নরেন্দ্র মোদির সত্যভাষণ এবং ভোজরাজের ইসলাম গ্রহণ

Islamকে. এস. সিদ্দিকী: ‘শক্কে কামার’ বা চাঁদ দ্বিখন্ডিত হওয়ার অলৌকিক ঘটনা প্রত্যক্ষ করে মালাবারের মহারাজা চেরুমাল পেরুমাল ভোজ (ভিন্ন বর্ণনায় পেরুমাল ভোজ উল্লেখ করা হয়েছে) মহানবী (স.)-এর দরবারে গিয়ে ইসলাম গ্রহণ করে তাঁর জীবনকে ধন্য করেছিলেন এবং মহানবী (স.) তাঁর নাম রেখেছিলেন ‘আব্দুল্লাহ’। তাঁরই মাধ্যমে ভারতে সর্ব প্রথম ইসলাম প্রচারিত হয় বলে ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়। তাঁর মতো ভারতে আরও যারা ইসলাম গ্রহণ করে জীবনকে ধন্য করেছেন যুগে যুগে, তাঁদের সঠিক সংখ্যা বলা কঠিন।
পবিত্র মাহে রমজান শুভাগমনে প্রতি বছর বিশ্ব নেতৃবৃন্দ রজমান, ঈদ প্রভৃতি ইসলামী অনুষ্ঠানাদি উপলক্ষে শুভেচ্ছাবাণী ও অভিনন্দনবার্তা প্রেরণ করে থাকেন। সেজন্য তাঁরা মুসলমানদের সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য। এবার রমজান মাস আগমনের পক্ষকাল পূর্বেই একটি ব্যতিক্রমধর্মী বার্তা এসেছে প্রতিবেশী ভারত থেকে। সে দেশের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ‘মহানবী (সা.)-এর জীবন অনুসরণ করা সকলের দায়িত্ব বলে অভিমত ব্যক্ত করেছেন।’ তার বক্তব্য পাঠ করলে বুঝা যায় যে, তিনি মহানবী (সা.)-এর আদর্শ শিক্ষা সম্পর্কে যথেষ্ট অবহিত। এজন্য তাঁকে ধন্যবাদ।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘সমতা ও ভ্রাতৃত্বপূর্ণ যে জীবন মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) পালন করেছেন তা অনুসরণ করা সকল মানুষের দায়িত্ব।’ অতি চমৎকার উক্তি, মহানবী (সা.)-এর বরাতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী আরও নানা শিক্ষা অনুসরণের উপদেশ প্রদান করেছেন সকলকে। তিনি ভারতসহ সমগ্র দুনিয়ার মানব সমাজের জন্য এ উপদেশ রেখেছেন। তিনি মহানবী (সা.)-এর মানবতা শিক্ষার কথা প্রসঙ্গে রমজান মাসের ‘রোজা’র তাৎপর্যও তুলে ধরেছেন। তাঁর এসব বক্তব্য প্রশংসা, সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য। ভবিষ্যতে তাঁর ইসলাম সংক্রান্ত এসব মূল্যবান কথা স্মরণীয় হয়ে থাকবে। হয়তো অনেকে এগুলোকে তাঁর অমর বাণী হিসেবে উদ্ধৃত করবে। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে, বহু অমুসলিম জ্ঞানী, গুণী, বিজ্ঞানী, পন্ডিত, ইসলামের সত্যতা ও শ্রেষ্ঠত্ব, বৈশিষ্ট্য, মানবতাবাদ, সাম্যবাদ, বিচার ইত্যাদির প্রশংসা করে ইতিহাসকে সমৃদ্ধ করেছেন। কিন্তু তাদের জীবনকে ধন্য করতে পেরেছিলেন কিনা তা অজানা। অনুরূপভাবে বর্ণিত শ্রেণির মণীষী, পন্ডিতবর্গের ন্যায় বহু খ্যাতনামা রাজা-বাদশাহ’র নাম পাওয়া যায়, ইসলাম বৈরিতা-বিদ্বেষে যাদের প্রচুর খ্যাতি রয়েছে। ইতিহাসে তাঁদের নাম স্মরণীয় হয়ে থাকার পাশাপাশি ইসলাম গ্রহণের মাধ্যমে তাঁদের অনেকের জীবনও ধন্য হয়েছে।
বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ভারতের অধিপতি। তাঁর শাসনামলে ভারতের নানা প্রদেশে মুসলমানদের চরম অবস্থা বিরাজ করছে। আসাম থেকে বাঙ্গালী বিতাড়ন, জম্মু-কাশ্মীরে মুসলিম নির্যাতন, হত্যা ছাড়াও ভারতের নানা স্থানে সংখ্যালঘু মুসলমানদের ওপর চলছে অকথ্য অত্যাচার, নির্যাতন ও মানবতাবিরোধী তৎপরতা, যার তালিকা সুদীর্ঘ। মুসলমানদের অন্যতম ধর্মীয় অনুষ্ঠান কোরবানি (ওদের ভাষায় গো হত্যা), প্রধানমন্ত্রী শাসিত ‘মহা ভারতের’ বিভিন্ন রাজ্যে নিষিদ্ধ কেন এবং এ কোরবানিকে কেন্দ্র করে এত দাঙ্গা-হাঙ্গামা, খুনা-খুনি, রক্তপাত, সাম্প্রদায়িক হানাহানি কেন? ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী মহানবী (স.)-এর যেসব মূল্যবান বাণী, আদর্শ অনুসরণের জন্য সারা বিশ^মানবের প্রতি উপদেশ প্রদান করে প্রশংসা কুড়িয়েছেন, পাশাপাশি যদি তিনি সংখ্যাগরিষ্ঠ স্ব-সমাজ ও স্ব-জাতিকে সংখ্যালঘুদের ওপর অত্যাচার, নির্যাতন ও মানবতাবিধ্বংসী তৎপরতার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দিতেন তা হলে অধিক সুনাম অর্জন করতে পারতেন।
বস্তুত ইসলামের সুনাম প্রচার করে ইতিহাসকে ধন্য করা যায়, জীবনকে ধন্য করা যায় না। পক্ষান্তরে ইসলাম গ্রহণের মাধ্যমে সুনামও অর্জন করা যায়, জীবনকেও ধন্য করা যায়। ইতিহাসে উভয় প্রকারের ভুরি ভুরি দৃষ্টান্ত রয়েছে। আমরা এখানে মওলানা মোহাম্মদ আকরাম খাঁ রচিত ‘মোছলেম বঙ্গের সামাজিক ইতিহাস’ হতে একজন হিন্দু রাজার ইসলাম গ্রহণের ঘটনাটি উল্লেখ করতে চাই। মওলানা আকরাম খাঁ তার পুস্তকের ৮ম অধ্যায়ে ‘মালাবারে ইছলাম’ প্রসঙ্গে দীর্ঘ আলোচনায় ‘বিশ্বকোষ’-এর সম্পাদককে উদ্ধৃত করে লিখেছেন: ‘হিন্দু সমাজরে প্রাচীন শাস্ত্রে ও সাহিত্যে মালাবার সম্বন্ধে কিছু কিছু উল্লেখ দেখা যায়। বিশ^কোষের সম্পাদক মাহাশয় তাহার অনেকগুলি উদ্ধৃত করেছেন। সেগুলোর অধিকাংশই মহাভারত ও পুরাণাদি পুস্তক হতে উদ্ধৃত পরশুরামের কীর্তিকলাপ সম্বন্ধে কতগুলো উদ্ভট উপকথা ছাড়া আর কিছু না। তবে এই কোষকার নিজে মালাবারের হিন্দু রাজা সম্বন্ধে একটা বিশেষ ঘটনার উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন, পুরাবৃত্ত পাঠে জানা যায় যে, চেরর রাজ্যের শেষ রাজা, চেরুমাল পেরুমাল ইচ্ছাপূর্বক সিংহাসন পরিত্যাগ করে মুছলমান ধর্ম গ্রহণ অভিলাষে মক্কা নগরীতে গমন করেন’ (বিশ্ব, ১৪-২৩৪)। শেখ জইনুদ্দীন কৃত ‘তোহফাতুল মোজাহেদীন’ পুস্তকেও একজন রাজার মক্কা গমন, তাঁহার হজরত রাছুলে কারীমের খেদমতে উপস্থিত হওয়া এবং স্বেচ্ছায় ইছলাম গ্রহণের বিবরণ প্রদত্ত হইয়াছে। কিন্তু তাঁহার বর্ণনার এক অংশে যে সকল রাবী ও রেওয়াতের উল্লেখ করা হইয়াছে, রেজাল শাস্ত্র অনুসারে পরীক্ষা করিয়া সেগুলির উপর সম্পূর্ণ নির্ভর করা আমরা সঙ্গত বলিয়া মনে করিতে পারি নাই। কিন্তু স্থানীয় জনসাধারণের মধ্যে ব্যাপকভাবে প্রচলিত যে সকল সংস্কার ও প্রবাদের উল্লেখ তিনি করিয়াছেন, সেগুলিকে অবিশ্বাস্য বলিয়া উড়াইয়া দেওয়ার সমর্থনও আমরা করিতে পারিতেছি না। তোহফার মাননীয় লেখক উপরোক্ত বিবরণের প্রথম অংশ সম্বন্ধে নিজেও সন্দেহের আভাস দিয়াছেন, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে নিজের পাঠকদিগকে বিবরণের দ্বিতীয় অংশের গুরুত্বটাও স্পষ্ট ভাষায় জানাইয়া দিয়াছেন।
