ইসরাইলকে আমিরাতের স্বীকৃতি

কোন পথে মধ্যপ্রাচ্য?

মাসুম খলিলী: সংযুক্ত আরব আমিরাত তৃতীয় দেশ হিসেবে এমন একদিন ইসরাইলকে স্বীকৃতি দেয়ার চুক্তি স্বাক্ষর করেছে যেদিন দেশটি গাজার ফিলিস্তিনিদের ওপর অব্যাহত বোমা হামলা চালিয়েছে। পশ্চিম তীর থেকে ফিলিস্তিনিদের জোরপূর্বক উচ্ছেদ করে ইহুদি বসতি স্থাপনের কাজও জারি রেখেছে। ট্রাম্পের মধ্যস্থতায় দু’দেশের মধ্যে সম্পাদিত চুক্তি অনুসারে আবু ধাবি আর তেল আবিব সব ক্ষেত্রেই পরস্পরের প্রতি সহযোগিতার সম্পর্ক নির্মাণ করে যাবে।

ইসরাইল ও আমিরাতের এই সম্পর্কের বিষয় নিয়ে অনেক দিন ধরে বৈশ্বিক গণমাধ্যমে লেখালেখি হচ্ছিল। বলা হচ্ছিল, স্বীকৃত সম্পর্ক না দেখানো হলেও আমিরাত মধ্যপ্রাচ্যে যে ভূমিকা পালন করছে তা ইসরাইলি নীতিরই ছায়া। ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যস্থতায় নতুন চুক্তি হওয়ার পর এখন আর দু’দেশের সম্পর্কে রাখঢাক থাকল না। এখন থেকে সংযুক্ত আরব আমিরাত ও এর নেতা জায়েদ আল নাহিয়ান মধ্যপ্রাচ্য তথা পুরো মুসলিম দুনিয়ায় ইরাইলের ছায়া রাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ ভূমিকা পালন করবে। আর দেশটির শাসকদের ক্ষমতার নিশ্চয়তা বিধান করবে ইসরাইল। কেবল যে আমিরাতই এই ভূমিকায় আসছে তাই নয়। ট্রাম্প আর নেতানিয়াহুর ইঙ্গিত অনুসারে আরো আরব রাষ্ট্র ইসরাইলকে স্বীকৃতি দিয়ে এর সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করতে যাচ্ছে। আমিরাতের পরে বাহরাইন, ওমান ও সৌদি আরব একই পথে এগোচ্ছে বলে ইসরাইলি মিডিয়াতে ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে।
আরব রাষ্ট্রগুলোর ইসরাইলকে স্বীকৃতি দেয়ার এ ঘটনা শুধু মধ্যপ্রাচ্যেই নয় গোটা মুসলিম বিশ্বে যে এক ধরনের ‘পেরাডাইম শিফটের’ সূচনা করতে পারে তারই ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে বিশ্লেষকদের বক্তব্যে। এটিকে ক্যাম্পডেভিড চুক্তির পর ইসরাইলের জন্য সবচেয়ে বড় সফলতা হিসেবে বর্ণনা করা হচ্ছে। আর ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র ও অধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে গত কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে বড় আঘাত হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে এটিকে।
আর গোপন সম্পর্ক নয়
সংযুক্ত আরব আমিরাত-ইসরাইলের চুক্তি সম্পর্কে ইসরাইলের গোয়েন্দা বিশ্লেষক প্রতিষ্ঠান ডেবকাফাইলের বক্তব্যটি বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। এর বর্ণনাটি ঠিক এরকম, ‘আরব বিশ্বে প্রচলিত প্রায় একটি ধর্মীয় প্রজ্ঞা ছিল যে ১৯৬৭ সালের পূর্বের সীমান্তের মধ্যে ফিলিস্তিনের রাষ্ট্রক্ষমতা অর্জনের আগে ইসরাইলের সাথে কোনো সাধারণ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা (পড়ুন স্বীকৃতি) করা যাবে না। ২০২০ সালের ১৩ আগস্ট ট্রাম্প প্রশাসন কর্তৃক সংযুক্ত আরব আমিরাত-ইসরাইল ঐতিহাসিক চুক্তি এটিকে ঘুরিয়ে দিয়েছে। ধনী উপসাগরীয় আরব দেশ কোনো শঙ্কা ছাড়াই এই শর্তটি (ইসরাইলের পাশাপাশি ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা) বাদ দিয়ে দিয়েছে এবং ইহুদি রাষ্ট্রের সাথে দীর্ঘকালীন গোপনীয় সম্পর্কের আবরণ তুলে নিয়ে আনুষ্ঠানিকতা প্রদান করেছে।’
