সরকার স্বীকৃতি নিয়ে কওমি উলামার মধ্যে বিভক্তি সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছে

Mahfuzul Hoqueমাওলানা মাহফুজুল হক। রাজধানী ঢাকার অন্যতম বড় মাদরাসা জামিআ রাহমানিয়া আরাবিয়ার প্রিন্সিপাল। তার আরেকটি বড় পরিচয় তিনি শায়খুল হাদীস আল্লামা আজিজুল হক রহ.-এর বড় ছেলে। দীর্ঘদিন ধরে তিনি বাংলাদেশ কওমি মাদরাসা শিক্ষাবোর্ডের সহ-সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। রাজনীতির ময়দানে সরব আছেন শায়খুল হাদীস প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের নায়েবে আমির হিসেবে। এছাড়া হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় নেতা তিনি। সম্প্রতি কওমি মাদরাসার সনদের স্বীকৃতি, হেফাজতে ইসলাম, কওমি শিক্ষাব্যবস্থাসহ আরো নানা বিষয়ে তিনি কথা বলেন সাপ্তাহিক লিখনীর সঙ্গে। তার সঙ্গে কথা বলেছেন সালাহউদ্দীন জাহাঙ্গীর ও এহসান সিরাজ।
লিখনী : কওমি মাদরাসার স্বীকৃতি নিয়ে সম্প্রতি যে প্রীতিকর-অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটছে, এই ঘটনাগুলোকে আপনি কোন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখছেন?
মাওলানা মাহফুজুল হক : এখানে তো আসলে আমার ব্যক্তিগত কোনো দৃষ্টিকোণ নেই। আমি যেহেতু কওমি মাদরাসার শিক্ষাবিষয়ক একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে দীর্ঘদিন যাবত যুক্ত আছি সে কারণে আমার যে মতামত সেটা বেফাকের বক্তব্য হিসেবেই গণ্য হবে।
স্বীকৃতির দাবিটা প্রথম যখন তোলা হয় তখন কওমি মাদরাসার জন্য সেটাকে ভালো মনে করেই তোলা হয়েছিলো এবং এ জন্য বিভিন্নমুখী পদক্ষেপও গ্রহণ করা হয়েছিলো। এই স্বীকৃতির বড় দিকটা হলো, এর দ্বারা কওমি আলেমদের একটা সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধি পাবে এবং সামাজিকভাবে আলেমদের দ্বীনি কাজ করার ক্ষেত্র আরো বিস্তৃত ও গ্রহণযোগ্য হবে। এমন একটা চিন্তা নিয়েই সনদের স্বীকৃতির প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছি এবং এর জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ এবং আন্দোলন হয়েছে। সেই সঙ্গে ওলামায়ে কেরাম এটাও চেয়েছেন, এই স্বীকৃতির নামে সরকারি কোনো হস্তক্ষেপ বা নিয়ন্ত্রণ যেন কওমি মাদারাসার ওপর না আসে। এটাই স্বীকৃতির সবচেয়ে খারাপ এবং চিন্তার দিক। শুরু থেকে আজ পর্যন্ত যারা স্বীকৃতির দাবি করছেন, তারা এই বিষয়টির ওপর পূর্ণ লক্ষ্য রেখেই তাদের দাবিতে অটল আছেন। এটাই মূলত আমাদের দাবি।
লিখনী : সরকার আপনাদের শিক্ষাকে সরকারি স্বীকৃতি দেবে অথচ তারা আপনাদের কোনোভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না, এটা কীভাবে সম্ভব?
মাওলানা মাহফুজুল হক : হ্যাঁ, এটা অবশ্যই সম্ভব। বৃটিশ আমলে ভারতের দারুল উলুম দেওবন্দের সনদের স্বীকৃতি ছিলো এবং এখন পর্যন্ত আছে। সেই স্বীকৃতির কারণে দারুল উলুম দেওবন্দসহ ভারতের বড় বড় মাদরাসার ওপর সরকারের কোনো ধরনের নিয়ন্ত্রণ নেই।
লিখনী : এই স্বীকৃতিটা কি শুধু দারুল উলুম দেওবন্দকেন্দ্রিক নাকি পুরো ভারতের কওমি মাদরাসাগুলোরও একইভাবে স্বীকৃতি দেয়া হয়?
