ডিসিসি’র ভাগফল শূন্য
রানা হানিফ: সেবার মান বৃদ্ধির দোহাই দিয়ে ঢাকা সিটি করপোরেশনকে দুই ভাগ করেছে সরকার। কিন্তু প্রতিশ্রুত সেবা দিতে পারেনি নগরবাসীকে। ফলে ঢাকা সিটি করপোরেশন দুই ভাগ হলেও তার ফল মেলেনি দেড় বছরেও। ডিসিসি ভাগফল শূন্য। এমতাবস্থায় অনেকের মতে, ডিসিসি ভাগ ইতিবাচক না হয়ে বরং নেতিবাচক হয়েছে।
২০১১ সালের ২৯ নভেম্বর জাতীয় সংসদে স্থানীয় সরকার আইন-২০০৯ সংশোধনের মাধ্যমে ঢাকাকে দুই ভাগ করে সরকার। তবে ভাগ হওয়ার দেড় বছরেও নির্বাচিত প্রতিনিধির হাতে সিটি করপোরেশনের দায়িত্ব বুঝিয়ে দেওয়া সম্ভব হয়নি। এতে করে সিটি করপোরেশন থেকে প্রাপ্ত সেবাগুলো যথাযথভাবে পাচ্ছে না নগরবাসী।
প্রশ্ন উঠেছে ডিসিসিকে দুই ভাগ করার উদ্দেশ্য নিয়েও। করপোরেশন থেকে প্রাপ্ত সেবার মান উন্নত না হওয়ায় নগরবাসী ও নগর বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন ঢাকা সিটি করপোরেশনের ভাগফল শূণ্য।
রাজধানীর কাঠাল বাগান এলাকার মুদি দোকানদার দেলোয়ার হোসেন বছরের শুরুতে স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলরের কার্যালয়ে যান তার বাচ্চার জন্ম নিবন্ধন সনদ আনতে। ওয়ার্ড কাউন্সিলরের অফিসে যাওয়ার পর দেলোয়ারকে জানানো হয়, সেখানকার সকল কার্যক্রম এখন পরিচালনা করা হচ্ছে জোনাল অফিস থেকে। জন্ম নিবন্ধন সনদের মতো ছোটখাটো বিষয়গুলোর জন্য তাদের যেতে হবে স্থানীয় সিটি করপোরেশনের জোনাল অফিসে। এজন্য দেলোয়ারকে যেতে হয় আজিমপুরের হাজী আবদুল গনি কমিউনিটি সেন্টারে অবস্থিত সিটি করপোরেশন দক্ষিণের অঞ্চল-৩ এর অফিসে। কিন্তু সেখানে যাওয়ার পর দেলোয়ারকে আরো বেশি হতাশ হতে হয়। কারণ, এই অঞ্চল-৩ এর অফিস থেকেই ১১টি ওয়ার্ডের বাসিন্দাদের সেবা দেওয়া হচ্ছে। দেলোয়ারের মতো আরো অনেকেই শুধুমাত্র সন্তানকে স্কুলে ভর্তি করানোর জন্য বছরের একটা সময় ওয়ার্ড কাউন্সিলরদের অফিসে ধর্ণা দিতে হতো। এখন সেই জন্ম নিবন্ধন সনদ দেওয়ার কাজটি করতে হচ্ছে মাত্র একটি জোনাল অফিসের মাধ্যমে।
এদিকে মোহাম্মদপুর আদাবর এলাকার বাসিন্দারা পড়েছে অন্য এক সমস্যায়। এখন আর সকালবেলা বর্জ্য সংগ্রহের জন্য সিটি করপোরেশনের কোনো ময়লার গাড়ি আসে না এই এলাকায়। ফলে সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত রাস্তার একপাশে জড়ো করা হয় গৃহস্থালির বর্জ্য। দিনে একবার ময়লা সংগ্রহ করা হয় বলে এসব বর্জ্যরে দুর্গন্ধে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে এলাকার বাসিন্দারা। তবে
এ বিষয় নিয়ে এলাকাবাসী স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলরের কার্যালয়ে ছুটে গেলেও কোনো কাজ হয়নি। তাদেরকে দেখানো হয়েছে কারওয়ানবাজার এলাকায় উত্তর সিটি করপোরেশনের অঞ্চল-৫ এর অফিস। সেখানে গিয়ে লিখিত ও মৌখিক অভিযোগ দেওয়ার পরও এই সমস্যার সমাধান হচ্ছে না। এসব সমস্যার কারণে সিটি করপোরেশনের সেবার মান বাড়ার পরিবর্তে কমেছে বলেই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
