রাতারগুল আর লালাখালে উপচে পড়া ভিড়

জাফলং ভরে উঠেছে প্রাণের ছোঁয়ায়

jaflongকবির আহমদ ও গোলাম সারওয়ার বেলাল গোয়াইনঘাট ও জৈন্তাপুর (সিলেট) থেকে ফিরে: মুসলমানদের অন্যতম ধর্মীয় উৎসব ঈদুল ফিতরের টানা ৩ দিনের ছুটিতে কেউ সপরিবারে আবার কেউ বা বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে ছুটে এসেছেন সিলেটের বিভিন্ন পর্যটন স্পটগুলোতে। দেশের দক্ষিণ ও উত্তর প্রান্ত থেকে ছুটে আসা পর্যটকরা যেমনি আনন্দ আর উল্লাসে মেতে উঠেছেন তেমনি হয়রানির মধ্যে পড়তে হয়েছে অনেককে। টানা বৃষ্টি ও পাহাড়ী ঢলে নেমে আসা পানিতে মৌলভীবাজারে স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যা দেখা দেয়ায় সিলেটের পর্যটন স্পটগুলো লোকেলোকারণ্য। শ্রীমঙ্গলের চা বাগান আর মাধবকুন্ডের জলপ্রপাত দেখতে না পেরে মৌলভীবাজার শহরে হাঁটু পানি পাড়ি দিয়ে সুদূর হবিগঞ্জ ঘুরে সিলেটে জমায়েত হয়েছেন হাজারো পর্যটক। সিলেটের হোটেল মোটেলে তিল ধারণের ঠাঁই নেই। মালনীছড়া ও লাক্কাতুড়া চা বাগানে সিলেটে আসা হাজারো মানুষের যেমনি ভিড় রয়েছে তেমনি ভিড় রয়েছে হযরত শাহজালাল ও হযরত শাহপরাণ (রহ.) এর মাজারগুলোতে। প্রকৃতি কন্যা জাফলং ভরে উঠেছে পর্যটকদের প্রাণের ছোঁয়ায়। লালাখাল ও রাতারগুল যেন প্রতিনিয়ত পর্যটকদের হাতছানি দিয়ে ডাকছে। পুরুষ-মহিলা ও ছোটমনিরা পর্যটক স্পটের ডাকে সাড়া দিয়ে পাহাড়, টিলা ও সমতল ভূমিতে জড়ো হয়েছেন মহান আল্লাহপাকের অনেক নিদর্শনের অন্যতম নিদর্শন পাহাড়-টিলা আর ঝরণা দেখার জন্য। তবে বিছানাকান্দি যেতে প্রায় ৮ কিলোমিটার রাস্তা যেন মরণফাঁদ। সিলেটের জাফলং জলারবন্দ, রাতারগুল, বিছানাকান্দি ও লালাখাল পর্যটকদের পদচারণায় মুখর হয়ে উঠেছে। প্রকৃতি কন্যা জাফলং ভরে উঠেছে প্রাণের ছোঁয়ায়। রাতারগুল সোয়াম ফরেস্ট ও পান্তমাইয়ের ফাটাছড়া ঝর্ণাধারাও হাজারো পর্যটকের পদচারণায় মুখরিত। বিছানাকান্দিতে রয়েছে পর্যটকদের উপচে পড়া ভিড়। স্বপরিবারের লোকজন দেখলে সিলেটের সীমান্তবর্তী গোয়াইনঘাট উপজেলার হাদারপাড়ের নৌকার মাঝিরা দৌড়ে আসে পর্যটকদের কাছে। রিজার্ভ নৌকা করে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখার জন্য বা ভ্রমণ করার জন্য অনুরোধের যেন শেষ নেই। কিন্তু দামতো চড়া। শুদ্ধ ভাষায় কথা বলতে শুনলে যাওয়া-আসা ৩শ থেকে ৬শ টাকার স্থলে ৩ হাজার টাকা দাম হাকে নৌকার মাঝিরা। এ যেন আরেক বিড়ম্বনা।
