ইতিহাসের পাতায় ভাষা আন্দোলন

Vashaশরীফ আবদুল গোফরান: বাংলাভাষা বাঙালি মুসলিমদের মাতৃভাষা। এ ভাষা আমাদের জাতীয় ভাষা। এ কথা সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরীর আগে কোনো অভিজাত মুসলিম এমন দৃপ্তকণ্ঠে ঘোষণা করেননি। প্রকৃতপক্ষে তিনিই উপমহাদেশে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার প্রথম প্রস্তাবক। একবার ইতিহাসের পাতা  উল্টিয়ে দেখ না, ইতিহাসের পরতে পরতে তা স্পষ্ট লেখা আছে।
১৯১১ সালে রংপুরে মুসলিম প্রাদেশিক শিক্ষা সম্মেলন চলছিল। এ সম্মেলনে সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী বাংলা ভাষার পক্ষে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখেন। তিনি যুক্তিসহকারে বাংলাকে শিক্ষার মাধ্যম করার জোর সুপারিশ করেন।
কুড়ি শতকের গোড়ার দিকে, ভারতবর্ষে একটি সাধারণ ভাষার প্রশ্ন প্রবল হয়ে দেখা দেয়। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর থেকে শুরু করে সর্বভারতীয় নেতৃবৃন্দ ভারতে রাষ্ট্রভাষারূপে হিন্দি ভাষার পক্ষে দাবি তোলেন, বাংলার বাইরে অন্যান্য প্রদেশের মুসলিমদের রায় ছিল উর্দুর পক্ষে। কিন্তু বাঙালি মুসলিমদের মধ্যে থেকেই এ সময় বাংলার পক্ষে আওয়াজ ওঠে।
১৯১৮ সালে বিশ্বভারতীতে অনুষ্ঠিত এক সভায় ভারতের সাধারণ ভাষা হিসেবে রবীন্দ্রনাথের হিন্দি সম্পর্কিত প্রস্তাবের বিরোধিতা করে ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ এক প্রবন্ধের মাধ্যমে বাংলাভাষার দাবি পেশ করেন। সে সভায় সভাপতিত্ব করেন কে জানো? সে সভায় সভাপতিত্ব করেন স্বয়ং কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। সারা ভারতের ভাষাতত্ত্ববিদ ও পন্ডিতগণ সে সভায় উপস্থিত ছিলেন এবং আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন। ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহর প্রবন্ধটি পাঠ শেষ হলে সভাস্থলে মহা হইচই পড়ে যায়।
১৯২১ সালে তৎকালীন ব্রিটিশ সরকারের কাছে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার জন্য লিখিতভাবে দাবি উত্থাপন করেন সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী। দাবি জানিয়ে তিনি লিখেন, ভারতে রাষ্ট্রভাষা যাই হোক বাংলার রাষ্ট্রভাষা করতে হবে বাংলাকে।
১৯৩৭ সালে মাওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ দৈনিক আজাদ পত্রিকায় প্রকাশিত এক সম্পাদকীয় নিবন্ধে বলেন, ‘সাহিত্যে বাংলা সমস্ত প্রাদেশিক ভাষার মধ্যে শ্রেষ্ঠ। বাংলা ভাষায় বিবিধভাবে প্রকাশের উপযোগী শব্দের সংখ্যাই বেশি। অতএব বাংলাভাষা সব দিক দিয়েই ভারতের রাষ্ট্রভাষা হইবার দাবি করিতে পারে। মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্বে কংগ্রেস হিন্দিকে ভারতের রাষ্ট্রভাষা করিবার প্রস্তাব করিয়াছে বটে, কিন্তু এ বিষয়ে বাংলা ভাষার চেয়ে হিন্দির যোগ্যতা কোনো দিক দিয়াই বেশি নহে।’
পাকিস্তান আমলের ভাষা আন্দোলনের ভিত্তি নির্মিত হয়েছে ভারত ভাগের পর। অর্থাৎ ১৯৪৭ সালে ভারত বাটোয়ারার ভিত্তিতে। দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে পৃথক দু’টি স্বাধীন রাষ্ট্ররূপে সাতচল্লিশের ১৪ আগস্ট ভারত ও পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম না হলে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে আন্দোলন করার ক্ষেত্রই তৈরি হতো না।
