স্টিভেন হকিংয়ের সংক্ষিপ্ত জীবনী

stephenপুরো নাম স্টিভেন উইলিয়াম হকিং, সিএইচ, সিবিই, এফআরএস, পিএইচডি (ইংরেজি: Stephen William Hawking; ৮ জানুয়ারি, ১৯৪২ – ১৪ মার্চ ২০১৮) বিশিষ্ট ইংরেজ তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানী ও গণিতজ্ঞ হিসেবে বিশ্বের সর্বত্র পরিচিত ব্যক্তিত্ব। তাঁকে বিশ্বের সমকালীন তাত্ত্বিক পদার্থবিদদের মধ্যে অন্যতম হিসাবে বিবেচনা করা হয়।
হকিং কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের লুকাসিয়ান অধ্যাপক (স্যার আইজ্যাক নিউটনও একসময় এই পদে ছিলেন) হিসেবে ১ অক্টোবর, ২০০৯ তারিখে অবসর নেন। এছাড়াও তিনি কেমব্রিজের গনভিলি এবং কেয়াস কলেজের ফেলো হিসাবে কর্মরত ছিলেন।
শারীরিকভাবে ভীষণরকম অচল এবং এ.এল.এসের (এমায়োট্রফিক ল্যাটারাল স্ক্লেরোসিস বা লাউ গেহরিগ রোগ – যা একপ্রকার মোটর নিউরন রোগ) জন্য ক্রমাগতভাবে সম্পূর্ণ অথর্বতার দিকে ধাবিত হওয়া সত্ত্বেও বহু বছর যাবৎ তিনি তাঁর গবেষণা কার্যক্রম সাফল্যের সঙ্গে চালিয়ে গেছেন।
পদার্থবিজ্ঞানে হকিংয়ের দুইটি অবদানের কথা সবচেয়ে বেশি স্বীকৃত। প্রথম জীবনে সতীর্থ রজার পেনরাজের সঙ্গে মিলে সাধারণ আপেক্ষিকতায় সিংগুলারিটি সংক্রান্ত তত্ত্ব। হকিং প্রথম অনিশ্চয়তার তত্ত্ব ব্ল্যাক হোল-এর ঘটনা দিগন্তে প্রয়োগ করে দেখান যে ব্ল্যাক হোল থেকে বিকিরিত হচ্ছে কণা প্রবাহ। এই বিকরণ এখন হকিং বিকিরণ নামে (অথবা কখনো কখনো বেকেনস্টাইন-হকিং বিকিরণ) অভিহিত।  লিকিং তত্ত্বীয় পদার্থবিজ্ঞানের উপর লিখিত পুস্তক এবং বিভিন্ন অনুষ্ঠানে হাজির থেকে হকিং একাডেমিক জগতে যথেষ্ট খ্যাতিমান হয়ে উঠেছেন। তিনি রয়েল সোসাইটি অব আর্টসের সম্মানীয় ফেলো এবং পন্টিফিকাল একাডেমি অব সায়েন্সের আজীবন সদস্য। ২০১৪ সালে তাঁকে নিয়ে একটি মুভি তৈরি হয়,,নাম থিওরি অব এভরিথিং।
১৯৮৮ সালে ‘অ্যা ব্রিফ হিস্ট্রি অব টাইম’ বইয়ের কারণে তিনি বিশ্বব্যাপী পরিচিতি লাভ করেন। বইটিতে তিনি মহাবিশ্বের সৃষ্টি রহস্য নিয়ে তত্ত্ব দেন। আন্তর্জাতিকভাবে বেস্ট সেলার হিসেবে বইটির কয়েক কোটি কপি বিক্রি হয়। মহাবিশ্ব নিয়ে প্রকাশিত তাঁর সর্বশেষ বই ‘দ্য গ্র্যান্ড ডিজাইন’।
stephen_obamaআইনস্টাইনের পর হকিংকে বিখ্যাত পদার্থবিদ হিসেবে গণ্য করা হয়। তার কর্মময় জীবনে প্রিন্স অব অস্ট্রিয়ান্স পুরস্কার, জুলিয়াস এডগার লিলিয়েনফেল্ড পুরস্কার, উলফ পুরস্কার, কোপলি পদক, এডিংটন পদক, হিউ পদক, আলবার্ট আইনস্টাইন পদকসহ বহু পুরুষ্কারে ভূষিত হন।
