চালিকা শক্তি। ছাত্রদের থেকে কোন নির্দিষ্ট বেতন নেওয়া হত না। মুষ্ঠি চাল রাখতে হত প্রত্যেকের বাড়িতে। আমাদের মায়েরা প্রতি অক্তে ভাত রান্না করবার সময় এক মুষ্ঠি চাল আলাদা করে জমাতেন। এই চালই সপ্তাহ শেষে মাদ্রাসায় পাঠিয়ে দেওয়া হত। হুজুররা সমাজের প্রত্যেক শুভাকাঙ্ক্ষির কাছে এইরকম মুষ্ঠি চালের আবেদন করতেন। যাদের ইচ্ছে হত, তারা রাখত। সবার জন্য রাতে মাদ্রাসায় থাকাও ছিল বাধ্যতামূলক। রাতে সবাই মিলে পড়ালেখার নাম তকরার। একজন ছাত্র এই তকরার পরিচালনা করত, আর আর সবাই শুনত ও অংশগ্রহণ করত। আবার আর একজন। এইভাবে চলত। খাওয়া দাওয়াও মাদ্রাসায় করতে হত। এইসব কিছুর মধ্যে আমার বাবা আমাকে পৃথক শর্ত দিয়ে মাদ্রাসায় পাঠালেন। এক. আমি মুষ্টি ভিক্ষায় যাব না কখনো। দুই. খাওয়া দাওয়া বাড়িতে এসে করব। আমার ভিতর একটা অহংকার ছিল এইসব কারণে। বড় হুজুর এইসব পৃথক নিয়ম আমার জন্য মেনে নিয়েছিলেন। তারপরও বলতেন, এই বিনয়, মুষ্টিভিক্ষা জ্ঞান অর্জনের অংশ। তুমি কখনো ভালমতন জ্ঞান অর্জন করতে পারবে না। ছাত্রদের মধ্যে আমাদের গ্রামের ছেলেপেলে যেমন কিছু ছিল, আবার ছিল বহুত দূর দূরান্তের ছাত্রও। তখন বিদ্যুৎ ছিল না, কেরোসিনের চেরাগ ছিল। আছরের সময়ে বাড়িতে এসে রাতের খাবার দাবার খেয়ে নিতাম। তারপরে মাগরিবের আগেই চলে যেতে হত মাদ্রাসায়। খুব ভয় করত পথে একটি মহিরুহর মত তাল গাছ, তারপরে একটি খাল, খালের উপর বাঁশের সাঁকো। পরে এই সাঁকো পাকা করা হয়েছিল এই মাদ্রাসার কয়েকজন শুভাকাঙ্ক্ষীর উদ্যোগেই। সন্ধ্যার আলো আঁধারিতে আমার এই শৈশব বড় ভয়ে থাকত। পড়াশোনার চাপের ভিতরে আর একটি মধুর সময় ছিল। দুপুর। দুপুর অক্তে আম্মার হাতের সুটকি মাছের ঝোল আর তরকারী দিয়ে রান্নার সেই তৃপ্তি এখনো ভুলি না। জিভে লেগে থাকে।
৫.
আমার শিক্ষকটিকে বড় হুজুর বইলা ডাকতাম, আমরা সবাই। ক্বওমী মাদ্রাসায় ছাত্র শিক্ষক একটা ওস্তাদ আর শিষ্যের সম্পর্ক থাকে, যা আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থায় ছাত্র-শিক্ষকের যে ফিউডাল সম্পর্ক, তার থেকে পৃথক। পড়া না পারলে, বা দুষ্টুমি করলে, হুজুররা পিটুনি দিতেন। বলা হতো, এইটা পড়ালেখার অনিবার্য অংশ। আমার ভেতরে সব সময়ই একটা ভক্তি কাজ করেছে। সেইটা হল, এই পিটুনি আমার প্রাপ্য, যদি আমি সবক না পারতাম। কখনোই এমন সংশয় হয় নাই, কেন হুজুর আমাকে মারবেন। সেই কারণে আমি যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে এসে শিক্ষকদের প্রতি আমাদের ক্লাসিক্যাল ভক্তি নিয়ে কথা বলি, তখন একই সাথে শিক্ষক, আবার আমার প্রগতিশীল বন্ধুরা অবাক হয়ে যায়। আমাদের সেই বড় হুজুরটি ছিল সহজ-সরল গ্রামীণ বুজর্গ মানুষ। এখনো বেঁচে আছেন। সেই মাদ্রাসাটি নিয়েই।
৬.