কলকাতাকেন্দ্রিক পশ্চিম বাংলার বাঙালিরা উনিশশতকে কুড়ি শতকের প্রেক্ষাপটে বাংলাভাষা চর্চায় এগিয়ে যাওয়া সত্ত্বেও সর্ব  ভারতীয় রাষ্ট্র কাঠামোর অধীনে হিন্দির কাছে সমর্পিত হয়ে সাংস্কৃতিক আত্মবিলোপের দ্বারপ্রান্তে উপনীত হয়েছে। তাদের চাইতে অগ্রসর অর্থনৈতিকভাবে শোষিত ও বঞ্চিত কৃষিজীবী মুসলিম অধুষ্যিত অখন্ড রাষ্ট্ররূপে স্বাধীন হলে আজকের স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের উদ্ভব যেমন সম্ভব হতো না, তেমনি সম্ভব হতো না সংখ্যাগরিষ্ঠতার যুক্তিতে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি তোলা, বরং অখন্ড ভারতে পূর্ব বাংলার বাঙালি মুসলিমদের অবস্থা কী হতো তা বোঝার জন্য আজকের অধিকৃত কাশ্মির এবং পশ্চিমবঙ্গের মুসলিমদের অবস্থার দিকে নজর দিলেই তা সহজেই বোঝা যায়।
ফলে ইংরেজি বর্ণ হিন্দুদের শঠতা, প্রবঞ্চনা ও চক্রান্তমূলক বাটোয়ারা কৌশলের ফসল হিসেবেই পাকিস্তান আন্দোলনের পাশাপাশি ভাষা আন্দোলনের মানসিক পর্ব শুরু হয়।
বাঙালি মুসলিমগণ ঢাকা বাংলা ভাষার রাজধানী করার সংগ্রাম ও কোরবানির পথে অগ্রসর হওয়ার গৌরব অর্জন করে।
১৯৪০ সালে লাহোর প্রস্তাব গৃহীত হওয়ার দু’বছরের মধ্যে কলকাতা ও ঢাকায় যথাক্রমে পূর্ব পাকিস্তান রেনেসাঁ সোসাইটি ও পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য সংসদ নামে দু’টি সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের জন্ম হয়। এ প্রতিষ্ঠান দু’টির বিভিন্ন সভায়ও বহুবার বাংলাকে পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার কথা আলোচিত হয়।
১৯৪৩ সালে সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে অনুষ্ঠিত পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য সংসদের সম্মেলনে সংসদের সভাপতি সৈয়দ সাজ্জাদ হোসেন বলেন, ‘পূর্ব পাকিস্তানের সাহিত্যের বাহন হবে বাংলাভাষা। এ প্রশ্ন বহু পূর্বে চূড়ান্তভাবে মীমাংসিত হয়ে গেছে।‘ একই অনুষ্ঠানে সভাপতি হিসেবে ভাষণ দিতে গিয়ে আবদুল মওদুদ বলেন, ‘পশ্চিম ও উত্তর ভারতে যেমন ভাষাবিজ্ঞানে মুসলিমদের শ্রেষ্ঠ অবদান উর্দু ভাষা, সেই রকম পূর্ব ভারতে মুসলিমদের সর্বশ্রেষ্ঠ অবদান হচ্ছে বাংলাভাষা।‘ এ সময় রেনেসাঁ সোসাইটির উৎসাহী সমর্থক কবি ফররুখ আহমদ বাংলার সমর্থন করেন এবং এক শ্রেণীর উর্দুপ্রেমিক বঙ্গসন্তানদের তীব্র সমালোচনা করে “উর্দু বনাম বাংলাভাষা” শীর্ষক ব্যঙ্গ সনেট রচনা করেন। এ সনেট ১৩৫২ বাংলা সনে জ্যৈষ্ঠ সংখ্যায় মাসিক মোহাম্মদীতে প্রকাশিত হয়। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর ভাষা আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটে তমুদ্দুন মজলিসের মাধ্যমে ১৯৪৭ সালে ১ সেপ্টেম্বর প্রিন্সিúাল আবুল কাশেমের উদ্যোগ ও নেতৃত্বে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন ছাত্র-শিক্ষকের সহযোগিতায় ভাষা আন্দোলনের এই জনক সংগঠন প্রতিষ্ঠা লাভ করে। প্রিন্সিপাল আবুল কাশেম তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর সাহিত্য সাংস্কৃতিক অঙ্গনে তমুদ্দুন মজলিস ছিল একটি চমক দেয়া বিপ্লবী নাম। ভাষা আন্দোলনে মজলিসের মুখপাত্র ‘‘সৈনিক” পত্রিকার এক গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা রয়েছে।