হাতেগোনা কয়েকটি নাগরিক সেবা দেওয়ার এখতিয়ার ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের থাকলেও অধিকাংশ সেবাই প্রদান করছে ভিন্ন ভিন্ন সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান। আবার এসব প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সমন্বয়ও নেই। সিটি করপোরেশন ব্যতিত আরো প্রায় ৫৪টি সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান নগরবাসীর সেবা দিয়ে থাকে।
এগুলোর মধ্যে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) মূল নগরায়নের কাজ করছে। এছাড়া সুপেয় পানির ব্যবস্থাটি করছে ঢাকা ওয়াসা। বাসা-বাড়ি ও সিএনজি স্টেশনে গ্যাসের সেবা প্রদান করছে তিতাস গ্যাস কোম্পানি, বিদ্যুতের দায়িত্বে রয়েছে ডেসকো ও ডিপিডিসি, ট্রাফিক ম্যানেজমেন্টের দায়িত্বে রয়েছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের ট্রাফিক বিভাগ, ঢাকার মধ্যকার খালগুলো রক্ষণাবেক্ষণে রয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ড।
রাজধানীর ভিন্ন ভিন্ন সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান থাকায় একটি প্রতিষ্ঠান সেবা দিতে গেলে অন্যটার সেবাদানে বাধার সৃষ্টি হয়।
সম্প্রতি ঢাকার বিভিন্ন ওয়ার্ডের রাস্তা সংস্কার কাজ শেষ করেছে ঢাকা সিটি করপোরেশন। ঢাকা সিটি করপোরেশনের সংস্কার কাজ শেষ হওয়ার পর তিতাস গ্যাস তাদের নতুন সঞ্চালন লাইন স্থাপনের জন্য রাস্তার খনন কাজ শুরু করে। এতে চরম ভোগান্তির শিকার হতে হয় নগরবাসীকে। ঢাকার মোহাম্মদপুর-আদাবর অঞ্চলে গিয়ে দেখা যায়, তিতাস গ্যাস কোম্পানির সঞ্চালন লাইন বিতরণের কাজ শেষ হওয়ার পর আবার ওয়াসা নতুন করে কাজ শুরু করেছে। ফলে সকল প্রতিষ্ঠানের কাজ শেষ হলে আবারো এসব রাস্তা সংস্কার করতে হবে সিটি করপোরেশনকে।
সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলো করপোরেশনের নিয়ন্ত্রণে না থাকায় অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রশাসনিক জটিলতার কারণে প্রকৃত সেবা প্রদান করতে ব্যর্থ হচ্ছে সিটি করপোরেশন।
এ ব্যাপারে কথা বলা হলে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও গ্রামীণ পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক গোলাম মর্তুজা বলেন, দেশে আমরা যে স্থানীয় সরকার দেখছি, এটা প্রকৃত পক্ষে কোনো গভর্নিংবডি হতে পারে না। কারণ নগরবাসীকে সব সেবা দেওয়ার ক্ষমতা সিটি করপোরেশনের মতো স্থানীয় সরকারের নেই। আর কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে উন্নয়ন বাজেটের সকল অর্থ থাকায় স্থানীয় সরকারকে তাকিয়ে থাকতে হয় মন্ত্রী ও মন্ত্রণালয়ের দিকে। ফলে স্বায়ত্তশাসিত বললেও প্রকৃতপক্ষে কোনো স্বাধীনতা নেই বাংলাদেশের স্থানীয় সরকারগুলোর।
গোলাম মর্তুজা বলেন, সেবার মান বাড়ানোর কথা বলে ঢাকাকে দুই ভাগ করা হলেও প্রকৃতপক্ষে সেবার মান বাড়ার পরিবর্তে কমেছে অনেকাংশে।