মাওলানা মাহফুজুল হক : পুরো ভারতের ব্যাপারটা আমার জানা নেই। দারুল উলুম দেওবন্দের ব্যাপারটা আমার পুরোপুরি জানা আছে। সেখানকার বড় বড় সব কওমি মাদরাসার সনদের স্বীকৃতি আছে এবং সরকার এসব মাদরাসায় কোনো ধরনের হস্তক্ষেপ করেন না।
লিখনী : পাকিস্তানে স্বীকৃতির ব্যাপারটা কেমন?
মাওলানা মাহফুজুল হক : পাকিস্তানেও একইভাবে কওমি মাদরাসার সনদের স্বীকৃতি আছে, তবে সেগুলোর মধ্যে সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত নেই। তাদের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন বিগত প্রেসিডেন্ট পারভেজ মোশাররফ। এর প্রতিবাদে পাকিস্তানের আলেমরা বলেছিলেন, দরকার হলে আমরা গাছের নিচে বসে শিক্ষাদান করবো, তবুও সরকারের নিয়ন্ত্রণ মেনে নেবো না। লাল মসজিদ ট্রাজেডিও এই দাবিকে কেন্দ্র করেই ঘটেছিলো।
লিখনী : আপনার কি মনে হয় বর্তমান সরকার যেভাবে স্বীকৃতি দিতে চাচ্ছে, সেভাবে কওমি মাদরাসার উপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা হবে?
মাওলানা মাহফুজুল হক : হ্যাঁ, আমরা মনে করি বর্তমানে যে আলোকে স্বীকৃতি দেয়া হচ্ছে এবং স্বীকৃতির জন্য যেভাবে কিছু মানুষ মাঠে নেমে গেছে তাতে সরকারি হস্তক্ষেপ এবং সরকারের নিয়ন্ত্রণ আবশ্যিকভাবেই কওমি মাদরাসাকে গ্রাস করবে।
লিখনী : অনেক বড় বড় আলেমই স্বীকৃতির ব্যাপারে ইতিবাচক কথা বলেছেন এবং সরকারের এই শর্তের মধ্যেই স্বীকৃতি নিতে আগ্রহী।
মাওলানা মাহফুজুল হক : যারা এটাকে সাধুবাদ জানাচ্ছেন, আমার মনে হয় তাদের কাছে স্বীকৃতির ভালো দিকটাই কেবল দেখানো হয়েছে এবং তারাও শুধু এর ভালো দিকটাই দেখছেন। স্বীকৃতির খারাপ দিকটা হয়তো তারা এখন পর্যন্ত সেভাবে বুঝে ওঠতে পারেননি। কারণ এই স্বীকৃতিদানের ব্যাপারে সরকারের কিছু লোকও কাজ করছে। এই লোকগুলো এই আলেমদের সামনে স্বীকৃতির শুধু ভালো দিকটাই তুলে ধরছে। এর খারাপ দিকগুলো তারা সেভাবে বুঝতে পারছেন না বা বুঝতে দেয়া হচ্ছে না।
লিখনী : অনেকেই অভিযোগ করে বলছেন, আওয়ামী লীগ সরকার স্বীকৃতি দেয়ার কারণে আপনারা স্বীকৃতি নিচ্ছেন না। বিএনপি সরকার দিলে ঠিকই নিয়ে নিতেন!
মাওলানা মাহফুজুল হক : এ কথাটা বাস্তবতার নিরীখে সত্য নয় বলে আমি প্রমাণ করবো এভাবেÑ এই সরকারের আমলে বেফাকুল মাদারিসসহ হেফাজতের নেতৃবৃন্দ, যাদের ব্যাপারে এসব কথা বলা হচ্ছে তারাই স্বীকৃতির ব্যাপারে এই সরকারের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে এতো ব্যাপকভাবে দুই দুইবার সাক্ষাৎ করেছেন যে ইতোপূর্বে আর কোনো আলেম বা কেউ সাক্ষাৎ করেননি। কিছুদিন আগে যে কওমি মাদরাসার জন্য কমিশন গঠন হলো, সেটা নিয়ে নানা বিতর্ক জন্ম নিয়েছে। তবুও বিতর্ককে পিছনে ফেলে তারা আলোচনা এগিয়ে নিয়ে গিয়েছেন। যদি তারা এই সরকারের অধীনে স্বীকৃতি নিবেন না, এমন মনোভাব রাখতেন তাহলে তারা সরকারের কোনো কার্যক্রমেই সহযোগিতা করতেন না।
লিখনী : বর্তমান সরকার যে পদ্ধতিতে স্বীকৃতি দিতে চাচ্ছে সেখানে আপনাদের দাবির সঙ্গে কী কী অসামঞ্জস্য দেখতে পাচ্ছেন?