আমরা একদিন শুনলাম, মাদ্রাসায় কোন একটি এনজিও অর্থায়ন করবে। এনজিও এই শব্দটি সেই প্রথম শুনছিলাম। সেইদিন আমরা অপেক্ষা করে ছিলাম। বেশ কিছু প্যান্ট শার্ট পরা লোক এসে আমাদের হুজুরদের সাথে বসল। অনেক কথা বলল। আমাদের মাদ্রাসার রান্নাঘরে সেইদিন চা রান্না হল। দেখলাম, হুজুররা না করছে। সেই এনজিও হল না। কেন, সে খুব সহজ কাহিনী। ওরা অর্থায়ন করবে, কিন্তু ওদের কিছু শর্ত পালন করতে হবে। নেসাবে ওদের প্রেস্তাবিত বই ঢুকাতে হবে। আমাদের বড় হুজুরের সেই সবে সাই নেই। পরে দেখেছিলাম, সমাজের অনেক বিত্তশালি লোকের অনুদান ফিরিয়ে দিয়েছেন বড় হুজুর। কারণ, সেই অনুদানে স্বার্থ আছে। বড় হুজুর সেই স্বার্থ পুরণ করতে ইচ্ছুক নন। আমরা খুব মন খারাপ কইরা থাকতাম, আমাদের মাদ্রাসাটি খুব ছোট, মাটির দেয়াল, খড়ের চাল, মাটিতে যেখানে বইসা পড়তে হয়, ওখানে একটা ভাল পাটি নেই। ইলেক্ট্রিসিটি নেই। ভাবতাম, পাশের স্কুলটির মত আমাদের যদি পাকা ঘর থাকত। আলো থাকত যদি। হুজুররা বলত, পাকা দালানে শয়তান থাকে। ওখানে শান্তি নেই। মাটির ঘরে আল্লাহর রহমত। মাঝে মধ্যেই বর্ষাকালে রহমতের বৃষ্টি নামত চাল ফুটো করে। মধ্যরাতে আমাদের ছুটোছুটি পড়ে যেত।
৭.
একদিন এক নতুন হুজুর আসল আমাদের মাদ্রাসায়। আমাকে অসম্ভব পছন্দ করতেন। শিক্ষাপদ্ধতিতে বেশ অভিনব কিছু ব্যাপার আনলেন। ঘোষণা দিলেন, পুরো মাদ্রাসার মধ্যে যে গড়ে সবচেয়ে বেশি নম্বর পাবে, তাকে পুরস্কার দেওয়া হবে। পরীক্ষা হল। দেখা গেল সেই সৌভাগ্যবান আমি। মাদ্রাসার বার্ষিক সভাতে আমাকে পুরস্কার দেওয়া হল। আমি পুরস্কারের মোড়ক খুলে দেখলাম, একটি বাংলা বই। বইয়ের নাম: মওদূদীর তফসির ও চিন্তাধারা। মওদূদী নামক এক ভদ্রলোকের করা কোরআন শরীফের তফসির ও এর ভ্রান্তি নিয়ে লেখা। লেখকের নাম, ঠিক মনে পড়ছে না এখন। এই মওদূদী কে, জানতাম না। বাড়িতে গিয়ে বড় ভাইদেরকে দেখালাম। বড় ভাই তো অবাক। এই বই এমন বাচ্চা বয়সের একজনকে পুরস্কার দেওয়ার মানে কী? যাই হোক, সেই নতুন হুজুরকে ডেকে বড় ভাই বকা দিলেন। বাচ্চা ছেলেদের জন্য এ কেমন উপহার? পরে জেনেছি, এই মওদূদির পুরো নাম সাইয়েদ আবুল আলা মওদূদী। উপমহাদেশে জামায়াতে ইসলামী নামক পলিটিক্যাল ইসলাম ধারণায় একটি সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা। একাত্তর এর মুক্তিযুদ্ধে অবস্থানের বিষয়ে তার প্রতিষ্ঠিত দলটি বেশ বিতর্কিত। পরে এই ভদ্রলোকের প্রচুর লেখাও পড়েছি। সেই কাহন অন্য কোথাও। এখানে এই ঘটনার উল্লেখ এই কারণে যে, ক্বওমি মাদ্রাসাগুলো ঐতিহ্যগতভাবেই জামায়াত শিবিরের পলিটিক্যাল ইসলাম ধারণার বিপক্ষে। সেইটা আমার অভিজ্ঞতা হয়েছিল পঞ্চম শ্রেণিতে। এই পঞ্চম শ্রেণীর ওখানকার নাম, হাফতুম। চতুর্থ শ্রেণীকে বলা হত, হাশতুম। তৃতীয় শ্রেণীকে বলা হতো, নাহুম। তার আগের দুইটি শ্রেণীর আরবী নাম সম্ভবত ইয়াজদহম এবং দোয়াজদহম।
