একের পর এক উইকেট পতন!

trump-whitehouseমুশফিকুল ফজল আনসারী: ক্রিজে নেমে কেউ হয়তো চার-ছক্কা ছাড়াই কোনো রকম টিকে আছেন আবার কেউ ফিরছেন ঝটপট বোল্ড আউট হয়ে শুন্য রানে। একের পর এক উইকেট পতন। ফিরছেন সাজঘরে। না ক্রিকেট নয়। এটি হচ্ছে ট্রাম্প প্রশাসনের চিত্র। যে মাত্রায় হায়ারিং এবং ফায়ারিং চলছে তা কেবল ক্রিকেট খেলার সাথেই তুলনা চলে। বুধবার আরেকটি উইকেটের পতন ঘটলো। সাজ ঘরে ফিরলেন ভেটেনার্স অ্যাফেয়ার্স বিষয়ক মন্ত্রী ডেভিড শোলকিন। তার স্থলে নিয়োগ পেলেন প্রেসিডেন্টের ব্যক্তিগত চিকিৎসক অ্যাডমিরাল রনি জ্যাকসন।
প্রেসিডেন্ট মেয়াদের শুরু থেকেই ‘থোড়াই কেয়ার’ নীতিতে চলছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। হোয়াইট হাউসের আশে-পাশে সমালোচনার গুঞ্জন, লোক লজ্জার ভয় কোনো কিছুই ঘায়ে মাখছেননা তিনি। এক টুইট নোটিশে সরিয়ে দিলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী রেক্স টিলারসনকে। কোনো ধরনের কূটনৈতিক অভিজ্ঞতা ছাড়াই জ্বালানী ব্যবসায়ী ও এক্সন মোবিলের এই প্রধান নির্বাহীকে ক্ষমতা গ্রহণের শুরুতেই শীর্ষ কূটনীতিক পদে নিয়োগ দিয়েছিলেন ট্রাম্প। তার টিলারসনের সাথে পাল্লা দিয়ে ছিটকে পড়লেন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ৩ তারকা জেনারেল, ম্যাকমাস্টার।
২০১৭ সালের ২০ জানুয়ারি ক্ষমতা গ্রহনের পর থেকে এপর্যন্ত যারা পদচ্যুত হয়ে বাড়ি ফিরলেন:
জেমস কোমি
২০১৬ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রাশিয়ার হস্তক্ষেপ নিয়ে তদন্ত চালিয়ে যাচ্ছিলেন সাবেক এফবিআই প্রধান জেমস কোমি। দায়িত্ব নেবার পর মে মাসেই কোমিকে অপসারণ করেন ট্রাম্প। উইকেট পতনের শুরু এখান থেকেই।
সেলি ইয়েটস
ট্রাম্পের বিতর্কিত অভিবাসন নীতির আদেশ বাস্তবায়ন না করতে বিচারবিভাগের আইনজীবিদের নির্দেশ দেয়ায় পদ খোয়াতে হয়েছে ভারপ্রাপ্ত অ্যাটর্নি জেনারেল সেলি ইয়েটসকে। সেলি বিচার বিভাগের সঙ্গে প্রতারণা করছেন অভিযোগ এনে ট্রাম্প তাঁকে জানুয়ারি মাসে অপসারণ করেন।
মাইকেল ফ্লিন
ট্রাম্প দায়িত্ব নেবার আগে রাশিয়ার উপর যুক্তরাষ্ট্রের অবরোধ নিয়ে রাশিয়ান এক দূতের সঙ্গে বৈঠক করেছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা মাইকেল ফ্লিন। আর ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্সকে এ নিয়ে বিভ্রান্তও করেছিলেন, এসব অভিযোগে ফেব্রুয়ারি মাসে পদ ছাড়েন তিনি।
প্রিট বারারা
ওবামার সময়ে নিয়োগ পাওয়া ৪৬ জন আইনকর্মকর্তাকে পদত্যাগের আদেশ দিয়েছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল জেফ সেশনস। কিন্তু তাঁর সে আদেশের তোয়াক্কা করেননি নিউইয়র্কে অ্যাটর্নি প্রিট বারারা। ফলে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প তাঁকে বরখাস্ত করেন মার্চ মাসে।
ওয়ালটার সোওব
যুক্তরাষ্ট্র সরকারের গভর্ণমেন্ট ইথিকস এর প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন জর্জ বুশ আর ওবামার মেয়াদেও। নীতির প্রশ্নে আপোষহীন ওয়ালটার ছিলেন ট্রাম্প নীতির কঠোর সমালোচক। আর তারি বহিঃপ্রকাশ প্রতিক্রিয়া হিসেবে মেয়াদ পূর্ণ হবার পূর্বেই জুলাই মাসে নিজ পদ থেকে সরে দাঁড়ান।
মাইকেল ডুবকে