মাওলানা মাহফুজুল হক : আমরা মৌলিক যে অসামঞ্জস্য দেখছি, স্বীকৃতি দেয়ার যে প্রক্রিয়াÑ তারা একটা কমিশন গঠন করবে, সেখানে একজন চেয়ারম্যান থাকবে, কিছু সদস্য থাকবে। তবে সেখানকার সবাই কওমি ঘরানারই হবেন, শুধু যুগ্মসচিব বা এই পর্যায়ের একজন কমিশনে থাকবেন। এখন প্রশ্ন হলো, এই যে কমিশন গঠন করার কথা বলা হচ্ছে, এই কমিশন গঠন করবে কে? গঠন করবে সরকার। চেয়ারম্যান নিয়োগ দিবে সরকার, সদস্য নিয়োগ দিবে সরকার এবং এই নিয়োগটা খসড়া আইন অনুযায়ী আমরা দেখতে পাচ্ছি, সেটা একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত হবে। দুই বছর, তিন বছর বা পাঁচ বছরÑ একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত এই নিয়োগ বলবৎ থাকবে। তারপর নতুন সদস্য নেয়া হবে। আবার সরকার চাইলে যে কোনো সময় যে কোনো সদস্যকে বাদ দিয়ে নতুন সদস্য নিতে পারে। সুতরাং দেখা যাচ্ছে, কওমি মাদরাসার সনদের ব্যাপারে সার্বিকভাবে এই কমিশনই মূল অথরিটির ভূমিকা পালন করবে এবং এই অথরিটিকে পরিচালনা করবে সরকার। আর যখন সরকার কর্তৃক কওমি মাদরাসায় কোনোভাবে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা হয়ে যাবে তখন সেখানে কওমি মাদরাসার স্বাতন্ত্র্য বলতে আর কিছু থাকবে বলে আমার মনে হয় না। আমরা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি, এই স্বীকৃতি দ্বারা সরকার সেই পথই সুগম করছে।
লিখনী : আপনারা কোন পদ্ধতিতে স্বীকৃতি চাচ্ছেন?
মাওলানা মাহফুজুল হক : বাংলাদেশে কওমি মাদরাসার শিক্ষার মান উন্নয়ন এবং সার্বিক কল্যাণ কামনায় একটি প্রতিষ্ঠান ৩৫ বছর ধরে কাজ করে আসছে। সেটি বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশ (বেফাক)। তারা তাদের কর্মদক্ষতা, পরীক্ষা নিয়ন্ত্রণ, ঐক্যবদ্ধ কার্যক্রম দিয়ে প্রমাণ করতে পেরেছে যে, তারা এই দেশের কওমি মাদরাসার জন্য কাজ করতে সবার চেয়ে অগ্রগামী এবং দক্ষ। ঢাকার মাত্র দুটি মাদরাসা বাদে সব মাদরাসাই এই বোর্ডের অধীনে। এর বাইরে সারাদেশের ৮০ ভাগের বেশি মাদরাসার শিক্ষা-কার্যক্রমের নিয়ন্ত্রণ বেফাকের হাতে। এসব মাদরাসার শিক্ষা-কার্যক্রমের উন্নয়নে বেফাক কিন্তু তাদের যোগ্যতা প্রমাণ করেছে। এখন কওমি মাদরাসার ভালোর জন্য, উন্নয়নের জন্য যদি স্বীকৃতি দেয়া হয় তবে সেটা বেফাকের অধীনেই দেয়া হোক। এর জন্য কিছু লোককে যদি বেফাকের সঙ্গে যুক্ত করতে হয় তবে সেটা আলোচনার মাধ্যমে করা হোক এবং এ ব্যাপারে বেফাক আন্তরিক। এভাবে যদি স্বীকৃতি দেয়া হয় তবেই সেটা সরকারের নিয়ন্ত্রণমুক্ত থাকবে বলে আমরা মনে করি।
লিখনী : আওয়ামী লীগ সরকার যদি আপনাদের এ দাবি মেনে নিয়ে স্বীকৃতি দেয় তাহলে কি আপনারা স্বীকৃতি নেবেন?
মাওলানা মাহফুজুল হক : অবশ্যই। এই সরকারের আমলে আমরা সনদের স্বীকৃতি চেয়ে স্মারকলিপি দিয়েছি। আমরা যদি স্বীকৃতি নাই-ই চাইতাম তাহলে স্মারকলিপি দিতে যাবো কেনো?
