ভ্রান্তির বেড়াজালে ঈদে মিলাদুন্নবী

Muhammadমাইমুনা সুলতানা: মানবতার মুক্তির দিশারী রহমাতুল্লিল আলামীন হযরত মুহাম্মদ (সা:) আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত সর্বশ্রেষ্ঠ রাসূল ও সর্বোত্তম মানুষ। তিনি আল্লাহর কাছে যেমন সবচেয়ে প্রিয় তেমনি মানুষের কাছেও সর্বাধিক প্রিয় ও সম্মানিত। রাসূল (সা:) এর প্রতি এই ভালবাসা ঈমানের অন্যতম শর্ত। পবিত্র কুরআনে এসেছে-
“বলুন (হে নবী!) যদি তোমরা সত্যিই আল্লাহকে ভালবাস তবে আমার অনুসরণ করো, তাহলে আল্লাহ তোমাদেরকে ভালবাসবেন এবং তোমাদের অপরাধসমূহ ক্ষমা করে দেবেন।” (আলে ইমরান : ৩১)
রাসূল (সা:) নিজেও এ ব্যাপরে বলেছেন, হযরত আনাস (রা:) থেকে বর্ণিত, রাসূল (সা:) বলেছেন, “তোমাদের কেউ ততক্ষণ মুমিন হতে পারবে না, যতক্ষণ আমি তার কাছে তার পিতা-মাতা, সন্তান-সন্ততি এবং অপর সব মানুষের চেয়ে অধিক প্রিয় হব।” (বুখারী)
রাসূল (সা:) এর প্রতি ভালবাসা পোষণের যথার্থ দাবী হলো আল্লাহ ও তার রাসূলের (সা:) পূর্ণ আনুগত্য ও অনুসরণ। আর তা হতে হবে একমাত্র কুরআন- সুন্নাহ প্রদর্শিত পন্থায়। কুরআনে এরশাদ হয়েছে, “হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহর আনুগত্য করো, রাসূলের আনুগত্য করো এবং আমলসমূহ বিনষ্ট করো না” (মুহাম্মদ : ৩৩)
এই আয়াতটিতে আল্লাহ সতর্কবাণী দিয়েছেন, যদি ইসলামের বিধান পালনের ক্ষেত্রে আল্লাহ ও রাসূলের যথাযথ আনুগত্য করা না হয় তবে এই আমলগুলো বিনষ্ট হয়ে যাবে। উপরোক্ত মৌলিক কিছু  দৃষ্টিভঙ্গি সামনে রেখে আমরা আজকের আলোচনায়  ঈদে মিলাদুন্নবী পালনের যৌক্তিকতা ও প্রয়োজনীয়তা এবং এ ব্যাপারে ইসলামের বিধান কি তা অনুসন্ধান করার চেষ্টা করব।
মিলাদুন্নবী দিবস কোনটি?
বর্তমানে বাংলাদেশসহ বিশ্বের  অনেক দেশে খুব আয়োজন করে ঈদে মিলাদুন্নবী উদযাপন করা হয়। ঈদে মিলাদুন্নবী কথাটির প্রায়োগিক অর্থ হলো- নবী (সা:) এর জন্ম উপলক্ষে আনন্দ-উৎসব করা হয়। তা জন্ম দিনেই হোক  বা জন্ম উপলক্ষে অন্য কোন দিনেই হোক। যেহেতু রাসূল (সা:) এর জন্ম নিয়ে আলোচনা হচ্ছে তাই এ প্রসঙ্গে তাঁর জন্ম তারিখটা সামনে আসা প্রয়োজন। সর্বপ্রথম জ্ঞানের মূল উৎস কুরআনুল কারীমের দিকে দৃষ্টি দিলে আমরা এ ব্যাপারে কোন তথ্য লাভ করতে পারি না। দ্বিতীয়ত, হাদীস অনুসন্ধান করে আমরা দুটি বিষয় জানতে পারি । (এক) রাসূল (সা) সোমবার দিনে জন্মগ্রহণ করেছেন। (আবু কাতাদা রা. থেকে, সহিহ মুসলিম:২/৮১৯)।