হকিংয়ের বাবা ড. ফ্রাঙ্ক হকিং একজন জীববিজ্ঞান গবেষক ও মা ইসোবেল হকিং একজন রাজনৈতিক কর্মী। হকিংয়ের বাবা-মা উত্তর লন্ডনে থাকতেন। লন্ডনে তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দামামা বাজছে। হকিং গর্ভে আসার পর নিরাপত্তার খাতিরে তারা অক্সফোর্ডে চলে যান। হকিংয়ের জন্মের পর তাঁরা আবার লল্ডনে ফিরে আসেন। ফিলিপ্পা ও মেরি নামে হকিংয়ের দুই বোন রয়েছে। এছাড়া হকিং পরিবারে এডওয়ার্ড নামে এক পালকপুত্রও ছিল।হকিংয়ের বাবা-মা পূর্ব লন্ডনে বসাবস করলেও ইসাবেল গর্ভবতী থাকার সময় তারা অক্সফোর্ডে চলে যান। সে সময় জার্মানরা নিয়মিতভাবে লন্ডনে বোমাবর্ষণ করতো। হকিংয়ের একটি প্রকাশনা থেকে জানা গেছে তাদের বসতবাড়ির কয়েকটি গলি পরেই জার্মানির ভি-২ মিসাইল আঘাত হানে।
স্টিভেনের জন্মের পর তাঁরা আবার লন্ডনে ফিরে আসেন। সেখানে স্টিভেনের বাবা ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর মেডিক্যাল রিসার্চের প্যারাসাইটোলজি বিভাগের প্রধানের দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৫০ হকিংদের পরিবার হার্টফোর্ডশায়ারের সেন্ট অ্যালবাতে চলে যান। ১৯৫০ থেকে ১৯৫৩ সাল পর্যন্ত হকিং সেন্ট অ্যালবার মেয়েদের স্কুলে পড়েন। (সে সময় ১০ বছর বয়স পর্যন্ত ছেলেরা মেয়েদের স্কুলে পড়তে পারতো।) পরে সেখান থেকে ছেলেদের স্কুলে চলে যান। স্কুলে তাঁর রেজাল্ট ভালো ছিল বটে তবে অসাধারণ ছিল না।স্কুলের শিক্ষকদের মধ্যে গণিত শিক্ষক ডিকরান তাহতার অনুপ্রেরণার কথা হকিং পরবর্তী জীবনে স্মরণ করেন।পরবর্তী সময়ে হকিং স্কুলের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক বজায় রাখেন। নিজের নামে স্কুলের চারটি হাউসের একটি ও সহপাঠের লেকচার সিরিজের নাম দেন। স্কুল ম্যাগাজিন “দি অ্যালবানিয়ান”-এ দীর্ঘ সাক্ষাৎকার দেন।
বিজ্ঞানে হকিংয়ের সহজাত আগ্রহ ছিল। হকিংয়ের বাবার ইচ্ছে ছিল হকিং যেন তাঁর মতো ডাক্তার হয়। কিন্তু হকিং গণিত পড়ার জন্য অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ইউনিভার্সিটি কলেজে ভর্তি হন। কিন্তু যেহেতু সেখানে গণিতের কোর্স পড়ানো হতো না, সেজন্য হকিং পদার্থবিজ্ঞান বিষয় নিয়ে পড়া শুরু করেন। সে সময়ে তাঁর আগ্রহের বিষয় ছিল তাপগতিবিদ্যা, আপেক্ষিকতা এবং কোয়ান্টাম বলবিদ্যা।
সমকালীন মন্তব্যগুচ্ছ
