অসম প্রচারণা শেষ, এবার ভোট বিপ্লবের অপেক্ষা
ক্ষমতাসীন দলের পক্ষে একতরফা প্রচার এবং বিরোধী পক্ষকে নজিরবিহীন দমন-নির্যাতনের মধ্য দিয়ে শেষ হয়ে গেল একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আনুষ্ঠানিক প্রচারপর্ব। নির্বাচনের প্রতীক পাওয়ার পর থেকে টানা ১৮ দিন পর আজ শুক্রবার সকাল ৮টায় নির্বাচন কমিশনের বেঁধে দেওয়া প্রচারের সময়সীমা শেষ হয়েছে।
উনিশশো একানব্বই সাল থেকে যারা সংসদ নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করছেন তাদের অনেকেই বলছেন, এবারের নির্বাচনের প্রচারণার পরিস্থিতি ছিল অনেক দিক থেকে একেবারেই ভিন্ন। প্রথম দিন থেকেই বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো বলে আসছে, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোট একতরফা প্রচারণা চালানোর সুযোগ পাচ্ছে। বিভিন্ন নির্বাচনী এলাকায় পোস্টার, ব্যানার, কিংবা সনাতনী প্রথায় যেসব প্রচারণা হয় তার সবটাই তারা করতে পারছে। এই খবর রয়েছে গণমাধ্যমে এবং নির্বাচন পর্যবেক্ষকরাও এই অভিযোগ অস্বীকার করছেন না।
ড.কামাল হোসেনের নেতৃত্বে ঐক্যফ্রন্ট এবং বিএনপির নেতারা প্রথম থেকেই তাদের ওপর হামলা, গ্রেপ্তারের অভিযোগ করছেন। এবারে ডজন খানেক প্রার্থীর ওপর হামলার ঘটনা ঘটেছে। নির্বাচনকে ঘিরে সহিংসতার ঘটনা বাংলাদেশে নতুন নয়, কিন্তু প্রচারণার সময় খোদ প্রার্থীদের ওপর হামলা প্রচারণার প্রচলিত আমেজকে পাল্টে দিয়েছে।
বিএনপি দলের সাংগঠনিক দুর্বলতার কথা নাকচ করে দিয়েছে। বিএনপির একজন ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু বলছিলেন, তাদের তৃণমূল পর্যায়ের নেতারা ঐক্যবদ্ধ আছেন। তারা যেহেতু মূল ধারায় প্রচারণা চালাতে পারেননি তাই সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে তাদের বার্তা ভোটারদের কাছে পৌঁছানোর চেষ্টা করেছেন।
তিনি বলছিলেন “আমাদের মহাসচিব, আমাদের চেয়ারপার্সনের বিভিন্ন বক্তব্য, ঐক্যফ্রন্টের ড.কামাল হোসেনের বক্তব্যগুলো ইতিমধ্যে আমরা জাতির সামনে সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে তুলে ধরেছি। বিশেষ করে তরুণ ভোটারদের লক্ষ্য করে আমরা কিছু কথা বলেছি।”
“কেন তাদের ভোট দিতে বলেছি সেটাও বলার চেষ্টা করেছি। সেখানেও অনেক প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হয়েছে, আমাদের বক্তব্যকে বিকৃত করার চেষ্টা করা হয়েছে। তারপরেও আমরা চেষ্টা করেছি।”
বাংলাদেশে নির্বাচনে প্রচারণার শেষ দিন এসে সাধারণত দেখা যায় বড় দলগুলো সর্বশেষ জনসভা করে। রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে দলীয় প্রধানদের ভাষণ দেয়ার উদাহরণ রয়েছে বিগত নির্বাচনের প্রচারণার শেষ দিনে। কিন্তু এবারে এর কোনটিই দেখা যায়নি। উনিশশো একানব্বই সাল থেকে যারা নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করছেন তারা বলছেন, এটা একটা নজিরবিহীন প্রচারণা চিত্র ।
সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. সাখাওয়াত হোসেন বলছিলেন, বিগত কয়েকটি নির্বাচনী প্রচারণার সাথে তুলনা করলে এবারে একটা ব্যবস্থাপনাহীন প্রচারণা চলছে।
“এবার অব্যবস্থাপনার মধ্যে একটা ক্যাম্পেইন চলছে। এক পার্টি অনেক আগে থেকেই ক্যাম্পেইন শুরু করে দিয়েছে, রুলিং পার্টি। প্রতিপক্ষ পার্টির কিন্তু সেরকম কোন প্রচারণাও দেখা যাচ্ছে না। ক্যাম্পেইন পিরিয়ডে যা হওয়ার কথা না, সে সব হচ্ছে।”
এবারে নির্বাচনে প্রার্থী ও ভোটাররা মূলত দুটি প্রধান জোট ও প্রতীকে বিভক্ত। আর তা হলো ক্ষমতাসীন আ.লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট এবং প্রধান বিরোধী দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। এই দুই প্রধান জোটের প্রতীক হলো যথাক্রমে নৌকা ও ধানের শীষ।