তিনি বলেন, ঢাকা সিটি করপোরেশন কয়টা সেবা দিয়ে থাকে এবং সেগুলো ভাগ করলে কি এমন সেবার মান উন্নত হবে তা এখনো বুঝাতে পারেনি সরকার। পানি, বিদ্যুৎ, গ্যাস ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার মতো প্রধান সেবাগুলোর দায়িত্ব পালন করছে ভিন্ন ভিন্ন সংস্থা। ফলে ঢাকা সিটি করপোরেশন দুই ভাগ হলেও অন্যান্য সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান এক রয়েছে এবং তাদের সেবা প্রদান একইভাবে চলছে।
এই পরিকল্পনাবিদদের মতে, দুই ভাগে ভাগ করায় অন্যান্য সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানের সেবা প্রদানে জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে। যদি ওয়াসার এমন কোনো প্রকল্প থাকে যার বিস্তৃতি দুই সিটি করপোরেশনের এলাকার মধ্যে, তখন এই প্রকল্পের জন্য ওয়াসাকে আলাদা আলাদাভাবে দুই সিটি করপোরেশনের সঙ্গে সমন্বয় করতে হবে। এ ক্ষেত্রে প্রকল্প বাস্তবায়নে দীর্ঘসূত্রিতা দেখা দিতে পারে।
সিটি করপোরেশন ভাগ করার মাধ্যমে সেবার মানের কোনো গুণগত উন্নয়ন হয়নি বলে মনে করছেন উত্তর সিটি করপোরেশনের সম্ভাব্য মেয়র প্রার্থী মাহমুদুর রহমান মান্না।
তিনি বলেন, এটা সবার কাছে স্পষ্ট; রাজনৈতিক কারণে ঢাকা সিটি করপোরেশনকে বিভক্ত করেছে সরকার। যতই সেবার মান উন্নয়নের কথা বলা হোক না কেনো, সরকারের সে যুক্তি তা বাস্তবতার কাছে টিকবে না। সিটি করপোরেশন ভাগ করার ফলে সেবার মান আরো নিম্নমুখী হয়েছে।
মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, সিটি করপোরেশনকে সিটি গভার্মেন্টে রূপান্তর করা না গেলে সেবার মান বাড়বে না। নগরীর অন্যান্য সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানকে সিটি গভার্মেন্টের অধীনে আনতে হবে। তাদের কাজের মধ্যে সমন্বয় করতে হবে, তাহলেই প্রকৃত সেবা নগরবাসী পাবে। বিদ্যমান আইনে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের দিয়ে সিটি করপোরেশনের উন্নয়ন সম্ভব নয় বলে মন্তব্য করেন এই রাজনীতিবিদ।
তিনি বলেন, সিটি করপোরেশন যদি নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের দ্বারা পরিচালিত হয় তাহলেও কাক্সিক্ষত উন্নয়ন ও সেবা প্রদান করা সম্ভব নয়। কারণ স্থানীয় সরকার প্রতিনিধিদের সঙ্গে সংসদ সদস্যদের একটা দ্বন্দ্ব সব সময় লেগে থাকে। উভয় জনপ্রতিনিধিরা মনে করেন উন্নয়নের দায়িত্ব তাদেরই। এক্ষেত্রে আইনের সংশোধন করে স্থানীয় সরকার প্রতিনিধিদের ক্ষমতা প্রদান করতে হবে।
অন্যান্য সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সমন্বয়হীনতার কথা স্বীকার করে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আনসার আলী খান বলেন, আইনে অনেক কিছু থাকলেও বিভিন্ন সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানের কারণে অনেক সেবাই দিতে পারছে না সিটি করপোরেশন। আবার অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কোনো প্রকার যোগাযোগ না থাকায় অনেক উন্নয়ন কাজে সমন্বয়হীনতাও দেখা যায়।