হোয়াইট হাউসে প্রেসিডেন্ট এবং প্রেস টিমের মধ্যে সমন্বয়হীনতার অভিযোগ উঠলে ব্যক্তিগত কারণ দেখিয়ে মে মাসে পদত্যাগ করেন হোয়াইট হাউস কমিউনিকেশন ডিরেক্টর মাইকেল ডুবকে।
রিনস প্রেইবাস
কমিউনিকেশন ডিরেক্টর অ্যান্তনি স্কারামুচির সঙ্গে ব্যক্তিগত ক্ষমতার দ্বন্দে জুলাই মাসে পদ থেকে সরে দাঁড়ান হোয়াইট হাউসের চীফ অব স্টাফ প্রেইবাস। তার জায়গায় আসেন জেনারেল জন কেলি।
শন স্পাইসার
অ্যান্তনি স্কারামুচিকে হোয়াইট হাউস কমিউনিকেশনস ডিরেক্টরের দায়িত্ব দিলেন ট্রাম্প। বিষয়টি কোনোভাবেই মেনে নিতে পারেননি শন স্পাইসার। প্রতিক্রিয়াস্বরুপ ২১ জুলাই হোয়াইট হাউস প্রেস সেক্রেটারির পদটি ছেড়ে দেন।
মাইকেল শর্ট
স্কারামুচি দ্বন্দ্বের দ্বিতীয় বলি হোয়াইট হাউসের অ্যাসিটেন্ট প্রেস সেক্রেটারি মাইকেল শর্ট। তাঁকে এ পদে মোটেও দেখতে চাননা এমনটা পলিটিকোকে দেয়া সাক্ষাতকারে বলেছিলেন স্কারামুচি। এর জেরে পদত্যাগ করেন মাইকেল।
অ্যান্তনি স্কারামুচি
হোয়াইট কমিউনিকেশনস ডিরেক্টরের দায়িত্বটা সুখকর হয়নি অ্যান্তনি স্কারামুচির জন্যও। দায়িত্ব নেবার এগারদিন পর, যখন জেনারেল জন কেলি চীফ অব স্টাফের দায়িত্ব নেন তখনি তাকে অপসারণ করা হয়। তার প্রস্থান একেবারে ক্রিজে নেমেই বোল্ড আউট হওয়ার মতো।
স্টিভ ভেনন
ট্রাম্পের আস্থাভাজন ছিলেন স্টিভ ভেনন। ছিলেন চীফ স্ট্যাটেজিস্ট এর দায়িত্বে। মতের দ্বন্দ্বের জেরে আগস্টের ১৮ তারিখে তাকেও বরখাস্ত করেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প।
সেভাস্তিয়ান গোরখা
ব্রিটিশ ডেপুটি অ্যাসিট্যান্ট সেভাস্তিয়ান ছিলেন ট্রাম্পের ‘মেইক আমেরিকা গ্রেট অ্যাগেইন’ ক্যাম্পেইন বিরোধী। নাজি গ্রুপের সঙ্গে তাঁর যোগসূত্র রয়েছে এমন অভিযোগের তীরে পদ হারাতে হয় তাঁকে।
টম প্রাইস
ট্রাম্পের অন্যতম সহযোদ্ধা। ওবামা কেয়ার পলিসি বাস্তবায়নে যোগসাজশ, রাষ্ট্রীয় তহবিলের বিপুল টাকা খরচ করে ভ্রমণ ব্যায় নিয়ে প্রশ্ন উঠায় ২০১৭ সালের জুলাইয়ে পদত্যাগে বাধ্য হন।
ওমারোসা মেনিগোল্ট
ট্রাম্পের আফ্রিকান আমেরিকান বিষয়ক সিনিয়র সহকারি ছিলেন ওমারোসা। ক্রিসমাস পার্টিতে অগ্নিকান্ডের একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে বিবাদে জড়িয়ে পড়েন প্রেসিডেন্টের চীফ অব স্টাফের জন কেলির সঙ্গে। আর এ জের ধরেই ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে পদ থেকে সরে দাঁড়ান। এছাড়া দায়িত্বপালনকালে ট্রাম্পের বিভিন্ন পদক্ষেপে নাখোশ হয়েছেন বলেও জানান তিনি।
অ্যান্ড্রু ম্যাককেইব
এফবিআই ডেপুটি ডিরেক্টর অ্যান্ড্রুর বিরুদ্ধে ট্রাম্পের অভিযোগ হলো রাজনৈতিক পক্ষপাতদুষ্টতার। জনসমক্ষে বেশ কবারই ট্রাম্প বলেছেন যে ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে পদ ছাড়ছেন অ্যান্ড্রু। এই মার্চ মাসের মাঝামাঝিতেই মেয়াদ ফুরিয়েছে তাঁর।
রব পরটার
ট্রাম্পের আরেক ঘনিষ্ট মিত্র রব ছিলেন হোয়াইট হাউস স্টাফ সেক্রেটারির দায়িত্বে। নিজ স্ত্রীকে নির্যাতন আর পরকীয়ার অভিযোগ মিডিয়ায় চাউর হলে এ বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে পদত্যাগ করেন তিনি।
ডেভিড সোরেনসন
পরটারের মতো একই অভিযোগের তীর হামলে পরে ডেভিড সোরেনসনের দিকে। তার সাবেক স্ত্রী অভিযোগ করেন ২ বছরের সাংসারিক জীবনে ডেভিড ছিলেন আক্রমণাত্মক আর অশালীন। এ অভিযোগের মধ্যেই হোয়াইট হাউসের স্পিচ রাইটারের পদ ছেড়ে দিতে হয় তাকে।