১৯৮৫ সালে মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসেন হকিং ৷ ১৯৮৫ সালের গ্রীষ্মে জেনেভার CERN এ অবস্থানকালে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়েছিলেন বিজ্ঞানী৷ চিকিৎসকরাও তাঁর কষ্ট দেখে একসময় লাইফ সাপোর্ট সিস্টেম বন্ধ করে দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিলেন ৷ সম্প্রতি হকিংয়ের জীবন নিয়ে তৈরি হয়েছে এক তথ্যচিত্র। সেখানেই এই তথ্য জানিয়েছেন হকিং। তিনি বলেছেন, ‘নিউমোনিয়ার ধকল আমি সহ্য করতে পারি নি, কোমায় চলে গিয়েছিলাম। তবে চিকিৎসকরা শেষ অবধি চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছিলেন , হাল ছাড়েননি ৷’ কিন্তু চেষ্টা সত্ত্বেও অবস্থার উন্নতি না হওয়ায় যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দিতে চিকিৎসকরা হকিংয়ের স্ত্রী জেনকেও লাইফ সাপোর্ট সিস্টেম বন্ধ করে দেওয়ার কথা জানান। তবে সে প্রস্তাবে অবশ্য রাজি হন নি জেন।
পাঁচ দশক ধরে মোটর নিউরোনের ব্যাধির শিকার জগৎখ্যাত এই পদার্থবিদ। বিশেষজ্ঞদের মত, এই রোগে আক্রান্তরা বড়জোর বছর পাঁচেক বাঁচেন। তথ্যচিত্রে তুলে ধরা হয়েছে রোগের সঙ্গে হকিংয়ের লড়াইয়ের কাহিনি ৷ বেঁচে থাকার জন্য হকিংয়ের আর্তিও ফিরে এসেছে বারে বারে ৷
গত দু’দশকের সঙ্গী জেন বলেছেন, ‘হকিংয়ের এই ব্যাধি আমাদের ব্যক্তিজীবনের ব্ল্যাকহোল। যে গহ্বরে বাঁচার আশা হয়ত তলিয়ে যেতে পারত অনেক আগেই। কিন্তু সম্পর্কে আস্থা আর পরস্পরের প্রতি অগাধ ভালোবাসা তলিয়ে যেতে দেয় নি।’ তথ্যচিত্রে কর্মজীবনের চেয়ে হকিংয়ের ব্যক্তিজীবনকে বেশি গুরুত্ব দেওয়ায় বিজ্ঞানীদের একাংশ অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। তাঁদের দাবি, বিজ্ঞানে অবদান ছাড়া হকিংয়ের জীবনকে দেখানো মানে বকলমে তাঁকেই গুরুত্বহীন করে তোলা৷ তবে তথ্যচিত্রে এমন কিছু তথ্যও পরিবেশিত হয়েছে, যা হকিংয়ের একটা অদেখা দিক আমাদের সামনে তুলে ধরে।
ধর্ম বিশ্বাস
নিজের বই বা বক্তৃতায় নানা প্রসঙ্গে হকিং “ঈশ্বর” শব্দটি ব্যবহার করেছেন। তার স্ত্রীসহ অনেকে তাকে একজন নাস্তিক হিসাবে বর্ণনা করলেও হকিং নিজে মনে করেন তিনি “সাধারণ অর্থে ধার্মিক নন” এবং তিনি বিশ্বাস করেন “দুনিয়া বিজ্ঞানের নিয়ম মেনেই চলে। এমন হতে পারে নিয়মগুলো ঈশ্বর সৃষ্টি করেছেন কিন্তু তিনি নিয়মের ব্যত্যয় ঘটানোর জন্য কখনো হস্তক্ষেপ করেন না”।

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button