লিখনী : এই স্বীকৃতি দেয়া-না দেয়ার ব্যাপারে ধারণা করা হচ্ছে রাজনীতি একটা বড় ফ্যাক্টর। আপনার দৃষ্টিতে এই স্বীকৃতির ব্যাপারে রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা কতোটুকু?
মাওলানা মাহফুজুল হক : রাজনৈতিক কিছু সংশ্লিষ্টতা এখানে থাকতে পারে। সরকারি দল-বিরোধী দল রাজনীতি করে। কওমি আলেমরাও ব্যাপকভাবে রাজনীতি করেন। এসব এড়িয়ে সরকার এবং কওমি আলেমরা যদি একটি সমঝোতায় আসতে পারেন তাহলে স্বীকৃতি সম্ভবপর বলে আমি মনে করি।
লিখনী : স্বীকৃতি নিয়ে বলা হচ্ছে, সরকারের শর্ত অনুযায়ী স্বীকৃতি যদি দেয়া হয় তাহলেও সরকারের লাভ। এতে সরকার কওমি মাদরাসার উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারবে। আর যদি স্বীকৃতি না-ও দেয় তবু তারা কওমি আলেমদের মাঝে স্বীকৃতির পক্ষ-বিপক্ষ নিয়ে একটা বিভেদ সৃষ্টি করতে পারবে। দু’দিকেই সরকারের লাভ। ব্যাপারটিকে কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন?
মাওলানা মাহফুজুল হক : এ ব্যাপারে আমরা আগে থেকেই বলছি, প্রথম থেকেই স্বীকৃতি নিয়ে সরকারের কার্যক্রমে একটা ষড়যন্ত্র একটা চক্রান্তের আভাস পাই। স্বীকৃতি নিয়ে প্রথমদিকে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে যখন বৈঠক হলো তখনই কমিশন গঠনের ব্যাপারে চূড়ান্ত আলোচনা হয়। তখন স্বীকৃতি নিয়ে দুটি পক্ষ ছিলো। কিন্তু বাস্তবতার আলোকে কমিশন গঠনের ক্ষেত্রে যাদের প্রাধান্য দেয়া দরকার তাদের প্রাধান্য দেয়া হয় না। আবার তারা বলে আপনারা ঐক্যবদ্ধ হয়ে আসতে পারছেন না এজন্য স্বীকৃতি দেয়া হচ্ছে না। দোষটা আমাদের ঘাড়ে রেখে বিষয়টিকে তারা দীর্ঘদিন এড়িয়ে গেছে।
লিখনী : অনেকে বলছেন, এখানে স্বীকৃতিটাই তো মুখ্য, সেটা কওমি অঙ্গনের যে কারো অধীনে হলেই তো হয়।
মাওলানা মাহফুজুল হক : ব্যাপারটা আপনি নির্বাচন দিয়ে চিন্তা করুন। নির্বাচনে সবাই কিন্তু এক দলকে ভোট দেয় না। যারা বেশি ভোট পায় তারাই সরকার গঠন করে। অধিকাংশের ম্যান্ডেটটাই ধর্তব্য। কওমি মাদরাসার কমিশন গঠনে সরকার এই পদ্ধতিকে সম্পূর্ণভাবে এড়িয়ে গেছে। তারা যদি সারাদেশের মাদরাসার দায়িত্বশীলদের নিয়ে বসে দেখতো যে তারা যেটা চায় সেভাবেই কমিশন গঠন করা হবে। কিন্তু তারা সেদিকে না গিয়ে দীর্ঘদিন এ স্বীকৃতির ব্যাপারটি আটকে রাখে। তারা শুধু বলেÑ আপনারা ঐক্যবদ্ধ হয়ে আসেন।