ডেবকাফাইল আরো লিখেছে, ‘আরব বিশ্বের সাথে স্বাভাবিক সম্পর্কের যে কোনো আলোচনা হতে পারে, তার আগে নেতানিয়াহুর পূর্বসূরিরা এবং পশ্চিমা শান্তি আলোচনার মধ্যস্থতাকারীরা ফিলিস্তিনিদের সাথে শান্তির জন্য ইসরাইলকে কতটা মূল্য দিতে হবে তা নিয়ে ভাবতে বাধ্য হতেন। হঠাৎ করে, আবুধাবির ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন জায়েদ (এমবিজেড) এবং প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুকে দেয়া-নেয়াতে ব্যস্ত থাকতে দেখা গেল। প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু পশ্চিম তীরের ইহুদি অঞ্চলগুলোতে ইসরাইলের সার্বভৌমত্ব সম্প্রসারণে তার পরিকল্পনা স্থগিত রাখতে রাজি হন, যদিও তিনি নির্বাচনে জনসাধারণকে যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তা আসলে আইন, মানচিত্র বা কোনো টাইমলাইনের অন্তর্ভুক্ত ছিল না। তদুপরি, ফিলিস্তিনি ইস্যুটিকে করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাব এবং মারাত্মক অর্থনৈতিক পরিণতির কারণে পেছনের দিকে ঠেলে দেয়া হয়েছিল। অবশ্যই, সংযুক্ত আরব আমিরাতের শাসক প্রিন্স মোহাম্মদ বিন জায়েদের কাছে ভাজার জন্য আরো বড় মাছ ছিল।

২০২০ সালের ১৩ আগস্ট ইসরাইলের সাথে সংযুক্ত আরব আমিরাত তৃতীয় আরব দেশ হিসেবে শান্তিচুক্তি স্বাক্ষর করে ইসরাইলকে স্বীকৃতি দিতে এবং সম্পর্ক প্রতিষ্ঠায় সম্মত হয়। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প হোয়াইট হাউসে এই ঘোষণা দেয়ার সময় অনেকে অবাক হন। ট্রাম্প নিশ্চিত করেছেন যে, ইসরাইল ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের মধ্যে চুক্তির আনুষ্ঠানিক স্বাক্ষর ও ধুমধামের ঘটনা ওয়াশিংটনে অনুষ্ঠিত হবে।

তিনি আবুধাবি, আজমান, দুবাই, ফুজাইরাহ, রাস আল খাইমাহ, শারজাহ এবং উম্মুল কুওয়াইন সমন্বয়ে গঠিত সাত আমিরাতের একটি উপসাগরীয় রাজতন্ত্রের নেতৃত্ব দেন। মাত্র দশ মিলিয়ন নাগরিক এবং প্রায় নয় মিলিয়ন বিদেশী শ্রমিকের জনসংখ্যার সংযুক্ত আরব আমিরাত একসময় ব্যাকওয়াটার হিসেবে বিশ্বের অন্যতম উন্নত অর্থনৈতিক কেন্দ্র, আন্তর্জাতিক মিডিয়া হাব এবং একটি আকর্ষণীয় পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। বহু বছর ধরে, এর সরকার ইসরাইলের সাথে ঘনিষ্ঠ নিরাপত্তা সম্পর্ক আর মোসাদ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ফ্রান্সের সাথে গোয়েন্দা সম্পর্কের ওপর নির্ভরশীল ছিল। দুটি দেশ ট্রাম্প প্রশাসনের সাথে শিয়া ইরান এবং এই অঞ্চলে এর সম্প্রসারণবাদী হস্তক্ষেপের গভীর সন্দেহ করে। আবুধাবি এবং তেহরানের মধ্যে উপসাগরীয় কয়েকটি দ্বীপ নিয়ে বিতর্কও রয়েছে।’