যাই হোক, এই মাদ্রাসায় আমার অভিজ্ঞতা হাফতুম পর্যন্ত। সেই হাফতুম এর বছর, আমি একই সাথে শোভনদণ্ডী প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে পঞ্চম শ্রেণীর পরীক্ষা দেই এবং পাশ করি। এই পর্যন্ত এসে একটি ঘটনা ঘটল। আমি ছিলাম চরিত্রগতভাবে গো বেচারা, নিরীহ গোছের। সাত চড়ে রা করার অভ্যাস ছিল না। এখনো, খুব একটা বদল হয় নাই এই অভ্যাসের। বাবার সামনে এসে কথা বলবো, সেই সাহস আমাদের ভাই বোন কারোরই ছিল না। খুব জলদ গম্ভির মানুষ ছিলেন। একদিন আমি বাবার কাছে এসে বললাম, আমি আর এ মাদ্রাসায় পড়ব না। বাবা অবাক হয়ে গেলেন। ভাই বোনেরা ভয় পেয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরল আড়াল করার জন্য। বাবা চুপচাপ শুনলেন আমার কথা। কিছু বললেন না। রাতে বড় হুজুরকে ডেকে পাঠালেন আমাদের বাড়িতে। এ কথা সে কথার পর বললেন, আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমি আর আপনার মাদ্রাসায় আমার ছেলেকে পড়াব না। হুজুর আকাশ থেকে পড়লেন। কেন? বাবা বললেন, সেই কেনর উত্তর আমার কাছে নেই। আপনার ছাত্রর সিদ্ধান্ত। আপনার ছাত্র আমাকে কখনো মুখ ফুটে মুখের সামনে কথা বলে নাই। এই প্রথম বলেছে। তাই আমিও সিদ্ধান্ত নিয়েছি ওকে এখানে আর পড়াব না। আপনার অনুমতি নেওয়ার জন্য ডাকলাম। বড় হুজুর স্নেহের সাথে আমাকে কাছে ডাকলেন। জিজ্ঞেস করলেন, কেন আমি মাদ্রাসায় আর পড়তে রাজি নই। কেউ কি কিছু বলেছে? আমি বললাম, না। কিন্তু আমি এখান থেকে চলে যাবো। হুজুর আমার মাথায় আদর করে দিলেন। আমারো চোখে জল আসল। আমি বলি নাই, কারণ বলার মত তেমন কিছুই ছিল না। এইসব উনিশ শ নব্বুই সালের ঘটনা। এর আগের কোন ঘটনারই সাল তারিখ মনে নেই। তখন এরশাদ বিরোধী আন্দোলন তুঙ্গে। আমাদের গ্রামেও তার কিছু ঢেউ এসে লেগেছে। সালমান রুশদির স্যাটানিক ভার্সেস মাঠ গরম করে রেখেছে আন্তর্জাতিক মহলে ও দেশে। কিছুদিনের মধ্যে এরশাদের পতন হল। আর আমি শহরে এসে উঠলাম।
(লেখাটি লেখকের সম্পর্ক, বন্ধুত্ব ও রাজনীতি বই থেকে পুনঃপ্রকাশিত। রচনাকাল: ৯ মে ২০১৩, রাজধানীর মতিঝিলে হেফাজতের অবস্থানে যৌথবাহিনীর রক্তক্ষয়ী অভিযানের পরে এই লেখাটি লেখা হয়।
লেখকের ভাষায়- রাষ্ট্র ও শাসক শ্রেণী,বুদ্ধিজীবীমহল ও মিডিয়া মাদ্রাসা ছাত্রদের অমানবিক মূর্তি বানিয়ে তার উপর জুলুম ও হত্যাকাণ্ডের নায্যতা দিচ্ছে। এই লেখাটিতে সেই মাদ্রাসা ব্যবস্থাকে লেখক নিজ শৈশবের মানবিক অভিজ্ঞতার আলোকে দেখার চেষ্টা করেছেন।)

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button