(দুই) রাসূল (সা) ‘হাতির’ বছরে জন্মগ্রহণ করেছেন। (হযরত উসমান (রা:), তিরমিযী- ৩৬১৯) এছাড়া রাসূল (সা:) এর জন্ম তারিখ সম্পর্কে  তাঁর নিজের বা সাহাবাদের পক্ষ থেকে কোন নির্ভরযোগ্য বর্ণনা বা উদ্ধৃতি হাদীস গ্রন্থসমূহে পাওয়া যায় না । তাই এ বিষয়ে মুসলিম ঐতিহাসিকগণ (ইবনে হিশাম, ইবনে সাদ,ইবনে কাসীর প্রমুখ) বিভিন্ন মত পোষণ করেছেন।
কারো মতে, তিনি রবিউল আউয়াল মাসের ২ তারিখ জন্মগ্রহণ করেন। এটি মাগাজী প্রণেতা মুহাদ্দিস আবু মা’শার নাজীহ এর অভিমত।
অন্য মতে, তাঁর জন্ম রবিউল আউয়াল মাসের ৮ তারিখ। এই মতটি দুইজন সাহাবী ইবনে আব্বাস ও জুবাইর ইবনে মুতয়িম (রা:) থেকে বর্ণিত। অধিকাংশ ঐতিহাসিক ও সিরাতুন্নবী বিশেষজ্ঞ এই মতটি গ্রহণ করেছেন।
অন্য মতে, রাসূল (সা:) এর জন্ম তারিখ ১০ রবিউল আউয়াল। এই মতটি ইমাম হুসাইনের পৌত্র মুহাম্মদ ইবন আলী আল বাকের থেকে বর্ণিত।
কারো মতে, রাসূল (সা:) এর জন্ম তারিখ  ১২ রবিউল এই মতটি প্রখ্যাত ঐতিহাসিক মুহাম্মদ ইবনে ইসহাক গ্রহণ করেছেন। তার এই তথ্যটির জন্য তিনি কোন সনদ উল্লেখ করেননি বিধায় অনেক গবেষক এই মতটি দূর্বল বলেছেন।
রাসূল (সা:) এর জন্ম তারিখ নিয়ে এই ব্যাপক মতানৈক্য থেকে দুটি বিষয় স্পষ্ট হয়ে যায়। এক) বর্তমানে ১২ রবিউল আউয়াল কে ঈদে মিলাদুন্নবী হিসেবে উদযাপন করার পিছনে কোন সুনির্দিষ্ট ঐতিহাসিক দলিল নেই। দুই) আরো যে বিষয়টি বুঝা যায় যে, রাসূল (সা:) নিজে, সাহাবাগণ বা তাবেয়ীগণ রাসূল (সা:) এর জন্মদিন উদযাপন করেন নি। যদি তারা তা করতেন, তাহলে তাঁর জন্ম তারিখ সবার কাছে স্পষ্ট হয়ে যেত। এ থেকে প্রতিয়মান হয়, মিলাদুন্নবী উদযাপন রাসূল (সা:) প্রদর্শিত  এবং সাহাবাগণ অনুসৃত শরীয়তের অংশ নয়। বরং পরবর্তীতে প্রচলিত একটি নতুন প্রথা। যা শরীয়তের ভাষায় সুস্পষ্ট বিদআত।
মিলাদুন্নবী উদযাপনের পক্ষের ও বিপক্ষের সকল আলেম ও গবেষক একমত যে, ইসলামের প্রথম শতাব্দীগুলোতে মিলাদুন্নবী উদযাপনের কোন প্রচলন ছিল না। প্রখ্যাত আলেম ও ঐতিহাসিক আল্লামা ইবনে হাজর আল আসকালানী লিখেছেন: “ মাওলিদ (জন্মদিন) পালন মূলত বিদআত । ইসলামের সম্মানিত প্রথম তিন শতাব্দীর সালফে সালেহীনদের কোন একজনও এ কাজ করেন নি।” (আস-সালেহী, সিরাত : ১/৩৬৬)
এখানে যে বিষয়টি সর্বাধিক প্রণিধানযোগ্য তা হলো, হিজরী ২য়, ৩য় ও ৪র্থ শতাব্দীতে সংকলিত অর্ধশতাধিক সনদভিত্তিক হাদীসগ্রন্থসমূহে রাসূল (সা:) এর ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কর্ম, আচার আচরণ, কথা, অনুমোদন, সাহাবা ও তাবেয়ীদের মতামত ও কর্ম সংকলিত রয়েছে সে সকল গ্রন্থে একটিও সহীহ বা দুর্বল হাদীস দেখা যায় না যে, রাসূল (সা:) এর জীবদ্দশায় বা তাঁর মৃত্যুর পর কোন সাহাবী সামষ্টিক বা ব্যক্তিগতভাবে তাঁর জন্মদিন উদযাপনের জন্য কিছু করেছেন।