ডেবকাফাইল আরো বলেছে, ‘ইসরাইলের সাথে আমিরাতের চুক্তি এই অঞ্চলে গভীর ধর্মীয়-রাজনৈতিক বিভাজনকে তীব্র করে তুলেছে। বাহরাইন আর ওমানের মতো মিসরের আবদেল ফাত্তাহ আল-সিসি আরব আমিরাতের ইসরাইলকে স্বীকৃতি দেবার চুক্তিকে এই অঞ্চল ও শান্তির পক্ষে মঙ্গলজনক বলে অনুমোদন করেছে। অন্য দিকে তুরস্ক ও ইরান এর নিন্দা জানিয়েছে। রাষ্ট্রপতি রজব তৈয়ব এরদোগান বলেছেন, তিনি আবুধাবিতে তুরস্কের দূতাবাস বন্ধ করা, এর রাষ্ট্রদূতকে প্রত্যাহার ও সম্পর্ক ছিন্ন করার বিষয়ে বিবেচনা করছেন। মিসর, সংযুক্ত আরব আমিরাত, সৌদি আরব এবং বেশির ভাগ উপসাগরীয় আরব সরকার ইরানের প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সময়ও মুসলিম ব্রাদারহুডকে অস্বীকার করে। অন্য দিকে তুরস্ক তাদের সমর্থন করে এবং ফিলিস্তিনিদের মধ্যে তার অফসুট হামাসকে সমর্থন করছে। ইয়েমেনে, ‘সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং সৌদি আরব যৌথভাবে একটি জোটের নেতৃত্ব দেয় যা ইরান-সমর্থিত হুথি বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে দেশটির নিয়ন্ত্রণের জন্য একটি অমীমাংসিত যুদ্ধে লড়াই করে আসছে। এমবিজেডের (পড়ুন : ইসরাইল অনুমোদিত) আঞ্চলিক আকাঙ্ক্ষার সাথে সামঞ্জস্য রেখে সংযুক্ত আরব আমিরাত দক্ষিণ ইয়েমেনের দিকে একা অগ্রসর হচ্ছে। গত জুনে, সংযুক্ত আরব আমিরাতের বাহিনী লোহিত সাগরের আন্তর্জাতিক শিপিং লেনকে উপেক্ষা করে কৌশলগত ইয়েমেনী দ্বীপপুঞ্জ সোকোত্রা দখল করে। এই বাহিনী দ্বীপপুঞ্জ থেকে সরে এসে একটি ছোট সামরিক ঘাঁটি রেখে গেছে।’
ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার অধিকার বিসর্জন
সংযুক্ত আরব আমিরাতের সাথে ইসরাইলের চুক্তির সবচেয়ে বড় দিকটি হলো ইসরাইলকে স্বীকৃতি দেয়ার জন্য ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার যে শর্ত ছিল সেটিকে বিসর্জন দেয়া। এক দিকে মিসর, জর্দান ও সিরিয়া এবং অন্য দিকে ইসরাইলের মধ্যে ১৯৬৭-এর ইসরাইল-আরব যুদ্ধের পরে আরব দেশগুলো জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের ২৪২ প্রস্তাবকে বাস্তবায়নে চাপ দেয়। নিরাপত্তা পরিষদের এই প্রস্তাবকে (ইসরাইল ও ফিলিস্তিন দুটি রাষ্ট্র পাশাপাশি থাকা) বছরের পর বছর ধরে ভিত্তি হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছিল আরব এবং ইসরাইল মধ্যে আলোচনার। এই প্রস্তাবের মূল উপাদান হলো ১৯৬৭ সালের যুদ্ধের সময় দখল করা সব অঞ্চল ইসরাইল ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য ফিরিয়ে দেবে। ইসরাইল এই অঞ্চলগুলোকে সমর্পণ না করা পর্যন্ত আরব লীগ একমত হয়েছিল যে ইসরাইল রাষ্ট্রের সাথে শান্তি প্রতিষ্ঠা, স্বীকৃতি দান বা সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণ নিয়ে কোনো আলোচনা হবে না। তবে মিসর ও জর্দান ১৯৭৭ এবং ১৯৯৪ সালে ইসরাইলের সাথে আলোচনা এবং পরে শান্তি চুক্তি স্বাক্ষর করে দেশটির সাথে আনুষ্ঠানিক সম্পর্কের বন্ধনে আবদ্ধ হয়।