তিনি বলেন, স্থানীয় সরকার অধ্যাদেশ (সিটি করপোরেশন)-২০০৯ অনুযায়ী সিটি করপোরেশনের আওতাধীন এলাকায় সকল প্রকার ভবনের নকশা অনুমোদন দিবে সিটি করপোরেশন। কিন্তু ঢাকাতে এ কাজ করছে রাজউক। আবার পানির জন্য রয়েছে ওয়াসা, বিদ্যুতের জন্য আরো দুটি কোম্পানি। সবার সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ সব সময় করা সম্ভব হয় না।
তবে সিটি করপোরেশন ভাগের ফলে সেবার মান নিম্নমুখী হয়েছে তা মানতে চান না এই সরকারি কর্মকর্তা। তিনি বলেন, নির্বাচিত মেয়র ও কাউন্সিলরদের হাতে ক্ষমতা গেলে ক্ষণিকের এই জটিলতা থাকবে না। বরং ভাগ হওয়ার কারণে সিটি করপোরেশন নাগরিকের সেবার প্রতি আরো যতœবান হতে পারবে।
ঢাকাবাসীকে সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানের মধ্যে অন্যতম রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)। ডিসিসিকে বিভক্ত করায় তাদের কাজে কোনো সুবিধা হচ্ছে না বলে জানান প্রতিষ্ঠানটির পরিকল্পনা বিভাগের সদস্য প্রকৌশলী শেখ মো. আবদুল মান্নান।
তিনি বলেন, ডিসিসি ভাগের ফলে দুই জন মেয়র ঢাকাকে সেবা দিবেন, কিন্তু রাজউক তার আগের জনবল দিয়েই রাজধানীর উন্নয়নে কাজ করছে। তাই ডিসিসি ভাগ করায় রাজউকের কাজে কোনো সহযোগিতা হচ্ছে না।
আবদুল মান্নান বলেন, রাজধানীর উন্নয়নে রাজউক যে ধরনের কাজ করে তার দুই একটার সঙ্গে সিটি কর্পোরেশনের সম্পৃক্ততা রয়েছে। বাকি কাজগুলো রাজউক, গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের অধীনেই করে থাকে।
রাজউকের এই কর্মকর্তা আরো জানান, অবকাঠামোগত উন্নয়নের ক্ষেত্রে রাজউক ও সিটি কর্পোরেশনের একটা সমন্বয় থাকে। তবে এ কাজে অবিভক্ত সিটি কর্পোরেশন থাকাকালে যে সুবিধা পেয়েছি তা দুইটার ক্ষেত্রে বাড়েনি। বরং দুইটা সিটি কর্পোরেশনের সঙ্গে সমন্বয় করতে অসুবিধাও হচ্ছে।
রাজউকের মতো রাজধানী পয়ঃনিষ্কাশন ও পানি সরবরাহের কাজে নিয়োজিত সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান ঢাকা ওয়াসাও কোনো সুবিধার কথা চিন্তা করছে না।
এ ব্যাপারে ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী তাকসীম এ খান বলেন, ডিসিসিকে ভাগ করায় ওয়াসার কার্যক্রমে কোনো সুবিধা হবে না। ওয়াসা আগে যত মানুষের সেবা করেছে এখনো একই সংখ্যক মানুষের সেবা করে যাচ্ছে। তাছাড়া ওয়াসার কাজের সঙ্গে ডিসিসির কোনো সম্পৃক্ততাও নেই যাতে সেবার মান বাড়বে।
তিনি বলেন, ওয়াসা স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ একটি প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠানটি স্বায়ত্তশাসিত হলেও অনেক কাজে সরকারের ওপর নির্ভর করতে হয়। কিছু কিছু কাজে সিটি কর্পোরেশনের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক রয়েছে, তবে ডিসিসি ভাগের ফলে এসব কাজের ওপর কোনো প্রকার প্রভাব পড়বে না।