দীর্ঘ সময় যাওয়ার পরে ২০১২ সালে যখন কমিশন গঠন করা হলো, কমিশন গঠনের সেই বৈঠকে মাত্র দুজন কওমি আলেম ছিলেন। একজন মাওলানা ফরীদউদ্দীন মাসঊদ অন্যজন মাওলানা রুহুল আমীন। তারপরও বেফাকের দায়িত্বশীলরা মনে করলেন, কওমি মাদরাসার স্বীকৃতিটা যখন দরকার এবং তারাও যেহেতু আমাদেরই লোক-কওমি আলেম, তাদের দ্বারাই কওমি কমিশন গঠন হোক। উনারা যেটা চাচ্ছেন সেটাই হোক, আবার আমরা যে দাবিগুলো করছি সেগুলো উনাদের মাধ্যমেই বাস্তবায়িত হোক। সেমতে তাদেরকে সহযোগিতার আশ্বাস দেয়া হলো এবং বলা হলো, বেফাক যেহেতু বড় প্রতিষ্ঠান সে হিসেবে বেফাকেরও দু-একজন প্রতিনিধি আপনারা কমিশনে রাখেন। কিন্তু তারা সে ব্যাপারে রাজি হলেন না। এই কাজটির মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছিলেন ইসলামিক ফাউন্ডেশনের ডিজি সামীম আফজাল। তাকে বলা হলে তিনি প্রথমে আশ্বাস দিলেও পরবর্তীতে তাদের বাধার সম্মুখীন হয়ে এ দাবিকে নাকচ করে দেন।
যা হোক, সরকার এই দুজনকে নিয়েই পরবর্তীতে কওমি কমিশন গঠন করে ফেললেন। এরপর এ দুজনের সঙ্গে ঘরোয়াভাবে দীর্ঘ আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে বেফাকের মহাসচিব মাওলানা আব্দুল জব্বার সাহেবকে সে কমিশনে রাখা হয়। এসব ঘরোয়া বৈঠকে কিছু শর্তের ব্যাপারে দুই পক্ষই সম্মত হয়। এরপর সরকারিভাবে কমিশনের প্রথম বৈঠকে গিয়ে এই দুইজন পূর্বে আলোচিত এবং সম্মত হওয়া সমস্ত শর্ত অস্বীকার করে বসেন।
এই বৈঠকের পর বেফাকের নীতি নির্ধারণী কমিটির বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়, আমাদের শর্ত মেনে কমিশন গঠন করতে হলে আমাদের দাবি অনুযায়ী সেটা শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে গেজেট আকারে প্রকাশ করতে হবে। এর আগে আমরা কমিশনের আর কোনো বৈঠকে যাবো না এবং চেয়ারম্যানও কমিশনের কোনো বৈঠক ডাকবেন না।
এরপর এ নিয়ে আলোচনা একদম চুপচাপ। দীর্ঘদিন পর কোনো রকমের কোনো মিটিং ছাড়াই হঠাৎ তারা কমিশনের রিপোর্ট পেশ করে সবাইকে বোকা বানিয়ে দেন। কিন্তু চেয়ারম্যান সংবাদ সম্মেলন করে এই রিপোর্ট প্রত্যাখ্যান করেন। তবু তাদের কার্যক্রম থেমে নেই। সর্বশেষ ১৩ এপ্রিল ২০১৩ তারা প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করে কমিশনের রিপোর্ট পেশ করে। অথচ সেই রিপোর্টে চেয়ারম্যানের কোনো সম্মতি বা স্বাক্ষর নেই। অথবা স্বাক্ষর জাল করে ব্যবহার করে।
তো শুরু থেকেই আমরা দেখতে পাচ্ছি, সরকার সনদের স্বীকৃতির ব্যাপারে কখনোই আন্তরিক নয় এবং এই স্বীকৃতি নিয়ে তারা শুধু ষড়যন্ত্রই করে আসছে। ভালো কিছু এখন পর্যন্ত জাতিকে দিতে পারেনি।
লিখনী : কওমি মাদরাসা নিয়ে সরকারের এ ষড়যন্ত্র কি উদ্দেশ্যমূলক?