২০২০ সালের ১৩ আগস্ট ইসরাইলের সাথে সংযুক্ত আরব আমিরাত তৃতীয় আরব দেশ হিসেবে শান্তিচুক্তি স্বাক্ষর করে ইসরাইলকে স্বীকৃতি দিতে এবং সম্পর্ক প্রতিষ্ঠায় সম্মত হয়। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প হোয়াইট হাউসে এই ঘোষণা দেয়ার সময় অনেকে অবাক হন। ট্রাম্প নিশ্চিত করেছেন যে, ইসরাইল ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের মধ্যে চুক্তির আনুষ্ঠানিক স্বাক্ষর ও ধুমধামের ঘটনা ওয়াশিংটনে অনুষ্ঠিত হবে।
ট্রাম্পের মতে, ইসরাইল নিজ মানচিত্রে পশ্চিম তীরের সংযোজন স্থগিত করতে সম্মত হয়েছে। আরব লীগের সদস্য রাষ্ট্রের এই সর্বশেষ পদক্ষেপ ফিলিস্তিনিদের লড়াইয়ে আরেকটি প্রতিবন্ধকতা তৈরি করল এবং আরব লীগকে এটি নিঃসন্দেহে আরো দুর্বল করে দেবে। ফিলিস্তিনিদের সাথে সমস্যার ন্যায়সঙ্গত সমাধানে ইসরাইলকে চাপ দেয়া এখন আরো কঠিন হবে। আরব লিগের অন্যতম উচ্চাকাক্সক্ষা ছিল আরব দেশগুলোর মধ্যে একটি সুসঙ্গত আঞ্চলিক পররাষ্ট্রনীতি প্রতিষ্ঠা করা। এই প্ল্যাটফর্মে ঐকমত্য হয় কম। এখন বিভাজনটা আরো বেড়ে গেল।
আরো দেশ লাইনে!
ইসরাইল এবং এই অঞ্চলের অন্যান্য ইস্যুতে সংযুক্ত আরব আমিরাতের সাম্প্রতিক বিদেশী নীতি অন্য কয়েকটি দেশ সম্ভবত অনুসরণ করার ক্ষেত্রে আদর্শ হয়ে উঠবে। সৌদি আরব ইতোমধ্যে ইসরাইলের সাথে নিয়মিত সংযোগ বজায় রাখার মধ্য দিয়ে ইসরাইলকে স্বীকৃতি দেয়ার ইঙ্গিত দিয়েছে। জেরুসালেমের আল-আকসা কম্পাউন্ডে ইসলামিক ওয়াকফ কাউন্সিলের সৌদি প্রতিনিধিদের অন্তর্ভুক্ত করার বিষয়ে ইসরাইল ও সৌদি আরব গত ডিসেম্বরের পর থেকে গোপন বৈঠক করেছে।
ফিলিস্তিনিরা দু’দেশের সম্পর্কের সাম্প্রতিক স্বাভাবিকতাকে ঘৃণা করেছে। তদুপরি, দু’দেশের মধ্যে সম্পর্কের স্বাভাবিকীকরণ বা যোগাযোগের অর্থ হলো ফিলিস্তিনের ওপর অব্যাহত বোমা হামলা ও অবরোধকে সমর্থন করা। ইসরাইল গাজায় বোমা হামলা চালিয়ে যাওয়ার সাথে সাথেই ট্রাম্পের আমিরাত ঘোষণা আসে। একই সাথে ফিলিস্তিন অঞ্চল থেকে অব্যাহতভাবে উচ্ছেদ অভিযানও চালানো হচ্ছে। ইসরাইল গাজা উপত্যকায় হামাসের লক্ষ্যবস্তুতে বৃহস্পতিবারও আক্রমণ করেছিল। আর ইসরাইলের রাজধানী হিসেবে জেরুসালেমের বিতর্কিত স্বীকৃতিটিকে গ্রহণ করে নেয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণ।
অনেক প্রশ্ন ও ট্রাম্প-নেতানিয়াহুর দাবার ঘুঁটি
