বাংলাদেশের দিকে তাকিয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত

ICCরোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে মিয়ানমারে সংঘটিত জাতিগত নিধনযজ্ঞের তদন্ত শুরুর অনুরোধ জানিয়ে এরইমধ্যে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে (আইসিসি) আবেদনপত্র জমা দেওয়া হয়েছে। বুধবার (৩০ মে) ৪০০ রোহিঙ্গা নারীর পক্ষে তাদের স্বাক্ষরিত আবেদনপত্রটি নেদারল্যান্ডসের হেগে অবস্থিত আন্তর্জাতিক আদালতে জমা দেন আইনজীবীরা। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, দিনদিন মিয়ানমারের গোয়ার্তুমি বাড়ছে। ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে আইসিসি-ই একমাত্র ভরসাস্থল। তবে আইসিসির অবস্থান নিয়েও সংশয়ী আইনবিশেষজ্ঞদের একাংশ। একে আরও কার্যকর প্রতিষ্ঠান হিসেবে দেখতে চান তারা। এমন বাস্তবতায়, নিউ ইয়র্ক টাইমসের এক বিশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মিয়ানমারের বিচার প্রশ্নে বাংলাদেশের অবস্থান কী হয়, তা জানার অপেক্ষায় রয়েছে আইসিসি। সেখানে থাকা বাংলাদেশি আইনবিশেষজ্ঞদের একাংশ মিয়ানমারের বিচারের দাবি জোরালো করার চেষ্টা করছে বলেও জানিয়েছে ওই সংবাদমাধ্যম।
গত বছরের আগস্টে রাখাইনে নিরাপত্তা বাহিনীর তল্লাশি চৌকিতে হামলার পর রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে পূর্বপরিকল্পিত ও কাঠামোবদ্ধ সহিংসতা জোরালো করে মিয়ানমার সেনাবাহিনী। খুন, ধর্ষণ ও অগ্নিসংযোগের মুখে বাংলাদেশে পালিয়ে আসে প্রায় সাত লাখ রোহিঙ্গা। মিয়ানমারে নিপীড়নের শিকার হয়ে পালিয়ে আসা এসব নারীর বেশিরভাগই নিরক্ষর। আদালেতে তাদের আবেদনটির পাশাপাশি আঙুলের ছাপযুক্ত ২০ পৃষ্ঠার একটি বেগুনি রংয়ের নথিও সংযুক্তি হিসেবে দেওয়া হয়েছে। একে আবেদনকারী ৪০০ রোহিঙ্গা নারীর স্বাক্ষরপত্র হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। আইনজীবীদের দাবি, মিয়ানমারকে বিচারের মুখোমুখি করা না গেলে রোহিঙ্গাদের ওপর নিপীড়ন চলতেই থাকবে।
আইসিসিতে জমা দেওয়া আবেদনপত্রে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের কাছে অনুরোধ করা হয় যেন আদালত রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে চলমান নৃশংসতা নিয়ে তদন্ত শুরু করে। মিয়ানমারে রোহিঙ্গা নিপীড়নকে জাতিসংঘ ও যুক্তরাষ্ট্র জাতিগত নিধনযজ্ঞ আখ্যা দিলেও আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালেতর এক্ষেত্রে হস্তক্ষেপ করার এখতিয়ার আছে কিনা তা নিয়ে চলমান বিতর্কের মধ্যেই আবেদনটি করা হলো। বুধবার রোহিঙ্গা নারীদের পিটিশনে বলা হয়, ‘আমরা খুব অসহায় বোধ করছি। আমরা কষ্ট অনুভব করছি। পরিবারের সদস্যদের হারিয়ে ফেলার শূন্যতা আমরা নিতে পারছি না। আমরা জাতিসংঘ এবং আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের কাছ থেকে ন্যায়বিচার আশা করছি।’
নিউ ইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনে বলা হয়, এতোদিন পর্যন্ত রোহিঙ্গা নিপীড়নের ঘটনায় অপরাধীদের দায়মুক্তি দিতে দেখা গেছে। প্রত্যক্ষদর্শীদের অনেকে অভিযোগ করেছেন, মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর সদস্যরা ইউনিফর্ম পরেই ধর্ষণ ও বেসামরিকদের হত্যা করেছে। মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলছে, জবাবদিহিতার ঘাটতি থাকার বিষয়টি ধাক্কা খাওয়ার মতো। তাদের দাবি, রোহিঙ্গাদের ওপর মিয়ানমারে যে ধরনের নিপীড়ন সংঘটিত