ভারতের মেঘালয় পর্বতের পাদদেশে নৈসর্গিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি সিলেটের জাফলং দেশী-বিদেশী পর্যটকদের কাছে খুবই পরিচিত। পাহাড়, টিলা আর সমতল ভূমিতে সারি সারি চা বাগানের সবুজের সমারোহ। অপরূপ রূপের চাদর মোড়ানো পাহাড় আর সেই পাহাড়ের পাশ ঘেষে বয়ে গেছে পিয়াইন নদী। বিশেষ করে বল্লাঘাটের জিরো পয়েন্টে ডাউকী নদীর উপর ঝুলন্ত ব্রীজ আরো বেশী আকৃষ্ট করে জাফলংয়ে আসা হাজারো পর্যটকদের। এই জন্য হয়তো প্রকৃতি কন্যা জাফলংয়ে থাকে মানুষের উপচে পড়া ভিড়। ঈদের দিন শনিবার বিকেল থেকে গতকাল মঙ্গলবার বিকেল পর্যন্ত হাজার হাজার পর্যটকদের পদচারণায় মুখরিত ছিল সিলেটের জাফলং, লালাখাল ও বিছানাকান্দি। পর্যটন এলাকার কোথাও যেন তিল ধারণের ঠাঁই নেই। জাফলংয়ের মোহাম্মদপুর থেকে শুরু করে বল্লাঘাট পর্যন্ত কয়েক শতাধিক পর্যটকবাহী গাড়ী। রাস্তাঘাট ও রেস্টুরেন্টের সম্মুখ ছাড়াও পাথর রাখার মাঠ ও ক্রাসার মেশিন জোন এলাকায় এলাপাতাড়িভাবে গাড়ী দাঁড়িয়ে থাকায় সিলেট-তামাবিল মহাসড়কে প্রচন্ড যানজটের সৃষ্টি হয়। আর জৈন্তাপুর উপজেলার সারিঘাটের বাম দিক থেকে বিছানাকান্দি যাওয়ার রাস্তা প্রায় ৩৫ কিলোমিটার। এই রাস্তার প্রায় ৮ কিলোমিটার যেন ঝুকিপূর্ণ ও মরণফাঁদ। বিছানাকান্দি যাওয়া-আসা সব আনন্দ ম্লান হয়ে যায় এই ভাঙ্গা রাস্তার কারণে। বড় বড় গর্ত দেখে মনে হয় এ যেন কিছুক্ষণ পর পর ছোঁ ছোঁ পুকুর। এগুলোর কারণে ক্ষুব্ধ হাজারো পর্যটক। বিছানাকান্দিতে দেখা হয় দৈনিক জালালাবাদের জেনারেল ম্যানেজার (জিএম) শফিকুর রহমান-এর সাথে। তিনি তার স্ত্রী কবি হাফসা শফিক ও একমাত্র পুত্র খালিদ সাইফুল্লাহকে নিয়ে প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্যের লীলাভূমি বিছানাকান্দিতে এসেছেন কিছু সময় কাটানোর জন্য। সাবেক কলেজ শিক্ষক বর্তমান সিলেটের জিন্দাবাজারস্থ আল হামরা শপিং সিটিতে অবস্থিত হিজাব ফ্যাশনের সত্বাধিকারী সফল ব্যবসায়ী কবি হাফসা শফিক এই প্রতিবেদককে জানান, ঈদের ছুটিতে বিছানাকান্দি ঘুরতে স্বামী ও একমাত্র পুত্র সন্তানকে নিয়ে এসেছি। কিন্তু রাস্তার যে অবস্থা এতে এই পর্যটন এলাকা পর্যটকদের জন্য আশির্বাদের পরিবর্তে অভিশাপে পরিণত হয়েছে। তিনি এই রাস্তা সংস্কারের জোর দাবি জানান। ঘর থেকে নিজ হাতে রান্œা তৈরি করে নিয়ে এসেছেন এই কবি। তবে খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা ভালো রয়েছে বলে জানান। স্যানিটেশন ব্যবস্থা সরকার পর্যটকদের জন্য চালু করার দাবি জানান কবি হাফসা শফিক। তিনি আরো জানান, বেসরকারী উদ্যোগে গড়ে উঠা প্রতিষ্ঠানে ৫০ টাকায় টয়লেট করা যায় ও পোষাক পরিবর্তনের জন্য ২০ টাকা নেয়া হয়। যা হাজারো পর্যটকদের জন্য যথেষ্ট নয়। এরপরও প্রাকৃতিক দৃশ্যপট দেখে সবাই মুগ্ধ। রাস্তাঘাটে বেহাল দশার কারণে একটু মন খারাপ তাদের। কবি হাফসা শফিকের মনে বার বার একটি প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে এতো সুন্দর জায়গার যোগাযোগ ব্যবস্থা এতো নাজুক কেন?