ইসরাইলকে স্বীকৃতি দেয়ার চুক্তি ঘোষণার সময়টিও বিভিন্ন প্রশ্নের সৃষ্টি করেছে। প্রথমত, সংযুক্ত আরব আমিরাত মনে হচ্ছে ট্রাম্প এবং নেতানিয়াহু উভয়েরই হাতে খেলছে। উভয় নেতা তাদের দেশে কোভিড-১৯ এর চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় ব্যর্থ হওয়ার পরে তাদের নিজের দেশে রাজনৈতিকভাবে বেঁচে থাকার লড়াই করছেন। কোভিড-১৯ মোকাবেলায় ট্রাম্পের অক্ষমতা আমেরিকার অর্থনীতি এবং বেকারত্ব পরিস্থিতির অবনতি ঘটায়। ইসরাইলের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক সৃষ্টির বিষয়ে রাজি হয়ে সংযুক্ত আরব আমিরাত ট্রাম্প ও নেতানিয়াহু উভয়েরই রাজনৈতিক ক্যারিয়ারকে একটি লাইফলাইন দেয়ার জন্য ব্যবহৃত হয়েছে বলে মনে হচ্ছে।

‘মুসলিম বিশ্বে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কৌশল’ শিরোনামে ৫৬৭ পৃষ্ঠার এক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এই প্রতিবেদনে ইসলামী গৃহযুদ্ধের বিষয় নিয়ে বিশদ আলোচনা করা হয়েছে। এ জন্য গঠিত ফ্রন্টগুলোর মধ্যে প্রথমটি হলো, শিয়া-সুন্নি যুদ্ধ এবং দ্বিতীয় ফ্রন্টটি আরব মুসলিম আর অ-আরব মুসলমানদের যুদ্ধ। প্রথম পর্বটি সম্ভবত শেষ করে আনা হয়েছে। এরপর দ্বিতীয় পর্বের মঞ্চায়নের কাজ হবে।

দ্বিতীয়ত, ট্রাম্প এবং নেতানিয়াহু উভয়ই ‘শতাব্দীর চুক্তির’ অংশ হিসেবে পশ্চিম তীরের ইসরাইলভুক্তির প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন এবং প্রতিশ্রুতি প্রত্যাহার করার কারণে বিব্রত অবস্থা থেকে তাদের বাঁচানোর চেষ্টাও এর মধ্যে থাকতে পারে।
তৃতীয়ত, সম্ভবত সংযুক্ত আরব আমিরাতকে এই অঞ্চলে আরো বৃহত্তর ভূমিকার জন্য প্রস্তুত করা হচ্ছে। এটি আরব লীগ এবং উপসাগরীয় সহযোগিতা কাউন্সিল (জিসিসি) উভয়েরই ভূমিকাকে ছাড়িয়ে যাবে। আর এটি যে ইসরাইলের জন্য সম্পূরক ভূমিকা হবে সে বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই।
চতুর্থত, এই মাসের শুরুর দিকে, দীর্ঘস্থায়ী আঞ্চলিক শত্রু ইরান ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাবসহ বেশ কয়েকটি দ্বিপক্ষীয় এবং আঞ্চলিক বিষয়ে বিরল আলোচনা করেছেন। ট্রাম্প ইঙ্গিত দিয়েছেন যে, তিনি ইরানের সাথে একটি চুক্তি করতে প্রস্তুত এবং সম্ভবত ইরান ও আমেরিকার মধ্যে একটি চুক্তি প্রত্যক্ষ করবে বিশ্ব। আশ্চর্যজনকভাবে, সংযুক্ত আরব আমিরাত, সৌদি আরব, বাহরাইন ও মিসর মে ২০১৬ সালে কাতার অবরোধ করেছিল কাতারের ইরানের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক হ্রাস করা, কাতার থেকে ইরানের সামরিক প্রতিনিধিদের বহিষ্কার করা এবং অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে অর্থনৈতিক সহযোগিতা সীমাবদ্ধ করার দাবিতে। শেষ অবধি, সংযুক্ত আরব আমিরাতের পারমাণবিক শক্তি ক্লাবে প্রবেশের জন্য প্রস্তুত করার বিষয়টি এবং ইসরাইলের সাথে সম্পর্কের স্বাভাবিকীকরণ হতে পারে খেলার মাঠের প্রস্তুতি।
আমিরাত এই মাসের শুরুর দিকে ঘোষণা করে যে, তারা বারাকাহ পারমাণবিক শক্তি কেন্দ্র সফলভাবে শুরু করেছে। এটি আরব বিশ্বে প্রথম এবং পারমাণবিক বিদ্যুতের লক্ষ্য অর্জনে দেশটির লক্ষণীয় পদক্ষেপ। এর সাথে ইসরাইলকে স্বীকৃতি দানের সম্পর্ক থাকতে পারে।
তুরস্কের বিরুদ্ধে আরব ফ্রন্ট?