হয়েছে, একেবারেই সে ধরনের নৃশংসতার বিচার করতেই আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের সৃষ্টি। এর ম্যান্ডেট হলো মানবতাবিরোধী অপরাধ, যুদ্ধাপরাধ এবং গণহত্যার বিচার করা। প্রসিকিউটর এবং মানবাধিকারবিষয়ক আইনজীবীদরে মতে নিপীড়নের কারণে যেহেতু কয়েক লাখ রোহিঙ্গা মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে পালিয়ে গেছে, সেক্ষেত্রে বাংলাদেশের মাধ্যমে এ মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার হতে পারে। কারণ বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের সনদে স্বাক্ষরকারী দেশ। বাংলাদেশ অপরাধ সংঘটনের দায়ে সন্দেহভুক্ত নয়, কিন্তু এ দেশ রোহিঙ্গা নিধনের বিচারের পথ খুলে দিতে পারে।
নভেম্বরে বাংলাদেশের কুতুপালং ক্যাম্পে এক রোহিঙ্গা
বুধবার শান্তি মহিলা বা পিস উইমেন নামের সংগঠনটির পক্ষ থেকে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে আবেদন জানানো হয়। সংগঠনটির আইনজীবীরা বলেন, যতক্ষণ পর্যন্ত মিয়ানমার রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনকে না বলবে এবং তাদেরকে ভয়াবহ পরিস্থিতিতে থাকতে বাধ্য করবে, ততক্ষণ পর্যন্ত জাতিবিদ্বেষ, নিপীড়ন ও গণহত্যা চলতে থাকবে। আদালত যদি আবেদনে সাড়া দেয়, তবে আন্তর্জাতিক আইনের ক্ষেত্রে মৌলিক যাত্রার সূচনা হবে।
রোহিঙ্গা নিপীড়ন প্রশ্নে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত মিয়ানমারের বিচার করতে পারে কিনা–গত ৭ মে (সোমবার) সে ব্যাপারে বাংলাদেশের মতামত জানতে চেয়েছে রোমভিত্তিক আদালতটি। আইসিসির প্রি-ট্রায়াল চেম্বার এক চিঠিতে মিয়ানমারের বিচারের প্রশ্নে বাংলাদেশের মতামত জানতে চেয়েছে। ওই চিঠিতে বলা হয়েছে, ‘মিয়ানমার থেকে রোহিঙ্গা বিতাড়নে বাংলাদেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ফলে চেম্বার মনে করে বাংলাদেশের কাছ থেকে এ বিষয়ে মতামত চাওয়াটা সঠিক।’
চিঠিতে মূলত তিনটি বিষয়ে বাংলাদেশের মতামত চাওয়া হয়েছে। ১. মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে পালিয়ে আসার পর রোহিঙ্গাদের অবস্থা কী ২. রোহিঙ্গা বিতাড়ন বিষয়ে শুনানির জন্য আইসিসির কোনও অধিকার আছে কিনা এবং ৩. এ সংক্রান্ত অন্য যেকোনও প্রয়োজনীয় তথ্য প্রদান করার ব্যাপারে বাংলাদেশের অবস্থান কী। আগামী ৮ জুনের মধ্যে প্রকাশ্যে বা গোপনীয়ভাবে মতামত জানানোর জন্য অনুরোধ জানানো হয়েছে। পররাষ্ট্র সচিব মো. শহীদুল সে সময় এ ব্যাপারে বলেছেন, ‘আমরা তাদের অনুরোধ পেয়েছি এবং বিষয়টি বিবেচনা করছি।’ নিউ ইয়র্ক টাইমস তাদের বুধবারের প্রতিবেদনে জানিয়েছে, আইসিসি অপেক্ষায় আছে, এ বিচারের ইস্যুটি নিয়ে বাংলাদেশ সরকার কী বলে। ওই সংবাদমাধ্যম বলছে, আইসিসি যেন মিয়ানমারের বিচারের আবেদনের ব্যাপারে ইতিবাচক পদক্ষেপ নেয়, তার সমর্থনে বাংলাদেশি স্কলারদের একটি দল তৎপরতা শুরু করেছে।
মিয়ানমারে রোহিঙ্গা নিপীড়নের ঘটনায় হস্তক্ষেপ করার জন্য অনেকগুলো অনুরোধ পেয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত। কিন্তু প্রসিকিউটর এবং বিচারকরা এ প্রথমবারের মতো বিচার প্রশ্নটি নিয়ে বিবেচনা করছেন, বাংলাদেশকে পাটাতন হিসেবে দেখছেন তারা।