১৯৪৭ সালে ৫ নভেম্বর পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য সংসদের উদ্যোগে ফজলুল হক মুসলিম হল মিলনায়তনে অধ্যাপক কাজী মোতাহার হোসেনের সভাপতিত্বে খ্যাতনামা শিল্পী জয়নুল আবেদীনের অভ্যর্থনা উপলক্ষে এক সভায়ও বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি উত্থাপন করা হয়।
১৯৪৭ সালের ২৭ নভেম্বর তৎকালীন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান পূর্ব পাকিস্তান সফরে আসেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জিমনেশিয়াম মাঠে ছাত্রসভায় অংশগ্রহণ করেন। তখন ছাত্রসমাজের পক্ষ থেকে রাষ্ট্রভাষা বাংলা ও পূর্ব পাকিস্তানের অন্যান্য দাবিসংবলিত এক ঐতিহাসিক স্মারকলিপি প্রদান করা হয়। ছাত্রদের পক্ষে ডাকসুর তৎকালীন জিএস অধ্যাপক গোলাম আযম স্মারকলিপি পাঠ করেন এবং হস্তান্তর করেন। এই স্মারকলিপিটি গ্রন্থনায় ছিলেন বিচারপতি আবদুর রহমান চৌধুরী। পরবর্তীতে এ দাবিগুলোর ভিত্তিতে এ দেশের জাতীয়তাবাদী ও স্বাধিকার আন্দোলন গড়ে ওঠে।
স্বাধীন পাকিস্তান রাষ্ট্রের অবকাঠামোতে সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণ মানুষের মুখের ভাষার সঙ্গত অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সাতচল্লিশ সাল এবং তার পরবর্তী রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন ছিল আমাদের হাজার বছরের ভাষার লড়াইয়ের ধারাবাহিকতার একটি অত্যুজ্জ্বল অধ্যায়।
এর পর শুরু হয় ভাষা আন্দোলনের সংগ্রাম-পর্ব। ১৯৪৭ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর অধ্যাপক আবুল কাশেমের সম্পাদনায় তমুদ্দুন মজলিস এর উদ্যোগে পাকিস্তানে রাষ্ট্রভাষা বাংলা না উর্দু শিরোনামে একটি পুস্তিকা বের হয়। তখন তমুদ্দুন মজলিসের উদ্যোগে প্রথম রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদও গঠিত হয়। এ পরিষদ নানা সভা সমাবেশের মাধ্যমে বাংলা ভাষার দাবি তুলে ধরার চেষ্টা করে। ১৯৪৮ সালে ১১ মার্চ মজলিসের উদ্যোগে ঢাকায় পূর্ণাঙ্গ ধর্মঘট এবং প্রদেশব্যাপী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহে ছাত্রধর্মঘট পালিত হয়। ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে ১১ মার্চ একটি মাইলফলক। এ ধর্মঘটের কারণে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন  এগিয়ে আসেন এবং রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সাথে ৭ দফা চুক্তিতে আবদ্ধ হন। এ চুক্তিতে উর্দুর সাথে সাথে বাংলা ভাষাকেও সমান মর্যাদা প্রদান এবং পূর্ব বাংলার সরকারি ভাষা হিসেবে বাংলাকে চালু করার প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়। ফলে এ দেশের মানুষ ধরে নিয়েছিল তারা তাদের মুখের ভাষার মর্যাদা ফিরে পাবে। কিন্তু সরকার অচিরেই এ দেশের মানুষের আশা-আকাক্সক্ষা পদদলিত করলো। ১১ মার্চ থেকে ২১ মার্চ এর মধ্যেই পাল্টে গেল দৃশ্যপট।
২১ মার্চ পাকিস্তানের তৎকালীন গভর্নর জেনারেল কায়েদে আযম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ পূর্ব বাংলা সফরে এলেন। তখন কার্জন হলে আয়োজিত বক্তৃতায় রাষ্ট্রভাষা প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে তিনি ঘোষণা করলেন, পাকিস্তানে রাষ্ট্রভাষা হবে উর্র্দু অপর কোনো ভাষা নয়। কায়েদে আযমের এ ঘোষণা ছিল এ দেশের মানুষের স্বপ্ন আকাক্সক্ষার বিরুদ্ধে প্রচন্ড আঘাত, তাই এ ঘোষণার বিরুদ্ধে গর্জে উঠলো দেশ। ফের শুরু হলো ভাষা আন্দোলন। প্রতিবাদ প্রতিরোধে কেঁপে উঠলো সারাদেশ। ভাষার দাবিতে সভা-সমাবেশ, বিক্ষোভ ও স্লোগানে বাংলার আকাশ বাতাস প্রকম্পিত হয়ে উঠলো। মানুষ আশা করেছিল সরকার এ দেশের জনগণের দাবিকে মর্যাদা দেবে, এ বাংলাকে সরকারি ভাষা হিসেবে গ্রহণ করে নেবে। ঘটনা ঘটলো উল্টো। এরই মধ্যে ১৯৫২ সালে ২৬ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হলো নিখিল পাকিস্তান মুসলিম লীগের ঢাকা অধিবেশন। এখানে বক্তৃতা করতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন পুনরায় ঘোষণা করলেন উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। দেশের মানুষ আরেকবার হতাশ হলো। তারা আর স্থির থাকতে পারলো না। প্রধামন্ত্রীর ঘোষণার প্রতিবাদে আবার জেগে উঠলো দেশ। ৩০ জানুয়ারি ঢাকায় পালিত হলো প্রতিবাদ দিবস।
এখানেই  থেমে থাকেনি দেশের মানুষ। তাদের ক্ষোভে ও বিদ্রোহ তীব্র হতে থাকলো। ফলে ভাষার আন্দোলন আরও সংগঠিত হলো। ৩১ জানুয়ারি রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ এবার জাতীয় পর্যায়ে গিয়ে গঠিত হলো সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ নামে। শুরু হলো নতুন উদ্যমে প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ।
ভাষা আন্দোলনে বিজয়পর্ব
১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ প্রদেশব্যাপী রাষ্ট্রভাষা দিবস পালনের কর্মসূচি ঘোষণা করে। অথচ সরকার জনগণের এ দাবিকে নস্যাৎ করার জন্য একই দিন ঢাকা শহরে সভা, শোভাযাত্রা নিষিদ্ধ ঘোষণা করল এবং জারি করল ১৪৪ ধারা। কিন্তু তাতেও মানুষের ক্ষোভকে থামানো যায়নি। ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে ছাত্র-জনতা রাস্তায় নেমে আসে। বাধা আসে পুলিশের। বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতাকে দমন করতে পুলিশ মিছিলের ওপর বেপরোয়া লাঠিচার্জ ও কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ করে। একপর্যায়ে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের সামনে ছাত্রদের মিছিলের ওপর পুলিশ গুলি চালায়। এতে ছাত্রসহ চার ব্যক্তি নিহত হন। ১৭ জন আহত হন। এবং গ্রেফতার হন ৬২ জন। পুলিশের গুলিতে যারা শহীদ হন তারা হলেনÑ রফিক উদ্দিন আহমদ (মানিকগঞ্জ দেবেন্দ্র কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র), আবদুল জব্বার (গ্রামীণ কর্মচারী), আবুল বরকত (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের এম এ ক্লাসের ছাত্র), মোহাম্মদ সালাউদ্দিন (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এম এ ক্লাসের ছাত্র) এবং আবদুস সালাম (শুল্ক বিভাগের পিওন) আহত অবস্থায় ৭ এপ্রিল মৃত্যুবরণ করেন। ২২ তারিখ নিহতদের গায়েবানা জানাজা ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের সামনে অনুষ্ঠিত হয়। জানাজার পর লক্ষাধিক মানুষের এক বিশাল শোভাযাত্রা ঢাকা শহর প্রদক্ষিণ করে। এ ঘটনার পর ক্ষমতাসীন ও সরকারের ক্ষমতার ভিত নড়ে ওঠে। এ দেশের মানুষ বুঝতে পারে পাকিস্তানি শাসকদের হাতে তাদের ভাষা, স্বাধীনতা ও মানমর্যাদা নিরাপদ নয়। তাই ধীরে ধীরে ভাষা আন্দোলন স্বাধীনতা সংগ্রামে রূপ নেয়। এরই ফলে ১৯৭১ সালে দীর্ঘ ৯ মাসের স্বাধীনতার লড়াইয়ে মানুষ অর্জন করে মহান স্বাধীনতা। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের ফল হিসেবে আমরা স্বাধীনতা পেলাম যা আজ আমাদের পরম পাওয়া। তাই ভাষা আন্দোলনের বীর সেনানীরা আমাদের সবার কাছে শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার পাত্র। আমরা তাঁদের আত্মত্যাগকে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করি।