সাম্প্রতিক বছরগুলোর প্রবণতা হলো, অ-আরব মুসলিম দেশগুলো ক্ষমতা অর্জন করছে যখন আরব মুসলিম দেশগুলোর, বিশেষত উপসাগরীয় আরবদের (অর্থাৎ সংযুক্ত আরব আমিরাত, সৌদি আরব এবং আবদেল ফাত্তাহ আল সিসির প্রশাসনের অধীনে মিসর) প্রকৃত সক্ষমতা ভেঙে পড়ছে।
আরব দেশগুলো দ্রুত অমুসলিম পাশ্চাত্যের জিম্মায় নিয়ে চলে যাচ্ছে, জড়িয়ে পড়েছে আরো বেশি পশ্চিমা নিরাপত্তা সুরক্ষায়, আরো বেশি নির্ভরশীল সম্পর্ক তৈরি করছে তাদের সাথে।
ঠিক এ সময় অ-আরব মুসলিম দেশগুলো ইসলামী বিশ্বকে এবং মুসলিম সম্প্রদায়ের অধিকারকে আরো দৃঢ়তার সাথে রক্ষার ভূমিকায় আসছে। এটি করছে এমন একসময় যখন আরব দেশগুলো উম্মাহর দাবি ও উত্তরাধিকার থেকে নিজেদের ক্রমাগতভাবে অনেক দূরে সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। এটি হচ্ছে ফিলিস্তিন কাশ্মির রোহিঙ্গা ইত্যাদি ইস্যুতে। সংযুক্ত আরব আমিরাতের নেতৃত্বাধীন নতুন ফ্রন্ট এটি স্পষ্টভাবে করছে এবং প্রকাশ্যে ইসলামী রাজনৈতিক উত্তরাধিকারকে পরিত্যাগ বা প্রত্যাখ্যান করছে।
অ-আরব মুসলিম দেশগুলো পশ্চিমের ‘সম্মুখ দেশ’ অবস্থানটিকে পুরোপুরি প্রত্যাখ্যান করছে। একসময়, তুরস্ক, পাকিস্তান এবং ইন্দোনেশিয়া সোভিয়েত কমিউনিজমের বিরুদ্ধে ‘দক্ষিণ অঞ্চল’ গঠন করেছিল এবং পশ্চিমাদের স্বার্থ রক্ষা করেছিল। এই তিনটি দেশ তখন থেকেই দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়েছে। এখন এই দেশগুলো নিজস্ব একটি অবস্থান নির্মাণ করতে চাইছে।
তবে, যে দেশগুলোকে আমেরিকা, ইউরোপ এবং ইসরাইল হুমকিস্বরূপ মনে করে, তাদের বিরুদ্ধে আরব দেশগুলো, বিশেষত সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, মিসর নিজেদের ঐক্যবদ্ধ করছে। মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলে তারা পশ্চিমা শক্তির সুরক্ষা বলয় তৈরি করতে চাইছে এবং অন্যদের প্রতি হুমকিপূর্ণ বার্তা প্রেরণ করছে।
অ-আরব মুসলিম দেশগুলো বিদেশী আক্রমণ মোকাবেলার প্রয়াস চালাচ্ছে আর আরব মুসলিম দেশগুলো তাদের অঞ্চলের মধ্যে লড়াই করছে আর এটি করার সময় তারা পশ্চিমা দেশগুলোর সহায়তা চাচ্ছে।
অ-আরব মুসলিম দেশগুলো যখন ভেতরে ও বাইরে শক্তি সংগ্রহ করছে, লড়াই করছে, তাদের নিজস্ব শক্তি সক্রিয় করছে তখন আরব মুসলিম দেশগুলো বাইরে থেকে এ শক্তির ওপর আক্রমণ করছে, বিদেশী শক্তির সাথে মিলে তারা নিজেদের মধ্যে সঙ্ঘাত জোরালো করে তুলছে।
আরব দুর্বলতা এর অন্তর্নিহিত কারণ নয়, বরং তাদের প্রশাসন পশ্চিমাদের সাথে যে একতরফা নির্ভরশীল সম্পর্ক তৈরি করে সেটিই এর কারণ। এই সম্পর্ক প্রায় সবসময়ই আরব জনগণ এবং তাদের দেশগুলোর স্বার্থের বিরুদ্ধে ছিল।
দু’জন ক্রাউন প্রিন্স ও এক স্বৈরশাসকের অক্ষ
