ইসরাইলের বৈরি নীতির শিকার আল আকসা মসজিদ

Al Aqsaগত ৪ঠা অক্টোবর ৪০ জন উগ্র ইহুদীবাদী ধর্মীয় অনুষ্ঠান পালনের অজুহাতে মসজিদুল আকসায় অনুপ্রবেশের চেষ্টা চালায়। ইসরাইলী পুলিশ তাদের পাহারা দিয়ে নিয়ে যায়। কিন্তু ফিলিস্তিনী মুসলিম যুবকেরা ইহুদীবাদীদের মসজিদে প্রবেশ করতে দেয়নি। তারা মসজিদের প্রবেশপথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেন। ফলে উভয়পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ বাধে। তাৎক্ষণিকভাবে উগ্র ইহুদীবাদীরা ফিরে গেলেও তাদের পুনরায় অনুপ্রবেশের প্রচেষ্টা রোধ করতে ২০০ ফিলিস্তিনী তরুণ আল আকসা মসজিদের চারপাশে অবস্থান ধর্মঘট করেন। ইসরাইলী সেনারা তাদেরকে চারদিক থেকে ঘিরে অবস্থান গ্রহণ করে। ফিলিস্তিনী জনগণের তীব্র প্রতিরোধের কারণে ইসরাইলী সেনারা তাদের অবরোধ প্রত্যাহার করে নিতে বাধ্য হয়, ফলে ফিলিস্তিনী তরুণরাও তাদের অবস্থান ধর্মঘট প্রত্যাহার করে নেন। আজ আমরা এ সম্পর্কে আলোচনা করবো।
গত ১১ই অক্টোবর ইসরাইলী সেনারা মুসলমানদের প্রথম কেবলা মসজিদুল আকসার ওপর থেকে অবরোধ তুলে নেয়ার ফলে ঐ মসজিদকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট সংকট অনেকখানি কমে এসেছে। তবে ইসরাইল সরকারের আগ্রাসী নীতির প্রেক্ষাপটে এটা ভাবার কোন কারণ নেই, অস্থায়ী এই সেনা প্রত্যাহারের মাধ্যমে তেলআবিব চিরদিনের জন্য আল আকসা মসজিদের অবমাননা বন্ধ করবে। ইহুদীবাদীরা ১৯৬৭ সালে বাইতুল মোকাদ্দাস বা জেরুজালেম শহর দখল করার পর ঐ শহরে অবস্থিত মসজিদুল আকসা ধ্বংস এবং সেখানকার ফিলিস্তিনী অধিবাসীদের বহিষ্কারের পরিকল্পনা গ্রহণ করে। অবশ্য ইহুদীবাদীদের জন্য এ কাজ বাস্তবায়ন করা সহজ নয়। কারণ, মুসলমান, খ্রিস্টান ও ইহুদী- এই তিন ধর্মাবলম্বীদের কাছেই আল আকসা মসজিদ অত্যন্ত মর্যাদার স্থান। এটি মুসলমানদের প্রথম কেবলা এবং বিশ্বনবী হযরত মোহাম্মাদ (সা.) এই মসজিদ থেকে মেরাজ বা ঊর্ধ্বালোকে গমন করেছিলেন।
আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী দখলীকৃত ভূমির জনগণ এবং ধর্মীয় ও ঐতিহাসিক স্থানের নিরাপত্তা রক্ষা করা দখলদার শক্তির দায়িত্ব। কিন্তু ইহুদীবাদী ইসরাইল আন্তর্জাতিক ঐ আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে ৬ দিনের যুদ্ধে বাইতুল মোকাদ্দাস দখল করার পরপরই আল আকসা মসজিদ ধ্বংসের কাজ শুরু করে। ১৯৬৯ সালে একজন উগ্র ইহুদীবাদী এই ধর্মীয় স্থাপনার একটি অংশে আগুন ধরিয়ে দেয়। তখন থেকে ইসরাইল সরকারের প্রকাশ্য ও গোপন সমর্থন নিয়ে মুসলমানদের প্রথম কেবলার ওপর উগ্র ইহুদীবাদীদের হামলা চলতে থাকে। এখন মসজিদুল আকসার ভিত্তি নড়বড়ে করার লক্ষ্যে এর নিচ দিয়ে বহু টানেল খনন করা হয়েছে, যাতে কোন এক সময় মসজিদটি এমনিতেই ধসে পড়ে। কুদসের গভর্নর আদনান আল হোসেইনি আল আকসা মসজিদের নিচে খননকাজের ব্যাপারে সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, স্বল্পমাত্রার ভূমিকম্পেই এটি ধসে পড়বে।
