নারীদের হজ কেমন হবে

মাওলানা সেলিম হোসাইন আজাদী
আমার ২০১০ সালের হজের একটি দৃশ্য বারবার হৃদয়ে নাড়া দেয় তা হলো সর্বপ্রথম যখন কেবলার দিকে তাকিয়েছিলাম, তখন দেখতে পেলাম লাখো মানুষ যেন সব কিছু হারিয়ে শুধু প্রভুকে পাওয়ার জন্যই চোখের অশ্রু ছেড়ে কাঁদছে। এদের মধ্যে নারীদেরই বেশি কাঁদতে দেখেছি। হাঁটতে হাঁটতে যখন কেবলার একেবারে কাছে চলে এলাম তখন দেখতে পেলাম, এক বাঙালি মা দুই হাত দিয়ে কেবলার চৌকাঠ ধরার চেষ্টা করছেন এবং বলছেন হে প্রভু, সব কিছু ছেড়ে দেশ থেকে এসেছি। তুমি ক্ষমা না করলে আর দেশে ফিরে যাবো না। এই যে প্রেম ও ভালোবাসার চরম বিকাশ, এটি পাষাণহৃদয়েরও নজর কাড়ে। জামরাতে কঙ্কর নিেেপর সময় প্রেমিকের আবেগ যখন চরমে পৌঁছে, তখন প্রেম লাভ করার পথে যে বাধা হয় তাকেই যে সে এলোপাতাড়ি পাথর নিপে করে, অনুরূপভাবে জামরাতে এসে হাজীও তাই করে থাকেন। এরপর পশু কোরবানি করে প্রেমানুরাগের শেষ মঞ্জিল অতিক্রম করে নবজাতকের মতো নিষ্পাপ অবস্থায় ফিরে আসেন হাজী নিজ মুসাফিরখানায়। তখনো মাহবুবের দেশে ফের যাওয়ার অনির্বাণ শিখা দাউ দাউ করে জ্বলতে থাকে হৃদয়ের কোণে। মহিলা হাজীদের বেলায় এটি বেশি লক্ষ করা যায়। হজ একান্তই ব্যক্তিগত আমল। ব্যক্তিগত জীবনে আল্লাহর নৈকট্য লাভ ও তাঁর সন্তুষ্টি হাসিলের জন্যই হাজী হজ করে থাকেন। তা সত্ত্বেও সামাজিক, রাজনৈতিক ও আন্তর্জাতিক েেত্র হজের বিরাট গুরুত্ব রয়েছে। বস্তুত হজের মওসুম এমন এক বসন্ত মওসুম, যার আগমনে নতুন প্রত্যয়ে উদ্দীপ্ত হয়ে ওঠে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে থাকা মুসলিম উম্মাহ। এ কারণেই হজের মওসুমে বিভিন্ন দেশ থেকে লাখ লাখ মানুষ হাজার হাজার মাইল পথ অতিক্রম করে বায়তুল্লাহ জিয়ারতে ছুটে আসে। যারা হজে গমন করেন, তারা তো ধর্মীয় চেতনায় উদ্দীপ্ত থাকেনই অনুরূপভাবে তাদের আত্মীয়স্বজন যারা হাজীদের বিদায় সম্ভাষণ এবং ফেরার পর অভ্যর্থনা জানান এবং হাজীদের থেকে হজের বিস্তারিত শুনে তাদের মধ্যেও ধর্মীয় দিক থেকে নবচেতনার উন্মেষ ঘটে। এমনিভাবে হাজীদের কাফেলা যে স্থান দিয়ে অতিক্রম করে তাদের দেখে এবং তাদের ‘লাব্বাইক’ আওয়াজ শুনে সেখানকার কত মানুষের দিল ধর্মীয় ভাবধারায় আপ্লুত হয়ে ওঠে এবং কত মানুষের অবচেতন আত্মায় হজ করার উৎসাহ জেগে ওঠে তা সহজেই অনুমান করা যায়। বিভিন্ন দেশ থেকে আগত হজযাত্রীদের শারীরিক কাঠামো ভিন্ন, ভাষা ভিন্ন; কিন্তু মিকাতের নিকটবর্তী হয়ে তারা নিজেদের পোশাক খুলে একই