আমাদের এ মহান ভাষা আন্দোলন এবং তারই পথ ধরে স্বাধীনতা অর্জন বিশ্বের দরবারে আমাদের গৌরবকে অনেক উচ্চে তুলে ধরেছে। আমরা আরও  বেশি গর্বিত হয়েছি যখন আমাদের ভাষা দেশের গন্ডি পেরিয়ে গোটা বিশ্বের কাছেও স্বীকৃতি লাভ করেছে। বাংলা এখন আন্তর্জাতিক ভাষা। স্বীকৃতি পেয়ে গৌরবের আরেক ধাপে উত্তীর্ণ হয়েছে। আর এ মহান কাজে যারা অবদান রেখেছেন তারাও বাংলাদেশী। তারা এ জাতির কাছে চির স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।
বিশ্বের বাংলাভাষী জনগণের সংখ্যা প্রায় ৩০ কোটি। সারাদেশ ও ভারতের বাইরে পাকিস্তান, ব্রিটেন, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও অস্ট্রেলিয়ায় বিপুল সংখ্যক বাঙালির বসবাস। মধ্যপ্রাচ্যের সব ক’টি দেশ, মালয়েশিয়া, কোরিয়া এবং ইউরোপের বিভিন্ন দেশে কর্মসংস্থানের জন্য বিপুলসংখ্যক বাংলাভাষী বসবাস করছেন। জাতিসংঘ শান্তিবাহিনীর বাংলাদেশের বাংলাভাষী সৈনিকদের কাজকর্মের কৃতজ্ঞতাস্বরূপ আফ্রিকার দেশ সিয়েরা লিওন বাংলাভাষাকে সে দেশের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘোষণা করেছে। এর আগে থেকে পাকিস্তান ও ভারতে বাংলাভাষা অন্যতম সরকারি ভাষা হিসেবে স্বীকৃত। এদিক থেকে বাংলাভাষা আন্তর্জাতিক ভাষা হিসেবে ইতোমধ্যে মর্যাদার দাবিদার।
জাতিসংঘ যেসব ভাষাকে দাফতরিক ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে তার বেশির ভাগই বাংলার চেয়ে কম প্রচলিত। ইউরোপ ও আমেরিকার বাইরে সাহিত্যে সর্বপ্রথম নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন বাংলা ভাষার কবি বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। মাতৃভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় বাংলাভাষী জনগণের অসামান্য স্বীকৃতিস্বরূপ জাতিসংঘ ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করেছে।  ভাষার প্রতি বাংলাভাষী জনগণের দরদ বিশ্বের সকল ভাষার সুরক্ষার ও যথাযথ স্বীকৃতির পথ দেখিছেন।
১৯৯৯ সালে ১৭ নভেম্বর জাতিসংঘের ইউনিসেফের এক বৈঠক বসে প্যারিসে। সভার ১৮৮ জন সদস্যের সমর্থনে আমাদের ভাষা সেদিন অমর মর্যাদা লাভ করে। এর আগে বিশ্বের ২৮টি দেশ বাংলাভাষাকে জাতিসংঘে উত্থাপনের সমর্থন জানায়। বাংলাভাষা আন্তর্জাতিক মর্যাদা পাবার পেছনে কানাডা প্রবাসী একদল বাংলাদেশী নাগরিকের অবদান ছিল সীমাহীন। তাদের সংগঠনের নাম ‘মাদার ল্যাঙগুয়েজ মুভমেন্ট‘। এর নেতা ছিলেন জনৈক রফিকুল ইসলাম। এ ছাড়াও যারা জড়িত ছিলেন তারা হলেন জ্যাসন, মেরিন, সুসান হভগিল, ড. কেলভিন চাও, বিনতে মারটিনস, করুনা জোসি, নাজনিন ইসলাম, আবদুস সালাম প্রমুখ। আজ বাংলাভাষার যে মর্যাদা নিয়ে একটি স্বাধীন জাতি হিসেবে আমরা মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছি তাকে অর্থবহ করতে হলে ভাষার মানোন্নয়নে আমাদের আরও অনেক কাজ করতে হবে।  মনে রাখা  দরকার, বাংলাভাষা এখনও দেশের রাষ্ট্রীয় কাজকর্মে যথাযথভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়নি। অথচ সিয়েরা লিওনের সরকারও বাংলাকে ভালোবেসে তাদের দেশের অন্যতম ভাষা হিসেবে ঘোষণা করেছে। আমাদের সরকার  বাংলাভাষার উন্নয়নে সঠিক ভূমিকা নিয়ে এগিয়ে আসবে- এটাই আমাদের প্রত্যাশা।

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button