নিউ ইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনে বলা হয়, মিয়ানমার ও বাংলাদেশকে ছাড়িয়ে এ রুল আরও সুদূরপ্রসারী বাস্তবায়নের দিকে যেতে পারে। যেমন সিরিয়া আন্তর্জাতিক আদালতের সদস্য দেশ নয়, কিন্তু প্রতিবেশী দেশ জর্ডান এ আদালতের সদস্য। সিরিয়ায় নৃশংসতাকে কেন্দ্র করে কয়েক লাখ সিরীয় জর্ডানে পালিয়ে গেছে। মিয়ানমারের বিচারের ইস্যুটি সেসময় আন্তর্জাতিক আদালতে তোলা হলো যখন আদালত আফ্রিকার বড় বড় কয়েকটি মামলায় ব্যর্থতার পর তার ভাবমূর্তি ফিরিয়ে আনতে সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে।
জাতিগত নিধনযজ্ঞের শিকার হয়ে ৭ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আসে
বুধবার আন্তর্জাতিক আদালতে দায়ের করা পিটিশনে ৪০০ রোহিঙ্গার পক্ষের আইনজীবীরা দাবি করেন, মিয়ানমার সরকার নিপীড়নমূলক ও গণহত্যামূলক অভিযান অব্যাহত রেখেছে। রোহিঙ্গা নারীদের প্রতিনিধিত্বকারী মানবাধিকার আইনজীবী ওয়েন জোরডাশ বলেছেন, যদি একজন ব্যক্তিকেও অবৈধভাবে আটক করা হয়, তবে সে ব্যক্তি মুক্তি না পাওয়া অপরাধ শেষ হয় না। ‘একইরকম করে, অপরাধ এখনও চলছে। মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ শর্ত দিয়েছে, হয় দলটিকে বিলোপ করতে হবে অথবা তাদেরকে দেশে ফিরতে দেওয়া হবে না।’
মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলছে, আবেদনকারী ৪০০ রোহিঙ্গাসহ সকল রোহিঙ্গার জন্য ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক আদালত একমাত্র আশা। নিউ ইয়র্কভিত্তিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচের আন্তর্জাতিক বিচারসংক্রান্ত বিশেষজ্ঞ পরম-প্রীত সিং বলেন, ‘সময়ের সাথে সাথে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের গোয়ার্তুমি কমেনি, বরং বেড়েছে।’ তার মতে, ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করার একমাত্র পরিষ্কার পথ হলো আইসিসি। ‘এর বাইরে এসে, আপনি যদি চিন্তা করেন যে মিয়ানমার তার নিজ দেশের সেনা ও নিরাপত্তা বাহিনীর বিচার করবে, তো সেটা খুবই বাস্তবতাবর্জিত এক চিন্তা হবে।’ নিউ ইয়র্ক টাইমসকে বলেন ওই বিশেষজ্ঞ।
গত ২০ জুন, বিচারপতিদের একটি প্যানেল এসব প্রশ্ন নিয়ে একটি রুদ্ধদ্বার অধিবেশন করবেন। তবে তা নিয়ে সমালোচনা করেছেন আইনজীবীরা। লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনবিষয়ক অধ্যাপক কেভিন জন হেলার বলেন, আদালত রুল জারি করতে চাইলে কেন আদালতের অধিবেশন গোপনে হচ্ছে তা নিয়ে বিচারকদের ব্যাখ্যা দিতে হবে। সাম্প্রতিক এক ব্লগ পোস্টে কেভিন প্রশ্ন তুলেছেন, ‘বিচারব্যবস্থা হলো আইনের একটি বিশুদ্ধ ইস্যু, তাতে গোপনীয়তার যৌক্তিকতা কী?’
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আদালত কোন প্রক্রিয়ায় রুল জারি করবে তা স্পষ্ট নয়। লন্ডনের স্কুল অব ওরিয়েন্টাল অ্যান্ড আফ্রিকান স্টাডিজের রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ফিল ক্লার্ক মনে করেন, আইসিসি নামে পরিচিত আন্তর্জাতিক আদালতের আরও বেশি করে বৈশ্বিক হওয়ার বিশাল সুযোগ আছে। যদিও এ আদালত সম্প্রতি জর্জিয়া, আফগানিস্তান এবং ফিলিস্তিনি-ইসরায়েল সংঘাত নিয়ে তদন্ত শুরু করেছে। এর বড় বড় মামলাগুলোর বেশিরভাগই আফ্রিকা কেন্দ্রিক। ক্লার্ক আরও বলেন, ‘ঊর্ধ্বতন সরকারি কর্মকর্তা ও উচ্চ পর্যায়ের সেনা কর্মকর্তাদের সংঘটিত অপরাধের বিচারেরও তেমন কোনও নজির স্থাপন করতে পারেনি আন্তর্জাতিক আদালত।’ “নিউ ইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনে বলা হয়, এ আদালতের কোনও পুলিশ বাহিনী নেই এবং গ্রেফতার করার জন্য আদালতটি জাতীয় সরকারগুলোর ওপর নির্ভরশীল।

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button