ধরনের কাপড় পরিধান করেন, তখন তাদের মধ্যে একই আল্লাহর বান্দা হওয়ার চিহ্ন পরিলতি হয়। এভাবে সমবেত মুসলিম জনতা ভাষা, জাতি এবং দেশ ও গোত্রের কৃত্রিম বৈষম্য ভেঙে দিয়ে বিশ্বভ্রাতৃত্ব স্থাপনের বিরাট সুযোগ পায়। হজের মওসুমে এ চেতনা গোটা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। হজ নিয়ে আলোচনা করতে গেলে দু’টি স্মৃতি চোখের সামনে ভেসে আসে। ১. ইব্রাহিম আ: যখন মা হাজেরা আ: এবং শিশু ইসমাইল আ:-কে কাবাঘরের পাশে রেখে এলেন। তখন তাদের যে খাবার ও পানি দেয়া হয়েছিল তা শেষ হয়ে গেল, কিন্তু মা হাজেরা আ: আল্লাহর প্রতি আস্থা রাখলেন, যে প্রক্রিয়ায়ই হোক আল্লাহ খাবার ও পানির ব্যবস্থা করবেন। অন্য দিকে আল্লাহ রাববুল আলামিন দেখতে চাইলেন যে হাজেরা আ: আল্লাহর প্রতি কতটা আস্থাশীল হতে পারেন। জনমানবহীন এই এলাকায় খাবার নেই, পানি নেই, প্রতিবেশী নেই, ক্রমান্বয়ে মা হাজেরা আ: ও তার শিশুপুত্র ইমাইল আ: ক্ষুধায় কাতর হতে লাগলেন। মা হাজেরা আ: নিজের চিন্তা না করে সন্তানের জীবন বাঁচানোর তাগিদে পানির জন্য সাফা-মারওয়া পাহাড়ে ছোটাছুটি করতে লাগলেন। ছোটাছুটি করার পর পানির সন্ধান না পাওয়া শিশুপুত্র ইসমাইলকে কাবাঘরের দরজা থেকে একটু সামনে রেখে আল্লাহর কাছে দুই হাত তুলে কাঁদতে লাগলেন এবং চোখের পানি ছেড়ে বলতে লাগলেনÑ
দয়াময়, আমি জেনেছি তোমার সন্তুষ্টির জন্য আমাকে এবং আমার দুধের সন্তানকে নীরব-নিস্তব্ধ, জনমানবহীন এ অঞ্চলে রেখে যাওয়া হয়েছে। আমি জানি, আমি সব হারালেও তুমি আমার আছো। তাই তোমার কাছেই আমার আরাধনা, আমার এই দুধের শিশুর জন্য একটু পানির সুব্যবস্থা করে দাও। হে কাবাঘরের মালিক, আমার এই সন্তানকে তোমার কাছে রেখে যাচ্ছি আমি। এ পৃথিবীর কত প্রাণী তোমার এই জমিনের পানি পান করে বেঁচে থাকছে, আর আমার পুত্র যদি একটু পানি পান করে তাহলে তোমার এই বিশাল ভাণ্ডার থেকে পানির কমতি হবে না। এ কথা বলে যখন সামনের দিকে এগোতে লাগলেন, সেই মুহূর্তে ইসমাইলের আর্তচিৎকার মা হাজেরা আ:-এর হৃদয় স্পর্শ করল। এবার পেছনে ফিরে হাত দু’খানা আকাশের দিকে তুলে দিয়ে অশ্রুসিক্ত নয়নে বলতে লাগলেনÑ দয়াময় আল্লাহ, যদি আমার দুধের শিশু ইসমাইল একটু পানির আভাবে আমি মায়ের সামনে মারা যায়, তাহলে আমি যত দিন বেঁচে থাকব, তোমার জমিনের এক ফোঁটা পানিও পান করব না।