নির্ভরতার সম্পর্কটি এখন নতুন করে তৈরি করা হচ্ছে এবং এটি আরো ধ্বংসাত্মক হয়ে উঠছে। এর নেতৃত্ব এখন মোহাম্মদ বিন জায়েদ (সংযুক্ত আরব আমিরাত), মোহাম্মদ বিন সালমান (সৌদি আরব) এবং সিসি (মিসর) দিচ্ছেন।
তারা প্রথম দিকে ইরানের বিরুদ্ধে আরব সরকারগুলোকে ব্যবহার করেছিল। এই রূপটি তাদের আগ্রহের ভিত্তিতে নয়, বরং ইসরাইলের অগ্রাধিকার এবং মার্কিন পরিকল্পনার ভিত্তিতে ছিল। তারা তিন দশক ধরে এই প্রসঙ্গে লড়াই করে আসছে এবং সর্বদা হেরে গেছে। কারণ তাদের পরাজয়কে অনিবার্য করা হয়েছে।
সুতরাং, আরব-পারস্য সীমানাটি ইরান-ইরাক সীমান্ত থেকে ভূমধ্যসাগর পর্যন্ত টানা হয়েছিল। তারা ইরাক ও সিরিয়াকে হারিয়েছে এবং তারা এখন লেবানন ও ইয়েমেনকে হারাতে চলেছে।
অঘোষিত যুদ্ধ!
এবার প্রায় একই মানসিকতা নিয়ে তুরস্কের বিরুদ্ধে আরব শক্তিকে সক্রিয় করা হচ্ছে। তারা সংযুক্ত আরব আমিরাত, সৌদি আরব, উপসাগরীয় দেশ এবং সিসির মিসরের সমন্বয়ে একটি ‘তুরস্ক-বিরোধী ফ্রন্ট’ প্রতিষ্ঠা করেছে।
এই মোর্চা আফ্রিকা থেকে দক্ষিণ এশিয়া পর্যন্ত সন্ত্রাসবাদী সংগঠন পরিচালনা, অর্থনৈতিক আক্রমণ, হত্যা ও মৃত্যুদ- কার্যকর করা- ইত্যাদির মাধ্যমে তুরস্ককে প্রতিটি ক্ষেত্রে দুর্বল করার চেষ্টা করছে।
তারা তুরস্কের সাথে লিবিয়ায়, পূর্ব ভূমধ্যসাগরে, ককেশাসে, পারস্য উপসাগরে, লোহিত সাগরের আশপাশে এবং মধ্য আফ্রিকায় অঘোষিত যুদ্ধ চালাচ্ছে। এসব করতে গিয়ে তারা ইসরাইল, ফ্রান্স, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ তথা বাস্তবে গ্রিস এবং গ্রিক সাইপ্রিয়ট প্রশাসনের সাথে অংশীদারিত্ব গড়ে তুলছে।
পরের টার্গেট পাকিস্তান
এটা বেশ মজার বিষয় যে, একই ফ্রন্টটি সম্প্রতি পাকিস্তানকে লক্ষ্যবস্তু করে আসছে। সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত ভারতের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করে পাকিস্তানকে লক্ষ্যবস্তু করতে শুরু করে।
পাকিস্তানে তাদের বিনিয়োগ বাতিল করা হচ্ছে, প্রদত্ত সহায়তা প্রত্যাহার করা হচ্ছে, এবং কাশ্মীর সম্পর্কিত ভারতের পরিকল্পনাগুলোকে সুস্পষ্ট সমর্থন দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়া হচ্ছে। কাশ্মীর ইস্যুতে ওআইসিকে নিষ্ক্রিয় করে রাখা হয়েছে। কাশ্মীরে ভারতীয় নিয়ন্ত্রণকে গভীরে নিয়ে যেতে ইসরাইলি ভূমিকায় সহায়তা দিতে কাজ করছে তারা। কাশ্মীরের মর্যাদা ও স্বায়ত্তশাসনের অবশিষ্টটুকু সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে যখন ছিনিয়ে নেয়া হয় ঠিক তখনই বাহরাইন, আমিরাতে ভারতের নেতৃত্বকে সংবর্ধিত করা হয়েছে।
প্রশ্ন হলো, তুরস্কের পরে এই আরব দেশগুলো কি পাকিস্তানের বিরুদ্ধেও ব্যবহার হতে চলেছে? এই প্রশ্নের জবাব সম্ভবত হ্যাঁ। এরপর কোন দেশ আসবে? খুব সম্ভবত শক্তিমত্তায় উদীয়মান মুসলিম শক্তি ইন্দোনেশিয়া।
শিয়া-সুন্নির পর সুন্নি গৃহযুদ্ধ এখন দিগন্তে!