ঈদে মিলাদুন্নবী প্রবর্তন ও উদযাপনের ইতিহাস: উপরের আলোচনা থেকে স্পষ্ট হয়েছে যে, মিলাদ অনুষ্ঠান পরবর্তীকালে উদযাপন শুরু হয়েছে। প্রশ্ন হলো কবে থেকে এবং কে শুরু করলো ? ইতিহাস থেকে জানা যায়, দুই ঈদের বাইরে কোন দিবসকে সামাজিক ভাবে উদযাপন শুরু হয় হিজরী ৪র্থ শতাব্দীর মাঝামাঝি থেকে শিয়াদের উদ্যোগে। উবাইদ বংশের রাফেযী ইসমাঈলী শিয়াগণ ৩৫৮হি: সনে মিশর দখল করে ২ শতাব্দীরও অধিককাল শাসন করে। এ সময় তারা বিভিন্ন দিবস পালন করতো। বিশেষ করে রাসূল(সা), আলী (রা:), ফাতেমা (রা:), হাসান ও হুসাইন (রা:) এর জন্মদিন, এসবের মূল প্রর্বতক ছিল খলীফা আল মুয়িজ্জু লি-দীনিল্লাহ। ৫৬৭ হিজরীতে গাজী সালাহউদ্দীন আইয়ুবী মিশর বিজয় করে  এ সকল অনুষ্ঠান বন্ধ করে দিয়েছিলেন। (আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া)
এখানে উল্লেখ্য যে, মিশরের এইসব অনুষ্ঠানাদি তখনো মুসলিম বিশ্বের অন্যত্র ছড়িয়ে পড়েনি।  পরবর্তীতে যিনি ঈদে মিলাদুন্নবীকে মুসলিমবিশ্বের অন্যতম উৎসব হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছেন, তিনি হলেন, ইরাক অঞ্চলের ইরবিল প্রদেশের  আবু সাঈদ কুকবুরী । সে হিসেবে জানা যায়, ৭ম হিজরী থেকে আনুষ্ঠানিক মিলাদ উদযাপন শুরু হয়। মিলাদের উপর সর্বপ্রথম গ্রন্থ রচনা করে আবুল খাত্তাব ওমর ইবনে হাসান ইবনে দেহিয়া আল কালবী । এর উপর ভিত্তি করেই পরবর্তীতে অসংখ্য গ্রন্থ রচিত হয়। (আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া: ৯/২৬)
এই ইতিহাস প্রমাণ করে যে, ঈদে মিলাদুন্নবী শরীয়তের অংশ নয়, বরং নতুন সংযোজন বা বিদআত।
প্রচলিত বিদআতসমূহ: দীর্ঘ কয়েক শতাব্দী ধরে মুসলিম সমাজে পালিত হয়ে আসছে ঈদে মিলাদুন্নবী, সেই সাথে লালিত হচ্ছে অসংখ্য বিদআত যা শরীয়াতের মূলে কুঠারাঘাত করে তার ভীতকেই দুর্বল করে দিচ্ছে। সংক্ষেপে ঈদে মিলাদুন্নবী উদযাপনের মৌলিক ভ্রান্তিগুলো তুলে ধরা হলো-
দ্বীনের মধ্যে নতুন সংযোজন: এই উৎসবটি কুরআন, সুন্নাহ ও সাহাবাগণ কর্তৃক সমর্থিত নয়। রাসূল সা. বলেন, “আমি তোমাদেরকে আমার এবং আমার পরবর্তী সঠিক পথপ্রাপ্ত খলীফাদের অনুসরণের ব্যাপারে তাগিদ দিচ্ছি, তোমরা একে দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরে থাক। (দ্বীনের মধ্যে) নব উদ্ভাবিত বিষয় সম্পর্কে সাবধান হও, কেননা প্রতিটি উদ্ভাবিত বিষয়ই বিদআত এবং প্রতিটি বিদআতই ভ্রষ্টতা।” (আহমাদ, তিরমিযী)
বিজাতীয়দের অনুকরণ: মুসলিম সমাজে মিলাদুন্নবী উদযাপনের রীতি এসেছে খ্রীষ্টানদের বড়দিন পালনের প্রথা থেকে। হাদীসে এসেছে, “যে কেউ কোন জাতির অনুসরণ করে, সে তাদেরই একজন হিসেবে পরিগণিত।” (আহমাদ, আবু দাউদ)
