গাড়িচাপায় শিক্ষার্থী নিহত

বিক্ষোভে উত্তাল ইবি ৩০টি বাসে আগুন

গাড়ির ধাক্কায় তৌহিদুর রহমান টিটু নামে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রের মৃত্যু হয়েছে। গতকাল রোববার দুপুর ১২টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকে এ মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে। নিহত শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োটেকনোলজি অ্যান্ড জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র। শিক্ষার্থীর মৃত্যুকে কেন্দ্র করে বিক্ষোভে ফুঁসে উঠেছে সাধারণ শিক্ষার্থীরা। ক্যাম্পাসের প্রায় সব বাসে আগুন দিয়েছে তারা। প্রশাসন ভবনসহ প্রায় সব ভবনে ব্যাপক ভাঙচুর চালিয়েছে। এতে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় ৩০ কোটি টাকা ক্ষতির আশঙ্কা করা হচ্ছে। এ সময় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা চালালে পুলিশের সাথে শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষে ৫০ জনের অধিক শিক্ষার্থী আহত হন। ক্যাম্পাস অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করেছে প্রশাসন।
প্রত্যক্ষদর্শী সূত্রে জানা যায়, রোববার দুপুর ১২টায় ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োটেকনোলজি অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ছাত্র তৌহিদুর রহমান টিটু ক্যাম্পাসের ঝিনাইদহগামী রাজমটর পরিবহনে ওঠার চেষ্টা করেন। বাসচালক হঠাৎ দ্রুত বাস চালালে তিনি বাসে উঠতে ব্যর্থ হন। এ সময় পেছন থেকে ‘সাগর পরিবহন’ (ঝিনাইদহ-ব ১১-০০১) নামে দ্রুতগামী একটি বাস তাকে চাপা দেয়। গাড়ির চাপায় তার দেহ থেকে গলা বিচ্ছিন্ন হয়ে ঘটনাস্থলেই নিহত হন। তার বাড়ি ঝিনাইদহ জেলার মহেশপুরের খালিশপুর গ্রামে। তার বাবার নাম আব্দুল আজিজ, মা তাহমিনা বেগম। তারা চার বোন, দুই ভাই। সে তার বাবা মায়ের তৃতীয় সন্তান।
এ দিকে ঘটনার পরপরই বিক্ষোভে ফেটে পড়েন সাধারণ শিক্ষার্থীরা। তারা মেইন গেট ও কুষ্টিয়া-খুলনা মহাসড়ক অবরোধ করে গাড়ি ভাঙচুর শুরু করে। পরে খবর পুরো ক্যাম্পাসে ছড়িয়ে পড়লে সব শিক্ষার্থী এসে বিক্ষোভে যোগ দিয়ে পরিস্থিতি ভয়াবহ করে তোলেন।
এ দিকে নিহত টিটুর লাশ ক্যাম্পাসে প্রায় তিন ঘণ্টা অবহেলায় পড়ে থাকলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরের কোনো ভূমিকা না থাকায় বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশের এলাকার বহিরাগতরা সুযোগ কাজে লাগিয়ে সাধারণ শিক্ষার্থীদের উসকে দেয়। এতে সাধারণ শিক্ষার্থীরা মেইন গেটের পাশে থাকা ক্যাম্পাসের ভাড়া করা গাড়িসহ মেডিক্যাল ভবনের পাশে বাসস্ট্যান্ডে থাকা বাসগুলোতেও আগুন দেন। ফলে ক্যাম্পাসের ভাড়া করা প্রায় ৩০টি বাস পুড়ে যায়। এ সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির বাংলোর ভেতরে ঢুকে পড়ায় কিছু বাস অক্ষত থাকে। একপর্যায়ে তারা ক্যাম্পাসের প্রশাসন ভবন, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ভবন, অনুষদ ভবন, আইন অনুষদ, কেন্দ্রীয় লাইব্রেরি ভবন, টিএসসিসহ প্রায় সব ভবনে ভাঙচুর চালায়। পরে তারা লাঠিসোটা নিয়ে ক্যাম্পাসে ও কুষ্টিয়া-খুলনা মহাসড়কে বিক্ষোভ মিছিল করে।