প্রকৃতির এক অপরূপ দান লালাখাল: স্বচ্ছ পানিতে নীল আকাশের রং, দু’পাশে পাথুরে টিলা আর সবুজ বন, অনতিদূরে ভারতের মেঘমাখা আকাশছোঁয়া পাহাড়। পাহাড় আর টিলার ঢালুতে বিস্তৃত চা গাছের মায়াবী বাগান যেন নিসর্গকে করেছে আরো বেশি ব্যঞ্জনাময়। এপার-ওপার দিয়ে বিনে সুতে মালা গাঁথছে ছোট্ট নৌকাগুলো। লোকজন আসে, প্রাণ ভরে দেখে আর তৃপ্তির ঢেকুর তুলে পুনরায় দেখার আকুতি নিয়ে চলে যায় আপন গন্তব্যে। মহান আল্লাহ পাকের গুণগান, প্রকৃতির তারিফ করা তাদের গল্প আর ছবিগুলো কেবলই ডানা মেলে, অনুপ্রাণিত করে দেশ-বিদেশের পর্যটকদের। নিজ এলাকায় গিয়ে প্রাকৃতিক লীলাভূমি লালাখালের প্রশংসায় পঞ্চমুখর হয় পর্যটকরা। প্রলুব্ধ হয়ে আরও বেশি দর্শক আসে, এভাবে মানুষের আনাগোনা কেবলই বাড়তে থাকে রূপের রাণী লালাখালে।
সিলেটের জৈন্তাপুর উপজেলার সীমান্তবর্তী প্রকৃতির এক অপরূপ দান লালাখাল। প্রকৃতি তার আপন হাতে একান্ত খাতির করে রূপ-সৌন্দর্যের সবটুকু দিয়ে সাজিয়েছে এ স্থানটিকে। পাহাড়-টিলা-অরণ্য আর নদী যেন ব্যতিক্রমি মিতালী পাতিয়েছে এখানে। সারি নদী লালাখালের প্রাণ। ভারতের জৈন্তা পার্বত্য জেলার মিহ-মাইথ্রু নামক স্থান থেকে উৎপত্তি লাভ করে আঁকা-বাঁকা পাহাড়ি পথ পাড়ি দিয়ে লামু ও উমসিয়ারাং নদীকে সঙ্গী করে এটি বাংলাদেশে লালাখাল দিয়ে প্রবেশ করেছে। প্রাচীনকালের কোন এক সময়ে রূপের টানে দুর্গম পাহাড়ী দুরাঞ্চল হতে ছুটে এসেছে সারি, মিলিত হয়েছে লালাখালে, নিজের পাতানো মিতালীকে সে যেন করেছে আরও নিখুঁত আর আকর্ষণীয়।
লালাখাল হতে সারি নদী ক্রমশ চলে এসেছে পশ্চিম দিকে, সিলেট-তামাবিল সড়ক ভেদ করে গোয়াইন নাম ধারণ করে অগনিত জনপদ মাড়িয়ে সে ছুটে গেছে সাগরের পাণে। লালাখাল হতে সে একাই আসেনি, যেন সঙ্গী করে নিয়ে এসেছে রূপের ডালি। আকাশের নীল রং নিজের মধ্যে ধারণ করে সে নিজেকে অপ্সরী করে ক্ষান্ত হয়নি, চলতি পথে সর্বত্রই সে মুগ্ধ করেছে দর্শকদের। তাই আগত পর্যটক ও দর্শনার্থীরাও তার রূপ-সৌন্দর্য উপলব্ধির জন্য নদী ভ্রমণে বের হন। সারিঘাট হতে নৌকা ভ্রমণ করে হাজারো পর্যটক চলে যান লালাখালে। প্রাণজুড়ানো সে ভ্রমণের অভিজ্ঞতা যার আছে, কেবল সে-ই বলতে পারবে কত উপভোগ্য সে ভ্রমণ! প্রকৃতির রূপ অরূপের মতো নতুন রূপে ধরা দেয় দর্শনার্থীদের মনে।