মাওলানা মাহফুজুল হক : আমার অন্তত তাই মনে হয়। কারণ বাংলাদেশে ইসলামের সঠিক শিক্ষা একমাত্র কওমি মাদরাসাতেই রয়েছে। এই কওমি মাদরাসাই যুগ যুগ ধরে এ দেশে ইসলামকে সঠিকভাবে মানুষের সামনে উপস্থাপন করছে। এখন সরকার চাচ্ছে যে কোনোভাবে এই শিক্ষাধারাকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে। আর ক্ষতিগ্রস্ত করার অন্যতম উপায় হচ্ছে বেফাকুল মাদারিসকে কোনোভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করা। বেফাক যেহেতু বাংলাদেশের কওমি মাদরাসার অন্যতম অভিভাবক, তাই তারা এটিকে নিষ্ক্রিয় কিংবা নিয়ন্ত্রণ করার জন্যই এই ষড়যন্ত্রমূলক কার্যক্রম চালাচ্ছে।
এখন সরকার যদি তাদের এই ষড়যন্ত্রে সফল না-ও হতে পারে তারপরও তাদের লাভ। কারণ এর দ্বারা তারা কওমি উলামার মধ্যে একটি বিভেদ-বিভক্তি সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছে। সরকার এই উদ্দেশ্যমূলক কাজ দ্বারা মূল দু’দিক থেকেই লাভবান হয়েছে। আর আমরাও ভুল করে সরকারের পাতা ফাঁদে পা দিয়ে আমাদের স্বীকৃতিকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছি।
লিখনী : আপনারা কি মনে করেন, আপনারা যে শর্ত দিয়ে স্বীকৃতি চাচ্ছেন, ভবিষ্যতে বিএনপি সরকার যদি ক্ষমতায় আসে তাহলে তারা কি আপনাদের এই শর্ত মেনে নিয়ে স্বীকৃতি দেবে?
মাওলানা মাহফুজুল হক : আমরা মনে করি, কোনো সরকারই সহজে এই স্বীকৃতি দিতে চাইবে না। বাংলাদেশে ঘুরেফিরে দুটি দলই ক্ষমতায় আসে। আওয়ামী লীগ নিজেরাও ধর্মনিরপেক্ষতার প্রবক্তা, আবার তাদের ঘাড়ে ভর করে আছে বামপন্থীরা। অপরদিকে বিএনপি তারাও ইসলামের যে খুব দরদিবন্ধু তা-ও বলা যাবে না। তার ওপর তাদের ঘাড়ে ভর করে আছে কওমিপন্থীদের অপছন্দের দল জামায়াতে ইসলামী। সে কারণে স্বীকৃতির ব্যাপারটি কোনো সরকারের আমলেই খুব সহজে পাওয়া যাবে বলে আমি মনে করি না।
লিখনী : এবার হেফাজতে ইসলাম প্রসঙ্গে আসি। নভেম্বর মাসজুড়ে আপনাদের কর্মসূচি পালনের কথা রয়েছে। সে কর্মসূচি বাস্তবায়নে হেফাজতের তৎপরতা দেখা যাচ্ছে না।
মাওলানা মাহফুজুল হক : নভেম্বরের এক তারিখে আমাদের সমাবেশ করার কথা ছিলো। কিন্তু দেশের পরিবর্তিত পরিস্থিতি এবং একই দিনে আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি সমাবেশ ঘোষণায় আমরা সে সমাবেশ প্রত্যাহার করি। এছাড়া সারা দেশব্যাপী আমাদের যে কর্মসূচি হওয়ার কথা সেগুলো যথানিয়মে অনুষ্ঠিত হবে।
লিখনী : কওমি কমিশনের ব্যাপারটি তো মন্ত্রিসভার বৈঠক থেকে বাতিল করা হয়েছে। এখন তো হেফাজতের দাবি অনুযায়ী আর কোনো কর্মসূচি না দেয়ারই কথা। কারণ এই ইস্যু নিয়েই হেফাজত নতুন কর্মসূচির ডাক দিয়েছিলো।
মাওলানা মাহফুজুল হক : যদিও কমিশন গঠনের ব্যাপারটি পিছিয়েছে সেটি কিন্তু একেবারে শেষ হয়ে যায়নি। আবার যারা এর পেছনে কাজ করছিলো তারা কিন্তু এখনও মাঠে তৎপর। তারা নানা তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। তাদের প্রতিহত করতে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়া ছাড়া গত্যন্তর নেই। এছাড়াও হেফাজতের অনেক নেতৃবৃন্দ কারাগারে মিথ্যা মামলায় কারাভোগ করছেন, তাদের মুক্তির দাবি আমাদের অন্যতম ইস্যু। মুফতি মুহাম্মদ ওয়াক্কাস, হারুন ইজহারসহ অনেক নেতাকর্মী জেলে আছেন। সর্বোপরি হেফাজতের ১৩ দফা দাবি তো রয়েছেই। সুতরাং আমাদের কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়া ছাড়া কোনো উপায় নেই।
লিখনী : হেফাজতের আন্দোলনে আখেরে লাভ হলো বিএনপি-জামায়াতেরÑ রাজনীতি সচেতন মানুষের এই বক্তব্যকে কীভাবে খ-ন করবেন?