হোপ হিকস
ট্রাম্পের যে কজন বিশ্বস্ত ও অনুগত সহকারি ছিলো তাঁদের একজন ছিলেন হোপ হিকস। দীর্ঘদিনের অনুগত এ মিত্র প্রেসিডেন্টসহ সবাইকে তাক লাগিয়ে মার্চ মাসে হোয়াইট হাউসের কমিউনিকেশন ডিরেক্টরের পদটি ছেড়ে দেন। কি কারণে এ সিদ্ধান্ত তা নিয়ে ধোঁয়াশা তৈরি করেই তার এ বিদায়ে হতবাক হয়ে পড়ে প্রশাসন।
গেরি কন
স্টীল আর অ্যালমুনিয়াম আমদানিতে ট্রাম্পের শুল্ক নীতির ঘোর বিরোধীতা করেন অর্থনৈতিক উপদেষ্টা গেরি কন। ট্রাম্পকে সিদ্ধান্তে অনড় দেখে শেষমেষ ৬ মার্চ পদ থেকে সরে দাঁড়ান তিনি।
রেক্স টিলারসন
মাইক পেন্স আর পল রাইয়ান এর পর ট্রাম্প প্রশাসনের তৃতীয় ক্ষমতাধর ছিলেন পররাষ্ট্র মন্ত্রী টিলারসন। রাশিয়ার পক্ষ ত্যাগী রাষ্ট্রদূতকে পয়জনিং করা নিয়ে যুক্তরাজ্যের তদন্তে মুখ খোলা, ইরান পারমাণবিক চুক্তি সমর্থনসহ বেশ কিছু ইস্যুতে ট্রাম্পের সঙ্গে টিলারসনের আর বনিবনা হচ্ছিলো না। নিজের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটাতে মার্চের ১৩ তারিখে টিলারসনেক অপসারণের ঘোষণা দেন ট্রাম্প। আর স্থলাভিষিক্ত করেন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ’র পরিচালক পম্পেওকে।
এইচ আর ম্যাক মাস্টার
ট্রাম্প প্রশাসনের আরেকটি বড় ধরনের রদবদল হলো ২২ শে মার্চ ম্যাককে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টার পদ থেকে সরিয়ে দিয়ে জন বোল্টন থেকে সে পদে বসানো। উত্তর কোরিয়া নেতা কিম জনের সঙ্গে সাক্ষাতের আগে ট্রাম্পের এমন সিদ্ধান্তকে নিয়ে ঘাঁটাঘাটি করছেন বিশ্লেষকরা। ম্যাককে নিয়ে একটি টুইট করেছিলেন ট্রাম্প আর তাতে লিখেছিলেন- তাঁর জয়কে মেনে নিতে প্রস্তুত না ম্যাক।
ডেভিড শোকলিন
এজেন্সিগুলোকে কেন্দ্র করে অসন্তোষ তৈরি আর নীতি ভাংগার অভিযোগে বুধবার বরখাস্ত করা হলো ওবামা মেয়াদের একমাত্র নীতিনির্ধারক, ভেটেনার্স অ্যাফেয়ার্স মন্ত্রী ডেভিড সোকলিনকে। এর মাধ্যমে ডেভিড হলেন দ্বিতীয় কেবিনেট সেক্রেটারি যাকে তার পদ ছাড়তে হলো। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ গুলোর মধ্যে রয়েছে- বেশি অর্থব্যয় করে ভ্রমণে বের হওয়া। এর জেরেই গত বছরের সেপ্টেম্বরে পদত্যাগ করেন হেলথ এন্ড হিউম্যান সার্ভিস সেক্রেটারি (স্বাস্হ্য মন্ত্রী) টম প্রাইস।
স্ত্রীকে নিয়ে বিজনসে ট্রিপে ইউরোপ যাবার অভিযোগ উঠেছে শুলকিন এর বিরুদ্ধে, নিয়ম ভেঙ্গে তিনি উইমব্লেডন এর টিকেট নিয়েছেন। তার জায়গায় ব্যক্তিগত চিকিৎসক অ্যাডমিরাল রনি জ্যাকসনকে বসিয়েছেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প।
তবে এতোসব রদবদল আর আলোচনা-সমালোচনা নিয়ে মোটেই বিচলিত নন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। ‘ওয়েস্ট উইং কেওয়াস’ কে তিনি দর্তব্যের মধ্যেই নিতে চাননা। তার সোজাসাপ্টা কথা, কিসের কেওয়াস? এসব হচ্ছে মতের বিরোধ আর এসব বিরোধকে আমি পছন্দ করি। সম্প্রতি এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, ‘মতের বিরোধ থাকাটাই স্বাভাবিক। সবার ক্ষেত্রেই এমনটি হয়। হোয়াইট হাউসে কাজ করতে আগ্রহী অনেক ট্যালেন্ট আছে। যার মধ্য থেকে আমি সেরাকেই বেছে নেয়ার চেষ্টা করছি।’

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button