বছর পূর্তিতে বিশ্বজুড়ে আলোচনায় রানা প্লাজা

Rana Plazaসাভারে রানা প্লাজা ধসের বছর পূর্তি হচ্ছে ২৪ এপ্রিল, বৃহস্পতিবার। কেবল বাংলাদেশে নয়, তৈরিপোশাক শিল্পের ইতিহাসে এটাকে সবচেয়ে ভয়াবহ দুর্ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। আর তাই আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় দুর্ঘটনাটির কথা বিশেষভাবে স্মরণ করা হচ্ছে। এমনকি শীর্ষস্থানীয় ফ্যাশন ডিজাইনার, সেলিব্রেটি, উদ্যোক্তরা এই দিনেই তাদের ‘ফ্যাশন রেভ্যুলুশন ডে’ পালন করতে যাচ্ছে। এ ধরনের দুর্ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে সচেতনতা সৃষ্টিই এর লক্ষ্য।
রানা প্লাজা দুর্ঘটনায় অন্তত এক হাজার ১৩৩ জন নিহত হয়। আহত হয় অন্তত আড়াই হাজার। বেঁচে যাওয়া লোকেরা এখনো ধুঁকছেন। শারীরিক, মানসিকভাবে তারা এতই পঙ্গু হয়ে পড়েছেন যে এক বছর পরও তারা কাজে ফিরতে পারছেন না। আবার প্রতিশ্রুত সাহায্যও মিলছে না। সব মিলিয়ে দুর্বিসহ অবস্থায় রয়েছেন তারা।
আন্তর্জাতিক মিডিয়াগুলো জানাচ্ছে, ওই বিপর্যয়ের পর শ্রমিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য প্রবল দাবি ওঠে। কিছু কিছু দাবি পূরণও হয়েছে। ফলে এখনো নিরাপত্তাহীনতার মধ্যেই কাজ করছেন শ্রমিকেরা। তাছাড়া সাহায্যের যে প্রতিশ্রুতি তারা পেয়েছিলেন, তা-ও পাননি।
সস্তা পোশাকের বলি
ব্রিটেনের প্রভাবশালী গার্ডিয়ান পত্রিকায় লুসি সিগল প্রশ্ন তুলেছেন, ‘আমাকে একটি প্রশ্ন এখনো তাড়া করে ফিরছে যে অত্যাধুনিক ফ্যাশনের সত্যিকারের দাম কত?’
তিনি বলেন, ভয়াবহ ওই দুর্ঘটনা সত্ত্বেও বিশ্বজুড়ে ফ্যাশন হাউজগুলোর মধ্যে কোনো সচেতনতা সৃষ্টি হয়নি। এ ঘটনা পুনরাবৃত্তি রোধেও তাদের মধ্যে কোনো আগ্রহ জন্মেনি। বরং তারা সব দায়িত্ব থেকে রেহাই পেয়ে ব্যবসা সম্প্রসারণ করে চলেছে।  বছরে এখন গার্মেন্ট ও টেক্সাইল শিল্পের মূল্য তিন ট্রিলিয়ন ডলারেরও বেশি, বছরে ৮০ বিলিয়ন নতুন পোশাক তৈরি হচ্ছে। সবচেয়ে দ্রুতগতিতে বাড়ছে অত্যাধুনিক ফ্যাশনের চাহিদা। নিত্যনতুন ফ্যাশনের আবির্ভাব ঘটছে। এক ‘জারা’ই বছরে ১২ হাজার নতুন স্টাইল নিজে বাজারে আসছে। প্রতিটি ব্র্যান্ডেরই লক্ষ্য- নতুন ডিজাইন আসবে খুব দ্রুত এবং সেটা হবে খুবই সস্তা। পরিণতিতে শ্রমিকদের মজুরি হয়ে যায় কম। তাদের রক্তে পাশ্চাত্য পায় নতুন পোশাক, অত্যন্ত কম দামে।
বিক্রেতারা এমনভাবে পোশাকের ডিজাইনে মনোযোগী হয় এবং প্রতিনিয়ত এমন ফ্যাশন নিয়ে আসতে থাকে যে ক্রেতাদের একটির পর একটি পোশাক কেনা ছাড়া যেন গত্যান্তর থাকে না। মাত্র চার পাউন্ডে টি শার্ট, ১০ পাউন্ডে জিন্স পেলে কিনতে সমস্যা কোথায়?