‘সিভিল ডেমোক্রেটিক ইসলাম: পার্টনারস, রিসোর্সেস অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিস’ শীর্ষক একটি প্রকল্পের বিষয় ২০০৩ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রকাশিত হয়েছিল। কীভাবে ‘ইসলামী গৃহযুদ্ধ’ আয়োজন করা যায় তার ব্যাখ্যা সেখানে করা হয়।
এর এক বছর পরে, ‘মুসলিম বিশ্বে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কৌশল’ শিরোনামে ৫৬৭ পৃষ্ঠার এক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এই প্রতিবেদনে ইসলামী গৃহযুদ্ধের বিষয় নিয়ে বিশদ আলোচনা করা হয়েছে। এ জন্য গঠিত ফ্রন্টগুলোর মধ্যে প্রথমটি হলো, শিয়া-সুন্নি যুদ্ধ এবং দ্বিতীয় ফ্রন্টটি আরব মুসলিম আর অ-আরব মুসলমানদের যুদ্ধ। প্রথম পর্বটি সম্ভবত শেষ করে আনা হয়েছে। এরপর দ্বিতীয় পর্বের মঞ্চায়নের কাজ হবে। আর এতে ইউএই এবং এরপর বাহরাইন ওমান সৌদি আরব যোগ দিলে মিসরসহ তাদের দাঁড় করানো হবে তুরস্ক ও মিত্র দেশগুলোর বিরুদ্ধে। পেছনে থাকতে পারে ইসরাইল, ফ্রান্স ও যুক্তরাষ্ট্র। এই মেরুকরণটি ঠিক কী রূপ নেবে তা পরিষ্কারভাবে বলা কঠিন। তবে লিবিয়া, সিরিয়া, ইয়েমেন এবং সর্বশেষ লেবাননের বিস্ফোরণের ঘটনায় মনে হচ্ছে আয়োজন অনেক দূর এগিয়ে গেছে।
আরব রাস্তাগুলো কি জাগ্রত হবে!
কথিত ইসলামী গৃহযুদ্ধের যে আয়োজন হচ্ছে তা এই অঞ্চলের দেশ ও জনগণের বিরুদ্ধে। সংযুক্ত আরব আমিরাত, সৌদি আরব এবং মিসর সরকারকে শিয়া-সুন্নি যুদ্ধের জন্য ব্যবহার করা হয়েছিল। তাদের এখন সুন্নিদের মধ্যে গৃহযুদ্ধের জন্য চালিত করা হচ্ছে। আর তুরস্ককে তাদের সামনে প্রাথমিক লক্ষ্য হিসেবে হাজির করা হচ্ছে।
এই সরকারগুলো প্রতিটি যুদ্ধে এর আগে পরাজিত হয়েছিল এবং অঞ্চলটি এখন ধ্বংসের কাছাকাছি এসে দাঁড়িয়েছে। তারা পরের যুদ্ধেও হয়তো হারতে চলেছে। তবে আরব জনগণের জন্য তাদের রাষ্ট্রকে এদিকে নিয়ে যাওয়া আত্মহত্যার প্রস্তুতি ছাড়া অন্য কিছু নয়। তারা আরব দেশগুলোতে ফাঁদ পেতেছিল। এসব নেতা এবং তাদের শাসনব্যবস্থা আরব অঞ্চলকে ধ্বংসের দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। আরব মুসলিম দেশগুলো ক্রমাগত শক্তি হারাতে থাকার পর অ-আরব মুসলিম দেশগুলো কেন ক্ষমতা অর্জন করছে? এই উপলব্ধি গভীরভাবে করা প্রয়োজন। প্রশ্ন হতে পারে এ পরিস্থিতিতে বিকল্প কি? আরবদের এখনই জেগে উঠতে হবে! অবশ্যই নতুন উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ করতে হবে! ইসরাইল ও তার মিত্রদের সিদ্ধান্তের ঘুঁটি হিসেবে জনগণের বিরুদ্ধে সরকারের শক্তি ব্যবহারের ব্যাপারে রুখে দাঁড়ানোর আর কোনো বিকল্প নেই।

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button