“কোড অব কন্ডাক্ট’ বলতে যে জিনিসটা আছে সেটা একেবারে অসাড় হয়ে গেছে। সরকারি টিভিতে একটা প্রোগ্রাম করে যে যার বক্তব্য তুলে ধরতো । ২০০৮ সালে এটা হয়েছে। সেই বক্তব্য কিন্তু এবারে দেখছি না। কাজেই সব মিলিয়ে একটা অস্বাভাবিক ক্যাম্পেইন পিরিয়ড আমরা দেখলাম।”
তবে অন্য যেকোন বারের তুলনায় এবার নির্বাচনী প্রচারণায় সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমকে বেশি ব্যবহার করেছে রাজনৈতিক দলগুলো।
বৃহস্পতিবার শেষ দিনে চারটি জেলায় ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের সভানেত্রী জনসভায় যোগ দিয়ে নৌকা মার্কায় ভোট চেয়েছেন।
অন্যদিকে, জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতারা সংবাদ সম্মেলন করে ৩০শে ডিসেম্বর ভোট কেন্দ্রে গিয়ে ভোট দেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।
এদিকে আর মাত্র ৪৮ ঘণ্টা পরই শুরু হয়ে যাবে কাঙ্ক্ষিত ভোটপর্ব। এবারে নির্বাচনে প্রার্থী ও ভোটাররা মূলত দুটি প্রধান জোট ও প্রতীকে বিভক্ত। আর তা হলো ক্ষমতাসীন আ.লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট এবং প্রধান বিরোধী দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। এই দুই প্রধান জোটের প্রতীক হলো যথাক্রমে নৌকা ও ধানের শীষ। ধানের শীষের প্রার্থী-সমর্থকরা নির্বাচনী মাঠে প্রচারাভিযানে নামতে না পারলেও তাদের ভোটাররা আশায় আছেন ভোটের মাধ্যমে জয় ছিনিয়ে আনতে।
নির্বাচন কমিশন থেকে জানানো হয়েছে, এরই মধ্যে ব্যালট পেপারসহ নির্বাচন সামগ্রী জেলায় জেলায় রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয়ে পাঠানো হয়েছে। আগামীকাল শনিবার ৪০ হাজারেরও বেশি ভোটকেন্দ্রে পৌঁছে যাবে সব সামগ্রী। শেষ মুহূর্তে ব্যালট পেপারে কোনো পরিবর্তন এলে তা ছাপিয়ে নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছে দেওয়ার জন্য হেলিকপ্টার প্রস্তুত রাখা হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য, সশস্ত্র বাহিনীর সদস্য, নির্বাহী ও বিচারিক হাকিম রয়েছেন নির্বাচনী এলাকায়।
এদিকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক পরিপত্রে বলা হয়েছে, গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের ৭৮ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী ভোটের ৪৮ ঘণ্টা আগে থেকে ভোটের পরবর্তী ৪৮ ঘণ্টা নির্বাচনী এলাকায় সভা-সমাবেশ, মিছিল ও শোভাযাত্রা করা যাবে না। সে ক্ষেত্রে আজ শুক্রবার সকাল ৮টা থেকে ১ জানুয়ারি বিকেল ৪টা পর্যন্ত সভা-সমাবেশ, মিছিল ও শোভাযাত্রা করা যাবে না।
নির্বাচন কমিশন সূত্রে জানা গেছে, এবারের নির্বাচনে নিবন্ধিত ৩৯টি রাজনৈতিক দলই অংশ নিচ্ছে। এক দশক পর ভোটের মাঠে মুখোমুখি হতে যাচ্ছে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগ ও বিএনপি তথা নৌকা ও ধানের শীষ।
এবারের নির্বাচনে সারা দেশে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন এক হাজার আটশর বেশি প্রার্থী। এর মধ্যে ৫০ জনের মতো রয়েছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী, বাকিরা বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের।
এবার ৩০০ আসনে ভোটার ১০ কোটি ৪২ লাখ ৩৮ হাজার। নির্বাচনে ৪০ হাজার ১৮৩টি ভোটকেন্দ্র ও দুই লাখ ছয় হাজার ৪৭৭টি ভোটকক্ষ রয়েছে। একজন প্রার্থীর মৃত্যুর কারণে গাইবান্ধা-৩ আসনে ভোট স্থগিত করে পুনঃতফসিল দেওয়া হয়েছে।
এবারই প্রথম সংসদ নির্বাচনে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) ব্যবহার করা হচ্ছে। ছয়টি আসনে ইভিএম ব্যবহার করা হবে।