আরো দুর্ঘটনা ঘটার আশঙ্কা
লস অ্যাঞ্জেলস টাইমসের এক প্রতিবেদনে রানা প্লাজা দুর্ঘটনাকে তৈরিপোশাক শিল্পের সবচেয়ে মারাত্মক বিপর্যয় হিসেবে অভিহিত করে বাংলাদেশে আরো অনেক ভবন ধসে পড়ার মতো অবস্থায় রয়েছে। অনেক ভবনের অবস্থাই অত্যন্ত করুণ।
ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক জ্যাসন মটলাগ জানান, অবস্থা যেমন রয়েছে, তাতে এমন দুর্ঘটনা আরো ঘটতেই পারে।
প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের বিশ্বের অন্যতম পোশাক রফতানিকারক দেশে পরিণত হওয়ার কারণ হলো এখানে সরকার এবং স্থানীয় কারখানা মালিকেরা মৌলিক নিরাপত্তা নীতিমালা অনুসরণ করে না। বাংলাদেশের পোশাকশ্রমিকদের মজুরি চীনের এক চতুর্থাংশ বলেও এতে উল্লেখ করা হয়।
আরো বিপর্যয়ের শঙ্কার মধ্যে কয়েকটি আমেরিকান কোম্পানি বাংলাদেশ থেকে চলে গেছে, কয়েকটি উৎপাদন কমিয়েছে, কিছু কিছু আধুনিক সুবিধা যোগ করেছে। তবে বেশির ভাগ কোম্পানিই রয়ে গেছে। তারা নিরাপত্তাহীন পরিস্থিতিতেও উৎপাদন কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে।
বাংলাদেশে পোশাকশ্রমিকদের নিরাপত্তা নিয়ে সক্রিয় ক্যালির্ফোনিয়ার সাবেক কংগ্রেসওম্যান ইলেন ও টসার প্রশ্ন তুলেছেন, ‘আমরা কি আরেকটি রানা প্লাজা প্রতিরোধ করতে পারব?’ তিনি এখানেই থামেননি। জানতে চেয়েছেন : ‘আমরা কারখানায় আগুন লাগা কখনো বন্ধ করতে পারব না। কিন্তু আমরা কি ভবন ধসে বা কারখানার আগুনে মানুষ মরা বন্ধ করতে পারি না?’
বেশি কিছু বদলায়নি
ওয়াশিংটন পোস্টের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভোক্তারা যতদিন পর্যন্ত কম দামে পোশাক পাওয়া চেষ্টা করবে, ততদিন পর্যন্ত শ্রমিকদের অবস্থার উন্নতি ঘটবে না। ১৯১১ সালে নিউ ইয়র্কে একটি দুর্ঘটনার (এতে মারা গিয়েছিল ১৪৬ জন) পর কারখানার পরিবেশে স্থায়ী পরিবর্তন ঘটেছিল। কিন্তু বাংলাদেশে তেমন কিছুই হয়নি। কয়েকটি কোম্পানি কিছু কাজ করেছে। কিন্তু তা যথেষ্ট নয়।
এখনো দুঃস্বপ্ন
মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক আলজাজিরার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এক বছর পরও রানা প্লাজার দুঃস্বপ্ন তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে অনেককে। ওই দুর্ঘটনার পর ভবনটিতে থাকা অনেক শ্রমিক এখনো শারীরিক ও মানসিক অসুস্থতা কাটাতে পারেনি।
এতে বলা হয়, বিশ্বের সবচেয়ে সস্তা শ্রমিকেরা সবচেয়ে উন্নত ডিজাইনের পোশাক তৈরি করে যাচ্ছে।
তারা বেকার
বার্তা সংস্থা এএফপি জানিয়েছে, রানা প্লাজা দুর্ঘটনায় আহত অনেক লোক এখনো বেকার রয়েছে। ব্রিটিশ দাতব্য সংস্থা অ্যাকশন এইড জানিয়েছে, তারা ওই দুর্ঘটনা থেকে বেঁচে যাওয়া এক হাজার ৪৩৬ জনের সাক্ষাতকার তারা নিয়েছে। এদের মধ্যে ৭৪ শতাংশ জানিয়েছে, এক বছর ধরে তাদের চাকরি নেই। প্রায় ৬৪ শতাংশ জানিয়েছে, তারা অঙ্গহানিসহ নানা শারীরিক প্রতিবন্ধকতায় আক্রান্ত হয়েছে।
এতে বলা হয়, দুর্ঘটনার পর প্রথম কিছুদিন ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তা দেয়া হয়েছিল। কিন্তু এখন তাদের দেখার যেন কেউ নেই।

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button