মাওলানা মাহফুজুল হক : এটা খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার। একটা শক্তি যদি একজনের বিরুদ্ধে যায় তাহলে তার বিরুদ্ধে যে থাকবে সেটা অবশ্যই তার পক্ষে যাবে। এটা আমরা হেফাজত চাইলেও যাবে না চাইলেও যাবে। শত্রুর শত্রু যেমন বন্ধু হয় তেমন আর কি! আমরা কুরআন শরিফেও সুরা রুমের প্রথম আয়াতে দেখতে পাই সেখানে মুসলমানদের রোমীয়দের পরাজয়ের সুসংবাদ দেয়া হয়েছে। অথচ তখন পর্যন্ত মুসলমানদের সঙ্গে রোমানদের কোনো ধরনের যুদ্ধ-বিগ্রহ কিছুই হয়নি। তবুও তারা যেহেতু শত্রুর শত্রু ছিলো তাই তাদের পরাজয়ই মুসলমানদের সান্ত¦নার কারণ বলা হয়েছিলো। সুতরাং আমার কাজের দ্বারা আরেকজনের যদি লাভ হয় তাই বলে তো আমি আমার কাজকে ফেলে রাখতে পারি না।
লিখনী : আপনার কি মনে হয় বিগত পাঁচ সিটি নির্বাচনের মতো আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও হেফাজত বড় ফ্যাক্টর হয়ে দেখা দেবে?
মাওলানা মাহফুজুল হক : এই সরকার ইসলামের বিপক্ষে তাদের কঠোর অবস্থানকে একেবারে পরিষ্কার করে দিয়েছে। বিশেষ করে গণজাগরণ মঞ্চকে সমর্থন দিয়ে দেশের ধর্মপ্রাণ মানুষের মনে গভীরভাবে রেখাপাত করেছে। সুতরাং স্বাভাবিকভাবেই এই দলের বিপক্ষে যারা থাকবে তাদের পক্ষে জনগণের ম্যান্ডেটটা যাবে, এটাই স্বাভাবিক। তবে এখানে যেহেতু এখন রাজনীতির একটা বড় ফ্যাক্টর হয়ে দাঁড়িয়েছে, তাই তাদের উচিত আগামীতে যারা ক্ষমতায় আসবে তাদের কাছ থেকে এখনই দাবি-দাওয়া আদায় করে নেয়া। কারণ ক্ষমতায় গেলে অধিকাংশ মানুষই অতীত ভুলে যায়। এটা ক্ষমতার একটা পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া।
লিখনী : মাদরাসার শিক্ষা প্রসঙ্গে আসি। বর্তমান মাদরাসা শিক্ষাকে আপনি কতোটা যুগোপযোগী মনে করেন?
মাওলানা মাহফুজুল হক : এ ক্ষেত্রে আমাদের উলামায়ে কেরাম যতোটা অগ্রসর হয়েছেন আমি মনেকরি এটা যথেষ্ট এবং যুগের সঙ্গে সামঞ্জস্যশীল। বেফাকের সিলেবাসে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত সাধারণ শিক্ষা অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। আরও বাড়ানো যায় কি-না সে ব্যাপারে আলাপ-আলোচনা হচ্ছে। সর্বোপরি আমি মনেকরি আমাদের মাদরাসাগুলো থেকে যেসব ছাত্র পাস করে বের হচ্ছে তারা সমাজ বিনির্মাণে যথেষ্ট ভূমিকা পালন করছে। সবচে’ বড় কথা হলো, আমাদের সনদের স্বীকৃতিটা যদি হয়ে যায়, তাহলে এই বিশাল কওমিগোষ্ঠী সরকারের নানা পর্যায়ে কাজ করার সুযোগ পাবে এবং দেশের কাজে সবার সঙ্গে সমান তালে ভূমিকা রাখতে পারবে বলে আমার বিশ্বাস।
লিখনী : এখন টেকনোলজির যুগ। সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই আধুনিক তথ্য-প্রযুক্তির দিকটিকে যথেষ্ট গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। সে তুলনায় মাদরাসায় এখন পর্যন্ত সেভাবে প্রযুক্তির ছোঁয়া লাগেনি। এভাবে চলতে থাকলে মাদরাসার ছেলেরা কি যুগের তুলনায় পিছিয়ে পড়বে না?