জাতিসংঘ এবং ইউনেস্কো বহুবার আল আকসা মসজিদ ধ্বংসের ব্যাপারে ইসরাইলকে সতর্ক করে দিয়েছে। কিন্তু তেলআবিব সেসব সতর্ক বার্তায় কান না দিয়ে উল্টো তার ধ্বংসাত্মক তৎপরতা অব্যাহত রেখেছে। ইহুদীবাদীরা দাবি করছে, কথিত সোলায়মানের মন্দিরের ধ্বংসাবশেষের ওপর আল আকসা মসজিদ নির্মাণ করা হয়েছে। কাজেই এটি ধ্বংস করে পুনরায় সেখানে সোলায়মানের মন্দির স্থাপন করতে হবে। ইহুদীবাদীদের এ দাবির কিন্তু ঐতিহাসিক কোন সত্যতা পাওয়া যায়নি। মসজিদুল আকসা এমন একটি প্রাচীন পবিত্র স্থান যা গোটা মানবজাতির সম্পদ।
শুধু আল আকসা মসজিদ নয়, ইসরাইল বাইতুল মোকাদ্দাস বা জেরুজালেমের সকল মুসলিম ঐতিহাসিক নিদর্শন ধ্বংসের কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। তারা ঐ শহরকে ইহুদীকরণের লক্ষ্যে সেখানকার ফিলিস্তিনী জনগোষ্ঠিকে বিতাড়ন করছে। ফিলিস্তিনের আদিবাসিদের বিতাড়নের লক্ষ্যে তারা নানামুখী পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। ইহুদীবাদীরা একদিকে ফিলিস্তিনীদের বাড়িঘর ভেঙ্গে দিচ্ছে, অন্যদিকে নতুন নতুন উপশহর নির্মাণের মাধ্যমে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ধরে আনা ইহুদীদের বসবাসের স্থান করে দিচ্ছে। ইসরাইল সরকার এখন পর্যন্ত বাইতুল মোকাদ্দাসে উপশহর নির্মাণের মাধ্যমে প্রায় ২ লাখ ইহুদী অভিবাসীকে থাকতে দিয়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে যেসব ইহুদী অভিবাসী স্থায়ীভাবে বসবাসের লক্ষ্যে ইসরাইলে আসে, তাদের শতকরা ১০ ভাগকে জেরুজালেমে থাকতে দেয়া হয়।
বাইতুল মোকাদ্দাসের ইসলামী পরিচিতি মুছে ফেলার লক্ষ্যে ইহুদীবাদীরা সেখানকার বহু মসজিদ ও মুসলিম স্থাপনা ধ্বংস করে সেখানে ইহুদী উপাসনালয় নির্মাণ করেছে। গত কয়েক বছরে শহরটিতে ‘তাওরাতের পার্ক’ নামে বহু পার্ক তৈরি করা হয়েছে। ইহুদীবাদীরা কয়েক মাস আগে বাইতুল মোকাদ্দাসের বহু পুরনো একটি মুসলিম কবরস্থান ধ্বংস করেছে। ঐ কবরস্থানে বিশ্বনবী (সা.) এর বেশ কয়েকজন সাহাবীর কবর ছিলো। এছাড়া দখলদার ইসরাইলীরা ফিলিস্তিনের বহু স্থানের আরবি নাম পরিবর্তন করে হিব্রু ভাষায় নতুন নাম দিয়েছে।
কাজেই দেখা যাচ্ছে, মসজিদুল আকসাসহ বাইতুল মোকাদ্দাসের ফিলিস্তিনী অধিবাসীরা বহুমুখী চাপের মধ্যে রয়েছেন। ফিলিস্তিনের নির্বাচিত হামাস সরকারের প্রধানমন্ত্রী ইসমাইল হানিয়া এ সম্পর্কে বলেছেন, ‘দখলীকৃত কুদস শহর বর্তমানে এর ইতিহাসের সবচেয়ে কঠিন সময় অতিক্রম করছে।’ ইসরাইল সরকারের ধ্বংসাত্মক তৎপরতার পাশাপাশি উগ্র ইহুদীদের ৩৫টিরও বেশি সংগঠন বাইতুল মোকাদ্দাসের ইসলামী পরিচিতি মুছে ফেলার লক্ষ্যে কাজ করছে। কিন্তু এতসব অপতৎপরতা সত্ত্বেও ফিলিস্তিনী জনগণের প্রতিরোধ সংগ্রাম কিন্তু থেমে নেই। ফিলিস্তিনীরা তাদের বসতবাটি ও জমিজমা ধরে রাখতে সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন এবং অত্যন্ত সতর্কতার সাথে আল আকসা মসজিদ সংরক্ষণ করছেন। উগ্র ইহুদীবাদীদের সর্বসাম্প্রতিক ষড়যন্ত্র ফিলিস্তিনী জনগণের প্রজ্ঞা এবং মুসলিম বিশ্বের প্রতিবাদের কারণে ব্যর্থ হয়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন মুসলিম দেশে আল আকসা মসজিদের সমর্থনে মিছিল এবং ফিলিস্তিনী তরুণদের প্রতিরোধ আমাদেরকে একথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছে যে, ঐ পবিত্র স্থাপনার ব্যাপারে মুসলিম উম্মাহ এখনো অত্যন্ত স্পর্শকাতর।
রাজনৈতিক ভাষ্যকারদের মতে, বিশ্বের অধিকাংশ মুসলিম সরকারের ভ্রুক্ষেপহীনতার কারণে ইহুদীবাদী সরকারের আল আকসা মসজিদ ধ্বংসের লক্ষ্যে যা খুশি তাই করতে পারছে। ১৯৬৯ সালে ইহুদীবাদীরা মসজিদুল আকসায় আগুনে দেয়ার পর তার প্রতিবাদ জানাতে ওআইসি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো। কিন্তু বর্তমানে মুসলিম দেশগুলো আল আকসা মসজিদ ধ্বংসের ইসরাইলী প্রচেষ্টার ব্যাপারে কোন প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে না। এমনকি কোন কোন আরব দেশ ফিলিস্তিনীদের প্রতি সমর্থনের পরিবর্তে ইসরাইলের সাথে আপোষ প্রক্রিয়া শুরুর চেষ্টা করছে। আরো দুঃখজনক ব্যাপার হচ্ছে, এসব আরব দেশ গাজা উপত্যকা ও লেবাননের ওপর ইসরাইলী সামরিক আগ্রসানের প্রতিও সমর্থন জানিয়েছে। ফিলিস্তিনের রাজনৈতিক ভাষ্যকার সাঈদ আবু মাহফুজ এ সম্পর্কে বলেছেন, “আল আকসা মসজিদের প্রতি সমর্থনের ব্যাপারে আরব দেশগুলোর নীরবতার কারণে ইসরাইলীরা আরো বেশি ধৃষ্টতার সাথে মুসলমানদের প্রথম কেবলা ধ্বংসের তৎপরতায় মেতে উঠেছে।
অত্যন্ত দুঃখজনক ব্যাপার হচ্ছে, ফিলিস্তিনীরা তাদের অধিকার আদায়ের সংগ্রামের ক্ষেত্রে অভ্যন্তরীণ কিছু বিশ্বাসঘাতকের ষড়যন্ত্রের শিকার হচ্ছে। সম্প্রতি জাতিসংঘের তদন্ত কমিটি গাজায় যুদ্ধ অপরাধ চালানোর জন্য ইসরাইলকে অভিযুক্ত করেছে। গাজা উপত্যকায় আগ্রাসনের কারণে ইসরাইলী কর্মকর্তাদের বিচার করার প্রচেষ্টায় ঐ প্রতিবেদন সহায়ক হবে বলে ফিলিস্তিনী জনগণসহ গোটা মুসলিম উম্মাহর মধ্যে আশাবাদ সৃষ্টি হয়। ঠিক সে মুহূর্তে ফিলিস্তিনের স্বশাসন কর্তৃপক্ষের প্রধান মাহমুদ আব্বাস অবিশ্বাস্যভাবে জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদে ঐ তদন্ত প্রতিবেদন পর্যালোচনা করার বৈঠক স্থগিত রাখার আহ্বান জানান। মাহমুদ আব্বাসের এ পদক্ষেপ ছিলো ফিলিস্তিনী জনগণের প্রতি পেছন থেকে খঞ্জর মারার মতো ঘটনা। খুব স্বাভাবিকভাবেই ফিলিস্তিনী জনগণ তাদের পক্ষ থেকে সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য এ ধরনের বিশ্বাসঘাতকের ওপর আস্থা রাখতে পারে না। কাজেই তাকে সরিয়ে দেয়ার লক্ষ্যে ফিলিস্তিনী জনগণের প্রচেষ্টায় মুসলিম দেশ ও ইসলামপন্থী সংগঠনগুলোকে এগিয়ে আসতে হবে বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন।

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button