বিক্ষোভ মিছিল চলাকালে পৌনে ২টার দিকে শিক্ষর্থীরা আবারো ভাঙচুরের চেষ্টা চালালে পরিস্থিতি অন্য দিকে মোড় নেয়। পুলিশ এ সময় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা চালালে পুলিশের সাথে শিক্ষার্থীদের দফায় দফায় ব্যাপক সংঘর্ষ বাঁধে এবং শিক্ষার্থীদের ওপর রাবার বুলেট ও টিয়ার শেল ছোড়ে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর প্রফেসর ড. টি এম লোকমান হাকিমের নির্দেশে পুলিশ সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর গুলি, রাবার বুলেট বর্ষণ ও লাঠি চার্জ শুরু করে। এতে ৩০ জনের অধিক শিক্ষার্থী আহত হন। তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিক্যালে প্রাথমিক চিকিৎসা দেয়া হয়েছে। এ ছাড়া সজল নামে এক শিক্ষার্থীকে পুলিশ ধরে নিয়ে হাত-পা ভেঙে দিয়েছে।
পরিবহন প্রশাসক অধ্যাপক ড. মামুনুর রহমান বলেন, ‘বিক্ষুব্ধ ছাত্ররা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব ও ভাড়া করা ৩০টি গাড়িতে আগুন দিয়েছে এবং ১০টি গাড়িতে ব্যাপক ভাঙচুর চালিয়েছে। এতে প্রায় ৩০ কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বলে তিনি জানান।
ইবি থানার ভারপ্রাপ্ত ওসির কাছে গুলি ছোড়ার বিষয়ে প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে ২০ রাউন্ড টিয়ার শেল নিক্ষেপ করেছি। ছাত্রদের সাথে সংঘর্ষে আমাদের পাঁচ পুলিশ সদস্য আহত হয়েছেন।
বায়োটেকনোলজি অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সভাপতি প্রফেসর ড. আনোয়ারুল হক বলেন, টিটু আমার খুব প্রিয় ও মেধাবী ছাত্র ছিল। সে এভাবে আমাদের কাঁদিয়ে চলে যাবে কখনো কল্পনাও করতে পারিনি। তার মৃত্যুতে আমরা বাকরুদ্ধ। তিনি বলেন, ক্যাম্পাসের ভাড়া করা প্রায় প্রত্যেক বাসের চালাকসহ হেলপাররা খুবই রূঢ় স্বভাবের। তারা শিক্ষক-শিক্ষার্থী কাউকেই পাত্তা দেয় না। ক্যাম্পাস সুষ্ঠুভাবে চালানোর জন্য নিজস্ব বাসের বিকল্প নেই বলেও মন্তব্য করেন তিনি। তার প্রিয় ছাত্র হত্যার সাথে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করার জোর দাবি জানান তিনি।
এ দিকে এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে জরুরি সিন্ডিকেটে বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। ছাত্র ও ছাত্রীদের আজ সকাল ১০টার মধ্যে হল ছাড়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
প্রো-ভিসি প্রফেসর ড. মো: শাহিনুর রহমান বলেন, ‘নিহত শিক্ষার্থীর জন্য আমরা শোকাহত। কিন্তু কোনো কিছু বুঝে ওঠার আগেই বহিরাগতরা শিক্ষার্থীদের আন্দোলন দখলে নেয় বলে জেনেছি। বহিরাগত সন্ত্রাসীরা বিশ্ববিদ্যালয়কে ধ্বংসের জন্য শিক্ষার্থীদের আন্দোলনকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা চালিয়েছে। আমরা বিষয়গুলো কঠোরভাবে খতিয়ে দেখব এবং শাস্তির ব্যবস্থা করব’।
এ ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয় ভিসি প্রফেসর ড. আবদুল হাকিম সরকার বলেন, অনাকাক্সিক্ষত এ ঘটনায় যে পরিস্থিতি দাঁড়িয়েছে তাতে বিশ্ববিদ্যালয় খোলা রাখা সম্ভব নয়। সুতরাং বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হলো। আর নিহত ছাত্রের জন্য আমরা বিশ্ববিদ্যালয় পরিবার শোকাহত। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন একটি উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন তদন্ত কমিটি গঠন করে এ ঘটনার নেপথ্যে যারা রয়েছে তাদের ব্যাপারে আইনানুগ ব্যবস্থা নেবে।’
তদন্ত কমিটি : প্রফেসর ড. কামাল উদ্দিনকে আহ্বায়ক করে ছয় সদস্যবিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির সদস্যরা হলেনÑপ্রফেসর ড. রুহুল কে এম সালেহ, প্রফেসর ড. ইকবাল হোছাইন, প্রফেসর ড. মাহবুবুল আরেফিন, প্রফেসর ড. আব্দুস শাহিদ মিয়া, উপ-রেজিস্ট্রার প্রফেসর ড. আব্দুল লতিফ।

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button