মাওলানা মাহফুজুল হক : আসলে আমাদের মাদরাসার অনেক সীমাবদ্ধতা আছে। তবে এটার প্রয়োজনীয়তা আমরা কখনোই অস্বীকার করি না। দারুল উলুম দেওবন্দে প্রযুক্তিকে যথেষ্ট গুরুত্ব দেয়া হয় এবং সে অনুযায়ী শিক্ষাদান করা হয়। বাংলাদেশেরও অনেক বড় এবং যাদের সাধ্য আছে এমন মাদরাসা এ ব্যাপারে যথেষ্ট উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। আবার এর মধ্যে ভালোর দিকটা যেমন আছে তেমনি মন্দ দিকটাও আছে। অনেক সময় ভালোর নিয়তে সুযোগ দিলেও দেখা যায় সেখানে মন্দটাই বেশি প্রভাবিত হয়। তবে যথেষ্ট তত্ত্বাবধায়ন করে এটিকে কাজে লাগানো যেতে পারে। আমরা আমাদের সাধ্যমতো সে ব্যাপারে পদক্ষেপ নেবো বলে আশা করি।
লিখনী : বর্তমান সমাজব্যবস্থায় কওমি মাদরাসার প্রয়োজনীয়তা এবং এর ভবিষ্যতকে আপনি কীভাবে চিত্রায়িত করবেন?
মাওলানা মাহফুজুল হক : পেছনের কয়েক বছরের শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে যদি জরিপ করা হয় তাহলে দেখা যাবে কওমি মাদরাসা কতোটা দ্রুত বাংলাদেশের প্রতিটি আনাচে কানাচে ছড়িয়ে পড়ছে। সাধারণ মানুষ পার্থিব শিক্ষাব্যবস্থা দেখে হতাশ। তারা এখান থেকে ভালো কিছুর আশা ছেড়ে দিয়েছেন। তারা সামাজিক কোনো শান্তি, নিরাপত্তা দিতে পারছে না। দুর্নীতি থেকে সমাজকে মুক্ত করতে পারছে না। এই কারণে মানুষ এখন প্রবলভাবে কওমি মাদরাসার দিকে ঝুঁকছে। আমি মনেকরি, এই শিক্ষাব্যবস্থাকে যদি সঠিকভাবে পরিচর্যা করা হয় তবে অদূর ভবিষ্যতে এই শিক্ষাব্যবস্থাই মানবতাকে শান্তির সোপান এনে দিতে পারবে।
লিখনী : সম্প্রতি মহিলা মাদরাসার প্রসার ব্যাপকভাবে লক্ষ করা যাচ্ছে। এ ব্যাপারে আপনার অভিমত কী?
মাওলানা মাহফুজুল হক : মহিলা মাদরাসা আসলে খুবই সেনসিটিভ একটি বিষয়। অনেক আলেম এটা অপছন্দ করেন। একটা সময় ছিলো যখন মেয়েদের অল্প কিছু শিক্ষা গ্রহণ করলেই চলতো। সমাজের সঙ্গে তারা মানিয়ে নিতে পারতেন। বাধ্যতামূলক কোনো শিক্ষা ছিলো না। কিন্তু বর্তমান সমাজ পরিবেশটাই এমন হয়েছে যে, একটা মেয়ে সে যে মাধ্যমেই শিক্ষা নিক তাকে একটা সম্মানজনক পর্যায় পর্যন্ত শিক্ষা নিতে হয়। নইলে মেয়েকে তো বটেই তার অভিভাবকদেরকেও সমাজে খাটো হয়ে থাকতে হয়। এ কারণেই আমি মনেকরি, মহিলা মাদরাসার প্রয়োজনীয়তা আছে। তবে এর জন্য অধিক সতর্কতা অবলম্বন করা প্রয়োজন। মহিলা মাদরাসার পরিবেশ সুন্দর হওয়া প্রয়োজন। কিন্তু দেখা যায়, অধিকাংশ মহিলা মাদরাসার পরিবেশ মেয়েদের জন্য উপযোগী নয়। তাদের অধিক পরিচর্যা দরকার, কিন্তু সেভাবে মাদরাসাগুলোতে তাদের পরিচর্যা করা হয় না। তাদের সুন্দরভাবে তত্ত্বাবধান করা দরকার। এমন সব সমস্যাগুলোকে কাটিয়ে যদি মহিলা মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করা হয় তাহলে সেটা সমাজের জন্য উপকারী হবে বলেই আমি মনে করি।
লিখনী : আমাদেরকে সময় দেয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
মাওলানা মাহফুজুল হক : আপনাদেরকেও ধন্যবাদ।

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button