একজন নারীর এই আল্লাহর প্রেমের নিদর্শন দেখে মহিমাময় প্রভু পানির ব্যবস্থা করে দিলেন। এবং যত নারী-পুরুষই হজ ও ওমরা পালন করবেন, তারা সবাই সাফা-মারওয়া সায়ির মাধ্যমে কিছু সময়ের জন্য হলেও যেন মা হাজেরা আ:-এর মতো প্রভু-প্রেমিক হিসেবে নিজেকে আল্লাহর কাছে পেশ করেন; সেজন্য সায়ি করা হজ ও ওমরা পালনে একটি অবশ্যকরণীয় কাজ হিসেবে সাব্যস্ত করা হয়েছে। মা হাজেরা আ:-এর প্রভু-প্রেমের গভীরতা, এ থেকে নারী হজযাত্রীদের শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে। হজ পালনের মাধ্যমে মা হাজেরা আ:-এর মতো প্রভুপ্রেমিক হতে হবে। পাঠকদের যে বিষয় গুরুত্ব দিয়ে বলতে চাই, তা হলো বাংলাদেশ থেকে যেসব নারী হজযাত্রী হজ পালন করতে যাবেন, তাদের সাথে অবশ্যই একজন মাহরিম থাকতে হবে। হজের নিয়মকানুন মহিলা ও পুরুষদের বেলায় প্রায় সমান, তবে এহরাম বাঁধার ক্ষেত্রে পুরুষেরা যেভাবে দুটো সেলাইবিহীন কাপড় পরিধান করেন, নারীদের বেলায় এমনটি করতে হয় না। তারা স্বাভাবিকভাবে যে সালোয়ার-কামিজ পরিধান করেন, এহরামের সময় সেগুলো পরলেই চলবে। কোনো মা ঘর থেকে হজের উদ্দেশে যখন বের হবেন, তখনই তার জীবনের সর্বক্ষেত্রে পরিবর্তন সাধন করার অঙ্গীকারবদ্ধ হতে হবে। আল্লাহর বান্দি হিসেবে তার ঘরে রওনা দিয়ে হজকার্য সম্পাদনের মাধ্যমে তার বন্ধু হয়ে দেশে ফিরতে হবে। মক্কায় গমনের পর মাসজিদুল হারামে প্রবশে করেই রাসূলুল্লাহ সা: তাওয়াফ আরম্ভ করতেন। এটা আল্লাহর নির্ধারিত হজের পবিত্র অনুষ্ঠানাদি ও নিদর্শনের প্রতি সম্মান-শ্রদ্ধার উদাহরণ। আয়েশা রা:-এর বর্ণনা অনুসারে, ‘রাসূলুল্লাহ সা: যখন মক্কায় আগমন করলেন, শুরুতেই অজু করলেন ও তাওয়াফ সম্পাদন করলেন’ (সহি বুখারি, হাদিস নম্বর ১৬১৫)। রাসূলুল্লাহ সা: হাজরে আসওয়াদকে স্পর্শ করেছেন, চুমু খেয়েছেন, এর ওপর সিজদা করেছেন ও এর পাশে কেঁদেছেন। সুওয়াইদ ইবন গাফালাহ রা: বলেছেন, ‘আমি উমর রা:কে দেখেছি, তিনি হাজরে আসওয়াদকে চুমু খয়েছেন, আঁকড়ে থেকেছেন, এবং বলেছেন, আমি রাসূলুল্লাহ সা:-কে তোমার প্রতি অত্যধিক শ্রদ্ধাশীলরূপে দেখেছি (সহি মুসলিম, হাদিস নম্বর ১২৭১)। তাই নারী হজযাত্রীদের চেষ্টা করতে হবে মক্কা পৌঁছে যাতে দ্রুত হেরেমে পৌঁছা যায় ও ওমরার কাজ সেরে নেয়া যায়। একটি কথা মনে রাখতে হবে, তা হলো কাবাঘরের দিকে প্রথম তাকিয়ে যে দোয়া করা হয়, সেটিই কবুল হয়। তাই এমন কিছু আবেদন পেশ করতে হবে, যেগুলো জীবনের সবচেয়ে বড় পাওয়া হতে পারে। নারী হজযাত্রীদেরকে তাওয়াফ এ নামাজের আগে একটি জায়গা নির্দিষ্ট করে রাখতে হবে এবং মোবাইল ফোনে মাহরিম ও মোয়াল্লেমের নাম্বার সেভ করে রাখতে