তাঁহার এই বর্ণনা হইতে জানা যাইতেছে যে, মালাবারের রাজা যে মক্কায় ছফর করিয়াছিলেন এবং হজরতের খেদমতে উপস্থিত হইয়া তাঁহার নিকট ইছলামের বায়আত গ্রহণ করিয়াছিলেন, স্থানীয় মুছলমানদিগের মধ্যে ইহাই মশহুর ছিল, ‘রাজা কিছুকাল হজরতের খেদমতে অবস্থান করিয়া দেশে ফিরিয়া আসার সময় “শহর” নামক স্থানে এন্তেকাল করেন’- এই বিবরণটা মালাবারের মুছলমান ও অমুছলমান উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে সমভাবে মশহুর হইয়া আছে। তবে স্থানীয় অমুছলমানরা বিশ্বাস করে যে, ‘রাজাকে ঊর্দ্ধে তুলিয়া লওয়া হইয়াছে, তিনি আবার দুনিয়ায় ফিরিয়া আসিবেন।’
স্থান-কালাদির খুটিনাটি বিষয়ে মতভেদ থাকিলেও এবং সেগুলিকে অবিশ্বাস্য বলিয়া গৃহীত হইলেও, রাজার মক্কায় যাওয়ার, হজরতের খেদমতে উপস্থিত হওয়ার এবং কিছুকাল মক্কায় অবস্থান করার পর দেশে ফিরিয়া আসার জন্য ছফর করার বিবরণকে ভিত্তিহীন বলিয়া উড়াইয়া দেওয়ার কোন কারণ নাই। মুছলমান-অমুছলমান নির্বিশেষে একটা দেশের সমস্ত অধিবাসী আবহমানকাল হইতে যে ঐতিহ্যকে সমবেতভাবে বহন করিয়া আসিতেছে, তাহাকে অনৈতিহাসিক ও ভিত্তিহীন বলিয়া উড়াইয়া দেওয়ার কোনও মতে সঙ্গত বলিয়া বিবেচিত হইতে পারে না। এই প্রসঙ্গে বিশেষভাবে বিবেচ্য হইতেছে বিশ^কোষের বিবরণটি। কোষকার বলিতেছেন- ‘পুরাবৃত্ত পাঠে জানা যায় যে; চেরর (মালাবার) রাজ্যের শেষ রাজা চেরুমাল পেরুমাল ইচ্ছাপূর্বক সিংহাসন পরিত্যাগ করিয়া, মুছলমান ধর্ম গ্রহণাভিলাষে মক্কা নগরীতে গমন করেন।’ সুতরাং মালাবার রাজ্যের রাজার স্বতঃপ্রবৃত্ত হইয়া সিংহাসন ত্যাগ করা, ইছলাম ধর্ম গ্রহণ করার উদ্দেশ্যে মক্কায় গমন করা এবং হজরতের নিকট উপস্থিত হইয়া ইছলাম ধর্মে দীক্ষা গ্রহণ করার বিবরণকে ভিত্তিহীন বলিয়া উড়াইয়া দেওয়া আদৌ সঙ্গত হইতে পারে না।
ইসলাম ধর্ম গ্রহণ সম্বন্ধে একজন রাজার এই ব্যাকুলতার বিভিন্ন কারণ ছিল। তাহার মধ্যে প্রধান হইতেছে, বৌদ্ধ ও জৈনদের মতবাদ, তাহাদের উপর হিন্দু পন্ডিতগণের নিষ্ঠুর অত্যাচার এবং পক্ষান্তরে ক’একজন মুছলমান সাধুপুরুষের সাক্ষাৎলাভ ও তাঁহাদের মুখে হজরতের ও ইছলাম ধর্মের পরিচয় লাভ। অন্যান্য স্থানে অতি অল্প সময়ে ইছলামের প্রভাব ও প্রসার বৃদ্ধির প্রধান কারণও ছিল ইহাই।
আহা! কি আনন্দ ও সুখকর হত, যদি বর্তমান বিশ্বের সম্রাট, রাষ্ট্র প্রধানগণ ও ইসলামের শত্রুশক্তিবর্গ ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের নানা কৌশল অবলম্বনের পরিবর্তে, রাজা ভোজের ধন্যজীবনের ন্যায় তাদের জীবনকেও ধন্য করতেন, তা হলে দুনিয়াতে শান্তি আর শান্তির বন্যা বয়ে যেত এবং কুশাসন, দুঃশাসন, নির্যাতন, নিষ্পেশন থেকে বিশ্ব মানবতা মুক্তি পেত। ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বর্ণিত সত্যভাষণ হতে এই উপলব্ধির জন্ম। বক্তৃতার মঞ্চে দাঁড়িয়ে মুক্তার ন্যায় সুন্দর-সুন্দর বুলিতে পদদলিত মানবতা উদ্ধার পায় না। সে বাণী ‘শীতের সকালের শিশির’-এর ন্যায় বিলীন হয়ে যায়।

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button