সম্মান প্রদর্শনে বাড়াবাড়ি:  এ সকল অনুষ্ঠানমালায় রাসূল সা. এর প্রতি সম্মান প্রদর্শনে সীমাহীন বাড়াবাড়ি করা হয়, এমনকি তিনি বা তাঁর রূহ সেখানে উপস্থিত হয় বলে ধারণা করা হয় যা সুস্পষ্ট শিরক।
রাসূল রা. বলেন, “আমাকে এমনভাবে প্রশংসা করোনা, যেমনভাবে খ্রীষ্টানরা মরিয়মের পুত্রকে করে থাকে। কেননা আমি তাঁর বান্দাহ মাত্র। সুতরাং আমার সম্পর্কে বল; আল্লাহর বান্দাহ ও রাসূল।” (বুখারী)
কিয়াম করা: এসব অনুষ্ঠানে রাসূল সা. এর জীবনী বর্ণনা করতে গিয়ে তাঁর সম্মানার্থে কিয়াম করা হয়, যা রাসূল সা. কখনো সমর্থন করেন নি। “হযরত আবু ইমামের বর্ণনা, তিনি বলেন, নবী করীম (সা:) লাঠির উপর ভর দিয়ে আমাদের সামনে আসলেন। তখন আমরা তাঁর তাজিমের (সম্মান) জন্য দাঁড়িয়ে গেলাম। নবী করীম (সা:) বললেন, অমুসলিম লোকেরা যেমন পরস্পরের তাজিমের জন্য দাঁড়ায় তোমরা তেমন করে দাঁড়াবে না।”
দিবস উদযাপন: একটি নির্দিষ্ট দিনে মিলাদ অনুষ্ঠান করা হয়, অথচ শরীয়ত দিবস নির্ধারণ/উদযাপনের অনুমতি দেয় না। হাদীসে এসেছে- “রাতসমূহের মধ্যে কেবল জুমার রাতকে তাহাজ্জুদের জন্য এবং শুক্রবারকে নফল রোজার জন্য বিশেষভাবে নির্ধারণ করে নিও না। এটাও বিজাতীয়দের অনুকরণ।”
ব্যাপক অপচয়: মিলাদ অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে গিয়ে আলোকসজ্জা, বিলাসী খাবার, মিষ্টান্নের ব্যবস্থা ইত্যাদিতে অনেক অর্থ ও সময়ের অপচয় হয়। শরীয়তে যার কোন ভিত্তি নেই। রাসূল সা. বলেন, “অপচয়কারী শয়তানের ভাই।”
অনৈসলামিক ক্রিয়াকলাপ: এসব অনুষ্ঠানে নাচ-গান, নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশাসহ অনেক ধরনের ইসলাম বিরোধী কাজ হয়।
বিদআতে হাসানার ভ্রান্ত যুক্তি: অনেকে এই অনুষ্ঠানকে বিদআতে হাসানা বা উত্তম বিদআত বলে জায়েজ প্রমাণের চেষ্টা করে। অথচ রাসূল সা. বলেন, “প্রতিটি বিদআতই ভ্রষ্টতা।” (আহমাদ)
এটা অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় যে, আমরা রাসূল (সা:) কে সম্মান প্রদর্শন করতে গিয়ে তাঁর কাছ থেকে পাওয়া কুরআন সুন্নাহর বিধানকেই সুস্পষ্টভাবে লংঘন করে চলছি। সাহাবা, তাবেয়ী ও তাবে-তাবেয়ীগণ আমাদের চেয়েও আল্লাহর রাসূলকে সা. অনেক বেশী ভালবাসতেন।
আর তারা এই ভালবাসার প্রমাণ দিয়েছেন তাঁর সুন্নাহর সর্বোত্তম অনুসরণের মাধ্যমে। তাই আমাদেরও উচিত প্রচলিত বিদআতের বেড়াজাল থেকে বেরিয়ে এসে কুরআন-সুন্নাহর যথার্থ অনুশীলনের মাধ্যমে নিজেদেরকে সফল করার চেষ্টা করা।

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button