হবে। তাওয়াফরত অবস্থায় হারিয়ে গেলে মাহরিমকে খোঁজাখুঁজি না করে তাওয়াফ-সায়ি শেষ করে নির্দিষ্ট জায়গায় এসে ফোনে খোঁজ করতে হবে। অনেক সময় দেখেছি, প্রথম তাওয়াফেই আবেগপ্রবণ হয়ে হাজরে আসওয়াদ চুমু দিতে গিয়ে প্রচণ্ড চাপে পড়ে যায় এবং অসুস্থ হয়ে পড়ে; যে কারণে বাকি তাওয়াফ শেষ করা অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। এ ক্ষেত্রে প্রথম তাওয়াফে এ ধরনের ঝুঁকি না নিয়ে হোটেলে টেলিভিশনে কাবা শরিফের লাইফ প্রচার করা হয়ে থাকে; সেখানে দেখতে হবে কখন ভিড় কম থাকে, যখনই ভিড় কম থাকবে তখন হাজরে আসওয়াদ চুমু দেয়ার পরিকল্পনা নিয়ে তাওয়াফে নামতে হবে। তাওয়াফরত অবস্থায় নামাজের সময় হয়ে গেলে নামাজে দাঁড়িয়ে যেতে হবে। যেখানে তাওয়াফ শেষ হবে সেখান থেকে নামাজের পরে শুরু করতে হবে। নামাজের ব্যাপারে মহিলাদের আলাদা আলাদা বসতে বলা হয়। এ ক্ষেত্রে অনেক মহিলা বাড়াবাড়ি করেন, আলাদা বসতে চান না। এমনটি যেন না হয়। আবার অনেক সময় দেখা যায় একত্রে বেশ কয়েকজন বসে গল্প জুড়ে দেন। এটি ঠিক নয়। যত সময় হেরেমে থাকা হবে বন্দেগিতে কাটানোর চেষ্টা করতে হবে। হেরেমের চার পাশে মহিলাদের জন্য আলাদা টয়লেটের ব্যবস্থা আছে, যা ব্যবহার করতে হবে। সর্বক্ষণ চেষ্টা করতে হবে পর্দা রক্ষা করে চলার। বাড়িতে, মিনায়, আরাফায়, মুজদালিফায়। অবশ্য মিনা ও আরাফায় সৌদি মোয়াল্লেম কর্তৃক পর্দার ব্যবস্থা থাকে, তাতেও যদি যথার্থ না হয় তাহলে বাংলাদেশ থেকে একটি আলাদা চাদর ও কিছু রশি নিয়ে যেতে হবে। যা দিয়ে মহিলা হাজীগণ আলাদা পর্দার ব্যবস্থা করে নেবেন। হজের কোরবানির পশুর রক্ত আল্লাহর কাছে পৌঁছে না, বরং তোমাদের তাকওয়াই তার কাছে পৌঁছে (সূরা আল-হজ: ৩৭)। মহিলা হজযাত্রীদের যা যা সাথে নিতে হবে তা হলোÑ
* মেসওয়াক বা ব্রাশ ও টুথপেস্ট, তোয়ালে বা গামছা একটি
*বিছানার চাদর দু’টি
* প্লেট একটি, ছোট আয়না বা চিরুনি, গ্লাস একটি
* ব্যবহারের জন্য তেল, খিলাল বা টয়লেট পেপার, জুতা ও মোজা
* একটি বালিশ, ছোট হ্যান্ডব্যাগ একটি, গলায় ঝুলানো ব্যাগ একটি, বড় ব্যাগ একটি, পাথর রাখার ছোট ব্যাগ একটি, জুতো রাখার ব্যাগ একটি, পবিত্র হজ বিষয়ক ও প্রয়োজনীয় দোয়ার কিতাব
* ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন ও ওষুধ
* এক কেজি চিঁড়া ও আধা কেজি গুড়
* দুই সেট সালোয়ার-কামিজ।
লেখক : খতিব, ধানমন্ডি, ঢাকা

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button