অতি সম্প্রতি পর্যটকদের নদী পথে যাতায়াতের নিরাপত্তার জন্য জৈন্তাপুর উপজেলা পরিষদ হতে পর্যটকদের নিরাপত্তার জন্য লাইফ জ্যাকেট পর্যটন বহনকারী নৌকায় চালকদের মাঝে বিতরণ করা হয়েছে এবং পর্যটক করপোরেশনের অর্থায়নে লালাখাল নামক স্থানে নৌকা থেকে নিরাপদে উটা-নামার জন্য একটি ঘাট নির্মান করা হয়েছে। এ ব্যাপারে জৈন্তাপুর উপজেলার নির্বাহী অফিসার (ভারপ্রাপ্ত) মুনতাসির হাসান পলাশ, দৈনিক সংগ্রামকে জানান পর্যটকদের যাতায়াত নির্বিঘেœ রাখতে প্রয়োজনীয় সকল ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। উপজেলা প্রশাসন কর্তৃক পর্যটকদের বহনকারী নৌকার ভাড়া নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে। সারি জিরো পয়েন্ট হতে লালাখাল পর্যন্ত পর্যটকদের কাছ থেকে নির্ধারিত ভাড়ার অতিরিক্ত কেউ আদায় করলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে এবং পর্যটকদের সার্বিক নিরাপত্তায় সংশ্লিষ্ট সকলকে সার্বিক সহযোগিতার অনুরোধ জানান। অপরদিকে সারিঘাট পর্যটক বহনকারী নৌকা শ্রমিক সংগঠনের সেক্রেটারি হারিছ উদ্দিন জানান, ঈদকে সামনে রেখে পর্যটকদের সুবিধার্তে ৩০টি নৌকা প্রস্তুত রাখা হয়েছে এবং প্রতিটি নৌকায় ০৫টি করে লাইফ জ্যাকেট রাখা হয়েছে। প্রতি নৌকায় ১০ জন করে যাত্রী বহন করা হবে ও ০৩ ঘন্টার জন্য ভাড়া নির্ধারন করা হযেছে ১২০০ টাকা করে। এছাড়া জাফলং ও লালাখাল এবং বিছানাকান্দি পর্যটন এলাকায় ভারতীয় স্বল্পদামী কসমেটিকে সয়লাভ হয়ে গিয়েছে। অরিজিনাল ইন্ডিয়ান শাল বলে (চাঁদর) কমদামী শাল বলে দর্শকদের হাতে চড়া দামে বিক্রি করা হচ্ছে। এতেও প্রতারিত হচ্ছেন হাজারো ক্রেতা সাধারণ।

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button